You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে বগুড়া সদর উপজেলা

বগুড়া সদর উপজেলা আন্দোলন-সংগ্রামে বগুড়ার ছাত্রসমাজ সব সময়ই অগ্রগামী ছিল। স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রস্তুতি হিসেবে ১৯৭০ সালে ছাত্র ইউনিয়ন-এর জেলা সহ-সভাপতি সরকারি আজিজুল হক কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি রফিকুল ইসলাম লালের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ-এর মকবুল হোসেন, মাহবুবর রহমান রাজা, আব্দুল মোত্তালেব, খাদেমুল ইসলাম এবং ছাত্র ইউনিয়নের মুস্তাফিজুর রহমান ফিজু, হায়দার আলী, মাহফুজার রহমান ও আব্দুর রাজ্জাক এই আটজনকে নিয়ে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এ কমিটির নেতৃত্বে জেলার প্রতিটি স্কুল-কলেজে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। অসহযোগ আন্দোলন-এর সময় এখানকার ছাত্র-যুবকরা প্রতিদিনই মিটিং-মিছিল ও সমাবেশ করত। ২৫শে মার্চের পর বগুড়াবাসী সরাসরি যুদ্ধে নেমে পড়ে। ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর বাদুড়তলার একটি বাসায় আওয়ামী লীগ নেতা মাহমুদুল হাসান খানের নেতৃত্বে বগুড়ায় সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন— এ কে মজিবর রহমান, মোশারফ হোসেন মণ্ডল, মোখলেছুর রহমান ও গাজীউল হক। এ কমিটির নির্দেশেই বগুড়ার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়।
বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ এর পরই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় কমিটি গঠন করে রাতে পাহারার ব্যবস্থা করে। তারা কৃষক-শ্রমিক-জনতাকে সংগঠিত করার জন্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে দায়িত্ব পালন করেন। ছাত্র ইউনিয়ন ছাত্র বিগ্রেড তৈরি করে। জিলা স্কুল, করোনেশন ইনস্টিটিউশন এবং সেন্ট্রাল স্কুলে ছাত্রদের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। জিলা স্কুলে মাসুদার রহমান হেলাল (পিতা মোশারফ হোসেন মণ্ডল), করোনেশন ইনস্টিটিউশনে মোজাম্মেল হক লালু এবং সেন্ট্রাল স্কুলে বিমান বাহিনীর সদস্য আগরতলা মামলার আসামী এম সোহরাব প্রশিক্ষকের চ দায়িত্ব পালন করেন। ছাত্রনেতৃবৃন্দ এবং অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে ডামি রাইফেল দিয়ে গুলি চালানো, বোমা নিক্ষেপসহ বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দেন। B বগুড়া জিলা স্কুল ট্রেনিং সেন্টার ছাড়াও প্রধান কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হতো। প্রতিটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে প্রায় ২০০ জনকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। এসব প্রস্তুতিতে দায়িত্ব পালন করেন আওয়ামী লীগ নেতা এ কে মজিবর রহমান এমপিএ, মোখলেছুর রহমান রেডিও, টি এম মুসা পেস্তা, নুরুল আনোয়ার বাদশা প্রমুখ।
২৭শে মার্চ মিউনসিপ্যাল কমিশনার আমজাদ হোসেন, মোশারফ হোসেন মণ্ডল, আবু মিয়া, মুজিবর রহমানসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহরের বাদুড়তলায় একটি খাদ্য ক্যাম্প স্থাপন করেন। ডা. কমিরউদ্দিন তালুকদার (বগুড়া ডাক্তার এসোসিয়েশনের সভাপতি)-এর নেতৃত্বে তাঁর বাদুড়লাস্থ হোয়াইট হাউস নামক বাড়িতে প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়।
একটি বুলেটিন প্রকাশ করে সন্ধ্যায় তা শহরে বিলি করা হয়। এ বুলেটিন কয়েকদিন অন্তর যুদ্ধের খবর নিয়ে ১লা এপ্রিল পর্যন্ত প্রকাশিত হয়।
বগুড়ায় মুক্তিযুদ্ধকালীন কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন আব্দুস সবুর সওদাগর, ফজলুল আহসান দীপু, এ টি এম জাকারিয়া, মিছবাহুল মিল্লাত নান্না, নজিবুর রহমান, মঞ্জুরুল হাসান জাহেদ, মাসুদুল আলম চাঁন্দু প্রমুখ।
২৫শে মার্চ রাতে রংপুর থেকে বগুড়ার দিকে পাকসেনাদের আগমনের খবর ছড়িয়ে পড়লে ছাত্র-জনতা একতাবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য রাত ১২টার পরে যার হাতে যা আছে তাই নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। তারা শহরের মাটিডালি থেকে বড়গোলা হয়ে ২নং রেলগেট পর্যন্ত প্রধান সড়কে ইটভাটা থেকে ইট, গাছের গুঁড়ি এবং রেলস্টেশন থেকে বগি এনে শহরের রেলগেটে ব্যারিকেড দেয়। ভাষাসৈনিক গাজীউল হক খবর পেয়ে ডা. জাহিদুর রহমানকে নিয়ে বগুড়া সদর থানায় আসেন এবং রাতেই তাঁরা আওয়ামী লীগ নেতা মাহমুদুল হাসান খান, মোস্তাফিজার রহমান পটলসহ অন্যদের নিয়ে মাঠে নেমে পড়েন। তাঁরা বগুড়া পুলিশ লাইনে গিয়ে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পাকহানাদার বাহিনী কর্তৃক পুলিশ সদস্যদের হত্যার খবর দেন। এ খবর শুনে বগুড়া পুলিশ লাইনের কর্মকর্তারা পুলিশের সকল সদস্যকে অস্ত্র হাতে নিয়ে সশস্ত্র প্রতিরোধের প্রস্তুতির নির্দেশ দেন। এদিকে বগুড়া সদর থানার দারোগা নিজাম উদ্দিন এবং নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে স্থানীয় কিছু পুলিশ এবং ছাত্র-জনতা পাকসেনাদের প্রতিহত করার জন্য শহরের ঝাউতলায় আজাদ গেস্ট হাউজের ছাদের ওপর অবস্থান নেয়। বড়গোলা ও ঝাউতলা সড়কের বিভিন্ন স্থান ও ভবনের ছাদে পাকসেনাদের প্রতিরোধে অংশ নেন এনামুল হক তপন, নুরুল আনোয়ার বাদশা, টিটু, হিটলু, চুনু, আজাদ, তারেক, খোকন পাইকার, সালাম, বখতিয়ার হোসেন, রাজিউল্লাহ, জাকারিয়া তালুকদার প্রমুখ।
বগুড়া সদর থানার উত্তরে রেল লাইনের এক পাশে অবস্থান নেন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের রফিকুল ইসলাম লাল, মাছুদার রহমান হেলাল, মকবুল হোসেন, খাদেমুল ইসলাম, মাহবুবুর রহমান রাজা, নুরুল আনোয়ার বাদশা, মাহফুজার রহমান মান্নান প্রমুখ। রাতভর তারা স্লোগান দিয়ে সকলকে জাগ্রত রাখে।
বগুড়ায় দুটি প্রতিরোধযুদ্ধ হয় – সুবল বিজ্র প্রতিরোধ যুদ্ধ ও বগুড়া প্রতিরোধযুদ্ধ। প্রথমটি চলে ২৬শে মার্চ থেকে ১লা এপ্রিল পর্যন্ত। এতে ২৩ জন পাকসেনা নিহত হয়। অপরপক্ষে একজন প্রতিরোধযোদ্ধা শহীদ হন।
দ্বিতীয়টি চলে ২৬শে মার্চ থেকে ৩১শে মার্চ পর্যন্ত। এতে ৪৯ জন পাকসেনা নিহত হয়। অপরপক্ষে বেশ কয়েকজন প্রতিরোধযোদ্ধা শহীদ হন।
২৬শে মার্চ সকালে রংপুর থেকে পাকবাহিনী বগুড়া শহর অভিমুখে রওনা হয়ে বাঘোপাড়া এলাকায় এসে আটকে যায়। বাঘোপাড়া থেকে শহরে আসার পথে পাকসেনাদের প্রতিহত করতে শতাধিক জায়গায় বন্দুক, বল্লম, লাঠিসোটা, দা, কুড়াল নিয়ে সহস্রাধিক মানুষ প্রস্তুত থাকে। সকাল সাতটার দিকে পাকবাহিনী বাঘোপাড়া পেরিয়ে ঠেঙ্গামারা পর্যন্ত পৌঁছায়। সেখানে গাছ কেটে রাস্তা বন্ধ করে দেয়ার সময় ঠেঙ্গামারা গ্রামের রিকশা চালক তোতা মিয়া (পিতা ভোলা শেখ) পাকবাহিনীর গুলিতে শহীদ হন। তোতা মিয়ার লাশের ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে পাকসেনারা নওদাপাড়া পেরিয়ে গুলি ছুড়তে-ছুড়তে মাটিডালি পৌঁছায়। পাকসেনাদের একটি অগ্রগামী দল পায়ে হেঁটে শহরের মধ্যে এগিয়ে আসে। এ সময় তারা মাটিডালি, ফুলবাড়ি ও বৃন্দাবনপাড়ার বেশ কিছু বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। মাটিডালির পর থেকে জয়পুরপাড়া, বিসিক, ফুলবাড়ি, কালিতলা, দত্তবাড়ি, বড়গোলা ও ঝাউতলা হয়ে ২নং রেলগেট পর্যন্ত রাস্তায় তখন হাজার-হাজার ছাত্র-জনতা অবস্থান করছিল। শহরের ফুলবাড়ি সুবিল ব্রিজের কাছে পাকবাহিনী ছাত্র-জনতার প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ভাষাসৈনিক গাজীউল হক ও এনামুল হক তপনের নেতৃত্বে দুটি দল কালিতলা থেকে বড়গোলা পর্যন্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পাকসেনারা ২নং রেলগেটের কাছে এলে আজাদ রেস্ট হাউজের ছাদের ওপর অবস্থান নেয়া দারোগা নিজামউদ্দিন, দারোগা নুরুল ইসলাম এবং তাদের সহযোগীদের ৩০৩ রাইফেল এবং বড়গোলার মোড়ে ইউনাইটেড ব্যাংকের ছাদে অবস্থান নেয়া ৩ জন তাদের বন্দুক দিয়ে পাকবাহিনীকে আক্রমণ করেন। উভয় পক্ষের এ যুদ্ধে টিটু নামে অষ্টম শ্রেণির একজন ছাত্র গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হয় এবং দুজন পাকসেনা গুরুতর জখম হয়। পাকসেনারা দ্রুত ব্যাংক ভবনটি ঘিরে ফেলে এবং সেখানে অবস্থানরত মোস্তাফিজুর রহমান চুন্নু ও হিটলুকে হত্যা করে। তাদের গুলিতে বোম্বে সাইকেল স্টোরের ছাদে মাথায় গুলি লেগে আজাদ শহীদ হন। পাকবাহিনী ২নং রেলগেট সংলগ্ন একটি চায়ের দোকান ও ৩নং রেলগেট সংলগ্ন একটি রেস্টুরেন্টে হামলা চালিয়ে ১২ জন হোটেল শ্রমিককে গুলি করে হত্যা করে, যা বগুড়া রেলগেট গণহত্যা নামে পরিচিত। সকাল সাড়ে আটটার দিকে ডা. জাহিদুর রহমানের নেতৃত্বে পুলিশ লাইন থেকে ৬০ জনের একটি দল ৩০৩ রাইফেল হাতে নিয়ে পাকসেনাদের প্রতিরোধে নেমে পড়ে। দুপক্ষে প্রচণ্ড গুলি বিনিময় হয়। গোলাগুলির মধ্যেই পাকহানাদার বাহিনী সড়ক ধরে পিছু হটে শহরের উত্তর প্রান্তে কটন মিল রেস্ট হাউজ এবং মুজিবুর রহমান মহিলা কলেজে অবস্থান নেয়। সেখান থেকে তারা ভারী মেশিনগান ব্যবহার করে মর্টারের গোলাবর্ষণ করে। ২৭শে মার্চ তিনটার দিকে তাদের মর্টারের গোলার আঘাতে দশম শ্রেণির ছাত্র তারেক শহীদ হয়। তারা এদিন কালিতলা এলাকায় ফজলুল বারীর বাড়িতে ঢুকে তাকে হত্যা করে। এসময় তারা আওয়ামী লীগ কর্মী মাহফুজার রহমান বাবুর বাড়িতে (মাটিডালি) তার ভাইয়ের ছেলে রেজাউল ইসলাম ডাবলু, জুবিলি স্কুলের শিক্ষক আবদুল হামিদ এবং শিববাটিতে রিকশাচালক সোলেমান আলীকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ২৮শে মার্চ নওগা থেকে আগত ৩৯ জন ইপিআর সদস্য, স্থানীয় পুলিশ, মুক্তিযোদ্ধা এবং ছাত্র- জনতার মিলিত অপারেশনে ২৩ জন পাকসেনা এবং মুক্তিযোদ্ধা তপনের রাইফেলের গুলিতে কটন মিল গেস্ট হাউসের ছাদে অবস্থারত একজন পাকসেনা নিহত হয়। এদিন পাকবাহিনী হাবিব ম্যাচ ফ্যাক্টরিতে অগ্নিসংযোগ করে। ২৯শে মার্চ পাকবাহিনী বেতার ভবনের পেছেনে বৃন্দাবনপাড়ায় হামলা এবং লুটপাট চালায়। পুলিশ সদস্য কলিম উদ্দিনের নেতৃত্বে ছাত্র-জনতা পাকসেনাদের বর্বরতার বিরদ্ধে গেরিলা আক্রমণ চালায়। পাবাহিনীর পাল্টা আক্রমণে কলিম উদ্দিন শহীদ হন। ৩০শে মার্চ পাকবাহিনীর আক্রমণে বেশকিছু নিরীহ মানুষ শহীদ হন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মিলিত প্রতিরোধে কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়। ৩১শে মার্চ সুবেদার আকবরের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা মহিলা কলেজ ঘাঁটিতে গ্রেনেড চার্জ করে এবং পেট্রোলের ড্রামে আগুন ধরিয়ে গড়িয়ে দেয় পাকসেনাদের ঘাঁটির দিকে। এদিন পাকবাহিনী ফুলবাড়ি এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে। প্রতিরোধ যুদ্ধে টিকতে না পেরে পাকবাহিনী ১লা এপ্রিল রংপুরের দিকে পালিয়ে যায়। বগুড়ার প্রতিরোধ যুদ্ধে ৪৯ জন পাকসেনা নিহত হয়।
৪ঠা এপ্রিল মুক্তিযোদ্ধা তারিকুল আলম, খাজা ছামিয়াল ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের রহমান আলী, ইলেক্ট্রশিয়ান সামাদসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ডিনামাইট দিয়ে কাটাখালি ব্রিজের অংশবিশেষ ধ্বংস করে দেন।
প্রথম দফায় বিতাড়িত হওয়ার পর ২২শে এপ্রিল দ্বিতীয় বারের মতো পাকবাহিনী বগুড়া শহরে অনুপ্রবেশ করে। তারা বগুড়া সার্কিট হাউজ, সরকারি আজিজুল হক কলেজ নতুন ও পুরাতন ভবন, জিলা স্কুল, মুজিবুর রহমান মহিলা কলেজ, এসডিও-র বাংলো, বগুড়া রেল স্টেশন কলোনি, কটন মিল রেস্ট হাউজ এবং ভার্জিনিয়া টোবাকো কারখানায় ক্যাম্প স্থাপন করে।
পাকসেনারা বগুড়া শহর দখল করার পরে এখানকার বিহারি ও কতিপয় স্থানীয়দের সমন্বয়ে গঠন করা হয় শান্তি কমিটি, রাজাকারআলবদর, আলসামস বাহিনী। ডা. হাবিবুর রহমান খানকে আহ্বায়ক এবং ওসমান গণি, মোমিন মিয়া, ডা. মজিবর রহমান, খোরশেদ তালুকদার, মুরাদুজ্জামান, আব্দুল হামিদ খান, হারুন খান প্রমুখ সদস্যদের নিয়ে বগুড়া সদর থানা শান্তি কমিটি গঠিত হয়। এখানকার কুখ্যাত রাজাকাররা হলো— ওসমান গণি ওরফে ওসমান বিহারি, মাহফুজুল হক (নামাজগড়), মতি গোকুল, আনোয়ার হোসেন (ওসমান বিহারির ভাতিজা), ইকবাল হোসেন (ওসমান বিহারির ছেলে), আকুল (জলেশ্বরীতলা), কাইল্যা মজিদ, আসলাম হোসেন বিহারি প্রমুখ। কুখ্যাত রাজাকার ওসমান বিহারি পাকসেনাদের একজন পরীক্ষিত দোসর ছিল। হত্যা, লুণ্ঠন ও ধর্ষণসহ নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে সে জড়িত ছিল। পাকবাহিনী তাদের দোসরদের সহযোগিতায় বগুড়া শহরের বগুড়া রেল স্টেশন, এসডিও-র বাংলো, এসপি-র আমবাগান, গোকুল রামশহরের পীরবাড়ি, ফুলবাড়ি, বগুড়া পুলিশ লাইন্স, চেলোপাড়া শান্তি নার্সারী, নারুলী, চেলোপাড়া কুঁয়ো, ওয়াপদা ভবন, কাটনারপাড়ার ঠিকাদার হাফিজার রহমানের বাড়ি প্রভৃতি এলাকায় গণহত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ করে। প্রথম দফায় বিতাড়িত হয়ে ২৪শে এপ্রিল পাকবাহিনী তিনদিক দিয়ে বগুড়া শহরে প্রবেশ করে। তখন স্থানীয় প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। নগরবাড়ি, নওগাঁ ও রংপুর সড়ক দিয়ে পাকবাহিনী বগুড়া শহরে প্রবেশ করে হত্যা ও নির্যাতনে মেতে ওঠে। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় স্থানীয় বিহারিরা। পুরো শহর জুড়ে চলে হত্যা, লুণ্ঠন আর অগ্নিসংযোগ। পাকসেনারা এদিন শহরের ফুলবাড়ি এলাকায় গণহত্যা চালায়। ফুলবাড়ি গণহত্যায় আজিজুল হক কলেজের লাইব্রেরিয়ান মমতাজ উদ্দিনসহ ৩৩ জন শহীদ হন। একই দিন পাকসেনারা স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় শহরের চকলোকমান, লতিফপুর, চকফরিদ, ঠনঠনিয়া, মালগ্রাম, গণ্ডগ্রাম, মালতিনগরসহ বিভিন্ন স্থানে অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ চালায়। ২৩শে এপ্রিল থেকে ৩০শে এপ্রিল এই আটদিনে পাকবাহিনীর সদস্যরা দুই শতাধিক সাধারণ মানুষকে হত্যা করা ছাড়াও ব্যাপক অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠন করে।
পাকবাহিনী ৩০শে এপ্রিল বগুড়া রেলওয়ে কলোনি গণহত্যা সংঘটিত করে। রেলওয়ে কলোনি পুকুরপাড়ে সংঘটিত এ গণহত্যায় ঢাকা এজি অফিসের অডিটর আব্দুস সাত্তার, দুই সহোদর মাওলানা আব্দুল কাদের ও আব্দুস সালাম, জেলা সমবায় পরিদর্শক আব্দুল গণি, আব্দুল মতিন সুজা, মোহন আলী শেখসহ ৭ জন শহীদ হন।
পাকবাহিনী ১১ই নভেম্বর বাবুরপুকুর গণহত্যা চালায়। -বাবুরপুকুর গণহত্যায় মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তাদানের জন্য ঠনঠনিয়ার তেতুলতলা এলাকার টেলিফোন অপারেটর নূরজাহান বেগম (স্বামী আজিজার রহমান)সহ মণ্ডলপাড়া, শহীদনগর, পশারীপাড়া ও শাহ্পাড়া থেকে ১৪ জনকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে বাবুরপুকুরে নির্মমভাবে হত্যা করে।
১৩ই নভেম্বর পাকবাহিনী শহর থেকে ৯ কিমি দূরে রামশহর গণহত্যা চালায়। এতে গ্রামের সম্ভ্রান্ত সুফি ডাক্তার ক্কাহারুল্লাহর পীর পরিবারের ৭ জনসহ ১১জন শহীদ হন।
পাকবাহিনী ১৩ই ডিসেম্বর নারুলী গণহত্যা সংঘটিত করে। এতে নারুলী, সাবগ্রাম, চেলোপাড়া, দত্তবাড়িসহ পার্শ্ববর্তী কয়েকটি গ্রামের দুশতাধিক গ্রামবাসী শহীদ হন। ওসমান বিহারি মুক্তিযুদ্ধকালে বগুড়ার বড়বাজার নামে খ্যাত রাজাবাজারে একটি বাড়ি দখল করে। মাড়োয়ারি ও হিন্দু ব্যবসায়ীদের দোকানপাট ও বাড়িঘর লুট করে। লুট করা সোনা, টাকা পয়সা, কাঁসার থালাবাসনসহ অন্যান্য জিনিসপত্র কাটনারপাড়া এলাকার একটি বাড়িতে জমা রাখে। ওসমান বিহারির নেতৃত্বে তার ভাতিজা আনোয়ার হোসেন, দুই ছেলে আসলাম হোসেন ও ইকবাল হোসেন শহরের থানা রোডে অবস্থিত মোমিন রেডিও হাউস লুট করে। লুণ্ঠনে বাঁধা দিলে দোকান মালিক মোমিন শেখ ও তার ১৩ বয়সের নাতি গুলজারকে ওসমান বিহারি রিভলবার দিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এছাড়াও ওসমান বিহারী পাকসেনাদের সহায়তায় লতিফপুরসহ শহরের বিভিন্ন জায়গায় হামলা চালিয়ে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। বাঙালি বিশেষ করে হিন্দু মেয়েদের ধরে এনে তার বাড়িতে বা ক্যাম্পে পাকসেনাদের হাতে তুলে দিত অজিজুল হক কলেজ, মুজিবুর রহমান মহিলা কলেজ, জিলা স্কুল, বোবা স্কুল, পুলিশ লাইন, বগুড়া রেলস্টেশন কলোনি, ভার্জিনিয়া টোবাকো কোম্পানি, এসডিও-র বাংলো, ওয়াপদা ভবন ও রেস্ট হাউজ এবং এসপি-র বাগান ছিল পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির।
বগুড়া সদরে কয়েকটি বধ্যভূমি ও গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। সেগুলো হলো- বগুড়া রেলস্টেশন বা আমবাগান বধ্যভূমি, ফুলবাড়ি বধ্যভূমি, এসপি বাগান বধ্যভূমি, এসডিও বাংলো বধ্যভূমি, বগুড়া সাধুর আশ্রম বধ্যভূমি, রামশহর গণকবর, বগুড়া পুলিশ লাইন্স বধ্যভূমি, বাবুরপুকুর বধ্যভূমি, সার্কিট হাউজ বধ্যভূমি ও নির্যাতন কেন্দ্র, চেলোপাড়া কুয়ো বধ্যভূমি, নারুলী গণকবর এবং চেলোপাড়া শান্তি নার্সারি গণকবর।
১লা এপ্রিল বগুড়া শহরে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, পাকসেনারা বগুড়া-নগরবাড়ি সড়কে আড়িয়া বাজার ক্যান্টনমেন্টে বেশ কিছু বাঙালি সেনাকে বন্দি করে নির্যাতন করছে। তখন নায়েক সুবেদার আকবর আলীর নেতৃত্বে ৩৯ জন ইপিআর, ৫০ জন পুলিশ এবং ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ আড়িয়াবাজার ক্যান্টনমেন্টের উত্তর, পূর্ব এবং পশ্চিম এই তিনদিক থেকে আক্রমণ করে। দুই পক্ষের মধ্যে সম্মুখ যুদ্ধে পাকবাহিনী বিমান থেকে বোমা হামলা চালায়। এতেও পিছু হটেনি বাঙালি জনতা। মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীকে পরাস্ত করতে গ্রামের লোকদের সহায়তায় দক্ষিণ দিক থেকে মরিচের গুঁড়া ছিটায়। এতে পাকবাহিনী কাবু হয়ে একজন ক্যাপ্টেনসহ ৬৮ জন আত্মসমর্পণ করে এবং জনতার ক্রুদ্ধ আক্রমণে সকলেই নিহত হয়। আড়িয়াবাজার যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা মাসুদ আহম্মেদ (পিতা ডা. টি আহমেদ, ঠনঠনিয়া) সহ অনেক বাঙালি শহীদ হন।
১৩ই ডিসেম্বর বগুড়া সদর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। তবে ১৮ই ডিসেম্বর পর্যন্ত বগুড়ার কিছু এলাকায় পাকবাহিনী ছিল।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মোহাম্মদ খাদেমুল বাশার, বীর উত্তম (পিতা মোহাম্মদ হাসমত উল্লাহ শাহ) ও এ টি এম হামিদুল হোসেন, বীর বিক্রম (পিতা আবদুল হামিদ, রজাকপুর)।
বগুড়া সদর উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- ইপিআর হাবিলদার রহিম উদ্দিন (পিতা নিদানু শেখ, সেউজগাড়ি), পুলিশ সদস্য মোসলেম উদ্দিন (পিতা পরেশউদ্দিন শেখ, সেউজগাড়ি), আব্দুস সামাদ (পিতা মোজাম্মেল হক, সুলতানগঞ্জপাড়া), মাসুদুল আলম খান চান্দু (পিতা আ. খালেক খান, ঠনঠনিয়া), খন্দকার আবু সুফিয়ান (পিতা সাদত আলী খন্দকার, নিশিন্দারা), আনোয়ারুল হক আজাদ (পিতা মো. আলী আযম মিয়া, জলেশ্বরীতলা), আমিনুল কুদ্দুস বুলবুল (পিতা মো. সামসুউদ্দিন আহমেদ, কাটনারপাড়া), টি এম আইয়ুব টিটু (পিতা আছালতজামান, মালতিনগর), মোতাছিম বিল হক (পিতা মো. মাইদুল হক, কাটনারপাড়া), আবুল কাশেম (পিতা আব্দুর রহমান মণ্ডল, চকসুত্রাপুর), আবুল হোসেন পশারী (পিতা বাহার পশারী, সুত্রাপুর), মাসুদ আহম্মেদ (পিতা ডা. টি আহমেদ, ঠনঠনিয়া), মোস্তফা পাইকার খোকন (পিতা মোজাম পাইকার, মালতিনগর), আজিজার চাঁন (পিতা নাজিমউদ্দিন ফকির, সুত্রাপুর), হেলালুর রহমান চিশতি (পিতা মুনসুর রহমান চিশতি, রহমাননগর), আব্দুল মোমিন হিটলু (পিতা মোজাম্মেল হক, জলেশ্বরীতলা), মোস্তাফিজুর রহমান চুন্নু (পিতা ফজলার রহমান, মালতিনগর), ছাইফুল ইসলাম (পিতা আব্দুল গনি মণ্ডল, শহীদনগর), আব্দুল জব্বার (পিতা মহরম আলী, জলেশ্বরীতলা), সিরাজ উদ্দিন (পিতা ছিকাতউদ্দিন, সুত্রাপুর), পুলিশ সদস্য গঙ্গারাম চৌধুরী (পিতা পরবেশ রায় চৌধুরী, মালতিনগর), সুনীল কুমার মোহন্ত (সুত্রাপুর), আবুল কাশেম (পিতা সাধু প্রামানিক, মথুরা, নামুজা), আব্দুস সামাদ প্রামানিক (পিতা সমতুল্যা প্রামানিক, পাল্লাপাড়া, নামুজা), মাহফুজার রহমান (পিতা আলহাজ বজলার রহমান, সাতশিমুলিয়া), মদন মোহন কর্মকার (পিতা কালিপদ কর্মকার, আশাকোলা), কাবুল আহমেদ (পিতা গোলাম রসুল, ঠনঠনিয়া), আব্দুস সোবাহান গনি (পিতা রিয়াজ খান, নামাজগড়), দোলন (মালতিনগর), হান্নান (পিতা ওহি উদ্দিন পশারী, ঠনঠনিয়া শহীদনগর), মান্নান (পিতা ওহিউদ্দিন পশারী, ঠনঠনিয়া শহীদনগর), খন্দকার মোহাম্মদ জামাল (পিতা কে এফ হাসান, চকসুত্রাপুর), মোফাজ্জল হোসেন আবুল (পিতা গেদু জিলাদার, ঠনঠনিয়া), রোস্তম আলী (পিতা মোকছেদ আলী ফকির, আটাপাড়া), শফিউদ্দিন আহম্মেদ (পিতা সমতুল্য মণ্ডল, কাটনারপাড়া), রমজান আলী (পিতা নায়েম উদ্দিন, সুত্রাপুর), আবু তালেব (পিতা ছমির উদ্দিন, মালতিনগর), সোলায়মান আলী (পিতা বাদশা খলিফা, বৃন্দাবনপাড়া), করিম বেপারি (পিতা জামিল, জামিল মাদ্রাসা গেট) ও তবিবর রহমান (পিতা মালেক সরকার, উত্তর চেলোপাড়া)। শহীদদের স্মরণে বগুড়া শহরের সাত মাথায় ভাস্কর্য ‘বীর বাঙ্গালি’ নির্মাণ করা হয়। পরে এ ভাস্কর্যটি শহরের প্রবেশ মুখ বনানীতে পর্যটন মোটেলের সামনে স্থাপন করা হয়। শহরের সাত মাথায় ‘বীরশ্রেষ্ঠ স্কয়ার’ নামে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। বগুড়া রেলস্টেশন এবং ফুলবাড়ি বধ্যভূমিতে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামফলক ‘মুক্তির ফুলবাড়ী’ নির্মাণ করা হয়েছে। সরকারি আজিজুল হক কলেজের মসজিদের পাশে ফুলবাড়ি গণহত্যায় শহীদদের একটি তালিকা আছে। বগুড়া শহরের কেন্দ্রস্থলে নির্মিত হয়েছে ‘শহীদ চান্দু স্টেডিয়াম’। বাবুরপুকুর গণহত্যায় ১৪ জন শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে এবং ১৪ জন শহীদের নাম উল্লেখ করে তাদের কবরগুলো পাকা করা হয়েছে। বগুড়া পুলিশ লাইন্স গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে বগুড়া পুলিশ লাইন্স-এ স্মৃতিস্তম্ভ ‘৭১ নির্মাণ করা হয়েছে। এখানে ২১ জন শহীদদের একটি তালিকা রয়েছে। রেলওয়ে কলোনি গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। শহীদ মোস্তফা পাইকার খোকন স্মরণে শহীদ খোকন পার্ক নামে একটি পার্ক এবং শহীদ টিটুর নামে একটি মিলনায়তনের নামকরণ করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা মাসুদ আহমেদের নামানুসারে আড়িয়াবাজারের নামকরণ করা হয়েছে মাসুদ নগর। মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল বাকি, হিটলু, আজাদ ও ছুনুর নামে বগুড়া শহরে কয়েকটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। এছাড়া অধ্যক্ষ মহসিন আলী দেওয়ানের নামে একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। [মিলন রহমান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!