You dont have javascript enabled! Please enable it!

বংশাই নদীতীর বধ্যভূমি (মধুপুর, টাঙ্গাইল)

বংশাই নদীতীর বধ্যভূমি (মধুপুর, টাঙ্গাইল) টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর উপজেলায় অবস্থিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে সহস্রাধিক লোককে হত্যা করা হয়।
টাঙ্গাইল জেলা সদর থেকে ৪৭ কিলোমিটার উত্তরে মধুপুরের অবস্থান। মধুপুরের ওপর দিয়ে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে বয়ে গেছে বংশাই নদী। বর্ষাকালে নদীটি খুবই খরস্রোতা হয়। এর দক্ষিণ তীরে নির্জন স্থানে সিও অফিসে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকহানাদাররা ক্যাম্প স্থাপন করে। টাঙ্গাইল, জামালাপুর ও ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে হানাদাররা দিনের বেলায় স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের ধরে এনে সিও অফিসে তালাবদ্ধ করে রাখত এবং গভীর রাতে বংশাই নদীতীরে নিয়ে চোখ-হাত বেঁধে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে অথবা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে হত্যার পর লাশগুলো নদীতে ফেলে দিত। এভাবে মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সহস্রাধিক মানুষকে তারা হত্যা করে তাদের লাশ নদীতে ফেলে দেয়।
১৪ই মে মির্জাপুরের বাইমহাটী গ্রামের কুখ্যাত দালাল ও আলবদর কমান্ডার আবদুল অদুদ মাওলানা ও তার পুত্র মাহবুব মাওলানার নেতৃত্বে স্থানীয় দালালদের প্রত্যক্ষ সহযোহিতায় পাকবাহিনী মির্জাপুর গ্রাম থেকে ১০ জন, দুর্গাপুর, পোস্টকামুরী ও কাষ্ঠালিয়া গ্রাম থেকে একজন করে স্বাধীনতাকামী মানুষকে মির্জাপুর থানায় স্থাপিত হানাদার ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখান থেকে টাঙ্গাইল সার্কিট হাউজ ক্যাম্পে নিয়ে যায় এবং নির্যাতন শেষে রাতে ট্রাকযোগে বংশাই নদীতীর বধ্যভূমিতে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে লাশগুলো নদীতে ফেলে দেয়। এ বধ্যভূমি থেকে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান কাণ্ঠালিয়া গ্রামের সাধন ভট্টাচার্য। সেদিন বংশাই নদীতীর বধ্যভূমিতে হত্যার শিকার হন- মির্জাপুর গ্রামের হরিদাস সাহা (পিতা শ্যামচরণ সাহা), ধীরেন্দ্র সাহা (পিতা ব্রজেন্দ্র সাহা), সুদাম চন্দ্ৰ সাহা (পিতা হরলাল সাহা), দীনেশ চন্দ্র পোদ্দার (পিতা দুর্গাচরণ পোদ্দার), নিতাই চন্দ্র সাহা (পিতা ব্রজবাসী সাহা), ধীরেন্দ্রনাথ চৌধুরী (পিতা ঈশ্বরচন্দ্র চৌধুরী), পান্না লাল সাহা (পিতা বেনীমাধব সাহা), রবীন্দ্রনাথ সাহা (পিতা বীরেন্দ্রনাথ সাহা ওরফে টেনু সাহা), সুবাস চন্দ্ৰ সাহা (পিতা ক্ষেত্রনাথ সাহা), শ্যামসুন্দর পোদ্দার ওরফে ফজু পোদ্দার (পিতা শচীন্দ্র নাথ পোদ্দার), দুর্গাপুর গ্রামের সুরেশ চন্দ্র সাহা (পিতা যোগেন্দ্র চন্দ্র সাহা) এবং পোস্টকামুরী গ্রামের ডা. রেবতী মোহন সাহা (পিতা শশীমোহন সাহা)।
১৮ই মে আলবদর কমান্ডার আব্দুল ওদুদ মাওলানার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পাকবাহিনীর একটি গ্রুপ ভাতগ্রাম- বাগজান গ্রামে অভিযান চালিয়ে ২২ জনকে জোরপূর্বক হাত-পা বেঁধে জিপে তুলে টাঙ্গাইল সার্কিট হাউজে নিয়ে যায় এবং সেখান থেকে ট্রাকযোগে গভীর রাতে বংশাই নদীতীর বধ্যভূমিতে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে তাদের লাশ নদীতে ফেলে দেয়। পাকহানাদার বাহিনী কর্তৃক সেদিন বংশাই নদীতীর বধ্যভূমিতে ভাতগ্রামের হরিনারায়ণ সরকার ওরফে কালিপদ সরকার (পিতা হরিবন্ধু সরকার), জ্ঞানেন্দ্রনাথ সরকার (পিতা শ্রীনাথ সরকার), চিন্তাহরণ সরকার (পিতা রাধানাথ সরকার), সন্তোষ কুমার সরকার (পিতা কেশব কুমার সরকার), উদ্ভব কুমার তরফদার (পিতা সুরেন্দ্রনাথ তরফদার), রাখাল কুমার তরফদার (পিতা সুরেন্দ্রনাথ তরফদার), হরেকৃষ্ণ সিংহ (পিতা শ্রীকান্ত সিংহ), মদন মোহন সিংহ (পিতা শ্রীকান্ত সিংহ), সন্তোষ কুমার সূত্রধর (পিতা নীলমোহন সূত্রধর), সন্তোষ কুমার শিকদার (পিতা সুমন্ত্র কুমার শিকদার), হীরালাল সরকার (পিতা হরিমোহন সরকার), নারায়ণ চক্রবর্তী (পিতা হরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী), কেদারনাথ খাঁ (পিতা নবদ্বীপ খাঁ), মাধবচন্দ্ৰ খাঁ (পিতা দীনবন্ধু খাঁ), ভজহরি মজুমদার (পিতা প্রাণনাথ মজুমাদার), কালিপদ সরকার (পিতা গয়ানাথ সরকার), সুনীল কুমার সূত্রধর (পিতা জ্ঞানমোহন সূত্রধর), পূর্ণচন্দ্র শিকদার (পিতা সুমন্ত্র কুমার শিকদার), বিমল চন্দ্র চৌধুরী, বাগজান গ্রামের পার্শ্ববরণ রায় (পিতা কিশোর কুমার রায়), দামোদর দাস (পিতা জগবন্ধু দাস) ও সুখরঞ্জন রায় (পিতা কিশোর কুমার রায়) হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। বাগজান গ্রামের জয় গোপালকেও একই সঙ্গে হানাদাররা গুলি করলে তিনি আহত হয়ে পড়ে যান। মৃত ভেবে হানাদাররা তার লাশ পানিতে ফেলে দেয়। ঘটনাক্রমে তিনি সেদিন প্রাণে বেঁচে গেলেও দুমাস পর মারা যান। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে এখানে আরো লোককে হত্যা করা হয়। [শফিউদ্দিন তালুকদার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!