মুক্তিযুদ্ধে ফরিদপুর সদর উপজেলা
ফরিদপুর সদর উপজেলা ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। এ খবর প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ। শুরু হয় প্রতিবাদ ও অসহেযোগ আন্দোলন। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ-এর নেতৃত্বে ফরিদপুর সদর উপজেলায় আন্দোলন-সংগ্রাম চলতে থাকে। জেলা-উপজেলা পর্যায় থেকে শুরু করে পাড়া-মহল্লা পর্যন্ত গঠিত হয় সংগ্রাম কমিটি।
১লা মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত ফরিদপুর শহরে সভা- সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি পালিত হয়। ৩রা মার্চ ফরিদপুরে সৈয়দ কবিরুল আলম মাও (ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি)-কে আহ্বায়ক করে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এ পরিষদের সদস্যদের মধ্যে শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর (ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও রাজেন্দ্র কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি), সালাউদ্দিন আহমেদ (রাজেন্দ্র কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস), নাসির উদ্দিন আহমেদ মুসা (ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও রাজেন্দ্র কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি), আতিয়ার রহমান (ফরিদপুর জেলা ছাত্র ইউনিয়ন-এর সভাপতি), ছাত্রলীগ নেতা খন্দকার আতাউল হক, আবু সাঈদ খান, নাজমুল হাসান নসরু প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
৫ই মার্চ স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে অম্বিকা ময়দানে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সৈয়দ কবিরুল আলম মাও-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ঐ সমাবেশে ইমাম উদ্দিন আহমেদ এমপিএ-সহ নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন। বক্তারা সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। সভা থেকে ফরিদপুর শহরের প্রধান সড়ক জিন্নাহ এভিন্যু-র নাম পরিবর্তন করে শেখ মুজিব সড়ক, লিয়াকত আলী খান সড়কের পরিবর্তে সূর্যসেন সড়ক, কায়েদে আজম লাইব্রেরির পরিবর্তে শেরে বাংলা পাঠাগার এবং আজম মার্কেটের পরিবর্তে তিতুমীর বাজার নামকরণের ঘোষণা দেয়া হয়।
বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর কে এম ওবায়দুর রহমান (কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও ফরিদপুর সদর থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য)-কে আহ্বায়ক করে একটি সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির সদস্য ছিলেন আদেল উদ্দিন আহমেদ এমএনএ (জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি), শামছুদ্দিন মোল্লা এমএনএ (জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক), ইমাম উদ্দিন আহমেদ এমপিএ, মোশাররফ হোসেন এমপিএ, সৈয়দ হায়দার হোসেন এমপিএ, এস এম নুরুন্নবী (আওয়ামী লীগ নেতা) প্রমুখ। তখন থেকেই ছাত্রলীগের উদ্যোগে ফরিদপু রাজেন্দ্র কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। ২৩শে মার্চ পাকিস্তান দিবসে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে সদর উপজেলার সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ঐদিনই অম্বিকা ময়দানে এক সমাবেশে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার শপথ গ্রহণ করা হয়। ২৬শে মার্চ থেকে ফরিদপুর স্টেডিয়াম ও পূর্ব খাবাসপুরে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপিত হয়। রাজেন্দ্র কলেজ মাঠে মোকাররম হোসেন ও ফরিদপুর স্টেডিয়ামে প্রাক্তন নৌসেনা হাবিবুর রহমান ফরমান প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। নৌসেনা ও আগরতলা মামলার অন্যতম আসামী নূর মোহাম্মদ (পিতা তমিজ উদ্দিন আকন, গোয়ালচামট) ছিলেন ফরিদপুর জেলার যুদ্ধকালীন সাবসেক্টর কমান্ডার। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি ক্যাপ্টেন বাবুল নামে পরিচিত ছিলেন। এছাড়া মুজিব বাহিনীর জেলা কমান্ডার ছিলেন শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর, মহকুমা মুজিব বাহিনীর প্রধান ছিলেন সৈয়দ কবিরুল আলম মাও, কোতোয়ালি থানা মুজিব বাহিনীর প্রধান ছিলেন নীতিভূষণ সাহা এবং মুজিব বাহিনীর গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন মোকারম হোসেন ও সালাউদ্দিন আহমেদ (পরবর্তীতে কোতোয়ালি থানা মুজিব বাহিনীর প্রধান)।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা এবং ফরিদপুর সদর উপজেলাসহ জেলার সর্বত্র মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত সার্বিক কার্যক্রম সমন্বয় করার লক্ষ্যে ২৯শে মার্চ কে এম ওবায়দুর রহমানকে
আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। শতাধিক নেতা-কর্মী এ কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ঝিলটুলীস্থ জেলা পরিষদের ডাকবাংলোতে কমিটির কন্ট্রোল রুম স্থাপিত হয়।
যশোর থেকে কামারখালী হয়ে পাকবাহিনী ফরিদপুরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে এ খবর পেয়ে ফরিদপুরের ছাত্র-যুবকরা কামারখালী ঘাটে গিয়ে স্থানীয় যুবকদের সহযোগিতায় ফেরির ইঞ্জিন খুলে ফেরিগুলো দূরে সরিয়ে রাখে। ফরিদপুর, কামারখালী ও বালিয়াকান্দি থেকে শতশত ছাত্র-জনতা লাঠি, সড়কি, ঢাল, বল্লমসহ কামারখালী ঘাটে প্রতিরোধব্যূহ তৈরি করে। একই সঙ্গে ঢাকা-যশোর রাস্তার ওপর গাছ ফেলে ব্যারিকেড তৈরি করে। গোয়ালন্দ ঘাটেও ইপিআর-এর বিদ্রোহী সদস্য নাসের সরদার ও শামছুল হকের নেতৃত্বে বেশ কয়েকজন ইপিআর সদস্য ও ছাত্র-জনতা প্রতিরোধব্যূহ গড়ে তোলেন। ফরিদপুর থেকে তাঁদের জন্য খাদ্য পাঠিয়ে সহযোগিতা করা হয়। ১৩ই এপ্রিল পাকসেনারা গোয়ালন্দ অভিমুখে অগ্রসর হলে প্রতিরোধকারীদের সঙ্গে তুমুল সংঘর্ষ বাঁধে এবং এক পর্যায়ে পাকসেনারা পিছু হটে। ২১শে এপ্রিল দ্বিতীয় দফায় পাকবাহিনীর সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষে মুক্তিসেনারা পিছ হটলে সড়ক ও আকাশ পথে পাকসেনারা ফরিদপুরে প্রবেশ করে।
২১শে এপ্রিল পাকবাহিনী ফরিদপুরে প্রবেশ করে স্টেডিয়ামে ক্যাম্প স্থাপন করে। পরবর্তীতে তারা ফরিদপুর সার্কিট হাউজ ও ওয়াপদা অফিসে আরো দুটি ক্যাম্প স্থাপন করে। আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার (খাড়দিয়া, নগরকান্দা; ইসলামী ছাত্র সংঘ-এর নেতা ও জেলা আলবদর বাহিনীর প্রধান)-এর নেতৃত্বে ফরিদপুর শহরের ময়রা পট্টিতে একটি রাজাকার ক্যাম্প স্থাপিত হয়। কবি জসীম উদ্দীন রোডে হীরালাল মোক্তারের বাড়ি দখল করে সেখানে আলবদর বাহিনীর ট্রেনিং সেন্টার স্থাপন করা হয়।
ফরিদপুর সদর উপজেলা ছিল কুখ্যাত রাজাকারদের আস্তানা। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই এখানে রাজাকার, আলবদর ও আলশামস শান্তি কমিটি বাহিনী গঠন করা হয়। এখানে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগীদের মধ্যে আফজাল হোসেন (মুসলিম লীগ নেতা ও জেলা শান্তি কমিটির আহ্বায়ক), আব্দুর রহমান বাকাউল (ঝিলটুলী), আদেল উদ্দিন হাওলাদার (আটরশি), আব্দুস সোবহান মোল্লা (কানাইপুর), আব্দুল জলিল মোল্লা (কানাইপুর), মওলানা আব্দুল আলী (খাবাসপুর, জামায়াতে ইসলামী), মওলানা মোবারক আলী (খাবাসপুর), আলাউদ্দিন খান (আলীপুর), রকিব উদ্দিন আহমেদ (পিডিপি), মহিউদ্দিন আহমেদ (পিডিপি), খলিলুর রহমান ঠাকুর (পিডিপি) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। ফরিদপুর সদর থানা শান্তি কমিটির আহ্বায়ক ছিল আলাউদ্দিন খান (আলীপুর), সদস্য সাঈদ উদ্দিন চৌধুরী (কমলাপুর), আব্দুল জলিল মোল্লা (কানাইপুর), মইনউদ্দিন উকিল (ফরিদপুর শহর), খলিলুর রহমান ঠাকুর (ডোমরাকান্দি), আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার, সৈয়দ নজরুল হুদা তৌহিদ (কমলাপুর, ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতা ও শহর আলবদর বাহিনীর প্রধান), শাহাবুদ্দিন খান (আটরশি, জেলা আলশামস বাহিনীর প্রধান), আব্দুল মান্নান (জেলা যুব শান্তি কমিটির কমান্ডার) প্রমুখ। পাকবাহিনীর অন্য সহযোগী সদস্যদের মধ্যে মাইন উদ্দিন চৌধুরী (পূর্ব খাবাসপুর), মুসা বিন শমসের (গোয়ালচামট), জুলফিকার আলী (ফরিদপুর শহর), কামরুজ্জামান জাসু (গোয়ালচামট), ফাউল জাহাঙ্গীর (কমলাপুর), ইফতার ইফতু (আইনপুর) প্রমুখ বেশ সক্রিয় ছিল। এরা যুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের ধরিয়ে দেয়া, বিভিন্ন গ্রামে লুটপাট করা, নারীধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগসহ নানা অপকর্মে পাকবাহিনীকে সহায়তা করত। কুখ্যাত রাজাকারদের মধ্যে আদম আলী (করিমপুর), শুকুর (করিমপুর), আব্দুর রাজ্জাক মাতুব্বর (বসুনর সিংহদিয়া), মমিন (বসুনর সিংহদিয়া), নওশের আলী খাঁ নসু (কোমরপুর ) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
পাকিস্তানি সেনাদের প্রধান নির্যাতনকেন্দ্র ছিল ফরিদপুর স্টেডিয়াম ক্যাম্প। এখানে মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ বাঙালিদের ধরে এনে অবর্ণনীয় নির্যাতন চালানো হতো। এছাড়া পুরাতন সার্কিট হাউজ, আলীপুর ফনিক্স কেমিক্যাল ল্যাবরেটরি, রাজেন্দ্রপুর কলেজের পেছনে ছায়াবাণী সিনেমা হলের মালিক কিরণবালা বোসের বাড়ি, শহরের পোস্ট অফিসের পাশের দোতলা ভবনে ইয়ুথ পিস কমিটির অফিস পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির হিসেবে ব্যবহার করত।
পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা ফরিদপুর সদর উপজেলার শ্রীঅঙ্গন, ঈশান গোপালপুর, কানাইপুর, ভাঙ্গীডাঙ্গী, কোমরপুর, চরবালুধুম, খাসকান্দি, লক্ষ্মীপুর, হুগলাকান্দি প্রভৃতি গ্রামে হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠন, নারীনির্যাতন ও অগ্নিসংযোগ করে। ২১শে এপ্রিল সন্ধ্যায় পাকবাহিনী ফরিদপুর শহরের গোয়ালচামট গ্রামের জগদ্বন্ধু সুন্দরের আশ্রম শ্রীঅঙ্গনে আক্রমণ চালিয়ে কীর্তনরত অবস্থায় ৮ জন সাধুকে নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা করে, যা শ্রীঅঙ্গন গণহত্যা- নামে পরিচিত। ২রা মে ফরিদপুর শহর থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে ঈশান গোপালপুর জমিদার বাড়িতে স্থানীয় দালালদের সহযোগিতায় পাকবাহিনী ২৪ জন মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে, যা ঈশান গোপালপুর গণহত্যা নামে খ্যাত। ২১শে এপ্রিল পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা হিন্দু অধ্যুষিত ভাঙ্গীডাঙ্গী গ্রামে নৃশংস গণহত্যা চালায়। ভাঙ্গীডাঙ্গী গণহত্যা-য় শতাধিক মানুষ শহীদ হন। গ্রামটিতে তারা লুটপাটও চালায়। ৮ই মে বিহারিদের নিয়ে গঠিত রাজাকারদের একটি সশস্ত্র দল কানাইপুর সিকদার বাড়িতে আক্রমণ চালিয়ে ১৮ জন নিরীহ মানুষকে জবাই করে হত্যা করে। এটি কানাইপুর সিকদার বাড়ি গণহত্যা- নামে পরিচিত। জুলাই মাসের প্রথম দিকে চরবালুধুম গ্রামের কোরবান আলীর বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপ অবস্থান নেয়। রাজাকারদের দেয়া গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পাকবাহিনী ঐ বাড়িতে আক্রমণ চালায়। সে-সময় একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এরপর পাকবাহিনী ১৮ জন যুবককে ধরে নিয়ে গোয়ালন্দ ঘাটে জাহাজের ওপরে দাঁড় করিয়ে গুলি করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়। এ ঘটনা গোয়ালন্দ ঘাট গণহত্যা নামে পরিচিত। ২১শে द আগস্ট রাজাকার নওশের আলী খাঁ নসুর সহযোগিতায় পাকবাহিনী কোমরপুরের আওয়ামী লীগ নেতা আজহারুল ইসলামের বাড়িতে হামলা চালায়। তাঁর স্ত্রী তহুরা ইসলাম, কন্যা রোজিনা ইসলাম ও সাবিনা ইসলাম টপিকে পাকবাহিনী গুলি করে হত্যা করে। আজহারুল ইসলাম ও তাঁর অপর দুই কন্যা সেলিনা ইসলাম শেলী ও সুলতানা ইসলাম লাকী পাকবাহিনীর গুলিতে আহত হন।
ফরিদপুর স্টেডিয়াম ক্যাম্পের পূর্বপাশে একটি বধ্যভূমি ছিল। স্বাধীনতার পর এখান থেকে অসংখ্য মানুষের মাথার খুলি ও হাড়গোড় উদ্ধার করা হয়। এছাড়া ময়লাগাড়ি স্থানটিও বধ্যভূমি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। প্রায় রাতেই পাকবাহিনী তাদের ভ্যানে করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের যুবকদের পিঠমোড়া দিয়ে বেঁধে এখানে নিয়ে আসত এবং গুলি করে হত্যা করে তাদের লাশ ডাস্টবিনে ফেলে দিত।
৯ই ডিসেম্বর করিমপুরে কাজী সালাউদ্দিন নাসিমের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপ পাকবাহিনীর গাড়িবহরের ওপর আক্রমণ চালায়। পাকবাহিনীও পাল্টা আক্রমণ করলে উভয় পক্ষের মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়, যা করিমপুর যুদ্ধ নামে অভিহিত। এ-যুদ্ধে কাজী সালাউদ্দিন নাসিমসহ ৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। অন্যদিকে কয়েকজন পাকসেনা হতাহত হয়। ১৭ই ডিসেম্বর ফরিদপুর সদর উপজেলা হানাদার মুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন- সাহাবুদ্দিন আহমেদ, বীর উত্তম (পিতা গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, চর কমলাপুর)।
ফরিদপুর সদর উপজেলায় নয়জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম পাওয়া যায়। তাঁরা হলেন- কাজী আব্দুল হালিম (পিতা আব্দুল গফুর, কমলাপুর; ২৯শে মার্চ চট্টগ্রামে যুদ্ধে শহীদ), মোহন শেখ (পিতা মনির উদ্দিন শেখ, করিমপুর; ২১শে এপ্রিল পাকিস্তানি ছত্রীসেনা প্রতিরোধে শহীদ), কাজী সালাউদ্দিন নাসিম (পিতা জালাল উদ্দিন আহমেদ, ঝিলটুলী; ৯ই ডিসেম্বর করিমপুর যুদ্ধে শহীদ), মেজবাহ উদ্দিন নওফেল (পিতা আব্দুল বারী মিয়া, গোপালপুর; ঐ), আব্দুল ওয়াহাব (পিতা আব্দুর রহমান, আল্লাদিপুর; ঐ), আব্দুস সালাম (পিতা আব্দুল হামিদ, কুঠিবাড়ী; যশোরের যুদ্ধে শহীদ), মঞ্জু মিয়া (পিতা আয়নাল মিয়া, পশ্চিম খাবাসপুর; ২৯শে নভেম্বর আলিয়াবাদে শহীদ), ইউনুস মোল্লা (পিতা হাবিব মোল্লা, চরবালুধুম; ১৭ই ডিসেম্বর চরটেপুরাকান্দিতে শহীদ) এবং কবির আহমেদ (পিতা আব্দুস সাত্তার বেপারী, মমিনখার হাট; মমিনখার হাট যুদ্ধে শহীদ)।
ফরিদপুর সদর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। ফরিদপুর শহরের কোর্ট চত্বরে ‘স্বাধীনতা’ নামে মুক্তিযুদ্ধের একটি ভাস্কর্য ও ফরিদপুর স্টেডিয়াম ক্যাম্প সংলগ্ন বধ্যভূমিতে একটি স্মৃফিলক নির্মিত হয়েছে। শ্রীঅঙ্গনে ৮ জন শহীদের স্মরণে একটি স্মৃতিফলক নির্মিত হয়েছে। কোমরপুরে পাকবাহিনীর হত্যার শিকার ৩ জনের কবর ঘিরে একটি বেষ্টনী নির্মাণ করা হয়েছে। ৯ই ডিসেম্বর করিমপুর যুদ্ধে শহীদ ঝিলটুলী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা কাজী সালাউদ্দিন নাসিমের নামে পূর্ব খাবাসপুরে শহীদ কাজী সালাউদ্দিন প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং চরকমলাপুর রামকৃষ্ণ মিশন থেকে চানমারির চক পর্যন্ত একটি রাস্তার নাম শহীদ কাজী সালাউদ্দিন নাসিম সড়ক নামকরণ করা হয়েছে। একই যুদ্ধে শহীদ গোপালপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মেজবাহ উদ্দিন নওফেলের নামে লক্ষ্মীপুরে শহীদ মেজবাহ উদ্দিন নওফেল প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যশোরের যুদ্ধে শহীদ কুঠিবাড়ী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সালামের নামে ফরিদপুর শহরের কমলাপুর ডিআইটি বটতলা থেকে বায়তুল আমান পর্যন্ত একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে শহীদ আব্দুস সালাম সড়ক। মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার সেলিমের নামে ঝিলটুলীতে সানরাইজ কিন্ডারগার্টেন পর্যন্ত একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার সেলিম সড়ক। [হাসানউজ্জামান]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড