You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে ফুলবাড়ী উপজেলা (কুড়িগ্রাম) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে ফুলবাড়ী উপজেলা (কুড়িগ্রাম)

ফুলবাড়ী উপজেলা (কুড়িগ্রাম) কুড়িগ্রাম জেলার পুরনো থানাগুলোর একটি। ধরলা, নীলকমল ও রত্নাই নদী বেষ্টিত এ উপজেলার দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিম ও পূর্ব-দক্ষিণে ধরলা নদী। পশ্চিমে লালমনিরহাট এবং উত্তরদিকে ভারতের কুচবিহার জেলা। ভারতের অন্যতম বৃহৎ ছিটমহল দাসিয়ার ছড়া ১৯৭১ সালে ফুলবাড়ীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। নদী ও সীমান্ত বেষ্টিত ফুলবাড়ী উপজেলা একাত্তরে মুক্তাঞ্চল ছিল।
পুরো ষাটের দশকে এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে সারা দেশের মতো ফুলবাড়ী উপজেলায়ও বাংলাদেশের স্বাধিকারের প্রশ্নে ব্যাপক গণজোয়ারের সৃষ্টি হয়। এর প্রভাব পড়ে নির্বাচনে। বিপুল উৎসাহ- উদ্দীপনা নিয়ে ফুলবাড়ীতে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ এর নেতা-কর্মীরা নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেন। আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের সমর্থনে বদরুজ্জামান, বীর প্রতীক, আব্দুল মান্নান খন্দকার, বাঘা ইউনুছ, আমির আলী মিয়া, শামসুল হক সরকার, আবুল হোসেন প্রামাণিক, শাহজাদা আব্দুল্লাহ মিয়া, গোলাম মান্নান লাল, ডা. ছদরুজ্জামান, সেরাজুল হক আনছারী, শেখ আতাউর রহমান, আবু বকর মিয়া প্রমুখ নেতা ব্যাপক গণসংযোগ করেন। ফুলবাড়ী থেকে বিপুল ভোটে আওয়ামী লীগ প্রার্থী রিয়াজউদ্দিন আহমেদ এমএনএ ও আবুল হোসেন এমপিএ নির্বাচিত হন। নির্বাচনে সারাদেশে আওয়ামী লীগ বিজয় লাভ করলেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তর না
করার জন্য ষড়যন্ত্র করতে থাকে। এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান – তাঁর সাতই মার্চের ভাষণ-এ দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য রাখেন। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার খবর বিভিন্ন মাধ্যমে জেনে ফুলবাড়ীয়ার নেতা-কর্মীরা ইপিআর-এর অবাঙালি সদস্যদের কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। কিন্তু তার আগেই ভুরুঙ্গামারীর সোনাহাট থেকে ইপিআর-এর অবাঙালি সদস্যদের একটি দল এসে পড়লে পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যায়।
২৮শে মার্চ ভুরুঙ্গামারীর সোনাহাট সীমান্ত থেকে কিছু অবাঙালি ইপিআর সদস্য লালমনিরহাট যাবার পথে ফুলবাড়ীতে সাময়িক অবস্থান নেয়। এ খবর পেয়ে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও ছাত্রলীগের নেতারা ফুলবাড়ী থানা থেকে কয়েকটি বন্দুক ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে তাদের ধাওয়া করেন। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন বাঙালি ইপিআর সদস্য লুৎফর রহমান। তাঁরা ধরলা নদী পার হয়ে লালমনিরহাট থানার সাপটানা নেছারিয়া মাদ্রাসার কাছে গেলে দুই পক্ষের মধ্যে সম্মুখ যুদ্ধ হয়। বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ সেদিন অস্ত্র ছাড়া কেবল অসীম সাহস ও মনোবল নিয়ে তাদের মোকাবেলা করে। এ-যুদ্ধে ফুলবাড়ীর ইপিআর সদস্য লুৎফর রহমান শহীদ হন। এতে বিক্ষুব্ধ জনতা অবাঙালি ইপিআর সদস্যদের ঘিরে ফেলে এবং তকাদের হাতে ৭ জন পাকিস্তানপন্থী ইপিআর সদস্য নিহত হয়।
শহীদ লুৎফর রহমানের লাশ দাফনের পর ফুলবাড়ীতে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম নতুন উদ্যমে শুরু হয়। বেশ কয়েকটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প খোলা হয়। থানার পুলিশ ও সীমান্তের ইপিআর সদস্যদের সঙ্গে ছাত্র-যুবকরা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়। নন্দিরকুঠি, পাখীরহাট, ফুলবাড়ী সদরের থানা ট্রেনিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার, বালারহাট গার্লস স্কুল, গোড়কমণ্ডল, ভাঙামোড় ও দাসিয়ারছড়া ছিটমহলে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প খোলা হয়। দাসিয়ারছড়া ছিটমহলের কালিরহাট বাজারের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে দলে-দলে ছাত্র-তরুণরা যোগ দেয়। প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শেষে অনেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যায়। ফুলবাড়ী থানার পুলিশের কয়েকজন সদস্য প্রাথমিকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেন। তাঁদের মধ্যে কাইয়ুম আলী ও শহিদুল হক দারোগা ছিলেন। এছাড়া গোলাম মওলা ও আব্দুল মালেক চৌধুরী নামে দুজন ইপিআর সদস্য প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেন। এর বাইরে এছাহাক আলী সরকার, আবুল হোসেন, আক্তারুজ্জামান মণ্ডল, শুভাংশু চক্রবর্তী, গোরা প্রমুখ মুজিব বাহিনীর সদস্য আমির আলী মিয়ার বাড়িতে একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প খুলে অনেককে প্রশিক্ষণ দেন। এ ক্যাম্প প্রায় ছয় মাস স্থায়ী ছিল। বালাহাটে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল। সেখানে অনেক নারী মুক্তিযোদ্ধা সামরিক প্রশিক্ষণ নেন। কুর্শা ও গাগলায় ভারতীয় সেনাদের ক্যাম্প ছিল। গাগলা ব্রিজের পাশে আর কুর্শায় যোগেশ বাবুর বাড়িতে ভারতীয় বাহিনীর ক্যাম্প ছিল।
মুক্ত অঞ্চল ছিল বলে ফুলবাড়ীতে বেসামরিক প্রশাসনের কর্তৃত্ব চালু হয়। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও আওয়ামী লীগের নেতা আহাম্মদ হোসেন সরকারকে আঞ্চলিক কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। পাকসেনারা যাতে ফুলবাড়ীতে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য কুলাঘাট থেকে আঠার কাউনিয়া পর্যন্ত ধরলা নদীর উত্তরপাড়ে কড়া প্রহরা বসানো হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে কোনো বিশেষ বাহিনী ছিল না। তবে ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির যৌথ গেরিলা বাহিনী ছিল। এ বাহিনীর নেতা ছিলেন মণিকৃষ্ণ সেন, শংকর বসু, বদরুজ্জামান মিয়া, ডা. কালিপদ বর্মণ, চিত্তরঞ্জন দেব প্রমুখ। এঁদের তত্ত্বাবধানে বালাহাটে প্রমিলা দেবী নামে একটি হাসপাতাল চালু হয়েছিল। এখানে আকলিমা খন্দকার, কনক প্রভা, মাহমুদা ইয়াসমীন বিউটি, জাহানারা বেগম, শামীমা আক্তার গিনি, পিয়ারী বেগম, মমতাজ বেগমসহ কয়েকজন নারী মুক্তিযোদ্ধা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। হাসপাতাল পরিচালনার সার্বিক দায়িত্ব পালন করেন আওয়ামী লীগ নেতা ইউনুস আলী।
মুক্তিযুদ্ধে এ এলাকার বিভিন্ন যুদ্ধে নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনা দেন ৬ নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন নওয়াজিস উদ্দিন, কোম্পানি কমান্ডার মো. বদরুজ্জামান, বীর প্রতীক প্রমুখ।
রাজাকার, আলবদর, আলশামস সহ পাকবাহিনীর সহযোগীদের প্রত্যক্ষ কোনো তৎপরতা ফুলবাড়ীয়া উপজেলায় ছিল না। তবে ভাঙ্গামোড় ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দেওয়ান আবুল হোসেন মহকুমা কমিটির প্রভাবশালী সদস্য ছিল। দেশ স্বাধীনের পর লালমনিরহাট থেকে আটক হয় মতিউল্লাহ চেয়ারম্যান (শিমুলবাড়ী), আব্দুল হক, সৈয়দ আলী প্রমুখ। এদের লালমনিরহাটে আটক করে কুড়িগ্রাম জেলে পাঠানো হয়। এরা সবাই মুসলীম লীগ-এর সদস্য ও ফুলবাড়ী উপজেলার বাসিন্দা ছিল। এলাকায় এরা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তৎপরতা চালাতে সাহস না করলেও যুদ্ধের সময় লালমনিরহাটে পাকিস্তানিদের সহায়তা করে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ফুলবাড়ী উপজেলার অনেক সাধারণ মানুষ জীবন রক্ষার জন্য শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। তারা কুর্শাহাটের যুবশিবির-এ নাম তালিকাবদ্ধ করে দিনহাটা, ওকরাবাড়ী, নয়ারহাট, কুচবিহারসহ বিভিন্ন শরণার্থী শিবির-এ আশ্রয় নেয়। পাকবাহিনী অনুপ্রবেশ করতে পারেনি বলে ফুলবাড়ী উপজেলায় অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন, গণহত্যা ও নারীনির্যাতনের মতো ঘটনা ঘটেনি।
এ এলাকায় গণকবর নেই। তবে নন্দিরকুঠি স্কুলের পাশে দুজন ও ফুলবাড়ী কবরস্থানে একজন মুক্তিযোদ্ধার সমাধি আছে।
ফুলবাড়ী উপজেলায় পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি প্রতিরোধ যুদ্ধ হয়। ২০শে এপ্রিল ধরলা নদী পাড়ি দিয়ে কলাখাওয়া ঘাট দিয়ে পাকবাহিনী ফুলবাড়ীতে ঢোকার চেষ্টা করে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে তারা শেষ পর্যন্ত পালিয়ে যায়। এদিন ঘাটের পাশে শমসের নামে একজন পাকবাহিনীর গুলিতে শহীদ এবং মনির উদ্দিন আহত হন। মনির উদ্দিনকে চিকিৎসার জন্য কুচবিহারে পাঠানো হয়।
পাকবাহিনী এক সময় লালমনিরহাট থেকে কুলাঘাট হয়ে ফুলবাড়ী আক্রমণের পরিকল্পনা নেয়। কিন্তু কুলাঘাট ও আশেপাশে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের শক্ত প্রতিরোধ ব্যবস্থা। আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে কোম্পানি কমান্ডার সিরাজুল ইসলামের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল ধরলা নদী পার হয়ে কুলাঘাটে এম্বুশ করে। পাকিস্তানিদের ২৫ থেকে ৩০ জনের একটি দল মুক্তিযোদ্ধাদের এ এম্বুশে পড়ে। এখানে দুপক্ষের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে ১২ জন পাকসেনা নিহত ও একজন ধৃত হয় এবং বাকিরা পালিয়ে যায়। এ-যুদ্ধ কুলাঘাট যুদ্ধ নামে পরিচিত।
কুলাঘাট যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য পরদিন ১২ই আগস্ট পাকবাহিনী আবার ফুলবাড়ী আক্রমণের চেষ্টা করে। ৫০-৬০ সদস্যের পাকবাহিনীর একটি দল ধরলা নদী দিয়ে নৌকায় করে অগ্রসর হয়। এদের সহায়তার জন্য তীরে আরো বেশ কিছু পাকসেনা ছিল। পাকবাহিনীর এ প্রস্তুতি দেখে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকেও পদক্ষেপ নেয়া হয়। ধরলার চরের বিশাল কাঁশবনের ভেতর তাঁরা ওৎ পেতে থাকেন। এক পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা রাইফেল, এসএলআর, এলএমজি এবং ২ ইঞ্চি মর্টার নিয়ে পাকবাহিনীকে আক্রমণ করেন। অপরদিকে তীরে থাকা পাকবাহিনীর সদস্যরাও পাল্টা আক্রমণ করে। নৌকা ডুবে আর গুলিতে আহত হবার পরে সলিল সমাধি ঘটে ৬০ জন পাকসেনার। এদের লাশ ধরলায় ভেসেছিল অনেক দিন। ধরলা যুদ্ধ নামে পরিচিত এ-যুদ্ধের পর পাকবাহিনী আর কখনো ফুলবাড়ী দখলের চেষ্টা করেনি।
এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে সংঘটিত হয় কাউয়াহাগা ঘাট যুদ্ধ। এ-যুদ্ধে ১১ জন পাকসেনা নিহত হয়। অন্যদিকে পাকসেনাদের গুলিতে কয়েকজন সাধারণ মানুষ হতাহত হয়। একই সময়ে কলাখাওয়া যুদ্ধ- সংঘটিত হয়। এতে পাকবাহিনী পরাজিত হয়ে পিছু হটে।
কুলাঘাট থেকে লক্ষ্মীকান্ত ঘাট পর্যন্ত এলাকায় ধরলার উত্তর পাড়ে বাংকার করে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে মুক্তিবাহিনী। সংগ্রাম কমিটির সদস্যরা খাদ্য ও রসদ সরবারহ করতেন। হাট-ঘাটের টোল, খাস বিলের ট্যাক্স, সরকারি খাদ্য গুদামের চাল, গম বিক্রি ছাড়াও বিভিন্ন গ্রাম থেকে সংগৃহীত অর্থ সংগ্রাম কমিটির সদস্যরা মুক্তিবাহিনীকে দিতেন। এ এলাকায় ব্যারিকেড দেয়ার জন্য কয়েকটি বাংকার এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যাতে পাকবাহিনী ধরলা নদী পাড় হয়ে ফুলবাড়ীতে ঢুকতে না পারে। বাংকারগুলোতে প্রয়োজনীয় খাদ্য ও অর্থ সরবারহ করা হতো।
ফুলবাড়ী উপজেলায় যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য নাওডাঙ্গা হাইস্কুলে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, যা নাওডাঙ্গা ফিল্ড হাসপাতাল- নামে পরিচিত ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে অনেক আহত মুক্তিযোদ্ধা চিকিৎসা নেন।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন- বদরুজ্জামান মিয়া, বীর প্রতীক (পিতা নজিরুজ্জামান মিয়া, শিমুলবাড়ি)। ফুলবাড়ী উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- লুৎফর রহমান (ইপিআর সদস্য; পিতা শহীদ আলী, ফেনী, নোয়াখালী), মোজাম্মেল হক খন্দকার (পিতা আবু বক্কর খন্দকার, শিমুলবাড়ী, জেলা কুড়িগ্রাম), মজর উদ্দিন (পিতা সজিমুদ্দিন, চন্দ্রখানা), আলী হোসেন (পিতা মোহাকেত আলী, কাকিনা, কালিগঞ্জ, লালমনিরহাট) এবং শাহ আলম (পিতা হারুন আলী, হাড়িভাঙা, লালমনিরহাট)।
শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামে ফুলবাড়ীর কিছু সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। যেমন ফুলবাড়ি বাজার থেকে ফুলসাগর লেক পর্যন্ত সড়কের নাম শহীদ লুৎফুর রহমান সড়ক, ফুলবাড়ী-বালারহাট সড়কের নাম শহীদ মোজাম্মেল হক খন্দকার সড়ক, চন্দ্রখানা চৌপাতি থেকে কুলাঘাট সড়কের নাম শহীদ শাহ আলম সড়ক, ভাঙ্গামোড় ইউপি থেকে নেওয়াশী ঘাট সড়কের নাম শহীদ আলী হোসেন সড়ক, ফুলবাড়ী বাজার থেকে বড়ভিটা ঘাট সড়কের নাম শহীদ মজর উদ্দিন সড়ক এবং বালাহাটা ফুলবারী থেকে মিয়া পাড়া শিমুলবাড়ী সড়কের নাম বীর প্রতীক বদরুজ্জামান সড়ক। [আব্দুল খালেক ফারুক]
ফুলবাড়ী উপজেলা (দিনাজপুর) দিনাজপুর জেলা শহর থেকে ৪০ কিমি পূর্ব-দক্ষিণে অবস্থিত। এর উত্তরে পার্বতীপুর ও চিরিরবন্দর, দক্ষিণে বিরামপুর, পূর্বে নবাবগঞ্জ ও বিরামপুর উপজেলা এবং পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ। ১৯৭১ সালে দিনাজপুর, ঢাকা ও খুলনার সঙ্গে এর রেল যোগাযোগ ছিল। কিন্তু ঢাকার সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ ছিল না। ইট বিছানো সড়কপথে কেবল দিনাজপুর যাওয়া যেত। অন্য সকল স্থানীয় যোগাযোগ ছিল কাঁচা রাস্তায় পায়ে হেঁটে এবং গরু ও মহিষের গাড়িতে। বাই-সাইকেল থাকলেও সংখ্যায় ছিল খুবই কম।
১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগ-এর ৬-দফা আন্দোলনের পর থেকে ফুলবাড়ীর জনগণ জাতীয় নানা আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে ওঠে। এর ধারাবাহিকতায় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান-, ৭০-এর নির্বাচন, নির্বাচনের পর অসহযোগ আন্দোলন- এর সবকটিতে তারা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে। এসব আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন ফুলবাড়ী কলেজের অধ্যক্ষ মো. আব্দুল আজিজ, উপাধ্যক্ষ আব্দুস সামাদ, স্থানীয় আওয়ামী লীগের সভাপতি ডা. মোজাফ্ফর আহমেদ সরকার প্রমুখ।
নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পরও আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের গড়িমসিতে ফুলবাড়ীবাসীর মধ্যে তীব্র ক্ষোভ দেখা দেয়। ১৯৭১ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি পাকসেনাদের গুলিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহার নির্মম মৃত্যুর -প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যে উত্তাল আন্দোলন চলছিল, সেই আন্দোলনের সমর্থনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলবাড়ীর প্রাক্তন ছাত্র অবনীকান্ত, দবির আহমেদ, সুজাপুর হাইস্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক আসাদুজ্জামান চৌধুরী প্রমুখের উদ্যোগে একটি ছাত্রমিছিল বের হয়। মিছিলটি কিছুক্ষণের মধ্যে সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণে জনসমুদ্রে পরিণত হয়। ঐ মিছিলের পর থেকে ফুলবাড়ীর ছাত্র-শিক্ষক, কৃষক-শ্রমিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে তীব্র পাকিস্তানবিরোধী চেতনা জাগ্ৰত হয়। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ- শুনে ফুলবাড়ীবাসী ‘যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা’ করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়। স্থানীয় আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ (ভাসানী ও মোজাফ্ফর), ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দের মধ্যেও ঐক্য গড়ে ওঠে। তারা একটি অবশ্যম্ভাবী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন। কাছাকাছি সময়ে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বাঙালি সেনাঅফিসার ক্যাপ্টেন আনোয়ার পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে ফুলবাড়ী আসেন এবং তাঁর ঐ অবস্থা দেখে এলাকাবাসীর যুদ্ধের প্রস্তুতি আরো জোরদার হয়ে ওঠে।
ক্যাপ্টেন আনোয়ার এক কোম্পানি সেনাসহ ফুলবাড়ীর সিও অফিসের হলরুমে আশ্রয় নেন। এসময় অধ্যক্ষ মো. আব্দুল আজিজ, উপাধ্যক্ষ আব্দুস সামাদ, আওয়ামী লীগ সভাপতি ডা. মোজাফ্ফর আহমেদ সরকার, ডা. আব্দুল কাইয়ুম, আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল খালেক, কোবাত হোসেন, আলী হোসেন হাশমি (অবাঙালি), ন্যাপ নেতা খেলু মিয়া, কমিউনিস্ট নেতা রূপনারায়ণ রায়, ক্যাপ্টেন আনোয়ার প্রমুখের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হন। ছাত্র ইউনিয়নের আজিজ বাবু, মনসুর আলী, ছাত্রলীগের মোকছেদ আলী শাহ্, মঞ্জুর হোসেন, মো. মোস্তাফিজার রহমান ফিজার (বর্তমান প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী) এবং মতিয়ার, মোশাররফ প্রমুখ এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। প্রথম পর্যায়ে ৭ থেকে ১০ দিন ব্যাপী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ হয়। ক্যাপ্টেন আনোয়ার ও মুজাহিদ (বর্তমান আনসার) বাহিনীর নেতৃত্বে এ প্রশিক্ষণ চলে। মুজাহিদ বাহিনীর প্রশিক্ষক হিসেবে ছিলেন আব্দুস সামাদ, মজিবর রহমান, কমান্ডার হাপু প্রমুখ। প্রধান প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সুজাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মফিজ উদ্দিন আহমেদ। কালী রাইচ মিলের আমবাগানে কাঠের রাইফেল দিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। থানা থেকে রাইফেল নিয়ে কানাহার পুকুরে প্রাক্টিস করা হয়। সিও অফিসের পাশের আমবাগানে একটি গোপন ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপন হয়, যেখানে বেঙ্গল রেজিমেন্টের হাবিলদার ওহাব ও সিনিয়র মুজাহিদরা মুক্তিযোদ্ধাদের রাইফেল চালানো শেখান। পাকবাহিনী ফুলবাড়ী দখল করার পর এঁরা সকলে ভারতের ট্রেনিং ক্যাম্পগুলোতে চলে যান। তাঁদের মধ্যে মো. মঞ্জুর রহমান (পিতা জামিল উদ্দিন, ফুলবাড়ী সদর) খামারপাড়া ও রায়গঞ্জে এবং মো. লিয়াকত আলী (পিতা ওসমান মিয়া) শিলিগুঁড়ির পানিঘাটায় প্রশিক্ষণ নেন। মো. মঞ্জুর রহমান পরবর্তীকালে প্লাটুন কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। এ উপজেলার আরো কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হলেন- মো. মোস্তাফিজার রহমান ফিজার, তোজাম্মেল হোসেন (প্রাক্তন চেয়ারম্যান), মণীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম, আব্দুর রহমান, ফারুক, নুরুজ্জামান প্রমুখ।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ফুলবাড়ী অঞ্চলে বেশ কয়েকজন কমান্ডার ছিলেন, যাঁদের নেতৃত্বে ফুলবাড়ী ও আশপাশের এলাকায় হানাদারদের বিরুদ্ধে গেরিলা ও সম্মুখ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তাঁরা হলেন— প্লাটুন কমান্ডার মো. মঞ্জুর রহমান (সুজাপুর, ফুলবাড়ী; মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৩২ জন), প্লাটুন কমান্ডার মো. আফসার আলী (শিবনগর-পার্বতীপুর, ফুলবাড়ী; মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৩২ জন), গ্রুপ কমান্ডার মো. মকবুল হোসেন (ভাগপাইর, ফুলবাড়ী; মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১২ জন), গ্রুপ কমান্ডার মো. লুৎফর রহমান (বারকনা, ফুলবাড়ী; মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১২ জন), গ্রুপ কমান্ডার মো. জামাল উদ্দিন (জগন্নাথপুর, ফুলবাড়ী; মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১২ জন), গ্রুপ কমান্ডার মো. আব্দুস সালাম (বাগড়া- পার্বতীপুর, ফুলবাড়ী; মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১২ জন), গ্রুপ কমান্ডার মো. একরামুল হক (বাগড়া-পার্বতীপুর, ফুলবাড়ী; মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১২ জন), কমান্ডার গণেশ চন্দ্র রায় (ফুলবাড়ী, বিরামপুর; মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১১ জন; পরে শহীদ), কমান্ডার নজরুল ইসলাম (মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১৪ জন; পরে শহীদ), কমান্ডার মকছেদ আলী শাহ্ (মুক্তযোদ্ধার সংখ্যা ১৫০ জন), কমান্ডার বছির উদ্দিন এবং কমান্ডার পাষাণ চৌধুরী।
এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে সৈয়দপুর সেনানিবাসে বাঙালি রেজিমেন্টের ওপর পাকসেনাদের আক্রমণ হলে ক্যাপ্টেন আনোয়ারসহ কয়েকজন বাঙালি সেনা সিও অফিসে আশ্রয় নেন। পরে পাকবাহিনী দিনাজপুর থেকে জিপ নিয়ে ভারী অস্ত্র থেকে গুলি করতে-করতে ফুলবাড়ীর অদূরে রসুলপুরে আসে এবং সেখান থেকে ফুলবাড়ীতে প্রবেশের চেষ্টা করে। কিন্তু ফুলবাড়ী লোহার ব্রিজের কাছে তারা প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। হাবিলদার মেজর আব্দুল ওয়াহাব, ছাত্রনেতা মো. মঞ্জুর রহমান, মুজাহিদ বুদু মিয়া, আব্দুস সামাদ, মজিবর রহমান প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা তাদের বাধা দেন এবং উভয় পক্ষে যুদ্ধ হয়। কিন্তু পাকবাহিনীর ভারী অস্ত্রের সামনে টিকতে না পেরে প্রতিরোধকারীরা এক পর্যায়ে পশ্চাদপসরণ করেন। এ প্রতিরোধ যুদ্ধে একজন প্রতিরোধকারী শহীদ হন, একাধিক পাকসেনা নিহত হয় এবং একজন পাকসেনা আহত অবস্থায় ধরা পড়ে। আহত সেনাকে পরে হত্যা করে কানাহার পুকুরে পুঁতে ফেলা হয়। এ ঘটনার পর হিলিপথে ভারতে যাওয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধারা কালী রাইচ মিলের নিকট নেজাম নামে পাকবাহিনীর একজন মেজরকে হত্যা করেন।
১১ই এপ্রিল সকাল ৯টায় পাকবাহিনী ভারী অস্ত্রসহ দিনাজপুর ও পার্বতীপুরের দিক থেকে এসে ফুলবাড়ী দখল করে। তারা ফুলবাড়ী সদরের জি এম হাইস্কুল এবং সিএন্ডবি ডাকবাংলোতে প্রাথমিকভাবে অবস্থান নেয়। পরবর্তীতে সিও (ডেভলপমেন্ট) অফিস, সিও (রেভিন্যু) অফিস, ফুলবাড়ী থানা, চিন্তামন ডাকবাংলো, আটপুকুরী হাট প্রভৃতি স্থানে স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে।
উপজেলায় পাকবাহিনীর সহযোগী ব্যক্তিদের মধ্যে মুসলীম লীগ নেতা রুম মোমিন, আবুল মোমেন হাজী, মোহাম্মদ হোসেন, নূরুল হুদা চৌধুরী, জামায়াতে ইসলামী নেতা কেনান উদ্দিন সরকার, ডা. মাহাতাব, সাংবাদিক আতাউল্লাহ আনসারি প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। রুম মোমিনকে চেয়ারম্যান করে এদের নেতৃত্বে উপজেলা শান্তি কমিটি- এবং পরে রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। যে-সকল রাজাকার এলাকার ত্রাস হিসেবে কাজ করে তাদের মধ্যে কমান্ডার সগির আলী, ক্যাপ্টেন সানাউল্লা, আতাউল্লাহ, হরমুজ, আ. হাকিম, জুমরাতু, মঠারু, আবুল কাশেম, আবুল কালাম প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এদের মধ্যে ক্যাপ্টেন সানাউল্লা খুবই দুর্ধর্ষ ছিল। জবাইসহ নির্মমভাবে সে নিজহাতে মানুষ হত্যা করত।
শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা সাধারণ মানুষকে হত্যা ও নির্যাতনে পাকবাহিনীকে সহযোগিতা করত। রাজাকারদের সহযোগিতায় হানাদার বাহিনী শহর ও গ্রাম থেকে মুক্তিকামী বাঙালিদের ধরে এনে নির্যাতন করত। মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে কিংবা মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িবাড়ি গিয়ে তাঁদের পরিবারের লোকজনদের ধরে এনে নির্যাতন করত, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিত, নারীদের নির্যাতন ও সম্ভ্রম হানি করত। শান্তি কমিটির প্রাথমিক কাজ ছিল বিভিন্ন স্থান থেকে যুবকদের ধরে এনে রাজাকার বাহিনীতে নাম লেখানো এবং স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের কাজে নামানো। দ্বিতীয় কাজ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া এবং হানাদারদের পথ দেখিয়ে দেয়া। গ্রাম থেকে নারীদের সংগ্রহ করে তারা পাকসেনাদের ক্যাম্পে ক্যাম্পে সরবরাহ করত। রাজাকার মনছের আলী দুজন মুক্তিসেনাকে ধরে এনে পাকসেনাদের হাতে তুলে দেয়। পরে তাঁদের নির্যাতনের পর চামড়া তুলে গাছে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। এ দুজন মুক্তিযোদ্ধা হলেন কমান্ডার গণেশ চন্দ্র রায় এবং মুক্তিযোদ্ধা মংলা কান্ত।
পাকসেনারা গ্রামে-গঞ্জে নির্মম হত্যাকাণ্ড চালায়। তারা নিষাণকুড়ির আইনুদ্দিন খান, রামচন্দ্রপুরের ৪ জন, বাসুদেবপুরের উপেন ও ডলোসহ ৬ জন, চককড়েয়ার আশফাক মণ্ডল ও আহসান মুন্সি নামে দুই সহোদর এবং অন্যত্র মসির উদ্দিন ও শামসুদ্দিন হাজীকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এ-কাজে হাকিম, হরমুজ, ক্যাপ্টেন সানাউল্লা, আতাউল্লাহ প্রমুখ রাজাকার সার্বিক সহযোগিতা করে। শান্তি কমিটির দুর্ধর্ষ নেতা কেনান সরকার পাকসেনাদের সর্বতোভাবে সহযোগিতা করত।
পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা উপজেলায় একটি মর্মান্তিক গণহত্যা চালায়, যা ছয়পুকুরিয়া গণহত্যা- নামে পরিচিত মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে এ ঘটনা ঘটে। এতে পার্শ্ববর্তী আফতাবগঞ্জ উপজেলা থেকে আসা শতাধিক ভারতগামী শরণার্থী স্থানীয় শান্তি কমিটির সদস্য কেনান সরকার, কয়েকজন বিহারি এবং পার্বতীপুরের বাচ্চু খানের লোকদের সহযোগিতায় পাকসেনাদের হাতে নিহত হয়। নিহতদের সকলেই ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের।
রাজাকার আব্দুল হাকিমের নেতৃত্বে গ্রাম-গঞ্জের বিভিন্ন বাড়িতে প্রথমে লুটপাট এবং পরে বাড়িঘর আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়। অওয়ামী লীগ সমর্থক হিসেবে চিহ্নিত দোদুল গ্রামটি পুরো জ্বালিয়ে দেয়া হয়। সৈয়দপুর গ্রামের প্রায় সব বাড়িতে আগুন দেয়া হয়। এছাড়া প্রতিটি গ্রামের অন্তত দু- একটি করে বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়। রাজাকার ও অবাঙালিদের নেতৃত্বে হিন্দুদের বাড়িঘর ও দোকান-পাট লুটের পর তাতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে খ্যাতনামা মারোয়াড়ি ব্যবসায়ী রামলাল বেঙ্গানির বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লুট করা হয়।
যুদ্ধের সময় এ অঞ্চলের অনেক নারীই নির্যাতিত হয়েছেন, কিন্তু লোকলজ্জায় তা কেউ প্রকাশ করছেন না। দাউদপুর গ্রাম, বাসুদেবপুর মৌজা প্রভৃতি স্থানে নারীনির্যাতন ঘটে। যৌননির্যাতনের পাশাপাশি নারীদের অঙ্গ কেটে নেয়ার মতো নৃশংসতাও ঘটেছে।
হানাদারদের প্রতিটি ক্যাম্পই ছিল নির্যাতনকেন্দ্র। সেসব জায়গায় নিরপরাধ মানুষদের ধরে এনে নির্যাতন করা হতো। সারাদিন নির্যাতনের পর রাতের বেলা তাদের কানাহার পুকুরপাড়ে নিয়ে হত্যা করা হতো। কানাহার পুকুর বধ্যভূমি টি এখন কানাহার জাতীয় কবর নামে পরিচিত। এছাড়া বারই নামক স্থানে একটি বধ্যভূমি ও গণকবর আছে। ফুলবাড়ী অঞ্চলে পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকগুলি যুদ্ধের ঘটনা ঘটে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো- ৩০৩নং রেলব্রিজ যুদ্ধ, আটপুকুর হাট যুদ্ধ, সরস্বতীপুর যুদ্ধ, জলেশ্বরী যুদ্ধ- এবং চিন্তামন ডাকবাংলো ক্যাম্প যুদ্ধ। জুলাই মাসের দিকে কমান্ডার মো. মঞ্জুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ফুলবাড়ী থানার পাশে বারকোনা গ্রামসংলগ্ন রেলওয়ের ৩০৩নং ব্রিজটি উড়িয়ে দেন। এর ২-৩ দিন পর ১১টি রাইফেলসহ ১৭ জন রাজাকার কমান্ডার মঞ্জুরের নিকট আত্মসমর্পণ করে।
সেপ্টেম্বরের শেষদিকে কমান্ডার মো. মঞ্জুর রহমানের নেতৃত্বে গেরিলা যোদ্ধারা আটপুকুর হাট সংলগ্ন জাংগাল ব্রিজটি ধ্বংস করে পাকসেনাদের আটপুকুর হাট ক্যাম্প আক্রমণ করেন। এসময় উভয় পক্ষে তুমুল গোলাগুলি হয় এবং এক পর্যায়ে পাকসেনারা পালিয়ে যায়। এযুদ্ধে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। পরের দিন পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের আস্তানা সন্দেহে পার্শ্ববর্তী দোদুল গ্রামটি জ্বালিয়ে দেয়।
অক্টোবর মাসে কমান্ডার মোকছেদ আলী কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে সরস্বতীপুরের শরিফুদ্দিন নামে এক ব্যক্তির বাড়িতে আশ্রয় নেন। শরিফুদ্দিন যে পাকবাহিনীর অনুগত তা তিনি বুঝতে পারেননি। বিশ্বাসঘাতক শরিফুদ্দিন মুক্তিযোদ্ধাদের খেতে দিয়ে গোপনে পাকসেনাদের খবর দেয়। পাকসেনারা দ্রুত এসে আহাররত মুক্তিযোদ্ধাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। ফলে উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। এক পর্যায়ে বাইরে থেকে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা এগিয়ে এলে পাকসেনারা পালিয়ে যায়। এ-যুদ্ধে কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়। অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধা মোজাফফর হোসেন ও মুক্তিযোদ্ধাদের একজন সাহায্যকারী (চিরিরবন্দর) শহীদ হন। মুক্তিযোদ্ধা আমজাদ হোসেন (চিরিরবন্দর, দিনাজপুর সরকারি কলেজের ছাত্র, বর্তমানে ঢাকার ল্যাব এইড হাসপাতালের বিশিষ্ট চিকিৎসক) গুলিবিদ্ধ হন, যাকে চিকিৎসার জন্য ভারতে নেয়া হয় এবং খয়রাত আলী নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়েন।
অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি পাকসেনারা জলেশ্বরী ক্যাম্পের সামনে দিয়ে মিরপুর থেকে রশিদপুরের দিকে যাচ্ছিল। এসময় মুক্তিযোদ্ধারা অতর্কিতে তাদের আক্রমণ করেন। ফলে তুমুল গোলাগুলি শুরু হয়, যা সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে। কিন্তু এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হন। এযুদ্ধে ৯ জন পাকসেনা নিহত হয়। নিহতদের নিয়ে পাকসেনারা চিন্তামন ডাকবাংলো ক্যাম্পে চলে যায়।
অক্টোবরের শেষভাগে একদিন সকাল দশটার দিকে ১০০ জন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা দামোর মোড় থেকে পাকসেনাদের চিন্তামন ডাকবাংলো ক্যাম্প আক্রমণ করেন। তুমুল গোলাগুলি শেষে পাকসেনারা ক্যাম্প ছেড়ে ফুলবাড়ী সদরে চলে যায় এবং মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্প দখল করেন। এখানে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। আটপুকুরের কাজিয়াল গ্রামে তাঁকে কবর দেয়া হয়। ৩রা ডিসেম্বর রাতের আঁধারে পাকসেনারা বদরগঞ্জ ও সৈয়দপুর সেনানিবাসের দিকে পালিয়ে গেলে ৪ঠা ডিসেম্বর ফুলবাড়ী উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
ফুলবাড়ী উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মতিয়ার রহমান (পিতা অহির উদ্দিন, ফুলবাড়ী), বছির উদ্দিন (পিতা নইমুদ্দিন, রাজারামপুর), নজরুল ইসলাম (পিতা তছির উদ্দিন, দক্ষিণ ভারম), শফিউর রহমান (পিতা সাইদুর রহমান, জামগ্রাম), আব্দুল লতিফ (পিতা তায়েজ উদ্দিন, রামচন্দ্রপুর), আবুল খায়ের (পিতা আব্দুস সামাদ, চক এনায়েতপুর), জসির উদ্দিন (পিতা অখির উদ্দিন, দক্ষিণ ভারম), রহিম উদ্দিন (পিতা আরফ উদ্দিন, দক্ষিণ ভারম), মোয়াজ্জেম হোসেন (পিতা কফুর উদ্দিন, অম্রবাড়ি), শফি (পিতা কিনাজ উদ্দিন, সিদ্দিসি), গণেশ চন্দ্র রায় (পিতা ললিত মোহন রায়, জিয়াদগ্রাম), মংলা (পিতা অলোক রাম, কাটাবাড়ি), আব্দুস সামাদ (পিতা আব্দুল জলিল মণ্ডল, গোটারিপাড়া), প্রভাষ চন্দ্র রায় (পিতা কালিপদ রায়, খয়েরবাড়ি), সিদ্দিক (দিনাজপুর), ওহাব (ভেরমবাড়ি, কাজিয়াল), কাজী জহির উদ্দিন (পিতা কাসেম কাজী, উত্তর রঘুনাথপুর; পুলিশে চাকরিরত অবস্থায় পাকবাহিনীর হাতে রংপুরে শহীদ) এবং জামাল উদ্দিন (পিতা মহির উদ্দিন, সেনোড়া; পুলিশে চাকরিরত অবস্থায় ঢাকার রাজারবাগে শহীদ)।
মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে সুজাপুর উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। [আব্দুল জলিল আহমেদ]
তথ্যসূত্র: আজহারুল আজাদ জুয়েল, মুক্তিযুদ্ধে বৃহত্তর দিনাজপুরের অবদান, দিনাজপুর সুবচন প্রকাশন, ২০০২ এবং যুদ্ধকালীন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাৎকার

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড