বগুলাখাড়ী যুদ্ধ (বিরল, দিনাজপুর)
বগুলাখাড়ী যুদ্ধ (বিরল, দিনাজপুর) সংঘটিত হয় ১৩ই ডিসেম্বর। দিনাজপুর জেলার বিরল উপজেলার এ-যুদ্ধে ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং ২৫ জন আহত হন। এতে নেতৃত্ব দেন ক্যাপ্টেন ইদ্রিস ও লেফটেন্যান্ট সাইফুল্লাহ। ডিসেম্বর মাসে বিরল উপজেলায় পাকহানাদারদের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের ত্রিমুখী আক্রমণ শুরু হয় এবং ১১ই ডিসেম্বরের মধ্যে অধিকাংশ এলাকা হানাদারমুক্ত হয়। এলাকার দালাল ও রাজাকাররা ভয়ে লুকিয়ে পড়ে। এ উপজেলায় তখন মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা দুশরও অধিক। সবার হাতে এলএমজি, এসএলআর, স্টেনগান ও রাইফেল। ভারতের আর্টিলারি ইউনিটটি বিরলের দেড় মাইল পেছনে। ১২ই ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর কমান্ডারের নির্দেশ অনুযায়ী প্লাটুন কমান্ডাররা যার-যার প্লাটুন সাজিয়ে ক্যাপ্টেন ইদ্রিসের নিকট রিপোর্ট করেন। এরপর ক্যাপ্টেন ইদ্রিস যোদ্ধাদের সামনে এসে তাঁদের শৃঙ্খলা ও সতর্কতার সঙ্গে রাত্রিযাপনের নির্দেশ দেন এবং হুঁশিয়ার করে বললেন যে, শত্রুরা রাত্রির অন্ধকারে তাঁদের ওপর হামলা করতে পারে।
১৩ই ডিসেম্বর ভোরে গ্রামের কিছু লোক মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে এসে যোগ দেয়। তারাও তাঁদের সঙ্গে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। সবাই একসঙ্গে নাস্তা করেন। একটু পরে বাঁশি বেজে ওঠে। সকলে কমান্ডারের শেষ নির্দেশ নেয়ার জন্য সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ান। ক্যাপ্টেন ইদ্রিস ও লে. সাইফুল্লাহ তাঁদের সামনে এসে নির্দেশ দেন যুদ্ধে হয় পতন, না হয় বিজয়। সবাই সমস্বরে কমান্ডারের নির্দেশ মেনে নেন। তাঁদের গাইড করার জন্য স্থানীয় পাঁচজন লোককে সঙ্গে নেয়া হয়। দুই কমান্ডারের পেছনে সকলে এক লাইনে চলছেন। এক পর্যায়ে তাঁরা দোগাছি নামক একটি গ্রামে গিয়ে গ্রামের চারদিকে পজিশন নেন। এর কিছুক্ষণ পর তাঁদের পক্ষের গুপ্তচর এসে খবর দিলে তাঁরা আবার অগ্রসর হন।
তখন বেলা এগারোটা। ক্যাপ্টেন ইদ্রিস ও লে. সাইফুল্লাহর নেতৃত্বে প্রথম দলটি রেললাইনের পাশ দিয়ে দ্রুত অগ্রসর হয়। বাকি যোদ্ধারা ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিতে-দিতে তাঁদের অনুসরণ করেন। সামনে কয়েকটা বাংকার দেখা যায়। ক্যাপ্টেন ইদ্রিস বাংকারগুলো লক্ষ করে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়ার নির্দেশ দেন। সঙ্গে-সঙ্গে একঝাঁক এলএমজি-র গুলি ছুটে যায়। কিন্তু বাংকারগুলো থেকে কোনো উত্তরআসে না। তাই মুক্তিযোদ্ধারা আবার অগ্রসর হন। কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ সামনে থেকে বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ শুরু হয়। সামনের সারির কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা মাটিতে লুটিয়ে এবং বাকিরা শুয়ে পড়েন। কয়েকজন একটু মাথা তুলে তাকিয়ে কিছুটা দূরে একটি খাল দেখতে পান। এর নামই বগুলাখাড়ী। গড়িয়ে-গড়িয়ে তাঁরা সেখানে চলে যান এবং কভারিং ফায়ার শুরু করেন।
এমন সময় পাকসেনাদের গুলিবর্ষণ স্তিমিত হয়ে আসে। খোলা মাঠে শুয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা এই ফাঁকে মাথা তুলে চারদিকে দেখতে থাকেন। কেউ-কেউ দ্রুত পেছনের দিকে ছুটে যেতে থাকেন। কেউ-কেউ হতাহতদের পিঠে নিয়ে ছুটছেন। কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন ইদ্রিসকে ধরাধরি করে আনছেন। ক্যাপ্টেন ইদ্রিস এ অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক স্মরণীয় নাম। তিনি চাঁপাইনওয়াবগঞ্জ থেকে হিলি পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকায় তাঁর টাইগার বাহিনী নিয়ে পাকসেনাদের নাস্তানাবুদ করেন। তাঁর বুকে তিনটি গুলি লেগেছে। তাঁকে চিকিৎসার জন্য রায়গঞ্জ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
পাকসেনাদের গুলিবর্ষণ একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। মুক্তিযোদ্ধারা কাঁধে করে তাঁদের আহত ও নিহত সঙ্গীদের নিয়ে আসতে থাকেন। লে. সাইফুল্লাহ এসব কাজ পরিচালনা করেন। সব কাজ সুসম্পন্ন হলে তিনি দোগাছি গ্রামে ফিরে যান। পরে জানা যায়, পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে না পেরে প্রাণভয়ে পিছু হটে এবং তখন কাঞ্চন ব্রিজের নিকটবর্তী বহলা গ্রামের ৩৭ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে, যা বহলা গণহত্যা নামে পরিচিত। এরপর তারা ডিনামাইট দিয়ে ব্রিজটির আংশিক ক্ষতি করে দিনাজপুর শহরের দিকে চলে যায়।
বগুলাখাড়ীর যুদ্ধে সাতজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও পঁচিশ জন আহত হন। এরপর লে. সাইফুল্লাহ প্লাটুন কমান্ডারদের নিজ- নিজ প্লাটুন নিয়ে বহলা গ্রামটির চারদিকে ঘাঁটি স্থাপনের নির্দেশ দেন। ১৪ই ডিসেম্বর ভোরের দিকে আরো একশ মুক্তিযোদ্ধা এসে যোগ দেন।
দল ভারী হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস দ্বিগুণ বেড়ে যায়। তাঁরা ১৬ই ডিসেম্বর লে. সাইফুল্লাহর নেতৃত্বে কাঞ্চন ব্রিজের কাছে গিয়ে ঘাঁটি গাড়েন এবং লে. সাইফুল্লাহ ক্ষতিগ্রস্ত কাঞ্চন ব্রিজের অবস্থা দেখতে যান। ঠিক এ-সময় দিনাজপুর শহরের ৮ কিলোমিটার দক্ষিণে রামসাগর এলাকা থেকে অনবরত গুলির শব্দ শোনা যায়। কিন্তু শহর একেবারেই নীরব। লে. সাইফুল্লাহ একজন গাইডকে শহরের অবস্থা জানার জন্য পাঠান। কিন্তু গাইড ফিরে আসার আগেই তিনিসহ মুক্তিযোদ্ধারা সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে কাঞ্চন নদী পার হয়ে শহরে ঢুকে পড়েন এবং রেলস্টশনে ঘাঁটি স্থাপন করে শহরের খবরাখবর সংগ্রহ করেন।
মুক্তিযোদ্ধারা গোটা শহরটি ঘুরে দেখেন। রাস্তার দুধারের অসংখ্য দোকান-পাটে লুট-তরাজের চিত্র বিরাজমান। কোনো-কোনো দোকান ও ঘর আগুনে জ্বলছে। পাকসেনারা চলে যাওয়ার আগে এসব কাণ্ড করেছে। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা কোতয়ালি থানার দিকে অগ্রসর হতেই কয়েকজন শহরবাসী মুক্তির আনন্দে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিতে-দিতে এসে তাঁদের জড়িয়ে ধরে। তাদের কাছ থেকে জানা যায় যে, শহর শত্রুমুক্ত। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা ফিরে এসে লে. সাইফুল্লাহকে এ খবর জানান। ততক্ষণে রামসাগরের দিক থেকে মিত্রবাহিনী শহরে পৌঁছে গেছে। লে. সাইফুল্লাহ মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি ভাগে ভাগ করে শহরের বিভিন্ন স্থানে রাত যাপনের ব্যবস্থা করেন। পরের দিন ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে-সঙ্গে স্বাধীন বাংলার পতাকার নিচে জমায়েত হয় শতশত শিশু, বৃদ্ধ ও যুবক। তারা ঘুরে-ঘুরে প্রাণভরে তাদের প্রিয় শহরকে দেখে। [এম এ কাফি সরকার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড