You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে ফুলপুর উপজেলা (ময়মনসিংহ) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে ফুলপুর উপজেলা (ময়মনসিংহ)

ফুলপুর উপজেলা (ময়মনসিংহ) ময়মনসিংহ শহর থেকে ফুলপুর সদরের দূরত্ব ১৯ মাইল। ১৯৭১ সালে ফুলপুর থানায় ২১টি ইউনিয়ন ছিল। ২০১২ সালে ফুলপুর থেকে নতুন তারাকান্দা উপজেলা গঠিত হয়। ভারতের সীমান্তবর্তী হালুয়াঘাট উপজেলার খুব কাছের উপজেলা ফুলপুর। ফুলপুর হয়ে হালুয়াঘাট দিয়ে ভারতে প্রবেশ করা সহজ। সড়ক পথে সোজা হালুয়াঘাট-তারাকান্দা-গোয়াতলা হয়ে ভারতে প্রবেশ করা যায়। সীমান্তের নিকটবর্তী হওয়ায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাছে ফুলপুরের সামরিক গুরুত্ব অনেক বেশি ছিল। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছেও ফুলপুর উপজেলার আলাদা গুরুত্ব ছিল। একদিকে ভারতীয় সীমান্ত, অন্যদিকে মাত্র ১৯ মাইল দূরে ময়মনসিংহ শহরের কারণে পাকবাহিনী ফুলপুরে শক্ত ঘাঁটি গড়ে তোলে।
আওয়ামী লীগ নেতা শামছুল হক এমপিএ-র নেতৃত্বে ফুলপুরে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। সংগ্রাম পরিষদ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে ইচ্ছুকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। ফুলপুর থানায় কর্মরত আলী আকবর দারোগা নামে একজন পুলিশ অফিসার ফুলপুর উচ্চ বিদ্যালয় খেলার মাঠে শামছুল হক এমপিএ এবং এম এ রাজ্জাক চেয়ারম্যানের সহযোগিতায় স্থানীয় যুবকদের ডামি বন্দুক, লাঠি ও দেশীয় অস্ত্রের সাহায্যে প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করেন। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এ প্রশিক্ষণ চলে। ময়মনসিংহ জেলা শহরে পাকবাহিনী অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন থানায় যাতায়াত শুরু করলে প্রশিক্ষণ বন্ধ হয়ে যায়। এখানে প্রায় ৫ শত মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ নেন। এছাড়া পয়ারী গোকুল চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় মাঠেও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ফুলপুরের মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে ভারতের বিভিন্ন শিবির থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
ফুলপুরে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক ছিলেন শামছুল হক এমপিএ। তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ফুলপুরসহ গোটা এলাকায় জনমত গঠনের লক্ষ্যে ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ জেলার বিভিন্ন থানায় জনসভা, মিছিল, সমাবেশসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেন। ছাত্রজীবনে তিনি ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগ এবং পরে ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাওয়া যুবকদের বিভিন্ন শিবিরে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। ভারত থেকে অস্ত্র নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে সেসব বিতরণ করেন।
অপর সংগঠক ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক (পিতা ইসমাইল সরকার, কারাহা)। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ফুলপুর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ফুলপুরে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার লক্ষ্যে তিনি ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেন। স্বাধীনতা-উত্তর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি তাঁকে ১৯৭২ সালের ১১ই ডিসেম্বর হত্যা করে। অন্য সংগঠকদের মধ্যে ছিলেন- আলী আকবর দারোগা (পিতা নুর মোহাম্মদ মোল্লা, বাঘারচর, চরবাঘা), আবুল মুনসুর সরকার (পিতা হাজী মকবুল হোসেন সরকার, গড়পয়ারী), গোলাম মোস্তফা (পিতা হোসেন আলী গান্ধী, ঝিগাতলা), হোসেন আলী (পিতা জামাল উদ্দিন, পয়ারী) প্রমুখ।
আলী আকবর দারোগা ১৯৭১ সালে ফুলপুর থানায় দারোগা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ৭ই মার্চের পর ফুলপুর উচ্চ বিদ্যালয় খেলার মাঠে তিনি রাইফেল, বন্দুক, ডামি বন্দুক ও দেশীয় অস্ত্রের সাহায্যে স্থানীয় যুবকদের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেন। মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত এ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালিয়ে যান। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে ফুলপুর থানা থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। আবুল মুনসুর সরকার ১৯৭১ সালে বিএ ক্লাসে অধ্যয়নরত ছিলেন। ছাত্রনেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর পয়ারী গোকুল চন্দ্ৰ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে স্থানীয় প্রায় ৪০০ যুবককে মার্চের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরির জন্য তিনি বিভিন্ন স্থানে মিছিল ও সভা-সমাবেশের আয়োজন করেন। গোলাম মোস্তফা ১৯৭১ সালে সেনাবাহিনীর ইএমই হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ছুটিতে এসে ফুলপুর পয়ারী গোকুল চন্দ্ৰ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে যুবকদের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেন। ৭ই মার্চের পর প্রায় একমাস প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালিয়ে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। হোসেন আলী চট্টগ্রামে ওয়ারলেস অপারেটর হিসেবে পুলিশে চাকরি করতেন। ছুটিতে ফুলপুর এসে পয়ারী গোকুল চন্দ্র বিদ্যালয় মাঠে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। পরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন এবং শহীদ হন। তাঁর লাশ পাওয়া যায়নি।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ২৯শে এপ্রিল বিশাল বহর নিয়ে বিনা বাধায় ফুলপুর থানা সদরে প্রবেশ করে এবং সারা শহরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। পাকবাহিনী প্রথমেই ফুলপুর থানার দখল নেয়। সিও অফিসকে কেন্দ্র করে সেখানে থানা হেডকোয়ার্টার্স স্থাপন করে। পরে তারা পর্যায়ক্রমে থানার বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করে। ফুলপুর ও হালুয়াঘাট দুই থানার সীমানা বরাবর কংশ নদীর দুই পাড়ে তারা বিশাল ঘাঁটি গড়ে তোলে। কংশ নদীর সরচাপুর গোদারাঘাটে চেকপোস্ট স্থাপন করে। ফুলপুর থানা রোডের আব্দুল কাদির খানের বাসা, জারুয়া হাইস্কুল, ভাইটকান্দি বাজার, মধুপুর বাজার, বালিয়া মাদ্রাসা, তালদিঘি হাইস্কুল, বওলা বাজার ও ছনধরা (কাশিগঞ্জ) বাজারে রাজাকার, টিলাটিয়া মাদ্রাসায় আলবদর ও -আলশামস বাহিনীর এবং তারাকান্দা বাজার, বিসকা রেলস্টেশন ও খিচা হাইস্কুলে পাকবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপিত হয়। এছাড়া তারাকান্দা ও রূপচন্দ্রপুরে পাকিবাহিনী ও রাজাকারদের শক্ত ঘাঁটি ছিল।
ফুলপুর থানা এলাকায় মে মাসের শেষদিকে রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠন করা হয়। রাজাকার বাহিনী গঠন করে ফুলপুর সিও অফিস (বর্তমানে উপজেলা পরিষদ) চত্বরে তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। যে-সমস্ত রাজাকার প্রশিক্ষণে ভালো করত, তাদের পুরস্কার দেয়া হতো। রাজাকারদের মাসিক বেতন বা ভাতা প্রদান করা হতো। রাজাকার বাহিনীতে ভর্তির জন্য ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, মেম্বার, শান্তি কমিটি – ও মুসলিম লীগ-এর নেতারা যুবকদের ফুলপুর সিও অফিসে পাঠাত। ফুলপুরে কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা বেশি হওয়ায় আলবদর, আলশামস, মুজাহিদ ও রাজাকার বাহিনীতে অনেকে যোগ দেয়। সিও অফিস চত্বরে বেশিরভাগ সময়ই তাদের প্রশিক্ষণ চলত। বালিয়া মাদ্রাসা ও তিলাটিয়া মাদ্রাসায় আলবদর, আলশামস ও মুজাহিদদের প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। ফুলপুরের আলবদর ও আলশামসের কেউ-কেউ ময়মনসিংহেও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে।
ফুলপুর থানা এলাকার সর্বত্র রাজাকারদের তৎপরতা ছিল। নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করা এবং মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকদের পরিবারবর্গ, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিভিন্ন প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের সম্পর্কে খবর আদান- প্রদান এবং তাঁদের গতিবিধি পাকসেনাদের জানানো এদের প্রধান কাজ ছিল।
ফুলপুর থানায় স্বাধীনতাবিরোধী দল বা সংগঠন হিসেবে মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামী ও জামায়াতে ইসলামীর তৎপরতা ছিল। এসব দলের নেতা-কর্মীরা এখানে শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামস এবং মুজাহিদ বাহিনী গঠন করে।
ফুলপুর থানায় স্বাধীনতাবিরোধীদের মধ্যে জুলমত আলী খান (ঘোমগাঁও), মাওলানা সৈয়দ ফয়জুর রহমান (ঘোমগাঁও), মাওলানা দৌলত আলী (বালিয়া), আব্দুল জলিল খান (কাজিয়াকান্দা), রজব আলী ফকির (অর্জুনখিলা), বসির আহম্মদ ওরফে বসির উদ্দিন ওরফে বসির মেকার (বালিয়া), মো. আবুল হোসেন ওরফে আবুল চেয়ারম্যান (বাশাটি), হাফিজুর রহমান তৈয়ব (ঘোমগাঁও), হাফেজ মাহমুদ (জামালপুর), এ কে এম রফিকুল হুদা ওরফে মনু মিয়া (গোদারিয়া), এ কে এম শামসুল হুদা ওরফে সুরুজ মিয়া (গোদারিয়া), তৈয়ব আলী (ইমাদপুর), আয়ুব আলী (বাশাটি), মো. জিয়াউল হক বদরু (রবিরমারা), মো. আবুল মোতালেব ওরফে আনসার মোতালেব (কাকনী), মমিন উদ্দিন তালুকদার (নলদিঘি), আবুল হাসেম ওরফে পাষাণ ডাক্তার (রাইতনবাড়ি), হাতেম আলী হাতে (মিচকি), শামসুল হক ওরফে হক চেয়ারম্যান (চরআশাবট), আমজাদ আলী ওরফে আমজাদ চেয়ারম্যান (ইমাদপুর), আফতাব উদ্দিন ফকির (দেওলা), ময়ছর উদ্দিন তালুকদার (পুটিয়া), আনিসুর রহমান ওরফে চাঁন মিয়া (কালিখা; বর্তমানে তারাকান্দা উপজেলা), গিয়াস উদ্দিন (ওয়াই, তারাকান্দা), আফরোজ (আমুয়াকান্দা), মো. আব্দুল মোতালেব (আমুয়াকান্দা), মো. আব্দুল মানিক ওরফে চাউগুড়া (পশ্চিম ইমাদপুর), অধ্যাপক রফিক উদ্দিন (বালিয়া), সৈয়দ বদিউর রহমান ওরফে বনু (বরইকান্দি), আব্দুল হেকিম (পূর্ব বাখাই), আমির হোসেন খান (পূর্ব বাখাই), জৈমত আলী চেয়ারম্যান (চরপাড়া), আব্দুর রশিদ (বাতিকুড়া), জবেদ আলী ফকির (বাখাই), মুক্তার উদ্দিন (বাখাই), আয়ুব আলী (শালজান বালিয়া), মহরম আলী (লাউটিয়া, তারাকান্দা; বর্তমান ঠিকানা ইমাদপুর, উপজেলা ফুলপুর), মো. আবুল কাশেম (কাতুলী), আমিরুল হোসেন আকন্দ চৌধুরী (খিচা, তারাকান্দা), আজিম উদ্দিন (লাউয়ারী), আব্দুল হান্নান (ছনধরা), আব্দুল খালেক (বনগাঁও), মাওলানা মুফতি আব্দুল ওয়াহেদ (তিলাটিয়া), হারেজ আলী (পুলিশ সদস্য, ফুলপুর), হাফিজউদ্দিন আহমেদ ওরফে হাফিজ বিএসসি (গোরিয়া), মো. আব্দুল কুদ্দুস সরকার (কাজিয়াকান্দা), আবু বক্কর সিদ্দিক (ইমাদপুর), হাফিজুল ইসলাম (চরপাড়া) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
এসব মুক্তিযুদ্ধবিরোধী নানা অপকর্ম এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত ছিল। জুলমত আলী খান প্রভাবশালী দালাল ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশে ও বিদেশে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ব্যাপক তৎপরতা চালায়। ১৯৭১ সালে জাতিসংঘে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তথ্য তুলে ধরার জন্য একটি প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেয়। বঙ্গবন্ধুর সরকার তার নাগরিকত্ব বাতিল করে। জিয়াউর রহমানের আমলে নাগরিকত্ব ফিরে পায়।
মাওলানা সৈয়দ ফয়জুর রহমান জেলা শান্তি কমিটির সভাপতি ছিল। তার আদেশমতো ময়মনসিংহ জেলা শান্তি কমিটি পরিচালিত হতো। সে-সময় সশস্ত্র প্রহরীবেষ্টিত খোলা জিপে চলাচল করত। ময়মনসিংহ বড় মসজিদের পেশ ইমাম ছিল। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সকল প্রকার কর্মকাণ্ডে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সর্বাত্মক সহযোগিতা ও চক্রান্তে লিপ্ত ছিল। ময়মনসিংহ জেলায় অসংখ্য হত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল। হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, মুক্তিপণ আদায়সহ এমন কোনো অপকর্ম ছিল না, যা তার নেতৃত্বে শান্তি কমিটি করেনি। স্বাধীনতার পর দালাল আইনে গ্রেফতার হয়েছিল।
মাওলানা দৌলত আলী বালিয়া মাদ্রাসার নাজেম ছিল। জামিয়া আরাবিয়া আশরাফুল উলুম বালিয়া মাদ্রাসা ছিল তার প্রধান কার্যালয়। মাদ্রাসার মাঠে ফুলপুর আলবদরএর প্রধান কার্যালয় ছিল বলে এখানে আলবদর ও রাজাকারদের ট্রেনিং এবং লুটের মালামাল জমা হতো। লুণ্ঠিত মাল পরে রাজাকার, আলবদর ও স্থানীয় দালালদের মধ্যে বণ্টন করা হতো। বালিয়ার আশেপাশে অনেক হিন্দুর বসতি থাকায় নিয়মিত লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, মুক্তিপণ আদায় ও হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হতো। তার ছেলে অধ্যাপক রফিক উদ্দিন আলবদর ছিল। দৌলত আলীর বিরুদ্ধে দালাল আইনে মামলা হয়েছিল। তার মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তৎপরতার কথা এখনো এলাকার মানুষের মুখে-মুখে।
রজব আলী ফকির মুসলিম লীগের নেতা ছিল। ফুলপুর থানা শান্তি কমিটির সভাপতি ও জেলা শান্তি কমিটির সদস্য ছিল। তার প্ররোচনায় ফুলপুর ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় অনেক হত্যাকাণ্ড হয়। সে ফুলপুরের পয়ারী চৌধুরী বাড়িতে গণহত্যা, বাখাই হিন্দু পল্লীতে গণহত্যা, পোস্ট মাস্টার কাজী আব্দুল গণি ও আওয়ামী লীগ নেতা ডাক্তার আবু তাহের হত্যাকাণ্ড, সুতারকান্দি, চকগদাদর, নীলগঞ্জ গণহত্যায় সরাসরি জড়িত ছিল। ফুলপুর থানা শান্তি কমিটির সাধারণ সম্পাদকের বাসায় বিভিন্ন স্থান থেকে আটক করে আনা নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন করত। কোমরে দুটি রিভেলবার ঝুলিয়ে খোলা জিপে চড়ে বেড়াত। সে এলাকায় মূর্তিমান আতংক, খুবই দাম্ভিক ও অত্যাচারী ছিল। স্বাধীনতা-পরবর্তী দালাল আইনে গ্রেফতার হয়ে সে কারাগারে আটক ছিল।
আব্দুল জলিল খান ফুলপুর থানা শান্তি কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিল। তার বাসায় শান্তি কমিটির কার্যালয় ছিল। এখানে নির্যাতনের নীলনকশা প্রণীত হতো। তা পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, রাজাকার, আলবদর, মোজাহিদরা বাস্তবায়ন করত। সে রজব আলী ফকিরের অত্যন্ত কাছের লোক হিসেবে পয়ারী চৌধুরী বাড়ি গণহত্যা, বাখাই হিন্দু পল্লী গণহত্যা, নীলগঞ্জ গণহত্যা, লাউয়ারী-রামসোনা গণহত্যা, পোস্ট মাস্টার কাজী আব্দুল গনি, আওয়ামী লীগ নেতা ডাক্তার আবু তাহের হত্যাকাণ্ডসহ অসংখ্য যুদ্ধাপরাধে জড়িত ছিল। স্বাধীনতার পর দালাল আইনে দায়ের করা মামলায় কারাগারে ছিল।
বসির মেকারের কথা শুনলে মানুষের শরীর শিউরে উঠত। সে কুখ্যাত দালাল, রাজাকার ও নরঘাতক ছিল। রাজাকার কমান্ডার ও বালিয়া মাদ্রাসা রাজাকার ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিল। হত্যায় তার হাতেখড়ি ফুলপুর ডাকবাংলো সংলগ্ন খড়িয়া নদীর পাড়ে অজ্ঞাতনামা একজনকে হত্যা করে। সে কত মানুষকে হত্যা করেছে তার হিসাব নেই। সে উপেন্দ্ৰ চন্দ্র সূত্রধর (ভালকি), বজন মিস্ত্রি, উন্দুইরা মিস্ত্রি, শশাংক শেখর সেন (কোনাপাড়া, ৭ই আগস্ট), ধোবাউড়া থানার গোয়াতলা বাজারে অসংখ্য নিরিহ সাধারণ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে। বালিয়াসহ আশপাশের এলাকা থেকে যারা ভারতে যেত, তাদের কাছ থেকে জনপ্রতি ৫০ টাকা করে পণ রাখত। কেউ টাকা না দিয়ে পালিয়ে গেলে তার আত্মীয়-স্বজনদের ওপর নির্যাতন চালাত, বাড়ি লুট করত, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করত। বালিয়া গ্রামের ছাত্রনেতা এডভোকেট আবুল হাশেমের বাড়ি, গোয়াতলা বাজারসহ অসংখ্য বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে। কুণ্ডল বালিয়ার লালু মাস্টারের বাড়িতে লুণ্ঠন করে সকল মাল বালিয়া মাদ্রাসার মাঠে রাখে। লালু মাস্টার ও তার বাড়ির অন্যদের অমানবিক নির্যাতন করে মুক্তিপণ আদায় করে। তার সকল অপকর্মের সঙ্গী ছিল বড়ইকান্দি ক্যাম্পের রাজাকার কমান্ডার সৈয়দ বদিউর রহমান বনু, মাওলানা এরশাদ উল্লাহ, মাওলানা আবুল কাশেম, অধ্যাপক রফিক উদ্দিন, তার তিন ছেলে হারুন অর রশিদ, গোলাম মর্তুজা, এ টি এম মোস্তফা উমর আলী খাঁ মেম্বার, আব্দুল আজিজ সরকার, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী আইয়ুব আলীসহ আরো অনেক রাজাকার। দেশ স্বাধীন হলে বসির মেকার কারারুদ্ধ এবং যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত হয়। ৭৫-এর পর জিয়াউর রহমানের হস্তক্ষেপে কারাগার থেকে মুক্ত হয়। এখনো তার অত্যাচারের নির্মম কাহিনি লোকমুখে শোনা যায়। আবুল হোসেন ১নং ছনধরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং ইউনিয়ন শান্তি কমিটির সভাপতি ছিল। কাশিগঞ্জ বাজারে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, লাউয়ারী-রামসোনা- তালুকদানা গণহত্যায় সরাসরি জড়িত ছিল। অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, মুক্তিপণ আদায়সহ অসংখ্য যুদ্ধাপরাধে জড়িত ছিল।
হাফিজুর রহমান তৈয়ব জেলা শান্তি কমিটির সভাপতি মাওলানা সৈয়দ ফয়জুর রহমানের ছেলে। সে একজন ভয়ংকর প্রকৃতির আলবদর কমান্ডার ছিল। কাঁধে স্টেনগান ঝুলিয়ে ময়মনসিংহ শহর, পরানগঞ্জ, বোররচর, ফুলপুর, হালুয়াঘাট, ত্রিশাল, ভালুকাসহ সারা জেলা চষে বেড়াত। মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত আলবদর বাহিনীর রূপকার ও প্রধান উদ্যোক্তা মো. আশরাফ হোসেনের ডানহস্ত বলে কুখ্যাত ছিল। ময়মনসিংহ শহরের চামড়া আড়ৎ, পাট গোদাম, বাঘমারা, রেলস্টেশন, ব্রহ্মপুত্র ব্রহ্মপুত্র নদীর গোদারাঘাটসহ জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে অসংখ্য মানুষকে আটক করে শহরের ডাকবাংলোতে নিয়ে যেত। তার হাতে আটক অনেকে আর ফিরে আসেনি। ময়মনসিংহ শহরের এক আতঙ্কের নাম ছিল তৈয়ব। হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, মুক্তিপণ আদায়সহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত ছিল।
হাফেজ মাহমুদ আলবদর কমান্ডার ছিল। আলবদর প্রধান আশরাফ হোসেনের কাছের লোক ছিল। বালিয়া মাদ্রাসার ছাত্র এবং শিক্ষক ছিল। বালিয়া, ফুলপুর, গোয়াতলা, পূর্বধলা, ময়মনসিংহসহ পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে তার ব্যাপক প্রভাব ছিল। বসির মেকারের সঙ্গে যৌথভাবে অভিযান চালিয়ে সে ইছহাক উদ্দিন তালুকদার, লালু মাস্টারের বাড়ির লোকজনসহ অনেক লোকের ওপর শারীরিক নির্যাতন চালায়। কুণ্ডল বালিয়ার মৃত্যুঞ্জয় আদিত্যের বাড়ি লুণ্ঠন করে বাড়ির লোকদের শারীরিক নির্যাতন করে এবং তাদের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করে। লালু মাস্টারের বাড়ি লুণ্ঠনের সময় কুণ্ডল বালিয়ার উসমান মৌলভী, হালিম মুন্সি, উমর আলী খান মেম্বার, বসির মেকারসহ একটি বিশাল বাহিনী গরুর গাড়িতে করে বাড়ির মালামাল বালিয়া মাদ্রাসায় নিয়ে যায়। হাফেজ মাহমুদ শশাংক শেখর সেন, উপেন্দ্র চন্দ্র সূত্রধর, বজন মিস্ত্রীসহ অনেক লোকের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল। বালিয়া যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর গুলিতে নিহত হয়। তার অত্যাচারের কথা বালিয়াবাসী এখনো ভুলতে পারেনি।
এ কে এম রফিকুল হুদা মনু মিয়া দুর্ধর্ষ রাজাকার কমান্ডার ছিল। তার পিতা মেন্দি মিয়া মুসলিম লীগ নেতা ছিল। সে- সূত্রে ফুলপুরে তাদের পরিবারের রাজনৈতিক প্রভাব ছিল। মনু মিয়া পয়ারী চৌধুরী বাড়ি গণহত্যা, বাখাই হিন্দু পল্লীতে গণহত্যা, মোকামিয়া তালুকদার বাড়ি লুণ্ঠন, নারীনির্যাতন, মুক্তিপণ আদায়, নীলগঞ্জ গণহত্যা, সাহাপাড়া হিন্দু পল্লীতে লুণ্ঠন ও নারীধর্ষণে সরাসরি জড়িত ছিল।
এ কে এম শামসুল হুদা সুরুজ মিয়া রাজাকার কমান্ডার ছিল। সুরুজ মিয়া ও মনু মিয়া দুই সহোদর মিলে একটি আলাদা রাজাকার গ্রুপ গঠন করেছিল। তাদের গ্রুপে ছিল বিহারী ঈদ মামুদ, বিহারী আনোয়ার, বিহারী নঈম, বিহারী আব্দুল জব্বার, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বিএসসি, আবু সিদ্দিক (সাহাপুর), হাফিজুল ইসলাম (হাফিজ চেয়ারম্যান), আবু বক্কর (ইমাদপুর), আবু সিদ্দিক (পূর্ব বাখাই), আবু বক্কর (বাতিকুড়া)-সহ আরো অনেকে। এদের কাজ ছিল হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন, মুক্তিপণ আদায়, পাকসেনাদের নারী সরবরাহ করা ইত্যাদি। এরা পয়ারী চৌধুরী বাড়ি গণহত্যা, বাখাই গণহত্যা, নীলগঞ্জ গণহত্যা, মোকামিয়া তালুকদার বাড়ির সকল নারী ও পুরুষকে ফুলপুর ডাকবাংলোয় আটক করে নির্যাতন ও মুক্তিপণ আদায়, সাহাপাড়ায় হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, সাহাপুর হিন্দু পল্লীতে লুণ্ঠন, নারীধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধে সরাসরি জড়িত ছিল। এদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার পর দালাল আইনে মামলা হয়েছিল।
রাজাকার তৈয়ব আলী পয়ারী চৌধুরী বাড়ী গণহত্যা, নীলগঞ্জ গণহত্যা, কারাহা মোদকবাড়ি লুণ্ঠনসহ বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধে জড়িত ছিল।
আয়ুব আলী খুবই অত্যাচারী এবং দুর্ধর্ষ রাজাকার ছিল। সে রূপসী, বালিয়া, বওলা, ফুলপুর, ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে পাকবাহিনীর সঙ্গে অপারেশনে যেত। বাড়ি ও রাস্তা থেকে নারীদের তুলে ফুলপুর পাকসেনাদের ক্যাম্পে সরবরাহ করত। বসির মেকারের সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। জামিনী পাল, স্বপন পাল, শশাংক শেখর সেনসহ অনেকের হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল। ৯ই ডিসেম্বর ফুলপুর মুক্ত হলে সে ঢাকা চলে যায়। সেখানেও বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধে জড়িয়ে পড়ে। অধ্যাপক ড. এ কে আজাদকে ১৫ই ডিসেম্বর আজিমপুরের দায়রা শরীফের বাসা থেকে অপহরণ করে হত্যা করে আলবদররা। আয়ুব আলী এ অপহরণে জড়িত ছিল। ড. এ কে আজাদকে হত্যার অভিযোগে ১৯৭২ সালের ৫ই অক্টোবর ঢাকার বিশেষ জজ সৈয়দ সিরাজ উদ্দিন হোসেন রাজাকার আয়ুব আলী, আলবদর মকবুল হোসেন, আলবদর যুবায়ের হোসেন নামে ৩ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন। জিয়াউর রহমানের আমলে আয়ুব আলী কারাগার থেকে মুক্তি পায়। এভাবে মুক্ত না হলে চিকন আলীর পর আয়ুব আলী হতো দালাল আইনে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া দ্বিতীয় ব্যক্তি।
মো. জিয়াউল হক বদরু মুসলিম লীগ নেতার ছেলে হিসেবে নীলগঞ্জ গণহত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগে সরাসরি জড়িত ছিল। যেদিন নীলগঞ্জ গণহত্যা সংঘটিত হয়, সেদিন মুক্তিযোদ্ধারা বদরুর বাড়ি জ্বালিয়ে দেন। গণহত্যা কবলিত এলাকায় জিয়াউল হক বদরু জনতার ভয়ে চলাচল করেনি। বদরু একজন উচ্চশিক্ষিত দালাল ছিল।
মো. আবুল মোতালেব ওরফে আনসার মোতালেব নির্মম প্রকৃতির রাজাকার কমান্ডার ছিল। পোস্টমাস্টার কাজী আব্দুল গণি হত্যা, আওয়ামী লীগ নেতা ডাক্তার আবু তাহের হত্যা, দাদরা কামার বাড়ি গণহত্যা ও ধর্ষণ, বাখাই গণহত্যা, নীলগঞ্জ গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠণসহ বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধে জড়িত ছিল।
মমিন উদ্দিন তালুকদার তারাকান্দা অঞ্চলে প্রভাবশালী দালাল ও শান্তি কমিটির সদস্য ছিল। তালদিঘি উচ্চ বিদ্যালয়ে স্থাপিত রাজাকার ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রক ছিল। দাদরা কামারবাড়ি গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, গোয়াতলার খোশ মাহমুদ, নলদিঘির অমির শেখ, রূপচন্দ্রপুর হত্যাকাণ্ড, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণসহ বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধে জড়িত ছিল।
আবুল হাসেম ওরফে পাষাণ ডাক্তার রাজাকার কমান্ডার ছিল। সে ঢাকিরকান্দার পাক্কি বাড়ির আব্দুল কদ্দুস হত্যা ও অগ্নিসংযোগ, দাদরা কামারবাড়ি গণহত্যা, রূপচন্দ্রপুর হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠনসহ বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধে জড়িত ছিল।
হাতেম আলী হাতে জারুয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্যাম্পের খুবই অত্যাচারী রাজাকার কমান্ডার ছিল। তার সকল কুকর্মের সহযোগী ছিল আব্দুর রশিদ নামে আরেক রাজাকার। নীলগঞ্জ গণহত্যা, পয়ারী চৌধুরী বাড়ি গণহত্যা, দ্বারাকপুর বাজারে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণসহ বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধে জড়িত ছিল। মুক্তিবাহিনী ও জনতার হাতে নিহত হয়।
শামসুল হক ওরফে হক চেয়ারম্যান রামভদ্রপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন শান্তি কমিটির সভাপতি ছিল। হক চেয়ারম্যান ও নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে দ্বারাকপুর (রামনাথপুর) বাজারে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ, আহাম্মদ আলীকে শারীরিক নির্যাতন করে হত্যা, নীলগঞ্জ গণহত্যা, পয়ারী চৌধুরী বাড়ি গণহত্যা, দ্বারাকপুর নাপিত বাড়ি লুণ্ঠন ও জোড় করে দখল করা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, মুক্তিপণ আদায়সহ বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধ করে।
আমজাদ আলী ওরফে আমজাদ চেয়ারম্যান পয়ারী ইউনিয়ন শান্তি কমিটির সভাপতি ও থানা শান্তি কমিটির সদস্য ছিল। সে খুবই অত্যাচারী ছিল। এলাকার যুবকদের রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করত। পয়ারী চৌধুরী বাড়ি গণহত্যা, নীলগঞ্জ গণহত্যা, বাখাই গণহত্যা ও বিভিন্ন স্থানে অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠনসহ বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধে জড়িত ছিল। মুক্তিযোদ্ধা ও জনতার হাতে ধৃত ও কারারুদ্ধ হয়। আফতাব উদ্দিন ফকির ভাইটকান্দি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন শান্তি কমিটির সভাপতি ছিল। নীলগঞ্জ হত্যাকাণ্ড, পয়ারী চৌধুরীবাড়ী হত্যাকাণ্ড, দ্বারাকপুর বাজারে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধে জড়িত ছিল। ময়ছর উদ্দিন তালুকদার থানা শান্তি কমিটির সদস্য ছিল। এলাকার যুবকদের জোর করে রাজাকার বাহিনীতে যোগদান করাত। পয়ারী চৌধুরীবাড়ি গণহত্যা, নীলগঞ্জ গণহত্যা, বাখাই গণহত্যা ও বিভিন্ন স্থানে অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠনসহ বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধে জড়িত ছিল।
আনিসুর রহমান ওরফে চাঁন মিয়া ইসলামী ছাত্র সংঘ-এর নেতা এবং আলবদর কমান্ডার ছিল। স্বাধীন দেশে জামায়াতে ইসলামীর হয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল। তার নেতৃত্বে কালিখাঁ গ্রামের শাহেদ আলী মণ্ডল, আব্দুল হেকিম মণ্ডল, সুরুজ আলী, তারা মিয়া, আব্দুল মালেক এদের সমন্বয়ে একটি রাজাকার বাহিনী ছিল। কালিখাঁ গ্রামের মহেষ চন্দ্র সূত্রধরের বাড়ি লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করা, শংকর শীলকে হত্যা, রাজধারীকেল গ্রামের স্কুল শিক্ষক ওয়াফেজ উদ্দিন মাস্টারকে হত্যা ও নারীধর্ষণ, মুক্তিপণ আদায়সহ বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধে জড়িত ছিল।
গিয়াস উদ্দিন খুবই অত্যাচারী রাজাকার ছিল। গিয়াস উদ্দিন ও রাজধারীকেল গ্রামের আব্দুল গফুর মুন্সি একদল রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনাসহ ১১ই আগস্ট স্কুল শিক্ষক ওয়ায়েজ উদ্দিনকে আটক করে গাছে ঝুলিয়ে নির্যাতন করে ও ধরে নিয়ে যায়। পরে ওয়ায়েজ উদ্দিনের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
আফরোজ নিষ্ঠুর প্রকৃতির রাজাকার ছিল। আমুয়াকান্দা ও ছনকান্দা বাজারের বিভিন্ন দোকান থেকে মালামাল নিয়ে কোনো মূল্য দিত না। মূল্য চাইলে মারধর করত। মানুষের বাড়ি থেকে গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি জোর করে নিয়ে যেত। তার ভয়ে মানুষ সবসময় আতঙ্কিত থাকত। পয়ারী চৌধুরী বাড়ি গণহত্যা, নীলগঞ্জ গণহত্যা, বাখাই গণহত্যা এবং বিভিন্ন জায়গায় অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠনসহ যুদ্ধাপরাধে জড়িত ছিল। ফুলপুর মুক্ত হলে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে দিউ বালিয়া মোড়ে সে নিহত হয়।
মো. আব্দুল মোতালেব অত্যাচারী রাজাকার ছিল। সে রাজাকার আফরোজের চাচাত ভাই। পয়ারী চৌধুরী বাড়ি গণহত্যা, নীলগঞ্জ গণহত্যা, বাখাই গণহত্যা এবং হালুয়াঘাটে আওয়ামী লীগ নেতা মো. কুদরত উল্লাহ মণ্ডল এমপিএ-র বাড়িতে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগসহ ফুলপুর হালুয়াঘাটে অসংখ্য যুদ্ধাপরাধে জড়িত ছিল।
মো. আব্দুল মানিক ওরফে চাউগুড়া ভয়ংকর প্রকৃতির রাজাকার ছিল। আফরোজ, মোতালেব, আব্দুল কুদ্দুসসহ ১০/১৫ জনের একটি রাজাকার গ্রুপের সদস্য ছিল। এরা আমুয়াকান্দা বাজারে দোকানদারদের কাছ থেকে জোর করে মালামাল নিয়ে যেত। কেউ মূল্য চাইলে চাবুক বা বেত দিয়ে প্রহার করত। মানুষের ধান, চাল, হাঁস, মুরগি নিয়ে যেত। ভয়ে কেউ কোনো কথা বলত না। বললে শারীরিক নির্যাতনসহ হত্যার হুমকি দিত। মানিক পয়ারী চৌধুরীবাড়ি গণহত্যা, নীলগঞ্জ গণহত্যা, বাখাই গণহত্যাসহ বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধে জড়িত ছিল।
অধ্যাপক রফিক উদ্দিন আলবদর ছিল। বালিয়া, ভালকি, কোনাপাড়া হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধে জড়িত ছিল।
সৈয়দ বদিউর রহমান ওরফে বনু রাজাকার কমান্ডার এবং বরইকান্দি রাজাকার ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিল। বজন মিস্ত্রী, উপেন্দ্র চন্দ্র সূত্রধর, শশাংক শেখর সেন, যামিনী সেন, স্বপন সেনসহ অনেকের হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত ছিল। লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত ছিল।
আব্দুল হেকিম রাজাকার পূর্ব বাখাই গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল। হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন, ধর্ষণসহ বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধে জড়িত ছিল।
রাজাকার মহর উদ্দিন পূর্ব বাখাই গণহত্যার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিল। হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন, ধর্ষণসহ বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধে সে জড়িত ছিল।
রাজাকার আমির হোসেন খান পূর্ব বাখাই গণহত্যার সঙ্গে যুক্ত ছিল। সে হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন, ধর্ষণসহ বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধ করে।
জৈমত আলী চেয়ারম্যান ফুলপুর ইউনিয়নের চেয়াম্যান এবং ইউনিয়ন শান্তি কমিটির সভাপতি ছিল। সে প্রভাবশালী দালাল ছিল। পূর্ব বাখাই গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল। সে অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন, ধর্ষণসহ বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল।
রাজাকার আব্দুর রশিদ পূর্ব বাখাই গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল। তার বিরুদ্ধে হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন, ধর্ষণসহ বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ ছিল।
জবেদ আলী ফকির প্রভাবশালী রাজাকার ছিল। পূর্ব বাখাই গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল। হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন, ধর্ষণসহ বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধে জড়িত ছিল।
মুক্তার উদ্দিন প্রভাবশালী রাজাকার ছিল। পূর্ব বাখাই গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল। হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন, ধর্ষণসহ বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধে জড়িত ছিল।
রাজাকার আয়ুব আলী ঢাকুয়া গ্রামের বিপিন সেন হত্যা, উন্দুরিয়া মিস্ত্রি হত্যা, শালজান বালিয়া গ্রামের মুরারি মোহন দাসের বাড়ি লুণ্ঠন ও তাকে শারীরিক নির্যাতন, মুক্তিপণ আদায়, উত্তরকান্দার দীনেশ চন্দ্র সেনের বাড়িতে লুণ্ঠন ও ধর্ষণ, বীর মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট আবুল হাসেমের বাড়িতে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল।
মহরম আলী ভয়ংকর ও অত্যাচারী রাজাকার ছিল। বাড়ইপুকুরিয়া গ্রামের সন্তোষ ঠাকুর, উত্তরপাড়া গ্রামের গেন্দা ও কোনাপাড়া গ্রামের যামিনী পালকে হত্যা এবং বিভিন্ন স্থানে অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন, ধর্ষণসহ বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল। তার অত্যাচারে মানুষ এতই অতিষ্ঠ ছিল যে, ফুলপুর মুক্ত হলে মহরম আলী পালিয়ে ইমাদপুর গ্রামে শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সে জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
আবুল কাশেম ও তার ভাইয়েরা অত্যাচারী রাজাকার ছিল। কাতুলী, ইমাদপুর, অর্জুনখিলা, শিমুলিয়াসহ আশপাশের গ্রামগুলো থেকে গরু, ছাগল, ধান, পাট, হাঁস, মুরগি, লুট করে নিয়ে আসত। পাকসেনাদের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে গোপন খবর সরবরাহ করা তার অন্যতম প্রধান কাজ ছিল। ফুলপুর মুক্ত হলে সে অনেকদিন পলাতক জীবন যাপন করে।
আমিরুল হোসেন আকন্দ চৌধুরী প্রভাবশালী দালাল ছিল। বিসকা ইউনিয়ন শান্তি কমিটির সদস্য ছিল। হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধে জড়িত ছিল।
আজিম উদ্দিন রাজাকার কমান্ডার এবং খুবই অত্যাচারী ছিল। রামসোনা-লাউয়ারী-তালুকদানা গণহত্যায় সরাসরি জড়িত ছিল। হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিল।
রাজাকার আব্দুল হান্নান খুবই অত্যাচারী ছিল। ছনধরা উচ্চ বিদ্যালয় ক্যাম্পে দপ্তরি হিসেবে কর্মরত ছিল। রামসোনা- লাউয়ারী-তালুকদানা গণহত্যায় সরাসরি যুক্ত ছিল। তার বিরুদ্ধে হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ ছিল।
আব্দুল খালেক খুবই অত্যাচারী রাজাকার ছিল। ফতেপুর (ডোবারপাড়) গ্রামে হাফিজ উদ্দিন বেপারীসহ ৬ জনকে হত্যার সঙ্গে সে সরাসরি জড়িত ছিল। হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিল।
মাওলানা মুফতি আব্দুল ওয়াহেদ প্রভাবশালী দালাল ছিল। ফুলপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে রেডক্রসের অফিস ছিল। এখানে বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজনকে ধরে এনে নির্যাতন এবং মুক্তিযুদ্ধে না যাওয়ার জন্য শপথ করানো হতো। শপথ পরিচালনা করত মাওলানা মুফতি আব্দুল ওয়াহেদ। ফুলপুর ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠনসহ বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল।
হারেজ আলী ফুলপুর থানায় কর্মরত ছিল। পাকসেনা ও রাজাকারদের সঙ্গে বাখাই গণহত্যা, পয়ারী চৌধুরী বাড়ি গণহত্যা, নীলগঞ্জ গণহত্যা, সাহাপাড়া লুণ্ঠন, কারাহা মোদকপাড়া লুণ্ঠন, কারাহা গ্রামের মাওলানা আব্দুল করিমকে শারীরিক নির্যাতন ও হত্যার প্রচেষ্টাসহ অসংখ্য অপরাধের সঙ্গে সে জড়িত ছিল। ফুলপুর মুক্ত হলে হারেজ আলী আত্মগোপন করে।
স্বাধীনতার পর উল্লিখিত আবুল হোসেন, হাফিজুর রহমান তৈয়ব, এ কে এম রফিকুল হুদা ওরফে সুরুজ মিয়া, তৈয়ব আলী, মো. জিয়াউল হক বদরু, মো. মোতালেব ওরফে আনসার মোতালেব, মমিন উদ্দিন তালুকদার, আবুল হাশেম ওরফে পাষাণ ডাক্তার, হাতেম আলী হাতে, শামসুল হক ওরফে হক চেয়ারম্যান, আমজাদ আলী ওরফে আমজাদ চেয়ারম্যান, আফতাব উদ্দিন ফকির, ময়ছর উদ্দিন তালুকদার, আনিছুর রহমান ওরফে চাঁন মিয়া, গিয়াস উদ্দিন, আফরোজ, মো. আবদুল মোতালেব, মো. আবদুল মানিক ওরফে চাউগুডা, অধ্যাপক রফিক উদ্দিন, সৈয়দ বদিউর রহমান ওরফে বনু, আব্দুল হেকিম, মহর উদ্দিন, আমির হোসেন, জৈমত আলী চেয়ারম্যান, আব্দুর রশিদ, জবেদ আলী ফকির, মুক্তার উদ্দিন, আইয়ুব আলী ডাকুয়া, মহরম আলী, আমিরুল হোসেন আকন্দ চৌধুরী, আব্দুল খালেক, মাওলানা মুফতি আবদুল ওয়াহিদ প্রমুখ রাজাকার, শান্তি কমিটির সদস্য বা পাকিস্তানি দালালদের বিরুদ্ধে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ইত্যাদি অপরাধের অভিযোগে দালাল আইনে মামলা হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ফুলপুরের মানুষ চরমভাবে নির্যাতিত ও বিপর্যস্ত হয়। এখানে বর্বোরোচিত গণহত্যা, নারীনিযার্তন, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠনসহ এমন কোনো অত্যাচার নেই, যা সংঘটিত হয়নি। পাকবাহিনী তাদের দোসর রাজাকার, আলশামস, আলবদর, মুজাহিদ ও শান্তি কমিটির সদস্যদের দ্বারা ফুলপুরে নারকীয় তাণ্ডব চালায়। ফুলপুরে সংঘটিত গণহত্যাগুলোর মধ্যে ১৯শে জুলাই, ৩১শে জুলাই ও ১২ই আগস্টের ২পয়ারী গণহত্যা-, ৪ঠা আগস্টের পূর্ব বাখাই গণহত্যা-, ৪ঠা অক্টোবরের রামসোনা গণহত্যা-, ৪ঠা অক্টোবরের রামসোনা-লাউয়ারী-তালুকদানা গণহত্যা, ৪ঠা অক্টোবরের লাউয়ারী গণহত্যা-, ২রা ডিসেম্বরের সুতারকান্দি-নীলগঞ্জঘাট গণহত্যা – ও ৭ই ডিসেম্বরের -ফতেপুর গণহত্যা উল্লেখযোগ্য।
এছাড়া ২৯শে এপ্রিল পাকসেনা ও রাজাকারদের হাতে কাজিয়াকান্দা সাহাপাড়ার ব্রজেন্দ্র পাগল, নগেন্দ্র সূত্রধর, ১৯শে জুলাই বওলা গ্রামের এডভোকেট যতীন্দ্র চন্দ্র রায়, সেপ্টেম্বরে শান্তিপদ রায় (শ্যামপুর, কুমিল্লা), প্রিয় সাধন সরকার (পয়ারী), রামচন্দ্র দে (শ্যামপুর, কুমিল্লা), উপেন্দ্ৰ চন্দ্র দে (পয়ারী), ৭ই আগস্ট বিপিন চন্দ্ৰ (ভালকী), উপেন্দ্ৰ চন্দ্র সূত্রধর (বড় ভালকী) ও শশাংক শেখর সেন (কোনাপাড়া), ৯ই আগস্ট হরমুজ আলী (রূপচন্দ্রপুর), মহরম আলী (রূপচন্দ্রপুর), আব্দুল গফুর (রূপচন্দ্রপুর), অক্টোবর সিরাজ আলী (ছনধরা), ২১শে নভেম্বর কাজী উসমান গণি (বওলা), আলোকদী গ্রামের ডাক্তার আবু তাহের, সেপ্টেম্বরে হরেন্দ্র চন্দ্র সরকার (পয়ারী), কালিশ চন্দ্র বণিক (পয়ারী), হোসেন আলী (পয়ারী), নভেম্বরে গেদু মিয়া (মধ্যনগর) ও শিরিনা খাতুন (মধ্যনগর), ৪ঠা ডিসেম্বর আব্দুল লতিফ (সুতারকান্দি), সাদক আলী (সুতারকান্দি), রাহে (চর রাঘবপুর), আব্দুল কুদ্দুস (ঢাকিরকান্দা), খোশ মাহমুদ (গোয়াতলা), অমির শেখ (নলদিঘি) প্রমুখ প্রাণ হারান। রাজধারীকেল গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা আফতাব উদ্দিন মণ্ডল ওরফে কালা চেয়ারম্যানের ভাই স্কুল শিক্ষক ওয়াফেজ উদ্দিন মাস্টারকে হত্যা করা হয়। এছাড়া ফুলপুরে আরো অনেকে বিভিন্ন সময়ে হত্যার শিকার হন।
ফুলপুর থানার অসংখ্য স্থানে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে। কাশিপুর গ্রামের আব্দুল খালেকের বাড়ি, ঢাকিরকান্দা গ্রামে দত্ত বাড়ি, রাইতন বাড়ি গ্রামের শীলবাড়ি, বালিয়া গ্রামে এডভোকেট আবুল হাসেমের বাড়ি, কারাহা গ্রামের মোদকপাড়া, সুতারকান্দি গ্রাম, কালিখাঁ গ্রামের মহেশ চন্দ্র সূত্রধরের বাড়ি, রাজধারীকেল গ্রামে আওয়ামী লীগ নেতা আফতাব উদ্দিন মণ্ডল ওরফে কালা চেয়ারম্যানের বাড়ি, দ্বারাকপুর বাজার, কুণ্ডল বালিয়া গ্রামের লালু মাস্টারের বাড়ি, পয়ারীর চৌধুরী বাড়ি, দাদরা কামার বাড়ি, কাজিয়াকান্দা সাহাপাড়া, বাখাই গ্রামের হিন্দু পল্লী, মোকামিয়া গ্রামের তালুকদার বাড়ি এবং রামসোনা গ্রামের মণ্ডল বাড়িতে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করা হয়৷
পাকহানাদার, রাজাকার, আলবদর ও আলশামসরা ফুলপুর থানার বিভিন্ন জায়গায় নারীনির্যাতন চালায়। ফতেপুর গ্রামের ময়মনা খাতুন ও সাহেরা খাতুনের ওপর পাকসেনা ও রাজাকার কমান্ডার সুরুজ ও তার দলের লোকেরা পাশবিক নির্যাতন চালায়। বাখাই গ্রামের সুরবালা সিং, পূর্ব বাখাই গ্রামের আছিয়া, রাবিয়াসহ বেশ কয়েকজন নারী পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা নির্যাতিত হন। মোকামিয়া তালুকদার বাড়ির একজন নারীসহ বেশ কয়েকজনকে ফুলপুর ডাকবাংলোয় ৩- ৪দিন আটক করে পাকসেনারা নির্যাতন করে এবং পরে মুক্তিপণের বিনিময়ে তারা ছাড়া পান। রামসোনা ও তালুকদানা গ্রামে নারীধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এসব স্থানে মেজর ওমর নিয়মিত যাতায়াত করত। বাহাদুরপুর গ্রামের লালু ঘোষের বাড়িতে বেশ কয়েকজন নারীকে নির্যাতন করে পাকসেনারা। নাকাগাঁও-র হালিমা খাতুনসহ বেশ কয়েকজন নারী, ছনধরা ইউনিয়নের গফুরের মা-সহ কয়েকজন, লালু ঘোষের এক মেয়ে বিজলী রানী ঘোষ, ইমাদপুরের রেজিয়া খাতুন, রাবিয়া খাতুন, রইমনসহ বেশ কয়েকজন নারী পাকিস্তানি সেনাদের পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন। খোসকান্দায় ৮ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদাররা জহুরা নামে একজন নারীকে নির্যাতন করলে এলাকাবাসী বল্লম দিয়ে আঘাত করে এক পাকসেনাকে হত্যা করে। পরে পাকবাহিনী তার লাশ নিয়ে যায়। পাকসেনা এবং রাজাকারআলবদর আলশামস-মুজাহিদদের ক্যাম্প এবং শান্তি কমিটির অফিসে নারীনির্যাতনের অসংখ্য ঘটনা ঘটে।
পাকিস্তানি বাহিনী ফুলপুর থানা এলাকায় বেশ কয়েকটি নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির স্থাপন করে। সেগুলোর মধ্যে সরচাপুর গোদারাঘাট রাজাকার ক্যাম্প, ফুলপুর থানা সিও অফিসের ছাদ, আব্দুল জলিল খানের বাসা, মধুপুর রাজাকার ক্যাম্প, বিসকা রেলস্টেশন পাকসেনা ক্যাম্প, রূপচন্দ্রপুর পাকসেনা ক্যাম্প, খিচা হাইস্কুল পাকসেনা ক্যাম্প, বরইকান্দি রাজাকার ক্যাম্প উল্লেখযোগ্য।
ফুলপুর উপজেলায় বেশ কয়েকটি বধ্যভূমি ও গণকবর রয়েছে। উল্লেখযোগ্য বধ্যভূমিগুলো হলো- সরচাপুর গোদারাঘাট বধ্যভূমি-, বড়ইকান্দি বধ্যভূমি – হাফিজ উদ্দিনের বাড়ি বধ্যভূমি, কাজিয়াকান্দা বধ্যভূমি ইত্যাদি। উপজেলার উল্লেখযোগ্য গণকবর হলো- পয়ারী চৌধুরী বাড়ি গণকবর, ফতেপুর গণকবর- ও মধ্যনগর গণকবর।
ফুলপুরে পাকবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বেশ কয়েকটি সম্মুখ যুদ্ধ হয়। ফুলপুর থানার প্রথম যুদ্ধ ছিল বালিয়া যুদ্ধ। বালিয়া মাদ্রাসায় স্থাপিত রাজাকারআলবদর ক্যাম্পের দখল নেয়া ও অত্যাচারী রাজাকার কমান্ডার বসির মেকারকে আটক করার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের ১০৫ জনের একটি দল এ-যুদ্ধে অংশ নেয়। ২৬শে সেপ্টেম্বর বওলায় অবস্থান নিয়ে বালিয়া রাজাকার ক্যাম্পের ওপর রেকি করা হয়। ২৭শে সেপ্টেম্বর রাত ১টার দিকে (২৮শে সেপ্টেম্বর) বালিয়া ক্যাম্প আক্রমণের জন্য অগ্রসর হয়ে ক্যাম্প থেকে আধা কিলোমিটার দূরে তালুকদার বাড়ির কাছে পৌঁছলে ৪-৫ জন রাজাকার চাঁদের আলোয় মুক্তিযোদ্ধাদের দেখে ফেলে। মুক্তিযোদ্ধাদের দেখে রাজাকাররা দৌড়ে পালাতে থাকলে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবুল হাসেম এসএমজি দিয়ে ব্রাশ ফায়ার করেন। গুলির শব্দ শুনে বালিয়া বাজার ক্যাম্প থেকে অন্য রাজাকাররা গুলিবর্ষণ শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা আক্রমণ করেন। ১০ মিনিট গোলাগুলির পর রাজাকারদের গুলি থেমে যায়। তারা বিভিন্ন বাড়িতে আত্মগোপন করে। রাজাকারদের আশ্রয় নেয়া একটি বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা হামলা চালালে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে গুলি ছোড়ে। তবে গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। মুক্তিযোদ্ধারা পজিশন নিয়ে পাল্টা গুলি করেন এবং ৩ জন রাজাকার ঘটনাস্থলে নিহত হয়। ৩টি ৩০৩ রাইফেল মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। অপারেশনের পর মুক্তিযোদ্ধারা ঢালু ক্যাম্পে ফিরে যান। বালিয়া অপারেশনের সফলতা এ এলাকার রাজাকার ও পাকবাহিনীর মনোবলে মারাত্মক আঘাত হানে।
ফুলপুর উপজেলার ছনধরা ইউনিয়নের অন্তর্গত লাউয়ারী, রামসোনা ও তালুকদানা গ্রামে ৪ঠা অক্টোবর পাকবাহিনী ও রাজাকারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। পাকবাহিনী ও রাজাকারদের প্রতারণার কারণে লাউয়ারী-রামসোনা-তালুকদানা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এখানে ২৪ জন মুক্তিযোদ্ধা এবং ৪-৫ শত সাধারণ মানুষ শহীদ হন। অপরদিকে দুই থেকে আড়াইশত পাকসেনা ও রাজাকার নিহত হয়।
বিসকা ইউনিয়নের অন্তর্গত ময়মনসিংহ-নেত্রকোনা সড়ক সংলগ্ন খিচা উচ্চ বিদ্যালয়ে একটি রাজাকার ক্যাম্প ছিল।
সামরিক দিক দিয়ে এ ক্যাম্পটির বেশ গুরুত্ব ছিল। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে রাজাকার ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে এ ক্যাম্পের দখল নিয়ে যুদ্ধ হয়। এক দিন ও এক রাত ধরে চলা এ-যুদ্ধে অনেক রাজাকার হতাহত হয় এবং তাদের পরাজয় ঘটে।
ভাইটকান্দি ইউনিয়নের জারুয়া গ্রামে অবস্থিত জারুয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে রাজাকারদের একটি ক্যাম্প ছিল। প্রত্যন্ত অঞ্চল হলেও এর অনেক গুরুত্ব ছিল। এ ক্যাম্প দখল করার জন্য ৪ঠা ডিসেম্বর সকাল ১১টার দিকে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের ওপর মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করেন। শত্রুপক্ষ পাল্টা আক্রমণ করলে দুপক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে বেশ কয়েকজন রাজাকার ও পাকসেনা হতাহত হয়।
৬-৮ই ডিসেম্বর বাখাই-মধ্যনগর যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে পাকবাহিনীর প্রায় ২ শত সৈন্য নিহত হয়। যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর ২৫ জন সদস্য এবং বেশ কয়েকজন গ্রামবাসী শহীদ হন। যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত পাকবাহিনীর পরাজয় ঘটে এবং তারা ময়মনসিংহের দিকে পালিয়ে যায়। এর ফলে ফুলপুর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
৮ই ডিসেম্বর ফুলপুর থেকে পাকবাহিনী পালানোর সময় গোয়াতলার দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধারা তালদিঘি উচ্চ বিদ্যালয় রাজাকার ক্যাম্প লক্ষ করে গোলাবর্ষণ করেন। পাকবাহিনী ও রাজাকাররা পাল্টা গুলিবর্ষণ করে এর জবাব দেয়। ফলে উভয় পক্ষের মধ্যে ঘণ্টাব্যাপী যুদ্ধ হয়। যুদ্ধের পরিণতিতে পাকসেনা ও রাজাকাররা পিছু হটে ময়মনসিংহের দিকে পালিয়ে যায়।
ময়মনসিংহ-হালুয়াঘাট মহাসড়কের পাশে রূপচন্দ্রপুরে পাকিস্তানি হানাদারদের ক্যাম্প ও মধুপুরে রাজাকারদের ক্যাম্প ছিল। ময়মনসিংহ জেলা শহর মুক্ত হবার দুদিন আগে অর্থাৎ ৮ই ডিসেম্বর বিকেলে এ দুই ক্যাম্পের কাছে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকবাহিনীর মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে বেশ কয়েকজন রাজাকার হতাহত হয়। এখানে ৫৭ জন রাজাকার ৫৪টি অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে। পরদিন সকালে পাকবাহিনী ময়মনসিংহের দিকে পালিয়ে যায়। এটি ছিল ফুলপুর অঞ্চলের সর্বশেষ যুদ্ধ। ৯ই ডিসেম্বর ফুলপুর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
ফুলপুরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- হযরত আলী (পিতা বসির উদ্দিন, হোসেনপুর), আজাহার আলী (পিতা তোতাব আলী, রামভদ্রপুর), হোসেন আলী (পিতা জামাল উদ্দিন, পয়ারী), আব্দুর রহিম (পিতা সুলু মাহমুদ, মাইলুরা), গিয়াস উদ্দিন আকন্দ (পিতা মামুদ আলী আকন্দ, উলামাকান্দি) ও লাল মিয়া (পিতা কিতাব আলী, উলামাকান্দা)।
ফুলপুরে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে থানা সদরের শেরপুর রোড মোড়ে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ, সরচাপুর গোদারাঘাটে স্মৃতিসৌধ, নীলগঞ্জের গণহত্যার স্থানে স্মৃতিসৌধ এবং লাউয়ারী-রামসোনা মালিঝি নদীর পাড়ে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। [এ টি এম রবিউল করিম]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড