ফুলগাজী উপজেলা (ফেনী)
ফুলগাজী উপজেলা (ফেনী) মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিল ছাগলনইয়া থানার অন্তর্ভুক্ত। পরবর্তীতে ছাগলনাইয়া ও পরশুরামের কয়েকটি অঞ্চল নিয়ে এ উপজেলা গঠিত হয়। এর দক্ষিণে ফেনী সদর, উত্তরে পরশুরাম, পূর্ব-দক্ষিণে ছাগলনাইয়া উপজেলা, পূর্ব ও পশ্চিমে ভারতের ত্রিপুরা এবং ফেনী-চট্টগ্রামের পুরাতন (সড়ক) ট্রাঙ্ক রোডের উত্তরে সীমান্ত এলাকায় বিলোনীয়া রণাঙ্গন। এ রণাঙ্গনের উত্তরের উপজেলা পরশুরাম। তার উত্তরে বিলোনীয়া শহর, যা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মহকুমা শহর। বিলোনীয়া রণাঙ্গনে প্রথম প্রতিরোধ সংঘটিত হয় ফুলগাজী উপজেলায়।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ- বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা সত্ত্বেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে ষড়যন্ত্র শুরু করে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সংসদ অধিবেশন আহ্বান করে তা স্থগিত ঘোষণা করলে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সারা দেশে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। ফুলগাজী উপজেলার সর্বস্তরের মানুষ এতে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দেয়। এরপর বঙ্গবন্ধু সাতই মার্চের ভাষণ-এ স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘোষণা দিলে ফুলগাজীতে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তৈরি হয়।
ফেনী-২ আসনের খাজা আহমেদ এমএনএ-এর নির্দেশে ফেনী জেলার সর্বত্র সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে ফুলগাজী উপজেলার সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে মুন্সিরহাট, জি এম হাট ও নতুন মুন্সিরহাটে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। ক্যাপ্টেন শহীদুল ইসলাম, বীর প্রতীক (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার), কাজী গোলাম মোহাম্মদ (সেনাসদস্য), হাবিলদার সৈয়দ আমিনুল ইসলাম এবং আনসার কমান্ডার আমিন আহম্মদ ভূঁইয়া স্থানীয় ছাত্র-যুবক ও শ্রমিকদের প্রথমে বাঁশের লাঠি ও ডামি রাইফেল দিয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। পরবর্তীতে খাজা আহমেদ এমএনএ-এর নির্দেশে বিরেশ্বর নাহা (কালুবাবু), আজিজ আহম্মদ ভূঁইয়া, ইউনূছ চৌধুরী, আক্তারুজ্জামান, মোহাম্মদ মুসলিম ভুঁইয়া (বালুয়া), শফিউদ্দিন ভূঁইয়া, জাফর আহম্মদ মজুমদার, এডভোকেট লুৎফুল হক মজুমদার, মোহাম্মদ আলী, তাহের মজুমদার, রুহুল আমিন মজুমদার, হাবিবুর রহমান চৌধুরী, সামসুজ্জামান মজুমদার প্রমুখ নোয়াপুর ও গীতাবাড়ি ইপিআর ক্যাম্পের বাঙালি সৈনিকদের নিকট থেকে রাইফেল, গুলি ও হ্যান্ড-গ্রেনেড নিয়ে প্রশিক্ষণ কেন্দ্ৰসমূহে প্রশিক্ষণ পরিচালনা করেন। ছাত্রনেতা ওয়াজী উল্ল্যাহ ভূঁইয়া, আবদুল মোতালেব ভূঞা, আজিজুল হক, গোলাম মোস্তফা, নুরুন্নবী ভূঞা, ওয়াহিদুজ্জামান, আবদুর রহমান মজুমদার, নুরুল আলম চৌধুরী, আবদুল মোমেন, মোশাররফ হোসেন, তোফায়েল আহম্মদ, মুসলেহ উদ্দিন কচি, কাজী আবদুর রহীম, কাজী ফরিদ আহম্মদ প্রমুখ মিটিং- মিছিল ও সমাবেশের মাধ্যমে কৃষক, শ্রমিক ও ছাত্র-জনতাকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ করেন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রসমূহে প্রেরণ করেন। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত অত্র এলাকা শত্রুমুক্ত ছিল। ঐ সময় অনেক ছাত্র উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে গমন করেন।
এ অঞ্চলের যুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন ২নং সাব-সেক্টরের কমান্ডার ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম। কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন শহীদুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন গাফফার হালদার ও লে. ইমামুজ্জামান। এপ্রিল মাসের শেষের দিকে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকবাহিনী এসে ফেনী দখল করে। ফেনী দখল করার জন্য তাদের জঙ্গি বিমান ও আর্টিলারি ব্যবহার করতে হয়েছিল। এরপর পাকবাহিনী ফেনীতে তাদের সুদৃঢ় অবস্থান তৈরি করে। তারা ফেনী কলেজে অস্থায়ী সদর দপ্তর স্থাপন করে উত্তরে রাণীরহাট, পূর্বে পাঠান নগর ও সর্ব ডানে ছাগলনাইয়ায় ক্যাম্প স্থাপন করে।
পাকবাহিনী টহলের মাধ্যমে বিলোনীয়ার ওপর আধিপত্য বজায় রাখার চেষ্টা চালায় এবং ফেনী ও ছাগলনাইয়া অঞ্চল থেকে মর্টার শেল নিক্ষেপ করে মুক্তিযোদ্ধাদের চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। তাদের মর্টার শেলের আঘাতে ফুলগাজী এলাকায় অনেক লোকজন হতাহত হয় ও ঘরবাড়ি ধংস হয়। মে মাসের প্রথম দিকে তারা বিলোনীয়া রণাঙ্গন দখলের উদ্দেশ্যে উত্তর বিলোনীয়া রণাঙ্গনের দক্ষিণাংশে বন্ধুয়া, পাঠান নগর কাচারী বাজার ও কালীর হাট এলাকায় ক্যাম্প স্থাপন করে উত্তরাঞ্চলে টহল জোরদার করলে অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা এলাকা ছেড়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে যান।
এ উপজেলার তিনদিকে ভারতীয় সীমান্ত থাকায় দক্ষিণ দিকে শক্তিশালী অবস্থান থাকার যথেষ্ট প্রয়োজন ছিল। তাই ২ নং সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তম (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) বিলোনীয়াকে সাব-সেক্টর ঘোষণা করে বৃহত্তর নোয়াখালী ও কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম অংশের সমন্বয়ে গঠিত এলাকার দায়িত্ব ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম, বীর বিক্রমকে (পরবর্তীতে লে. কর্নেল) অর্পণ করেন। দরবারপুর গ্রামের উজীর আলী মুক্তার বাড়িতে অধিনায়ক ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের কমান্ড পোস্ট স্থাপিত হয়। মেজর খালেদ মোশাররফ ২নং সেক্টরের সৈনিকদের নিয়ে চারটি কোম্পানি গঠন করে পশ্চিম সীমান্তে ক্যাপ্টেন শহীদুল ইসলাম, বীর প্রতীককে (পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার) জামমুড়ায় ক্যাম্প করে যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দেন। পূর্ব বশিকপুর-শনিরহাট এলাকায় ক্যাম্প স্থাপন করে লে. ইমামুজ্জমান, বীর বিক্রম-কে (পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার) দায়িত্ব দেন। পেছনের অংশ শক্তিশালী রাখার উদ্দেশ্যে রিয়ার গার্ড হিসেবে ক্যাপ্টেন -গাফ্ফার হালদার, বীর উত্তমকে (পরবর্তীতে লে. কর্নেল) নতুন মুন্সিরহাটে ক্যাম্প স্থাপন করার নির্দেশ দেন।
মুহুরী নদীর পূর্ব সীমান্ত এলাকার দক্ষিণ-পূর্বাংশ ১নং সেক্টরের অধীনে থাকায় ছাগলনাইয়া থানার অন্তর্গত চাঁদগাজীর নিকটবর্তী স্থানে ১নং সেক্টরের সদর দপ্তর স্থাপিত হয়। এ সেক্টরের অধীনস্থ কোম্পানির নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন অলী আহম্মদ, মাঝখানের কোম্পানির নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন মাহফুজুর রহমান এবং পূর্ব সীমান্ত সংলগ্ন কোম্পানির নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান। ১নং সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান। ২নং সেক্টরের অধিনায়ক জাফর ইমাম তাঁর কমান্ডারদের নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, তাঁদের প্রতিরক্ষা অবস্থান আরো শক্তিশালী করার জন্য সম্মুখভাগে কিছু মাইন বসানো প্রয়োজন। কিছু এম-১৬ মাইন সংগ্রহ করে অধিনায়ক জাফর ইমামের নির্দেশে সমগ্র প্রতিরক্ষা লাইনের সম্মুখভাগে মাইন বেষ্টনী তৈরি করা হয়। এ রণাঙ্গনের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য মেজর খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তম ক্যাপ্টেন আবু জাফর মো. আনিসুল হককে দায়িত্ব দেন।
ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের পৈতৃক নিবাস বিলোনীয়া রণাঙ্গনের মধ্যবর্তী স্থান নোয়াপুর গ্রামে অবস্থিত। তিনি অত্র এলাকার ছাত্র-জনতা, কৃষক-শ্রমিক, বাঙালি ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ ও সেনাসদস্যদের সংগঠিত করে একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। পাকবাহিনী এ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙ্গে দিয়ে সম্মুখে অগ্রসর হতে থাকে। এ সময় ক্যপ্টেন জাফর ইমামের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী তাদের আক্রমণ করলে যুদ্ধ হয়। বিলোনীয়া যুদ্ধ-এ পাকবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। পাকবাহিনী জুন মাসের প্রথম থেকে তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীর অবস্থানসমূহে ১১ বার আক্রমণ চালিয়েও বিলোনীয়ায় প্রবেশ করতে পারেনি।
জুন মাসে বিলোনীয়া যুদ্ধ শেষে পাকবাহিনী বিলোনীয়ায় তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করে। গোটা এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ১৫ বেলুচ রেজিমেন্টের এক কোম্পানি সৈন্য বিলোনীয়ায় এবং অন্য এক কোম্পানি পরশুরামে অবস্থান নেয়। বেলুচ রেজিমেন্টের অপর একটি কোম্পানি পশ্চিমে ভারত সীমান্ত সংলগ্ন চন্দনাগ্রাম, সালদর বাজার ও নিলক্ষী এলাকায় অবস্থান নেয়। একই সময়ে পাকবাহিনীর রেজিমেন্ট কোম্পানিগুলোর সহযোগিতার জন্য ইপিসিএফ-এর একটি কোম্পানি উত্তরের সীমান্ত সংলগ্ন গুথুমা গ্রামে, অপর একটি কোম্পানি নোয়াপুর ও জাম্মুয়া সীমান্ত এলাকায় পশ্চিম দিকে মুখ করে প্রতিরক্ষা অবস্থান গড়ে তোলে। এছাড়া পূর্ব সীমান্তে আমজাদ হাটে ১৫ বেলুচ রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি অবস্থান নেয়। ফেনীতে ১৫ বেলুচ রেজিমেন্টের সদর দপ্তর স্থাপন করা হয়। এছাড়া ফুলগাজীতে একটি রাজাকার ক্যাম্প স্থাপন করা হয়।
পাকহানাদার বাহিনীর সহযোগিতায় মুসলিম লীগ-এর নেতা-কর্মী ও ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বারদের কতিপয় সদস্য নিয়ে শান্তি কমিটি, রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গঠন করা হয়। তারা গ্রামে-গঞ্জে ও হাটে-বাজারে, লুটতরাজ, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, হত্যা ও নারীধর্ষণের মতো ঘৃণ্যতম কাজে লিপ্ত ছিল। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের গতিবিধি ও অবস্থান সম্পর্কে হানাদার বাহিনীর সোর্স হিসেবেও কাজ করত। ফুলগাজী উপজেলা খাদ্য-গুদাম, নিলক্ষী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মুন্সিরহাট সিনিয়র মাদ্রাসা, কালিরহাট প্রাথমিক বিদ্যালয়, জি এম হাট ও আমজাদ হাটে রাজাকারদের ক্যাম্প স্থাপন করা হয়।
উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নেই শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। বিভিন্ন ইউনিয়নের শান্তি কমিটির সদস্যরা হলো— মৌ. মোহাদ্দেস আবদুল মালেক (পিতা গুরা গাজী, ইউপি ও শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান, দরবারপুর), মৌ. নুরুল ইসলাম (পিতা ছকু মিয়া, শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান, মুন্সিরহাট), মফিজুর রহমান (পিত নুরুল হক, ইউপি ও শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান, আমজাদহাট), মাওলানা শফিউল্লা (পিতা আব্দুর রহমান, শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান, ফুলগাজী), আব্দুল হাই পেস্কার (পিতা মফজলের রহমান, শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান, জি এম হাট), মাওলানা মোস্তফা (পিতা মৌ. গোলাম রব্বানী, শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান, আনন্দপুর) প্রমুখ।
বিভিন্ন ইউনিয়নের রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা হলো- দরবারপুর ইউনিয়ন : ছলিম উল্লাহ (কমান্ডার, পিতা মোহাদ্দেস আব্দুল মালেক, ধলীয়া), মৌ. আবুল খায়ের (ধলীয়া), রহিমউল্লা (ধলীয়া চকবস্তা), আহম্মদ উল্লাহ (জগতপুর), আয়ুব আলী (দরবারপুর) ও খলিলুল্লাহ চৌধুরী (উত্তর শ্রীপুর); মুন্সিরহাট ইউনিয়ন: তোফজ্জেল হোসেন চৌধুরী (পৈথারা), শেখ আহম্মদ (ফতেহপুর), দুলাল মিয়া (দক্ষিণ তারালিয়া), কাজী রফিকুল ইসলাম (নোয়াপুর) ও মুক্ত মিয়া (দক্ষিণ করইয়া); ফুলগাজী ইউনিয়ন : মৌ. আহম্মদ উল্লাহ (গোসাইপুর), শামসুল করিম (গাবতলা), মৌ. শফিউল্লাহ (গোসাইপুর), হাবিলদার হাবিবুর রহমান (নিলক্ষী) ও আবু তাহের (দক্ষিণ বরইয়া); আমজাদ হাট ইউনিয়ন: : নুরুল ইসলাম (কমান্ডার, পিতা সুজা মিয়া, মণিপুর), আফজলের রহমান (মণিপুর), নূরের জমান মোল্লা (মণিপুর), আমির হোসেন (উত্তর ধর্মপুর, বর্তমানে খাগড়াছড়ি), মোস্তফা মাস্টার (তালবাড়িয়া); জি এম হাট ইউনিয়ন: শাহাব উদ্দিন মজুমদার (নূরপুর), নুরুল ইসলাম ভূঁইয়া (নূরপুর), জাফর আহম্মদ (পূর্ব বশিকপুর), তাজুল ইসলাম খন্দকার (শ্রীচন্দ্রপুর) ও শামসুল আলম চৌধুরী ওরফে খোকা চৌধুরী (শ্রীচন্দ্রপুর); আনন্দপুর ইউনিয়ন: হবিবুর রহমান হাবু (খিলপাড়া) ও সুরুজ মিয়া (দক্ষিণ আনন্দপুর)। আমজাদহাট ইউনিয়নের আলবদর বাহিনীর সদস্যরা হলো- মাওলানা মো. হানিফ (সভাপতি, পিতা রজব আলী মুন্সি, উত্তর ধর্মপুর), এয়াকুব মিয়া (উত্তর ধর্মপুর), মাওলানা খোদা বকস্ (উত্তর ধর্মপুর), জাকের হুজুর (বসন্তপুর) ও ইব্রাহীম সরদার (উত্তর ধর্মপুর)।
পাকবাহিনী ১৬ই জুন দুপুরবেলা দক্ষিণ আনন্দপুর গ্রামে অতর্কিতে হানা দিয়ে আনন্দপুর চৌধুরী বাড়িতে ৫ জনকে গুলি করে হত্যা করে। এটি আনন্দপুর চৌধুরী বাড়ি গণহত্যা হিসেবে পরিচিত। একই দিন তারা হাসানপুর গ্রামে ৭ জন মানুষকে গুলি করে হত্যা করে। এটি হাসানপুর গণহত্যা নামে পরিচিত। ১৭ই জুন রাত ১২টা ৩০ মিনিটের সময় পাকবাহিনীর আর্টিলারি শেলের আঘাতে সীমান্তবর্তী জাম্মুয়া গ্রামের হাজী আনা মিঞার বাড়িতে একই সময়ে দুটি বসত ঘরে একই পরিবারের ৭ জনসহ ২৬ জন মানুষ শহীদ হন। এটি জাম্মুয়া গণহত্যা নামে পরিচিত।
১২ই জুন পুলিশ হাবিলদার নুরুল ইসলাম (চাটখিল, নোয়াখালী), মুন্সিরহাট এলাকায় রেকি করতে এসে সেখান থেকে ফেরার পথে কমুয়া গ্রামে পাকহানাদার বাহিনীর গুলিতে শহীদ হন। ২০শে জুন পাকবাহিনীর গুলিতে নিজ বাড়িতে শহীদ হন দক্ষিণ শ্রীপুর নিবাসী আলী আহম্মদ চৌধুরী (পিতা নজুম উদ্দিন চৌধুরী)। ২১শে জুন দক্ষিণ শ্রীপুর পশ্চিম পাড়া চৌধুরী বাড়ির কবরস্থানে মতিয়া খালের পূর্ব পাড়ে এই দু জনকে কবর দেয়া হয়।
২০শে জুন মুন্সিরহাট বাজারের পূর্ব পাশে ফতেপুর গ্রামের পূর্বদিক থেকে আগত সৈয়দ ছেরাজুল ইসলাম খন্দকার, কানু মিয়া ও রফিকুল হক চৌধুরীসহ পূর্বাঞ্চলের আরো ৮ জনকে পাকবাহিনীর সদস্যরা গুলি করে হত্যা করে। কয়েকদিন পর তাদের দেহ বাজারস্থ তহশীল অফিসের দক্ষিণ-পূর্বে একটি পুকুরপাড়ের উত্তর-পশ্চিম কোণায় সমাহিত করা হয়। এটি নতুন মুন্সিরহাট গণহত্যা নামে পরিচিত ২২শে জুন হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানসমূহ দখলের পর মুন্সিরহাটের দরবারপুর গ্রামে হানা দিয়ে ৯ জন সাধারণ মানুষকে বিভিন্ন বাড়ি ও রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে দরবারপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে গুলি করে হত্যা করে, যা দরবারপুর গণহত্যা বলে পরিচিত।
ফুলগাজী উপজেলার বিজয়পুর গ্রামে একটি বধ্যভূমি রয়েছে। হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকাররা বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিকামী লোকজনদের ধরে এনে নির্যাতন করে বিজয়পুর গ্রামের পেয়ার মিয়ার বাড়ির পূর্ব পাশে অবস্থিত পুকুরপাড়ে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে মাটিচাপা দিত। এটি বিজয়পুর বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত। দক্ষিণ আনন্দপুর ইউনিয়নের মাইজ গ্রামস্থ কালিরহাটে অবস্থিত ক্যাম্পের হানাদার বাহিনী বিভিন্ন সময়ে ফেনী-পরশুরাম সড়ক ও পাশের গ্রামসমূহ থেকে লোকজন ধরে এনে ক্যাম্পে নির্যাতন করে প্রায় প্রতিরাতে হাজী বাড়ির সম্মুখে একটি বড় ডোবার পাশে নিয়ে গুলি করে হত্যা করার পর লাশ ডোবায় ফেলে দিত। এটি মাইজ গ্রাম বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত। পাকবাহিনীর শেলের আঘাতে জামমুড়া গ্রামে ২৭ জন লোক নিহত হলে তাদের জামমুড়া ঈদগাহের দক্ষিণ পাশে গণকবর দেয়া হয়। এটি জাম্মুয়া গণকবর হিসেবে পরিচিত। আনন্দপুর চৌধুরী বাড়িতে গণহত্যায় নিহতদের ঐ বাড়ির সামনে গণকবর দেয়া হয়, যা আনন্দপুর চৌধুরী বাড়ি গণকবর নামে পরিচিত। নতুন মুন্সিরহাট বাজার সংলগ্ন এলাকায় একটি গণকবর রয়েছে, যা নতুন মুন্সিরহাট গণকবর নামে পরিচিত।
অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে ফুলগাজী উপজেলার অন্তর্গত আমজাদ হাট ইউনিয়নের উত্তর ধর্মপুর মৌজায় হাতিলুটা মাঠের মধ্যবর্তী স্থানে জেলে বাড়িতে অবস্থানরত একদল মুক্তিযোদ্ধা রাতের অন্ধকারে ফুলগাজী রাজাকার ক্যাম্পে গেড়িলা আক্রমণ চালান। এ অপারেশনে ৬০ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। অপরপক্ষে হানাদার বাহিনীর ২০০ জন সৈন্য নিহত ও বহু আহত হয়। এটি ফুলগাজী রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন নামে পরিচিত। পরদিন ভোররাতে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা জেলে বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ চালালে পার্শ্ববর্তী জগতপুর গ্রামে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল তা প্রতিহত করার চেষ্টা করে। আধাঘণ্টার মতো উভয় পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময়ের এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে নিরাপদ স্থানে চলে যান। এটি জেলে বাড়ির যুদ্ধ নামে পরিচিত।
২১শে জুন সন্ধ্যার পর পাকসেনারা হেলিকপ্টারযোগে বিলোনীয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ করলে উভয় পক্ষের মধ্যে রাত ৮টা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। বিলোনীয়া যুদ্ধে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের হাবিলদার নূরুল ইসলাম শহীদ হন এবং মুক্তিবাহিনীর অবস্থানসহ আশপাশের বসতবাড়িতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর বসানো মাইন বিস্ফোরণে মুন্সিরহাট ও বশিকপুরের রাস্তা ও মাঠে অগ্রগামী পঞ্চাশের অধিক পাকসেনা হতাহত হয়।
২৭শে অক্টোবর মেজর জাফর ইমামের সেকশন ও তদূর্ধ্ব পর্যায়ের সকল কমান্ডারদের নিয়ে একটি রেকিবাহিনী গঠন করা হয়। শত্রুর অবস্থানের ফাঁক দিয়ে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে শত্রুর অবস্থান সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেন। কিন্তু ফিরে আসার সময় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সুবেদার জব্বার মাইন বিস্ফোরণে আহত হলে তাঁকে স্ট্রেচারে করে নিয়ে আসার সময় শত্রুবাহিনী গোলা বর্ষণ শুরু করে। তবে কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া রেকিবাহিনী নিরাপদে অবস্থানে ফিরে আসতে সক্ষম হয়। ২রা নভেম্বর মুক্তিবাহিনী রাজনগরে সমবেত হয়। সন্ধ্যার পর তারা চন্দনা ও সুয়ারবাজারে পাকবাহিনীর অবস্থানের ফাঁকে ঢুকে মুহুরী নদী অতিক্রম করে সলিয়ার দিকে অগ্রসর হয়। লে. মিজান ও লে. দিদারের নেতৃতে ‘বি’ কোম্পানি ও ‘সি’ কোম্পানি এবং ক্যাপ্টেন হেলাল মোরশেদ, বীর বিক্রম- (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল, পিএসসি)-এর নেতৃত্বে ২য় ইস্ট বেঙ্গলের এক কোম্পানি সৈন্য অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ৩রা নভেম্বর ভোরের আগেই প্রতিরক্ষাব্যূহ রচনা করে। এ সময় ক্যাপ্টেন মাহাফুজ তাঁর সৈন্যসহ গুথুমার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘বি’ কোম্পানির সঙ্গে সলিয়াতে মিলিত হয়। ৭ই নভেম্বর সলিয়া দিঘি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে ৩০ জন পাকসেনা নিহত হয়। অপরপক্ষে একজন মুক্তিযোদ্ধা পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়ে শহীদ হন। ২২শে নভেম্বর ফুলগাজী উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আমিন আহমেদ চৌধুরী, বীর বিক্রম- (পিতা সুলতান আহমেদ চৌধুরী, দক্ষিণ আনন্দপুর), ইয়ার আহমেদ, বীর বিক্রম- (পিতা নজির আহাম্মদ, বালুয়া), জাফর ইমাম, বীর বিক্রম- (পিতা শেখ ওয়াহিদ উল্লাহ চৌধুরী, নোয়াপাড়া), মো. ইসহাক, বীর প্রতীক- (পিতা সৈয়দ আহম্মদ, গাবতলা), মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম, বীর প্রতীক- (পিতা আলী আহমদ, পূর্ব বশিকপুর), শাহাবউদ্দিন, বীর প্রতীক- (পিতা নেওয়াজ মজুমদার, আনন্দপুর) ও রবিউল হক, বীর প্রতীক- (পিতা আমিনউল্লা মজুমদার, উত্তর আনন্দপুর)। ফুলগাজীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- ইয়ার আহমেদ, বীর বিক্রম (৬ই নভেম্বর চিতলিয়া যুদ্ধে শহীদ), মো. ইসহাক, বীর প্রতীক (পাঠাননগর যুদ্ধে শহীদ), শাহাবউদ্দিন, বীর প্রতীক (মুন্সিরহাট যুদ্ধে শহীদ), রবিউল হক, বীর প্রতীক (১২ই ডিসেম্বর বিলোনিয়া যুদ্ধে শহীদ), মোশাররফ হোসেন (পিতা সুজাত আলী, ধলিয়া; ৫ই ডিসেম্বর চিথলিয়ায় মাইন বিস্ফোরণে আহত হন ও ১০ই ডিসেম্বর ভারতের আসামের তেলিয়ামুড়া হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন), মোসলেহ্ উদ্দীন (পিতা সোনা মিয়া, গাবতলা; ৫ই নভেম্বর নিলক্ষী যুদ্ধে শহীদ), হাবিলদার এয়ার আহম্মদ (পিতা নজীর আহম্মদ, বালুয়া; ৩রা নভেম্বর সলিয়ার যুদ্ধে শহীদ), মো. আয়ুব আলী (পিতা এয়ার আহম্মদ, দক্ষিণ আনন্দপুর; নিলক্ষীতে শহীদ), রোস্তম আলী (পিতা ফয়েজের রহমান, পূর্ব বশিকপুর; ফেনী-ছাগলনাইয়া ট্রাঙ্করোডে শহীদ), সুলতান বায়েজীদ (পিতা হাফেজ আহম্মদ, নীলক্ষী), বাচ্চু মিয়া (পিতা মজু মিয়া, পূর্ব বশিকপুর), রবিউল হক মজুমদার (পিতা আমিন আহম্মদ মজুমদার, উত্তর আনন্দপুর), সাহাব উদ্দীন মজুমদার (পিতা আলী নেওয়াজ মজুমদার, উত্তর আনন্দপুর), সুলতান আহম্মদ মজুমদার (পিতা মোহাম্মদ মিয়া মজুমদার, উত্তর আনন্দপুর), নজীর আহম্মদ মজুমদার (পিতা মাধু মিয়া মজুমদার, উত্তর আনন্দপুর), আবুল কাশেম (পিতা আব্দুল খালেক, দরবারপুর), মহসীন (পিতা মনির আহম্মদ, দরবারপুর), হাবিলদার বায়েজিদুর রহমান (পিতা আবু বক্কর সিদ্দিক, উত্তর নীলক্ষী), শফিউল আজম (পিতা আবদুল মজিদ, নীলক্ষী; ১৫ই নভেম্বর বিলোনীয়া যুদ্ধে শহীদ), আনছার নুরুল হক (পিতা মোহাম্মদ ইসমাঈল, দক্ষিণ আনন্দপুর)।
চৌধুরী বাড়ি গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে চৌধুরী বাড়ির সামনে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। জাম্মুয়া গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে ফেনী জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আজিজ আহম্মদ চৌধুরীর উদ্যোগে সেখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। ধলিয়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মোশাররফ হোসেনের স্মৃতি রক্ষার্থে ধলিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া শহীদ এয়ার আহম্মদের নামে ফেনী- বিলোনীয়া সড়কের আনন্দপুর থেকে তাঁর নিজ গ্রাম বালুয়া পর্যন্ত একটি এবং শহীদ শফিউল আজমের নামে ফুলগাজী-রাজষপুর ও উত্তর শ্রীপুর-পূর্ব নিলক্ষীতে দুটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। [মো. আবদুল মোতালেব ভূঁঞা]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড