You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ব্রিটিশ প্রবীণ রাজনীতিবিদ ফেনার ব্রুকওয়ে

ফেনার ব্রুকওয়ে (১৮৮৮-১৯৮৮) ব্রিটিশ প্রবীণ রাজনীতিবিদ, ঔপনিবেশবাদবিরোধী, নিরস্ত্রীকরণ আন্দোলনের নেতা, ইন্ডিপেনডেন্ট লেবার পার্টির চেয়ারম্যান (১৯৩১-১৯৩৩) ও সেক্রেটারি (১৯৩৩-১৯৩৯), Movement for Colonial Freedom (পরবর্তীতে, Liberation)-এর চেয়ারম্যান, ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য (১৯২৯-১৯৩১, ১৯৫০-১৯৬৪) এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একনিষ্ঠ সমর্থক।
১৮৮৮ সালের ১লা নভেম্বর ব্রিটিশ ভারতের কোলকাতায় ফেনার ব্রুকওয়ে-র জন্ম ৷ তাঁর পিতার নাম ডব্লিউ জি ব্রুকওয়ে এবং মাতার নাম ফ্রান্সেস এলিজাবেথ এবে।
লন্ডনে মিশনারি স্কুলে ছাত্র থাকাকালে তাঁর রাজনীতির প্রতি উৎসাহ সৃষ্টি হয়। স্কুলে লেখাপড়া শেষে তিনি কিছুদিন সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত থাকেন। ১৯০৭ সালে তিনি ইন্ডিপেনডেন্ট লেবার পার্টিতে যোগ দেন। তিনি ফেবিয়ান সোসাইটির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন আজীবন যুদ্ধবিরোধী ও শান্তিবাদী। তিনি কয়েকবার গ্রেপ্তার হন ও কারাবরণ করেন। ১৯১৯ সালে শেষবারের মতো কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন। এরপর তিনি লন্ডনে ইন্ডিয়া লীগে যোগদান করেন এবং ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করেন। ১৯৭৯ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মভূষণ খেতাবে ভূষিত করে।
১৯২৯ সালে ব্রুকওয়ে প্রথম লেবার পার্টির প্রার্থী হিসেবে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন খুবই স্পষ্টবাদী। ১৯৩১ সালে তিনি পার্লামেন্টের সদস্যপদ হারান এবং লেবার পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হন। প্রায় ২০ বছর পর তিনি পুনরায় লেবার পার্টিতে ফিরে আসেন এবং ১৯৫০ সালে লেবার পার্টি থেকে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি পার্লামেন্টের সদস্য ছিলেন। এরপর তিনি হাউজ অব লর্ডের সদস্য মনোনীত হন। ১৯৫১ সালে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা War on Want-এর তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। এ সংস্থার মূল লক্ষ্য ছিল পৃথিবী থেকে দারিদ্র্য দূর করা।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় লর্ড ফেনার ব্রুকওয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের বাংলাদেশপন্থী এমপি গ্রুপের আদর্শিক নেতা ছিলেন। শুরু থেকেই তিনি বাংলাদেশের পক্ষে শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করেন। ৪ঠা এপ্রিল লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড টাউন হলে লেবার পার্টির প্রভাবশালী সদস্য জন এনালস-এর সভাপতিত্বে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর গণহত্যার প্রতিবাদে যে সভা অনুষ্ঠিত হয়, তাতে অন্যান্যের মধ্যে লর্ড ফেনার ব্রুকওয়েও বক্তব্য রাখেন। তিনি তাঁর বক্তব্যে বাংলাদেশের ব্যাপারে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ দাবি করেন এবং পাকিস্তানকে কোনোরূপ সামরিক সাহায্য প্রদান না করার জন্য শ্রীলংকার প্রতি আহ্বান জানান। ১৮ই এপ্রিল লন্ডনে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের সমর্থকদের এক সম্মেলনে তিনি বলেন (বঙ্গানুবাদ), ‘পূর্ব বঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণ হিটলার আমলের পর দুনিয়ার সবচেয়ে অনুভূতিহীন ও বর্বরতম আক্রমণ বলে পরিগণিত হবে।’ ঐ সম্মেলনে গৃহীত এক প্রস্তাবে বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দানের দাবি জানানো হয়। মে মাসে লন্ডনে Bangladesh Freedom Movement Overseas একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং লর্ড ব্রুকওয়ে ছিলেন এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক। মে মাসের ৩য় সপ্তাহে বিখ্যাত কংগ্রেস নেতা আসফ আলীর স্ত্রী মিসেস অরুণা আসফ আলী বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনের উদ্দেশ্যে কয়েকটি দেশ ভ্রমণ শেষে লন্ডনে এলে কনওয়ে হলে লর্ড ব্রুকওয়ের সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। অরুণা আসফ আলী তাঁর বক্তৃতায় বাংলাদেশের সংগ্রামকে বাঙালির ‘জাতীয় বিপ্লব’ বলে আখ্যায়িত করেন। ঐ সভায় সভাপতির ভাষণে লর্ড ব্রুকওয়ে বাংলাদেশের ঘটনাকে নজিরবিহীন উল্লেখ করে বলেন (বঙ্গানুবাদ), ‘হিটলার কর্তৃক ইহুদিদের হত্যা করার ফলে তাঁর মনে যে পরিমাণ ঘৃণার উদ্রেক হয়েছিল, ঠিক সে পরিমাণ ঘৃণা তিনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অনুভব করেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশের সরকার এবং ব্রিটিশ সরকার যদি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, তবে পূর্ব বঙ্গের পাকিস্তানি শাসনকে নিন্দা না করে তাদের কোনো উপায় নেই।’ তিনি একই সভায় বঙ্গবন্ধু কোথায় এবং কী অবস্থায় আছেন তা জানতে চেয়ে বলেন, ‘তাঁর খবর জানার অধিকার সবার রয়েছে।’ ১লা আগস্ট পল কনেট-এর নেতৃত্বাধীন Action Bangladesh-এর উদ্যোগে বাংলাদেশে পাকিস্তানি গণহত্যা বন্ধ, সেনাবাহিনী প্রত্যাহার এবং স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের দাবিতে ট্রাফালগার স্কোয়ারে যে বিশাল জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে ভাষণদান কালে লর্ড ফেনার ব্রুকওয়ে বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের আশঙ্কা ব্যক্ত করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলের মাধ্যমে সমস্যার আশু রাজনৈতিক সমাধানকল্পে উদ্যোগ গ্রহণ করতে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হলে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে লন্ডনে এক জনসভায় লর্ড ব্রুকওয়ে যুদ্ধের জন্য পাকিস্তানের সামরিক চক্রের তীব্র নিন্দা করে বলেন যে, একমাত্র সোভিয়েত ইউনিয়ন ছাড়া এজন্য অন্যান্য বৃহৎ শক্তিবর্গ বিশেষভাবে দায়ী, কেননা পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা শুরুর পর ঐসব দেশ ‘নিষ্ক্রিয় থাকার নীতি’ গ্রহণ করে। তিনি এ অভিমতও ব্যক্ত করেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের অধিকার স্বীকার করে সর্বাত্মক যুদ্ধজনিত বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব ছিল।’
বাংলাদেশের একনিষ্ঠ বন্ধু লর্ড ফেনার ব্রুকওয়ে ১৯৮৮ সালের ২৮শে এপ্রিল ৯৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ৪ কন্যা ও ১ পুত্র সন্তানের জনক ছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও স্বাধীনতা অর্জনে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্র: আবদুল মতিন, স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙালী, লন্ডন, র্যাডিকেল এশিয়া পাবলিকেশন্স ১৯৮৯; শেখ আবদুল মান্নান, মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাজ্যের বাঙালীর অবদান, ঢাকা, জ্যোৎস্না পাবলিশার্স, ১৯৯৮; Harun-or-Rashid, “British perspectives, pressures and publicity regarding Bangladesh, 1971″, Contemporary South Asia 1995, Oxford, 4 (2), 139-149; Indian Express, New Delhi, June 2, 1971; https://en.wikipedia.org/wiki/Fenner_Brockway

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!