You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে ফুলতলা উপজেলা (খুলনা)

ফুলতলা উপজেলা (খুলনা) ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ১লা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কর্তৃক স্থগিত হওয়ায় সারা দেশের মতো ফুলতলা উপজেলার সর্বস্তরের মানুষও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এরপর বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ- এবং ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক বাঙালিদের ওপর গণহত্যা চালানোর ঘটনা তাদেরকে স্বাধীনতার যুদ্ধে উজ্জীবিত করে।
উপর্যুক্ত পরিস্থিতিতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ- নেতৃবৃন্দ ও সাধারণ জনগণ মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। ফুলতলা উপজেলার ৪০-৫০ জন ছাত্র-যুবক নড়াইল জেলার কালিয়া থানার অন্তর্গত খররিয়া গ্রামে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে।
ফুলতলা উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন এডভোকেট সালাউদ্দিন ইউসুফ এমএনএ (ধোপাখোলা; মুক্তিযুদ্ধের সময় বরিশাল, পটুয়াখালি, খুলনা ও ফরিদপুর জেলার অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত ৯ নম্বর সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা), কাজী আব্দুস সালাম (পায়গ্রাম কসবা), তবারক হোসেন (তাবু কাজী) (পায়গ্রাম কসবা, থানা কমান্ডার), মোহাম্মাদ আশরাফ হোসেন, কাজী শওকত হোসেন (পায়গ্রাম কসবা) ও মো. খসরুজ্জামান (শিরোমনি)।
২৮শে মার্চ পাকবাহিনী যশোর থেকে ফুলতলা বাজারের নিকটস্থ চৌদ্দমাইল নামক স্থানে পৌঁছলে স্থানীয় জনগণের সহায়তায় মুক্তিবাহিনী তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু সে প্রতিরোধ ভেঙ্গে ঐদিনই তারা উপজেলায় প্রবেশ করে এবং শিরোমনি ক্যান্টনমেন্ট ও উপজেলা সদরে সার্কেল অফিস (সিও) ভবনে ক্যাম্প স্থাপন করে।
তাদের সহযোগিতার জন্য স্বাধীনতাবিরোধীরা শান্তি কমিটি – ও রাজাকার বাহিনী গঠন করে। শান্তি কমিটির প্রধান ছিল মোকসেদ মোড়ল (দামোদর)। তার সঙ্গে ছিল আয়ুব মোল্লা (আলকা), কাজী গোলাম ইজদাইন (পায়গ্রাম কসবা), ইউনুস আলী মোল্লা (যোগনীপাশা) প্রমুখ। রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে মো. হাবিবুল হক জমাদ্দার (দামোদর, জেলা কমান্ডার), আব্দুল ওহাব মহলদার (ঢাকুরিয়া, থানা কমান্ডার), ইউনুস মোড়ল (ঢাকুরিয়া), জাকির মহলদার (ঢাকুরিয়া), দুরুর মোল্লা (বেগুনবাড়ীয়া), আব্দুর রহমান (বেজেরডাঙ্গা), রাহাজান গাজী (গাড়াখোলা), মোস্তফা মিনা (ছাতিয়ানী), শেখ আব্দুল হালিম (পিঁপরাইল), সরোয়ার মোল্লা (দামোদর), তৈয়ব আলী শেখ (জামিয়া), রেজোয়ান মোলা (ধোপাখোলা), কাজী মতিয়ার রহমান (দামোদর), আবুল কাসেম (দামোদর), ইউসুপ গাজী (গাড়াখোলা) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর মূল কাজ ছিল পাকবাহিনীকে সহযোগিতা করা এবং স্বাধীনতার পক্ষের লোকদের নিশ্চিহ্ন করা।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে হানাদার বাহিনী বাদামতলা, নশুখানের ইটের ভাটা, দুমার পাড়, ফুলতলা বাজার, সিও অফিস, তোয়েবাড়ী ঘাট, শ্রীনাথ মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রভৃতি স্থানে হত্যা ও গণহত্যা চালায়। এতে ৯ জন সাধারণ মানুষ শহীদ হন। এছাড়া ফুলতলা গিয়ে হানাদাররা ছরো মোল্লা, হাবিবুর রহমান, সৈয়দ মোল্লা, ওহাব মহলদার প্রমুখের সহযোগিতায় যোগীপোল গ্রামে ১৫ই এপ্রিল ও ২৯শে মে দু’বার গণহত্যা সংঘটিত হয়, যা নসুখান ইটভাটা গণহত্যা- নামে পরিচিত। এতে ২৬ জন সাধারণ মানুষ শহীদ হন। ফুলতলা প্রতিরোধ যুদ্ধের অন্যতম নেতা তাবু গাজী ও খোকন কাজীর বাড়িতে লুট-তরাজ ও অগ্নিসংযোগ করে।
পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা বেজেরডাঙ্গা রেলস্টেশনের পেছনে গহর আলী মোড়লের বাড়ি নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে ব্যাবহার করে। এছাড়া ৩ নং জামিরা ইউনিয়নের ফুলতলা বাজারে মনীন্দ্রনাথ ডাক্তারের বাড়ি এবং সিকির হাটে সরু মিয়ার বাড়িতে নিরীহ লোকজনদের ধরে এনে নির্যাতন করত।
ফুলতলা উপজেলায় দুটি বধ্যভূমি রয়েছে পিঁপরাইল চারাবাড়ি ঘাট বধ্যভূমি- ও -আটরা বধ্যভূমি-। পিঁপরাইল চারাবাড়ি ঘাটে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অনেক লোককে হত্যা করা হয়। যোগীপোল গ্রামে শিরোমনি যুদ্ধে শহীদ ১৫-১৬ জন মুক্তিযোদ্ধার কবর রয়েছে। আটরা শিল্প এলাকায় অবস্থিত শ্রীনাথ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাশে পাকবাহিনী ৯ জনকে গুলি করে হত্যা করে কবর দেয়।
২৮শে মার্চ ফুলতলায় প্রতিরোধযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে-যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, ১৭ই ডিসেম্বর তার পরিসমাপ্তি ঘটে। ফুলতলা থানার শিরোমনিতে নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ১৭ই ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর যুদ্ধ চলে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে যা ব্যাটেল অব শিরোমনি নামে খ্যাত। ১৭ই ডিসেম্বর সকাল পর্যন্ত এ-যুদ্ধ চলে। এক পর্যায়ে পাকবাহিনীর প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়লে তারা আত্মসমর্পণ করে এবং এদিনই ফুলতলা উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন— শেখ হরমুজ আলী (পিতা শেখ একলাছ আলী, খানজাহানপুর), সলেমান সরদার (পিতা ইসমাইল সরদার, বুড়িয়ারডাঙ্গা), আবুল হোসেন মোল্লা (পিতা বাহাদুর মোল্লা, শিরোমনি), শেখ খসরুজ্জামান (পিতা মাহামুদ শেখ, শিরোমনি), শান্তিলতা সাহা (পিতা অবিনাশ চন্দ্র সাহা, দামোদর), ভীম চন্দ্র পাল (পিতা বলরাম পাল, উত্তরডিহি) এবং কাজী মহিউদ্দিন (পিতা কাজী মমিন উদ্দিন, যোগনীপাশা)।
উপজেলার শহীদদের স্মরণে শিরোমনিতে একটি স্মৃতিফলক নির্মিত হয়েছে। [পারভীন সুলতানা]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!