ফাসিয়াতলা হাট গণহত্যা (কালকিনি, মাদারীপুর)
ফাসিয়াতলা হাট গণহত্যা (কালকিনি, মাদারীপুর) সংঘটিত হয় ১০ই অক্টোবর। এতে বহু লোক নিহত হয়। মাদারীপুর সদর থানার সীমানা হোগলপাতিয়া এবং কালকিনি থানার কালীগঞ্জ মৌজার সংযোগস্থলে পালরদী নদীর পাড়ে অবস্থিত প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী ব্যবসাকেন্দ্র ফাসিয়াতলা হাট। হাটটি এনায়েতনগর ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত। ১৯৭১ সালে এখানে সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বাধীন জাতীয় মুক্তিফ্রন্টের ঘাঁটি ছিল। পাকিস্তানি বাহিনী ১০ই অক্টোবর হাটবারের দিন প্রথমে ব্যবসাকন্দ্রটি পুড়িয়ে দেয়। পরে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করে বহু লোককে হত্যা করে।
পাকিস্তান আমলে ফাসিয়াতলা হাট তামা, কাসা, স্বর্ণ- রৌপ্যের ব্যবসার পাশাপাশি ধান, চাল, পাট ও আখের গুড়ের পাইকারি ব্যবসার জন্য বিখ্যাত ছিল। এসব পণ্যের বেচাকেনা অনেকটাই সম্পন্ন হতো নদীবক্ষে ভাসমান নৌকায়। ঘটনার দিন পাকিস্তানি সেনাবোঝাই একটি লঞ্চ এসে নদীতে ভাসমান নৌকার ক্রেতা-বিক্রেতাদের নির্বিচারে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে। দূরদূরান্ত থেকে আসা পাইকার ও ফড়িয়ারদের অনেকের লাশ নদীর স্রোতে ভেসে যায়। এ হত্যাকাণ্ডে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করে ফাসিয়াতলা হাট সংলগ্ন কালীগঞ্জ, এনায়েতনগর, সন্তাল, আলীনগর, লক্ষ্মীপুর ও পখিরা গ্রামের আলবদর ও রাজাকাররা। তাদের মধ্যে ছিল আলবদর বাহিনীর কালকিনি থানা কমান্ডার মুজিবর রহমান সরদার, আলশামস- কমান্ডার সিব্বির আহম্মেদ খান, রাজাকার কমান্ডার কমরুদ্দিন মোল্লা, নুরুল হক রাঢ়ি, সিরাজুল হক মোল্লা প্রমুখ। এদের সাহায্যে পাকিস্তানি বাহিনীর মেজর পায়েন্দা খানের নেতৃত্বে অতর্কিতে ফাসিয়াতলা হাট আক্রান্ত হয়। প্রথমে রাজাকার ও আলবদর বাহিনী নদীর মোহনায় লঞ্চ থেকে নেমে বন্দরে প্রবেশ করে। বাজারের দোকানি ও ব্যবসায়ীরা কর্মব্যস্ততার কারণে কিছুই বুঝতে পারেননি একইভাবে লঞ্চ থেকে নেমে আসে পাকিস্তানি সেনারা। স্থানীয় রাজাকার মতি হাওলাদার ও মমিন হাওলাদারের সহযোগিতায় কালকিনি থানা থেকে পাকিস্তানি প্যারামিলিশিয়া বাহিনীর একটি দলও গণহত্যায় অংশ নেয়। রাজাকার, আলবদর, মিলিশিয়া ও পাকিস্তানি সেনারা হাট থেকে বের হওয়ার প্রতিটি পথে অবস্থান নিয়ে পুরো বন্দরকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে।
রাজাকাররা গামছায় মুখ ঢেকে হাটে প্রবেশ করে যাতে তাদের কেউ চিনতে পেরে পালিয়ে না যায়। তারা বেছে বেছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের ধরে এক স্থানে জড়ো করে। তারা প্রথমে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা সেকেন্দার সরদারকে হত্যা করে। এক পর্যায়ে রাজাকাররা মুখোশ খুলে প্রকাশ্যে হত্যাকাণ্ড শুরু করে।
পাকিস্তানি বাহিনী ফাসিয়াতলা হাটে নৌকায় অবস্থিত ব্যবসায়ীদের গুলি করে হত্যা করতে থাকে। এলোপাতাড়ি গুলির শব্দে ভীত-সন্ত্রস্ত লোকজন দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। কিন্তু ততক্ষণে পালাবার সব পথ অবরুদ্ধ হয়ে যায় ৷ লোকজন দোকান-ঘর, মহাজনি গুদাম ও আড়তের গদির নিচে আশ্রয় নেয়। অনেক লোক ভয়ে দৌড়াদৌড়ির সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে হাটের অলিতে-গলিতে পড়ে মৃত্যু-যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে। সুধীর নামে এক যুবককে পাকিস্তানি সেনারা বেয়নেট চার্জ করে নির্মমভাবে হত্যা করে। তারা গান পাউডার ছিটিয়ে হাটের দোকানপাটে আগুন ধরিয়ে দেয়। গাঢ় কালো ধোঁয়া আর দাউ-দাউ আগুনের লেলিহান শিখায় আকাশ ছেয়ে যায়। গুলির কান ফাটানো বিকট শব্দ, বারুদের ঝাঁঝালো গন্ধ, ভয়ার্ত মানুষের চিৎকার-আহাজারি, আহতদের গোঙানি, জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডলী সব মিলে ফাসিয়াতলা হাটে সেদিন এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। দোকানের মধ্যে অবরুদ্ধ অববস্থায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে সুনীল কীর্তনীয়াসহ কয়েকজন মারা যান। এদিন কত লোক প্রাণ হারিয়েছিলেন তার সঠিক তথ্য জানা যায়নি। অনেকে দূরদূরান্তের গ্রাম থেকে হাটে এসেছিলেন এবং লাশ নদীতে ভেসে যাওয়ায় প্রকৃত সংখ্যা জানা সম্ভব হয়নি। কেউ-কেউ অনুমান করেন যে, এদিন প্রায় ২০০ নিরীহ মানুষ প্রাণ হারায়।
হত্যাকাণ্ডের পর ঘাতকরা ফাসিয়াতলা হাট সংলগ্ন হিন্দু অধ্যুষিত ঘোষপাড়াসহ এলাকার অসংখ্য বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে। ঘোষপাড়ার ৪-৫ জন মহিলাকে তারা ধর্ষণ করে। লক্ষ-লক্ষ টাকার মালামাল লুট হয়। সারা হাটের যত্রতত্র লাশের স্তূপ ফেলে রেখে এবং ৩৫ জনকে বেঁধে লঞ্চে তুলে নিয়ে সন্ধ্যার আগে হানাদার পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসর রাজাকারআলবদররা মাদারীপুরে ফিরে যায়। সারারাত ধরে দূরদূরান্ত থেকে আসা আত্মীয়-স্বজনরা হাটের বিভিন্ন গলিতে প্রিয়জনদের লাশ খুঁজে বের করেন। স্বজন হারানোদের বুকফাটা আর্তনাদে ভারী হয়ে ওঠে এলাকার পরিবেশ। শহীদ সেকেন্দার সরদারের স্ত্রী আলেকজান স্বামীর মৃত্যুর খবর শুনে জ্ঞান হারিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ফাসিয়াতলা হাট গণহত্যায় নিহতদের মধ্যে যাঁদের পরিচয় জানা গেছে, তারা হলেন- সেকেন্দার সরদার (পিতা লতিফ সরদার, এনায়েতনগর), রাজ্যেশ্বর দাস (পিতা উমাচরণ দাস, এনায়েতনগর), কালীপদ ঘরামি (পিতা নারায়ণ ঘরামি, এনায়েতনগর), মিনতি, সুনীল কীর্তনীয়া (পিতা মণীন্দ্র কীর্তনীয়া, ফাসিয়াতলা), অনিল গাইন (পশ্চিম চর), পরিমল চন্দ্র ঘোষ (ভোজেশ্বর), রণজিৎ সিং (পিতা কার্তিক চন্দ্র সিং, পশ্চিম কালিনগর), নরেন সিং (পিতা দেবনাথ কবিরাজ, পশ্চিম কালিনগর), রমেশ ঢাকী (পিতা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঢাকী, পশ্চিম চর), হরেকৃষ্ণ তুঙ্গি (এনায়েতনগর), সুধীর সাহা (পিতা অক্ষয় কুমার সাহা, কালীগঞ্জ বাজার), ভক্ত কাপুড়িয়া (পিতা ধনাই কাপুড়িয়া, গদারদন্দি), খোকন শীল (পিতা যোগীন্দ্র শীল, এনায়েতনগর), আবুল কালাম (পিতা মোক্তার আলী বেপারী, পশ্চিম চর), মোক্তার সরদার (পিতা আবদুর রব সরদার, এনায়েতনগর), হরিচান গাইন (পিতা ফোরনি গাইন, পশ্চিম চর), ডা. সুশীল (পিতা ডা. মথুরা, পশ্চিম কালিনগর), জয়দেব বিশ্বাস (পিতা কালিপদ বিশ্বাস, উত্তর কানাইপুর) ও মোনা দাস (উত্তর কানাইপুর)। [বেনজীর আহম্মদ টিপু]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড