You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা (সিলেট)

ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা (সিলেট) নদী, হাওর ও বিল অধ্যুষিত একটি এলাকা। বিশাল হাকালুকি হাওর এ উপজেলায় অবস্থিত। এর উত্তরে সিলেট সদর, দক্ষিণে রাজনগর ও কুলাউড়া, পূর্বে গোলাপগঞ্জ এবং পশ্চিমে বালাগঞ্জ উপজেলা। ১৯০৭ সালে ফেঞ্চুগঞ্জ থানা গঠিত হয় এবং ১৯৮০ সালে তা উপজেলায় রূপান্তরিত হয়।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে ইয়াহিয়া সরকার ষড়যন্ত্র শুরু করে। এর প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে অসহযোগ আন্দোলন-এর ডাক দেন। সাতই মার্চের ভাষণ এ তিনি মুক্তিযুদ্ধের জন্য দেশবাসীকে প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। ২৫শে মার্চ রাতে পাকবাহিনী সার্চলাইট-এর নামে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্মম গণহত্যা শুরু করলে ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তাঁর আহ্বানে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফেঞ্চুগঞ্জবাসীও এ- যুদ্ধে অংশ নেয়।
অক্টোবর মাসে মুক্তিযোদ্ধা মকবুল আলী, আব্দুস শহীদ, সজ্জাদ আলী, ফিরোজ আলী, কানু পাল, আক্কাস আলী প্রমুখ ভারত থেকে ফেঞ্চুগঞ্জে প্রবেশ করলে মাইজগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন চৌধুরী ওরফে ফিরু মিয়া তাঁদের হাঁটুভাঙ্গা নামক স্থানে তাঁর ফলের বাগানে তাঁদের আশ্রয় দেন এবং ৪-৫ দিন পর নৌকা দিয়ে তাঁদের কুশিয়ারা নদী পার করে দেন।
ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন- আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুল লতিফ, মাইজগাঁও ইউনিয়নের ফরিদপুর গ্রামের সাবেক ইপিআর সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল মছব্বির ওরফে রবাই মিয়া, ইসলামপুর গ্রামের আছকর আলী, আরকান আলী, ডা. রথীন্দ্র কুমার নাথ, ছাত্রনেতা হবিবুল ইসলাম শাহ, ডা. আবুল হোসেন, শ্রমিক নেতা ইসকন্দর আলী, করম উল্লাহ, এম এইচ খান হুরু মিয়া, ডা. দেওয়ান নুরুল ইসলাম চঞ্চল, মুজাহিদ আলী ওরফে জড়া মাস্টার, আলাউদ্দিন পীর, আব্দুল গনি মাস্টার প্রমুখ।
ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা ৪নং সেক্টরের অধীন ছিল। মেজর সি আর দত্ত, বীর উত্তম ছিলেন সেক্টর কমান্ডার। তাঁর বাহিনীর দ্বারা এখানে যুদ্ধ পরিচালিত হয়।
৪ঠা মে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় প্রবেশ করে এবং থানা সদরের কাইয়ার গুদাম নামে পরিচিত পাটের গুদাম (বর্তমানে উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়) ও ফেঞ্চুগঞ্জ পূর্ববাজার ডাকবাংলো (বর্তমানে এসি ল্যান্ডের কার্যালয়)-য় ক্যাম্প স্থাপন করে।
ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় শান্তি কমিটির নেতা ছিল মাইজগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দেলওয়ার হোসেন পিরু মিয়া। রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার ছিল মানিককোনা গ্রামের আসলাম আলী (পিতা আব্দুল মোতালেব)। এছাড়াও রাজাকার বাহিনীতে ছিল সুরুজ আলী (মোগলপুর), মাওলানা শামসুল ইসলাম শেরপুরী, আছমত আলী (পাঠানটিলা), জহির আলী, উস্তার আলী, মাহমুদ আলী, মকদ্দস আলী প্ৰমুখ। এরা কাইয়ার গুদামে বাঙালিদের ধরে এনে নির্যাতন চালাত। মাওলানা শামসুল ইসলাম শেরপুরী ও মকদ্দস আলী অপারেশনে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে পাকসেনাদের হাতে তুলে দিত। ৪ঠা মে পাকসেনারা ফেঞ্চুগঞ্জে প্রবেশ করেই মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও আওয়ামী লীগ নেতা ইসলামপুর গ্রামের আছকর আলীর বাড়িতে হানা দিয়ে তাঁর পুত্র সিলেট মদনমোহন কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র এবং ফেঞ্চুগঞ্জ থানা ছাত্র ইউনিয়ন-এর সভাপতি আসাদুজ্জামান বাচ্চুকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। এ সময় চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন চৌধুরী ওরফে ফিরু মিয়া পাকসেনাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে হত্যাকাণ্ড বন্ধের অনুরোধ করেন। এ মাসেই পাকিস্তানি বাহিনী সিলেট থেকে গিয়ে ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানার প্রথম ফটকে দুজন মালিকে গুলি করে হত্যা করে। এরপর তারা মণিপুর চা কারখানায় ঢুকে দুজন শ্রমিককে গুলি করে হত্যা করে।
থানা সদরের কাইয়ার গুদাম হিসেবে পরিচিত পাটের গুদামে পাকিস্তানি বাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করার পর এখানে স্বাধীনতাকামীদের ধরে এনে নির্যাতন ও হত্যা করা হতো। এখানে যাদের হত্যা করা হয়, তারা হলেন- নজরুল ইসলাম পংকি (ফেঞ্চুগঞ্জ কলেজের অন্যতম ভূমিদাতা ও ক্রীড়া সংগঠক), পানুলাল পাল (পিতা পরেশ চন্দ্র পাল, কর্মধা), নবীর আলী (পিতা আহমদ আলী, পাঠানচক), মানিক মিয়া (পিতা তবারক আলী, খিলপাড়া), সোলেমান চৌধুরী (পিতা জহির আলী চৌধুরী, আশিঘর), মো. ফজলু মিয়া (পিতা হাসিব বাদেদেউলি), আব্দার আলী (মানিককোনা), জোনাব আলী (মাইজগাঁও), নেওয়ার আলী (মাইজগাঁও) প্রমুখ। এদের অনেককেই গভীর রাতে নদীতীরে নিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে অর্ধমৃত অবস্থায় পাশের কুশিয়ারা নদীতে ফেলে দেয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধা মো. আকরাম হোসেনকে ধরার জন্য পাকহানাদাররা তাঁদের বাড়িতে হানা দেয়। তাঁকে না পেয়ে তারা যখন তাঁর পিতা-মাতা ও ভাই-বোনদের ধরে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেয়, তখন চেয়াম্যান দেলোয়ার হোসেন চৌধুরী ওরফে ফিরু মিয়া সংবাদ পেয়ে ছুটে আসেন এবং পাক হানাদারদের কাছ থেকে আকরাম হোসেনের পিতা- মাতা ও ভাই-বোনদের রক্ষা করতে সমর্থ হন।
থানা সদরের পাটের গুদাম ক্যাম্প ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান নির্যাতনকেন্দ্র। দুই কক্ষবিশিষ্ট এ গুদামের প্রথম কক্ষ ছিল আর্মিদের বৈঠকখানা, আর পেছনের বৃহৎ কক্ষটি ছিল টর্চার সেল। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের এখানে ধরে এনে নির্যাতনের পর হত্যা করে লাশ কুশিয়ারা নদীতে ফেলে দেয়া হতো। এছাড়াও পাকিস্তানি সেনারা ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানা ও মণিপুর চা বাগানে টর্চার সেল তৈরি করে নির্যাতন চালায়।
পাকহানাদার ও তাদের দোসরা স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের নির্যাতনের পর ইলাশপুরের ঢালা রেলসেতু এলাকায় হত্যা করে।
১০ই ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী- কুশিয়ারা নদীর ওপর রেলসেতু দিয়ে উত্তর পাড়ের দিকে অগ্রসর হলে পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের লক্ষ করে গুলি চালায়। যৌথবাহিনীও পাল্টা গুলি চালায়। এতে উভয় পক্ষে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। পাক হানাদাররা ভোররাতে সিলেটের উদ্দেশ্যে ফেঞ্চুগঞ্জ ছেড়ে চলে গেলে ১১ই ডিসেম্বর ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা হানদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- সুবেদার মেজর রাসিব আলী, বীর প্রতীক- (পিতা হোসেন আলী, বাদেদেউলি), সুবেদার মকবুল আলী, বীর প্রতীক- (পিতা মন্তাই আলী, মীর ছত্রিশ) এবং নায়েক রশীদ আলী, বীর প্রতীক- (পিতা মুন্সি মনসুর, আলী, মোগলপুর)।
ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন— রশীদ আলী, বীর প্রতীক (১৪ই আগস্ট কুষ্টিয়া জেলার জীবননগর থানার ধূপাখালি সীমান্ত যুদ্ধে শহীদ), নবীর আলী (পিতা আহমদ আলী, পাঠানচক), মো. মানিক (পিতা তবারক আলী, খিলপাড়া), আব্দুল বারী (পিতা রিয়াজ উদ্দিন আহমদ, রাজনপুর), ফয়েজ মিয়া (পিতা মদচ্ছির আলী, তফাদারটিলা), আসাদুজ্জামান বাচ্চু (পিতা আছকর আলী, ইসলামপুর), সুলেমান চৌধুরী (পিতা জহির আলী চৌধুরী, আশিঘর), আবদার আলী (পিতা আসিদ আলী, মানিককোনা), সারজান আলী (পিতা রওশন আলী, ধারন), ফজলু মিয়া (পিতা হাছিব আলী, বাদেদেউলি), পানুলাল পাল (পিতা পরেশ চন্দ্র পাল, কর্মধা) ও আবদুর রব (পিতা মো. রহিম, কচুয়াবহর)।
ফেঞ্চুগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের নামে বেশ কয়েকটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। উপজেলা সদরের কাসিম আলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ইসলামপুর পর্যন্ত সড়কের নাম শহীদ আসাদুজ্জামান সড়ক। দক্ষিণ ফেঞ্চুগঞ্জ বাজার থেকে গোলাঘাট পর্যন্ত সড়কের নাম শহীদ ফয়েজ মিয়া সড়ক। কর্মধা-নিজামপুর সড়কের নাম শহীদ পানু পাল সড়ক। ঘিলাছড়া-বাদেদেউলি সড়কের নাম ফজলু মিয়া সড়ক। উপজেলা ডাকঘর সড়কের নাম সৈয়দ মোজাহিদ আলী সড়ক। রাজনপুরের ‘রাজপথ’ সড়কটির নাম সৈয়দ মকবুল আলী সড়ক। কটলপুর-মাঝপাড়া সড়কের নাম উস্তার আলী সড়ক। এছাড়া দীনপুর রত্নানদীর ওপর নির্মিত সেতুটি মুক্তিযোদ্ধা শায়েস্তা মিয়ার নামে নামকরণ করা হয়েছে। [আজিজুল পারভেজ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!