You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে বকশীগঞ্জ উপজেলা (জামালপুর) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে বকশীগঞ্জ উপজেলা (জামালপুর)

বকশীগঞ্জ উপজেলা (জামালপুর) ভারতের সীমান্তবর্তী এবং ধানুয়া-কামালপুর রণাঙ্গন এ উপজেলার অন্তর্গত। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ভাষণের মধ্য দিয়ে বকশীগঞ্জের রাজনৈতিক নেতা-কর্মী- ছাত্রনেতাসহ সাধারণ মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধের দিকনির্দেশনা লাভ করে। ১৩ই মার্চ স্থানীয় আওয়ামী লীগ-এর সভাপতি আব্দুল হামিদ মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক আব্দুল বারীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিস্বরূপ বকশীগঞ্জে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এর আহ্বায়ক ছিলেন এডভোকেট মো. আশরাফ হোসেন এমপিএ। পরিষদের সদস্যবৃন্দের মধ্যে ছিলেন- আব্দুল হামিদ মিয়া, আব্দুল বারী, মফিজল হক খন্দকার, মির্জা বদরুল ইসলাম, ডা. সৈয়দুজ্জামান, আব্দুল মমিন, ইসলাম খান, বান্টু মেম্বার, ইয়ার হোসেন বিএসসি, সৈয়দ মেম্বার, করিম মাস্টার, কালু দফাদার, জহির সরকার, জালাল মুক্তি, ডা. অমল কুমার সেন, নুরুল ইসলাম, নুর ইসলাম খলিফা প্রমুখ। সংগ্রাম পরিষদের নেতা-কর্মীরা পাকিস্তানের পতাকা পুড়ে ফেলেন এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ২৬শে এপ্রিল পাকবাহিনী বকশীগঞ্জ বাজারে প্রবেশ করার পর এলাকার মুক্তিকামী মানুষের মধ্যে অনেকে ভারতের মহেন্দ্রগঞ্জে চলে যায় এবং ১১ নম্বর সেক্টরের (কমান্ডার কর্নেল আবু তাহের) অধীনে তেলঢালায় মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেয়।
এডভোকেট মো. আশরাফ হোসেন এমপিএ বকশীগঞ্জ এলাকার কৃষক, ছাত্র-জনতা সবাইকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি ১১ নম্বর সেক্টরের অধীনে বকশীগঞ্জ মুক্ত এলাকার রাজস্ব আদায় কমিটির সভাপতি ছিলেন। তিনি জামালপুরের এমএনএ, এমপিএ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নিয়ে ভারতের মহেন্দ্রগঞ্জে ‘শরণার্থী ক্যাম্প তহবিল’ গঠন করেন। এর অন্যতম সদস্য থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল হামিদ মিয়া বকশীগঞ্জের সকল শ্রেণির মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য অণুপ্রেরণা যোগান। বকশীগঞ্জ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল বারী ছিলেন দেওয়ানগঞ্জের মুক্ত এলাকার প্রধান রাজস্ব আদায়কারী এবং শরণার্থী ক্যাম্প তহবিলের একজন সদস্য।
২৬শে এপ্রিল পাকবাহিনী বকশীগঞ্জ উপজেলায় অনুপ্রবেশ করে এবং ইউনিয়ন পরিষদ ও উলফাতুন্নেছা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে ক্যাম্প স্থাপন করে। এছাড়া ধানুয়া-কামালপুরের বিওপি ক্যাম্পেও তারা ঘাঁটি স্থাপন করে। বকশীগঞ্জে হানাদার বাহিনীর একাধিক নির্যাতনকেন্দ্র ছিল। এর মধ্যে- বকশীগঞ্জ উলফাতুন্নেছা বালিকা বিদ্যালয় নির্যাতনকেন্দ্র বকশীগঞ্জ মাতৃমঙ্গল ভবন নির্যাতনকেন্দ্র- কামালপুর পাকক্যাম্প নির্যাতনকেন্দ্র- উল্লেখযোগ্য।
বকশীগঞ্জ উপজেলায় স্থানীয় মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র সংঘ-এর নেতা-কর্মীরা পাক হানাদারদের মূল দোসর ছিল। মফিজল হক তালুকদারকে চেয়ারম্যান এবং ডা. আজিজকে সাধারণ সম্পাদক করে এখানে শান্তি কমিটি গঠিত হয়। এদের নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী গঠন করা হয়। শান্তি কমিটির সহায়তায় বদর বাহিনী এলাকার গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও ব্রিজ-কালভার্ট পাহারা দিত। এরা মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগ পরিবারের খোঁজ-খবর রাখত। মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার দায়িত্ব ছিল এদের ওপর। এরা পাকসেনাদের গাইড হিসেবেও কাজ করত। বুচা, ইছা, বাবুল চিশতী, নূরল আমিন প্রমুখ আলবদরদের অত্যাচারে এলাকার মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত থাকত। এখানে স্বাধীনতাবিরোধীদের মধ্যে মুসলিম লীগের নেতা মফিজল হক তালুকদার, ডা. আজিজ, ডা. সামাদ, মতিউর মাস্টার, ডা. খলিলুর রহমান, জহুরল হক মেম্বার, আশরাফ আলী, আক্তার মিয়া, আজিমদ্দিন বেপারী, মৃনাল চেয়ারম্যান, ঢাচ্চু বেপারী প্রমুখ খুবই তৎপর ছিল। আলবদর বাহিনীর কমান্ডার ছিল নূরল আমিন ও ডেপুটি কমান্ডার ছিল মিয়াবাড়ির লাখপতি।
এখানকার মুসলীম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা হিন্দু বাড়িতে লুটতরাজ করে। তৎকালীন বকশীগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মফিজল হক তালুকদারের সহযোগী কুখ্যাত সোনাই, মহির উদ্দিন কাউল, ছানু ও মেঘা মিয়া আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে। আওয়ামী লীগ কর্মী কোব্বাছ আলীকে হাত বেঁধে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে। পাকসেনারা ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের জন্য মহাদেব নামে একজনকে গুলি করে হত্যা করে। আহত মুক্তিযোদ্ধা ফারুক, আবুল হোসেন ও তাহেরকে বকশীগঞ্জ পাকক্যাম্পে ধরে এনে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে। কয়েকজন পাকসেনা বকশীগঞ্জ গরুহাটি এলাকায় মোখলেছ চেয়ারম্যানকে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে হত্যা করে। পুরাতন মুক্তিযোদ্ধা অফিসের সামনে আলবদর আব্দুল মজিদ বাচ্চু খোসালপুরের ইদ্রিস আলীকে গুলি করে হত্যা করে। সেপ্টেম্বর মাসে পাকসেনারা দত্তেচর ঈদগাহ মাঠের পূর্বপাশে এক সারিতে দাঁড় করিয়ে ১৮ জন নিরীহ কৃষককে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে, যা দত্তেচর গণহত্যা নামে পরিচিত এছাড়াও বকশীগঞ্জ, বাট্টাজোড় ও কামালপুরের আওয়ামী লীগ সমর্থক ও মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়দানকারী বহু লোককে তারা হত্যা করে। পাকবাহিনী তাদের ক্যাম্পে নারীদের বন্দি করে তাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালাত।
বকশীগঞ্জে পাকবাহিনীর স্থায়ী নির্যাতনকেন্দ্র ছিল বর্তমান মাতৃসদন ভবন। এছাড়া কামালপুর ক্যাম্পও নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
বকশীগঞ্জ উপজেলায় দুটি বধ্যভূমি ও তিনটি গণকবর আছে, যথা— কামালপুর ইপিআর ক্যাম্প বধ্যভূমি, বকশীগঞ্জ এন এম হাইস্কুল মাঠসংলগ্ন বধ্যভূমি ও গণকবর এবং ধানুয়া-কামালপুর গণকবর, বকশীগঞ্জ গৌহাটি গণকবর। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্কুল মাঠের উত্তর পার্শ্বস্থ পুকুর পাড়ে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে পুতে রাখা হয়। এখানে একটি পরিত্যক্ত কূপেও মানুষ হত্যা করে ফেলে দেওয়া হতো। স্বাধীনতার পর ঐসব স্থান খননকালে মানুষের হাড়গোড়, মাথার খুলি, কঙ্কাল, মেয়েদের চুল, চুড়ি ও চেইন পাওয়া যায়। ধানুয়া কামালপুরের অছিমদ্দিন চেয়ারম্যানের বাড়ির রাস্তার পাশে শেওড়া গাছের নিচে অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে কবর দেয়া হয়।
বকশীগঞ্জ উপজেলার মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের তুরা ও তেলঢালায় উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে মে ও জুন মাসে বাংলাদেশে ঢুকে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে। ইপিআর, পুলিশ, আনসার ও সেনা সদস্যদের নেতৃত্বে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালিত হয়। ১২ই জুন ইপিআর নায়েক সুবেদার সিরাজের নেতৃত্বে ১৪৮ জন মুক্তিযোদ্ধা কামালপুর বিওপি ক্যাম্প যুদ্ধ- করেন। ১৫ই জুন মুক্তিযোদ্ধা রইচ উদ্দিন তাঁর সহযোদ্ধাদের নিয়ে বকশীগঞ্জ-কামালপুর রোড অপারেশন পরিচালিত করেন। এদিন তাঁরা এখানে একটি মাইন পুঁতে রাখেন। পরদিন সকাল ৮টায় পাকসেনাদের গোলাবারুদ ভর্তি একটি ট্রাক ঐ মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে যায়। ঘটনাস্থলে কয়েকজন পাকসেনা হতাহত হয়। ২০শে জুন হাবিলদার হাকিমের নেতৃত্বে ১২০ জন মুক্তিযোদ্ধা কামালপুর পাক ছাউনি আক্রমণ করেন। এদিন সম্মুখ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর একজন নিহত ও কয়েকজন আহত হয়। ২৮শে আগস্ট ও ৪ঠা ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা বকশীগঞ্জে পাকবাহিনী ক্যাম্পে আক্রমণ করেন, যা বকশীগঞ্জ যুদ্ধ নামে পরিচিত। পাকসেনারা পাল্টা আক্রমণ করলে উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড গোলাগুলি হয়। এ-যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর নিক্ষিপ্ত শেলের আঘাতে কয়েকজন পাকসেনা হতাহত হয়।
বকশীগঞ্জে সবচেয়ে বড় যুদ্ধ হয় কামালপুরে, যা কামালপুর যুদ্ধ নামে পরিচিত। ৩০-৩১শে জুলাই কামালপুর ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম অভিযান- পরিচালিত হয়। এতে প্রায় ২শ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। অপরদিকে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ, বীর উত্তমসহ ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এছাড়াও আগস্টের মাঝামাঝি, ৬ই সেপ্টেম্বর, ১০ই সেপ্টেম্বর, অক্টোরব মাসের শেষের দিকে, ৬ই নভেম্বর, ১৩ই নভেম্বর, ১৪ই নভেম্বর ও ৪ঠা ডিসেম্বর একাধিকবার এ-যুদ্ধ সংঘটিত হয়। অক্টোরব মাসের শেষের দিকে ধানুয়া-কামালপুর যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়, হয়। এতে ১৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ১৩ই নভেম্বরের যুদ্ধে কর্নেল তাহের পাকসেনাদের ছোড়া শেলের আঘাতে পায়ে গুরুতর আহত হন এবং তাঁর ঐ পা-টি কেটে ফেলতে হয়। ৪ঠা ডিসেম্বর সকালে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ড বকশীগঞ্জ পাকঘাঁটি আক্রমণ করে। এসময় বকশীগঞ্জের টিকরকান্দি ও টালিয়াপাড়ায় পাকসেনাদের সঙ্গে তাদের তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে বকশীগঞ্জ পাকঘাঁটির অধিনায়ক মেজর আইয়ুব খানসহ কয়েকজন পাকসেনা হতাহত হয়। ৫ই ডিসেম্বর বকশীগঞ্জ উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মো. নূর ইসলাম, বীর বিক্রম ও বীর প্রতীক- (পিতা মো. রইছ উদ্দিন, সূর্যনগর পূর্বপাড়া), বশির আহমেদ, বীর প্রতীক- (পিতা লাল মাহমুদ, ডুমুরতলা) ও মতিউর রহমান, বীর প্রতীক- (পিতা তছলিম উদ্দিন সরকার, ধানুয়া। এ উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- জামাল উদ্দিন (পিতা কছি শেখ, সাতানিপাড়া), গাজী আসাদুজ্জামান (পিতা গাজী সামসুল হক, আলীরপাড়া) ও তছলিম উদ্দিন (পিতা আব্দুল গফুর, সূর্যনগর)।
উপজেলা সদরে শহীদ গাজী আসাদুজ্জামান ও শহীদ তছলিম উদ্দিনের নামে দুটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। কামালপুর বাজার-সংলগ্ন বিজিবি ক্যাম্পের সম্মুখস্থ মাঠের শেষ প্রান্তে স্থাপন করা হয়েছে কামালপুর যুদ্ধে শহীদ শহীদ ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ, বীর উত্তম স্মৃতিস্তম্ভ কমপ্লেক্স-। এটি নির্মাণ করেন ভাস্কর শ্যামল চৌধুরী। এখানে ৬৫ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধাসহ স্বাধীনতা-উত্তর ২৯ জন রাষ্ট্রীয় খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার নামের তালিকা পাথরে খোদাই করা হয়েছে। পাশাপাশি কামালপুর রণাঙ্গনের সামরিক মানচিত্র এবং শহীদ ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ, বীর উত্তমএর সংক্ষিপ্ত জীবনী মোজাইক পাথরে খোদাই করে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। [রজব বকশী]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড