You dont have javascript enabled! Please enable it!

ফেনী প্রতিরোধযুদ্ধ (ফেনী সদর)

ফেনী প্রতিরোধযুদ্ধ (ফেনী সদর) সংঘটিত হয় ২৭ ও ২৮শে মার্চ। এতে ২৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট আত্মসমর্পণ করলে ক্ষুব্ধ জনতা তাদের ৯ জনকে পিটিয়ে মেরে ফেলে।
মুক্তিযুদ্ধকালে বর্তমান ফেনী জেলা ছিল নোয়াখালী জেলার একটি মহকুমা। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা বার্তা ওয়ারলেস মেসেজে নোয়াখালীতে সর্বপ্রথম জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল করিম পান। উক্ত মেসেজ তিনি ২৬শে মার্চ সকালে নোয়াখালী সার্কিট হাউজে সর্বদলীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গকে অবহিত করেন এবং ফেনী মহকুমার প্রধানসহ জেলার সর্বত্র বার্তা পাঠান। বার্তাটি বিলোনিয়ার বিওপি-তে অবস্থানরত বাঙালি ইপিআর সদস্যদের জানানো হয়। তাঁরা দেশমাতৃকার টানে ক্যাম্প ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে একাত্ম হয়ে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেন। অপরদিকে বিওপি থেকে বেশ কয়েকজন অবাঙালি সৈন্য ২৬শে মার্চের কোনো এক সময় ভারী অস্ত্রশস্ত্রসহ ফেনী এসে সেখানকার পুরাতন বিমান বন্দর সংলগ্ন সিও (উন্নয়ন) অফিসে অবস্থান নেয়। লোকমুখে খবর আসে যে, তারা এখান থেকে যে-কোনো সময় ফেনীতে আক্রমণ চালাবে। এ খবর জেলা হেডকোয়ার্টার্স মাইজদীসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা খাজা আহাম্মদ এমএনএ-কে জানানো হয়। তবে সিও অফিসে অবস্থানরত পাকিস্তানি সৈন্যরা ঐদিন বিকেল ২-৩টা পর্যন্ত কোনো আক্রমণ চালায়নি। এদিকে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ছুটিতে বা পালিয়ে আসা ও অবসরপ্রাপ্ত সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে এক জরুরি সভায় মিলিত হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, পাকাস্তানি সৈন্যরা আক্রমণ করার পূর্বেই তাদের আক্রমণ করতে হবে। এরূপ সিদ্ধান্তের পর মুক্তিপাগল হাজার-হাজার নিরস্ত্র জনতা জীবনের মায়া ত্যাগ করে দেশমাতৃকার টানে ফেনী সিও অফিস ঘিরে রাখে।
২৬শে মার্চ কোনো পক্ষ থেকেই গোলাগুলি হয়নি। ২৭শে মার্চ সকালে জেলা হেডকোয়ার্টার্সের নেতৃবৃন্দের পরামর্শক্রমে . স্থানীয় নেতৃবৃন্দ সিও অফিস ঘিরে রাখা হাজার-হাজার সাধারণ জনতাকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নেন। প্ৰায় সঙ্গে- সঙ্গে উভয় পক্ষের মধ্যে শুরু হয় তুমুল গোলাগুলি। হেডকোয়ার্টার্স মাইজদী ও ফেনীর বিভিন্ন স্থান থেকে জড়ো হওয়া পুলিশ, ইপিআর এবং সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি সৈন্যরা জীবন বাজি রেখে সাধারণ থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল দিয়ে সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হন। অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন গোলাম মাওলা, সুবেদার আবু আহম্মদ, সুবেদার সিদ্দিক আহাম্মদ, অধ্যাপক মুজিবর রহমান খান প্রমুখ এ প্রতিরোধ যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। ২৭শে মার্চ সারাদিন ও সারারাত উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড গুলি বিনিময় হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের সাধারণ অস্ত্রের তুলনায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অস্ত্র ছিল খুবই ভারী ও আধুনিক। অপরপক্ষে মুক্তিযোদ্ধাদের ছিল ইস্পাত-কঠিন মনোবল। ২৭শে মার্চের প্রতিরোধ যুদ্ধে ২৭ জন আনসার সদস্য শহীদ হন। কিন্তু যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামী সাধারণ মানুষের মধ্যে যাতে কোনো প্রকার আতঙ্ক কিংবা ভয়-ভীতির সৃষ্টি না হয়, সেজন্য নিহত হওয়ার এ খবর গোপন রাখা হয়৷
২৮শে মার্চ ভোর নাগাদ জেলা হেডকোয়ার্টার্স মাইজদী ও ফেনীর বিভিন্ন এলাকা থেকে আরো সামরিক ও বেসামরিক বাহিনীর মুক্তিকামী সৈনিকরা এসে এ-যুদ্ধে যোগ দেন। প্রতিরোধযোদ্ধারা ভারী অস্ত্র-শস্ত্র তেমন যোগাড় করতে না পারলেও, সবার সম্মিলিত প্রচণ্ড আক্রমণে যুদ্ধের গতি পরিবর্তিত হয়। বাঙালি সৈন্যরা ক্যাপ্টেন মাওলার নির্দেশে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফেনী সিও অফিসে অবস্থানরত পাকিস্তানি সৈন্যদের কাছাকাছি পৌঁছে যেতে সক্ষম হন। সকাল ১০টার দিকে পাকিস্তানি সৈন্যরা বুঝতে পারে তাদের অস্ত্রের ভাণ্ডার প্রায় শেষ; তাদের পক্ষে আর যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ক্রলিং করে আসা বাঙালি সৈন্যদের ক্ষিপ্ত আক্রমণ আঁচ করতে পেরে পাকিস্তানি সৈন্যরা উপায়ান্তর না দেখে সিও অফিসের দোতলা থেকে নেমে মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট আত্মসমর্পণ করে। ফলে যুদ্ধ থেমে যায়। চারদিকে অবস্থানরত হাজার- হাজার বিক্ষুব্ধ জনতা সিও অফিসের দিকে দ্রুত গতিতে ছুটে এসে যুদ্ধরত বাঙালি সৈনিকদের কোনোরকম সুযোগ না দিয়ে ৯ জন পাকিস্তানি সৈন্যকে পিটিয়ে হত্যা করে। জনতা তাদের লাশ টেনে-হিঁচড়ে মিছিল সহকারে ফেনী শহরে নিয়ে আসে। অতঃপর ফেনীর বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক খাজা আহমেদ এমএনএ, এ বি এম তালেব আলী এমপিএ ও অন্যান্য রাজনৈতিক ও ছাত্রবৃন্দ বিক্ষুব্ধ জনতাকে শান্ত করে পাকিস্তানি সৈন্যদের লাশগুলো ফেনী শহরের রাজার ঝি দিঘির পূর্বপাড়ে দাফন করেন। ফেনী প্রতিরোধ যুদ্ধের এ সাফল্য মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় ঘটনা হয়ে আছে। [মো. ফখরুল ইসলাম]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!