You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে ফরিদগঞ্জ উপজেলা (চাঁদপুর)

ফরিদগঞ্জ উপজেলা (চাঁদপুর) বায়ান্নর ভাষা- আন্দোলন – ছেষট্টির ৬-দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান – এবং সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-এর নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র সংগ্রাম ও স্বাধীনতার দিকে ধাবিত করে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে ষড়যন্ত্র শুরু করলে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। ফরিদগঞ্জবাসী এ আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। এরপর ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতার দিকনির্দেশনা পেয়ে ফরিদগঞ্জের সর্বস্তরের মানুষ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়।
৭ই মার্চের পর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে স্বাধীনতাকামী সব রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে চাঁদপুর টাউন হলে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে জেলা, উপজেলা ও গ্রামে-গ্রামে সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মো. এম ওয়ালিউল্লাহ এমএনএ, হাফেজ হাবিবুর রহমান এমএনএ, আবদুল আউয়াল এমএনএ, এ বি সিদ্দিক সরকার এমপিএ, আবদুল করিম পাটোয়ারী এমপিএ, মো. রাজা মিয়া এমপিএ, গোলাম মোর্শেদ ফারুকী এমপিএ, আলহাজ সিকান্দর আলী এমপিএ, ডা. আবদুস সাত্তার এমপিএ, আবদুর রব মিয়া (পরবর্তীতে এমপি), সিরাজুল ইসলাম পাটোয়ারী এমপিএ, এডভোকেট আবু জাফর মোহাম্মদ মঈনুদ্দিন (পরবর্তীতে এমপি), রফি উদ্দিন আখন্দ (সোনা আখন্দ), নুরুল হক (বাচ্চু মিজি), প্রফেসর আবদুছ ছাত্তার, জীবন কানাই চক্রবর্তী প্রমুখ।
চাঁদপুর জেলা সংগ্রাম কমিটির নির্দেশনা অনুযায়ী ফরিদগঞ্জ উপজেলায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কার্যক্রম ও প্রশিক্ষণ ক্যাম্প পরিচালনা করেন। পরবর্তীতে তাঁদের কেউ-কেউ ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পে দায়িত্ব পালন করেন। প্রথম দিকে থানা সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ছিলেন মো. এম ওয়ালিউল্লাহ এমএনএ এবং সেক্রেটারি ছিলেন রাজা মিয়া পাটোয়ারী এমপিএ। তাঁরা ভারতে চলে গেলে দায়িত্বের পরিবর্তন করা হয়। কমিটির পরবর্তী সেক্রেটারি থানা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি এডভোকেট সিরাজুল ইসলাম মিয়া ভারতে চলে গেলে আব্দুর রব সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন। সংগ্রাম কমিটির সর্বশেষ সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন আমিনুল হক মাস্টার। সংগ্রাম কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- আবদুল জব্বার পাটোয়ারী (প্রচার সম্পাদক, থানা আওয়ামী লীগ), আবদুর রব পাটোয়ারী, সফিউল্লাহ (ছাত্রনেতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), সিরাজুল ইসলাম বিএড, আবদুর রব শেখ (থানা আওয়ামী লীগ নেতা), সিরাজুল ইসলাম বিএসসি (পাইকপাড়া হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক) প্রমুখ।
ইউনিয়ন পর্যায়ে সংগ্রাম কমিটির সদস্যরা হলেন- ১নং বালিথুবা ইউনিয়ন: মনসুর মাস্টার (চান্দ্রা বাজার), রফিক পাটোয়ারী (সকদী রামপুর), ছিদ্দিক সরদার (মদনেরগাঁও), আবদুর রব (কৃষ্ণপুর, বালিথুবা), আবদুল হাই (চান্দ্ৰা বাজার) ও আবুল খায়ের (চান্দ্রা বাজার)।
২ নং বালিথুবা ইউনিয়ন: মাওলানা আবদুল হাই (মূল পাড়া), মোহাম্মদ রফিক পাটোয়ারী (ষোল্লা), আবদুর রশিদ মোল্লা (ষোল্লা), তাহের মোল্লা (ষোল্লা), আবুল হোসেন মাস্টার (বড়গাঁও হাইস্কুল, সুবিদপুর), ওহিদ চৌধুরী (সুবিদপুর), জয়নাল আবেদিন (বৈচাতলী), আবু ভূঁইয়া (ষোলদানা), এরসাদ খান (মানিকরাজ), সামসুল হক (মানিকরাজ) ও Saved সহিদ উল্যা (মানিকরাজ)।
৪, ৫ ও ৬নং গুপ্টি ইউনিয়ন: রশিদ পাটোয়ারী (গল্লাক বাজার), আবদুর রব পাটোয়ারী (দেইচর), আবদুর রব পাটোয়ারী (শ্রীগালিয়া), ইদ্রিছ মুন্সী (মুন্সিরহাট), মান্নান মুন্সি (মুন্সিরহাট), হাবিবুর রহমান (মুন্সিরহাট), আবদুল মান্নান শেখ (গণিয়া) ও আবুল কালাম ভূঁইয়া।
৭ ও ৮নং পাইক পাড়া ইউনিয়ন: সোবহান মাস্টার (কড়ইতলী), মন্নান দর্জি (কড়ইতলী), নুরু মাস্টার (কড়ইতলী), ডা. আবদুল জলিল (চৌমুখা), মাওলানা হেদায়েত উল্যা (বাঁশারা), ২৩°১০ . আবুল খায়ের (বাঁশারা), হাকিম মাস্টার (বাঁশারা), মমিন উল্যা ভূঁইয়া (কাসারা), রুস্তম আলী (গাজীপুর), আবদুল জলিল (খুরুমখালী), মোস্তফা পাটোয়ারী (বাঁশারা), ইউসুফ (চৌমুখা), মোহাম্মদ আবুল বাশার (চৌমুখা), আবদুর রশিদ, রুহুল আমিন (কড়ইতলা) ૭ তাজুল ইসলাম।
৯ নং গোবিন্দপুর ইউনিয়ন: রুস্তম আলী বেপারী (প্রত্যাশি), আবদুল হাই চৌধুরী (ধানুয়া), বাচ্চু ভূঁইয়া (চিরকাচানপুর) প্রমুখ।
১০ নং গোবিন্দপুর ইউনিয়ন: ফয়েজ বকস পাটোয়ারী (গোবিন্দপুর), হায়াত মাস্টার (হাঁসা), মৌলভী নুরুর রহমান (বিশকাটালি), লোকমান ভূঁইয়া (পূর্ব লাড়ুয়া), জাভেদ আলী মোক্তার (চরভাগল) প্রমুখ।
১১ ও ১২ নং চর দুখিয়া ইউনিয়ন: আব্দুল সোবহান পাটোয়ারী, ইউনুছ রাঢ়ি (চর দুখিয়া), বদিউল মিয়া (চর দুখিয়া), আলী মাস্টার (ফিরোজপুর বাজার), মাওলানা ইদ্রিছ (গোবিন্দপুর), মৌলভী মোহাম্মদ হোসেন (লড়াইরচর), বেনি আমিন (একলাশপুর) ও আবদুল লতিফ (পোয়ারচর)।
১৩ ও ১৪ নং ফরিদগঞ্জ ইউনিয়ন: জালাল পাটোয়ারী (হর্নিদুর্গাপুর), আবদুল মজিদ পাটোয়ারী (হর্নিদুর্গাপুর), আলী হোসেন, আবুল খায়ের (কোরোয়ারচর), আবদুল লতিফ সাউদ (নোয়াগাঁও), আবুল খায়ের (সাফুয়া), আবদুল আওয়াল (সাফুয়া), ডা. ইছহাক (ভাটিরগাঁও), ইদ্রিছ (রুদ্রেরগাঁও) ও আবুল খায়ের (ভাটিরগাঁও)।
১৫ ও ১৬ নং রূপসা ইউনিয়ন: শুক্কুর মাস্টার (আল্ট্রা), আবুল – কাসেম মজুমদার (শ্রীগালিয়া), মাওলানা মুসলিম উদ্দিন (কাউনিয়া), আমিন উল্যা কন্ট্রাক্টর (চরমাদারি), মো. মাস্তান (রূপসা), মোহাম্মদ নাজির খলিফা (রূপসা), লুতু খলিফা (রূপসা বাজার), সহিদ পাটোয়ারী (রূপসা জমিদার বাজার), আমান উল্যা চৌধুরী (রূপসা বাজার) ও মজু বিএসসি।
সংগ্রাম কমিটির হেডকোয়ার্টার্স ও লিয়াজু অফিস ছিল ফরিদগঞ্জ থানা ওয়াপদা রেস্টহাউজ। জেলা সংগ্রাম কমিটি থেকে যেসব নির্দেশ আসত, থানা ও ইউনিয়ন সংগ্রাম কমিটি তা পালন করত। স্বাধীনতা সংগ্রামকে আরো বেগবান করার জন্য ফরিদগঞ্জ থানা সংগ্রাম কমিটির পাশাপাশি ছাত্রলীগ-এর একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির সভাপতি ছিলেন মনির আহমেদ (চরহোগলা), সহ- সভাপতি আবুল খায়ের পাটোয়ারী (ভাটিরগাঁও), সাধারণ সম্পাদক আলমগীর হোসেন দুলাল (চরহোগলা), সহ- সাধারণ সম্পাদক হাসান আলী (চরহোগলা) এবং সদস্য ছিলেন আবদুল জলিল (কোরোয়া), আবদুর রব (রান্দারবাগ) প্রমুখ। পরবর্তীতে আবুল খায়ের পাটোয়ারীকে এ কমিটির সভাপতি করা হয়। এর গঠন, দায়িত্ব বণ্টন ও কর্ম- পরিকল্পনাকারী ছিলেন কে এম সফিউল্যাহ। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা নুর মোহাম্মদ কাজীর নেতৃত্বে ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ)-এর একটি গ্রুপ প্রতিরোধ সংগ্রামে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।
৭ই মার্চের পর সুবেদার আবদুল করিম (কেরোয়ারচর), সুবেদার আবদুল লতিফ (ইপিআর সদস্য, কাসারা), সুবেদার আলী আকবর পাটোয়ারী (পানপাড়া, রামগঞ্জ), ফজলুল হক, সিপাহী রহমত (ভাটিয়ালপুর), আবদুল মতিন পাটোয়ারী (ভাটিরগাঁও), আবু তাহের পাটোয়ারী (ভাটিরগাঁও) প্রমুখের নেতৃত্বে একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। তাঁরা প্রতিদিন জাতীয় সঙ্গীত ও গার্ড-অব-অনার দিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করতেন। প্রশিক্ষক ও প্রশিক্ষণার্থীদের সার্বিক সহযোগিতা করত থানা সংগ্রাম কমিটি। ‘পাইক পাড়া যুক্ত ইউনিয়ন ও ভাটিরগাঁও হাইস্কুল নিয়ে সমন্বিত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে ওঠে। এর সভাপতি ছিলেন আবদুর রব শেখ (কাসারা) এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সিরাজুল ইসলাম বিএসসি (প্রধান শিক্ষক, পাইক পাড়া হাইস্কুল)। কমিটির সদস্যরা হলেন- মোস্তফা পাটোয়ারী, মোহাম্মদ আবুল বাসার, আবুল হোসেন, বালিথুবার মাওলানা শফিকুর রহমান (সাংবাদিক) প্রমুখ। এ কমিটি প্রত্যেক ইউনিয়ন থেকে সদস্য সংগ্রহ করে থানা পর্যায়ে একটি শক্তিশালী থানা যুব কমিটি এবং এর অধীনে একটি গোয়েন্দা সংস্থা গঠন করে। গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান ছিলেন আবুল হোসেন (শিক্ষক, বড়গাঁ হাইস্কুল)। এ সংস্থার কাজ ছিল পাকিস্তানপন্থী নেতাদের গতিবিধির ওপর নজরদারি করা। এপ্রিল মাসে আমিনুল হক মাস্টার ও শেখ আবদুর রব সকল ইউনিয়নের নেতা- কর্মীদের নিয়ে পাইকপাড়ায় একটি দিকনির্দেশনামূলক সভা করেন। এ সভায় নেতৃবৃন্দ দীর্ঘমেয়াদী সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি এবং প্রশিক্ষণের নির্দেশ দেন।
২৫শে মার্চ ঢাকাসহ সারা দেশে পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা শুরু করলে মানুষ জীবন বাঁচানোর জন্য শহর ছেড়ে যে যেভাবে পেরেছে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে গেছে। এসময় বহু মানুষ সহায়-সম্বল হারিয়ে নৌকা, ভ্যান, ঠেলাগাড়ি, গরুর গাড়ি ও পায়ে হেঁটে চাঁদপুর হয়ে ফরিদগঞ্জ চলে আসে। তাদের সেবায় ফরিদগঞ্জের বড়বড় সড়কের পাশে, নৌঘাটে ও অন্যান্য স্থানে অস্থায়ী লঙ্গরখানা গড়ে তোলা হয়। এলাকাবাসী টাকা-পয়সা, চিড়া-মুড়ি, গুড়-চিনি, চাল-ডাল, ডিম, চা, বিস্কুট, পানি ইত্যাদি নিয়ে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ায়।
৭ই এপ্রিল পাকবাহিনী চাঁদপুরের বিভিন্ন স্থাপনায় বিমান আক্রমণ করলে সাধারণ মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে চলে আসে। ৮ই এপ্রিল চাঁদপুরের পতন হলে পূর্বের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বেশির ভাগ নেতা-কর্মী পাইকপাড়ায় আশ্রয় নেন। নেতা- কর্মীদের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা ও সদস্যরাও ছিলেন। এ বি সিদ্দিক সরকার এমপিএ, লেফটেন্যান্ট দিদারুল আলম, সুবেদার নুর মোহাম্মদ গাজী (২রা সেপ্টেম্বর বাখরপুর মজুমদার বাড়িতে পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ এবং বীর প্রতীক উপাধিতে ভূষিত), আব্দুল ওয়াদূদ (যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, বর্তমানে চাঁদপুর জেলা কমান্ডার), সুবেদার মেজর করিম, সুবেদার লুৎফর রহমান, নৌবাহিনীর কর্মকর্তা জয়নাল চৌধুরী, বিমানবাহিনীর সদস্য শাহ আসিকুর রহমান, নায়েক এরশাদ (মদনেরগাঁও), সিপাহি করিম (ভাটিয়ালপুর), নায়েক হেদায়েত উল্লাহ (উত্তর বালিয়া), নায়েক আবদুল মতিন পাটোয়ারী, হাবিলদার আবদুর রশিদ (কাসারা) প্রমুখ এ দলে ছিলেন। নেতৃবৃন্দের মধ্যে কেউ-কেউ সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আশ্রয় নেন। জীবনকানাই চক্রবর্তী ও আবদুল করিম পাটোয়ারী কয়েকজন কর্মীর সহায়তায় ১২টি রাইফেল ও কিছু বুলেট নিয়ে ডাকাতিয়া নদী অতিক্রম করে গভীর রাতে ফরিদগঞ্জ পৌঁছেন। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে আমিনুল হক মাস্টারের নেতৃত্বে আবুল খায়ের পাটোয়ারী, আবদুল জলিল, আবদুর রব পাটোয়ারী, আবদুল জব্বার পাটোয়ারী, আলমগীর হোসেন দুলাল, মফিজুল হক ভূঁইয়া, মনির হোসেন প্রমুখ অতর্কিতে ফরিদগঞ্জ থানা আক্রমণ করেন। কোনো প্রকার বাধা ছাড়াই তাঁরা থানার সেকেন্ড অফিসারসহ পুলিশ সদস্যদের আটক করে সব রাইফেল ও বুলেট নিয়ে আসেন এবং সেগুলো পাইকপাড়া ক্যাম্পে জমা দেন। চাঁদপুর জেলার নেতৃবৃন্দ, ছুটিতে আসা ও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক বাহিনীর সদস্য, পুলিশ, আনসার ও বিমান বাহিনীর সদস্যরা কেউ হাতিয়ায় নিয়ে, কেউ খালি হাতে পাইকপাড়া এসে জড়ো হন। ৫-৭ জনের গ্রুপ করে রাইফেল নিয়ে রায়পুর রাস্তা, রামগঞ্জ ও ইচলী নদীপথে প্রতিরোধব্যূহ তৈরি করা হয়। একই সঙ্গে তাঁরা ফরিদগঞ্জের প্রশাসন চালানোর উদ্দেশ্যে সার্কেল অফিসারের দফতর থেকে প্রজেক্টর, সাইক্লোস্টাইল মেশিন ও কাগজপত্র নিয়ে আসেন। সার্কেল অফিসার গোপনে চাঁদপুর মহকুমা অফিসারের পিয়ন আলতাফ খাঁ (বালিয়া, চাঁদপুর)-র দ্বারা পাকবাহিনীর নির্দেশনামূলক চিঠিপত্র ফরিদগঞ্জে পাঠাত। এ খবর প্রতিরোধ যোদ্ধাদের কানে এলে তাঁরা সার্কেল অফিসারকে সতর্ক করে দেন। এরপর তাঁরা আলতাফ খাঁকে ধরে ওয়াপদা রেস্ট হাউজে এনে পরে হাইস্কুলের পাশে নদীর পাড়ে তাকে গুলি করে হত্যা করেন। আলতাফ খাঁর হত্যাকাণ্ডের খবর ছড়িয়ে পড়লে পাকবাহিনীর দোসরদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। পরের দিন অনেক সরকারি কর্মচারী ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক অফিস- আদালত ও দোকানপাট বন্ধ করে পালিয়ে যায়। ফলে থানা হেডকোয়ার্টার্স জনশূন্য হয়ে পড়ে। এ সময় ইছলীর কলন্দর গাজী দুজন পাকিস্তানি গোয়েন্দাকে আটক করে ফরিদগঞ্জ পাঠিয়ে দেন এবং আবুল খায়ের পাটোয়ারী কেরোয়ারচরের হজু কোম্পানিকে সঙ্গে নিয়ে বাগড়া বাজার নদীর পাড়ে পাইকপাড়ায় তাদের গুলি করে হত্যা করেন। এ ঘটনার পর ফরিদগঞ্জ ও তার আশপাশে চুরি, ডাকাতি ও অসামাজিক কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যায়।
৯ই এপ্রিল রাতে চাঁদপুরের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে পাইকপাড়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়। এ বৈঠকে ৯ সদস্যবিশিষ্ট সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। সুবেদার জহিরুল হক পাঠান এবং বি এম কলিমউল্যা ভূঁইয়াকে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ফেব্রুয়ারি মাসে বি এম কলিমউল্যা ভূঁইয়া গেরিলা কায়দায় দুবার থানা অপারেশন করে বিপুল গোলাবারুদ ও অস্ত্র হস্তগত করেন। তিনি বিভিন্ন স্থানে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। ডা. সাত্তার হাজিগঞ্জ থানার মাঠে প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য জহিরুল হক পাঠানকে বলেন। বি এম কলিমউল্যা ভূঁইয়ার সঙ্গে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও আনসার সদস্য এবং ছাত্রসহ কয়েকজন দক্ষ যোদ্ধা ছিলেন। এ গ্রুপের প্রথম হেডকোয়ার্টার্স ছিল ওগারিয়া চৌধুরীর বাড়িতে। পরে এ ক্যাম্প চেড়িহারা করের বাড়িতে স্থানন্তর করা হয়। জহিরুল হক পাঠান ও বি এম কলিমউল্যা ভূঁইয়া পাইকপাড়ায় একত্রিত হয়ে তাঁদের বাহিনীসহ ২৫ জনের মতো মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে একটি নিয়মিত বাহিনী গড়ে তোলেন। ইতিমধ্যে তাঁরা সুবেদার আলী আকবরকে দিয়ে রামগঞ্জ থেকে একটি ডাকাত দলের নিকট থেকে এলএমজিসহ প্রচুর বুলেট হস্তগত করেন। এদিকে মিজানুর রহমান চৌধুরী, এম ওয়ালিউল্লাহ এমএনএ, রাজা মিয়া পাটোয়ারী, এডভোকেট আওয়াল, ডা. আবদুস সাত্তার, গোলাম মোরশেদ ফারুকি, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এ বি সিদ্দিক, সরকার রফিউদ্দিন (সানা আখন্দ) ও অনেক ছাত্রনেতা ভারতে চলে যান। এ সময় ফরিদগঞ্জে সংগ্রাম কমিটির সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধা ও নেতা-কর্মী মিলে ৩০০ লোকের খাবার ব্যবস্থা করতে রাতদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। তাঁরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে বাড়ি-বাড়ি গিয়ে চাল, ডাল, লবন, তেল, পেঁয়াজ, গরু-ছাগল, আটা, সবজি, নারিকেল, সুপারি, নগদ অর্থ ও পুকুরের মাছ সংগ্রহ করে এদের খাবারের ব্যবস্থা করেন।
এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় আমিনুল হক মাস্টার (স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা) ও আবুল খায়ের পাটোয়ারীর পরামর্শে জহিরুল হক পাঠান ও বি এম কলিমউল্যাহ ভূঁইয়াকে নিয়ে ফরিদগঞ্জে সংগ্রাম কমিটির একটি বৈঠক হয়। উদ্দেশ্য, ফরিদগঞ্জ গোডাউনে কি পরিমাণ খাবার মজুদ আছে সে বিষয়ে খোঁজ-খবর নেয়া। গোডাউনের একজন নির্ভরযোগ্য পাহারাদারের সূত্রে প্রচুর খাদ্য-শস্য মজুদের খবর পেয়ে রাতেই আড়াই হাজার থেকে ৩ হাজার মণ ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ৪-৫ খানা নৌকার ব্যবস্থা করা হয়। চতুর্দিকে ডিফেন্স দিয়ে ভোরে গোডাউন ভেঙ্গে চাল, ডাল, লবন, ধান, ডালডা, চিনি, ময়দা ও আটা সংগ্রহ করে নৌকা বোঝাই করা হয়। এসব খাদ্য-সামগ্রী নিয়ে গিয়ে নেতা-কর্মীরা দ্রুত তালিকা করে তা সাধারণ মানুষের বাড়িতে গোপনে মজুদ রেখে দেয়। নগদ অর্থের জন্য কিছু চাল ও ধান বাজারে বিক্রি করা হয়। অর্থ সংগ্রহের দায়িত্বে ছিলেন বি এম কলিমউল্যা ভূঁইয়া। তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল এবং সুবেদার রবের নেতৃত্বে অপর একটি দল রামগঞ্জ ব্যাংকে অভিযান চালান। অভিনব কায়দায় ব্যাংকের সকলকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে সব অর্থ এনে সংগ্রাম কমিটির এডভোকেট সিরাজুল ইসলাম পাটোয়ারীর কাছে জমা দেন। কিছু অর্থ সংগ্রাম কমিটির আবু জাফর মোহাম্মদ মঈনুদ্দিনের কাছে রেখে বি এম কলিমউল্যা ভূঁইয়া ও আবদুর রব কয়েকজন কর্মীসহ ভারতে চলে যান।
সুবেদার জহিরুল হক পাঠান ও বি এম কলিমউল্যা ভূঁইয়া দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত অত্যন্ত আস্থা ও সাহসিকতার সঙ্গে নৌকায়-নৌকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে থেকে স্বাধীনতার জন্য কাজ করেন। প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, প্রচার এবং যুদ্ধ পরিচালনা সংক্রান্ত বিষয়ে সংগ্রাম কমিটি বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়। কমিটি একটি মিনি পরিষদ গঠন করে মুক্তাঞ্চলে আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখে। এ পরিষদকে ৫টি ভাগে ভাগ করে দায়িত্ব বণ্টন করা হয়— ১. সাধারণ প্রশাসন ও সমন্বয়: দায়িত্বে ছিলেন আবদুল করিম পাটোয়ারী এমপিএ (থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি), ২. অর্থ ও খাদ্য বিষয়ক: দায়িত্বে ছিলেন এডভোকেট আবু জাফর মোহাম্মদ মঈনুদ্দিন, ৩. স্বরাষ্ট্র বিষয়ক: দায়িত্বে ছিলেন বি এম কলিমউল্যা ভূঁইয়া, ৪. প্রতিরক্ষা বিষয়ক: দায়িত্বে ছিলেন সুবেদার জহিরুল হক পাঠান এবং ৫. তথ্য ও যোগাযোগ: দায়িত্বে ছিলেন ন্যাপের জীবনকানাই চক্রবর্তী (তিনি একই সঙ্গে দফতর সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন)। দায়িত্ব বণ্টনের পর সুবেদার জহিরুল হক পাঠান ও বি এম কলিমউল্যা ভূঁইয়ার নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি একটি খসড়া দলিল তৈরি করে।
-সংগ্রাম কমিটি দ্বারা পরিচালিত সুবেদার জহিরুল হক পাঠানের নেতৃত্বাধীন বাহিনী এখানকার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে। এ বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন সুবেদার জহিরুল হক পাঠান নিজে এবং তাঁর সহকারী ছিলেন বি এম কলিমউল্যা ভূঁইয়া। এ বাহিনী চাঁদপুর, লাকসাম ও নোয়াখালীর ব্যাপক অংশ নিয়ন্ত্রণ করত। জহিরুল হক পাঠান তাঁর অধীনস্থ এলাকাকে ৬টি অঞ্চলে ভাগ করে ৬ জন সহকারী কমান্ডার নিয়োগ করেন। পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি প্লাটুনে ভাগ করে সহকারী কমান্ডারদের প্লাটুন কমান্ডার নিয়োগ দেন। ফরিদগঞ্জ থানা কমান্ডে ছিল ২টি প্লাটুন ও ৬ জন সেকশন কমান্ডার (অধিকাংশই ছিলেন বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য)। ১নং প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন নায়েক সুবেদার আবদুর রব এবং ২নং প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন হাবিলদার আবদুর রশিদ (কাসারা)। ফরিদগঞ্জ কমান্ডের হাতে ছিল ৪টি ব্রিটিশ এলএমজি, ২টি রাশিয়ান স্ট্যান্ডগান, ৬২টি রাইফেল ও কিছু হ্যান্ড গ্রেনেড।
রেগুলার বাহিনীর পাশাপাশি বিএলএফ ও এফএফ বাহিনীও ক্রমান্বয়ে উপজেলায় সংগঠিত হয়ে কমান্ড গঠন করে। ফরিদগঞ্জ থানার বিএলএফ কমান্ডার ছিলেন মো. হানিফ পাটোয়ারী (চাঁদপুর কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস ও ছাত্রলীগ নেতা) এবং ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন আবু তাহের পাটোয়ারী (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা, কড়ইতলী)। এঁরা ভারতের দেরাদুন থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে আগস্ট মাসে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। এঁদের অধীনে ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ৩০ জনের মতো সদস্য ছিলেন ফরিদগঞ্জ থানার এফএফ কমান্ডার ছিলেন মো. বেলায়েত হোসেন পাটোয়ারী (দায়চরা)। তাঁর অধীনে ছিলেন ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ৩টি প্লাটুনে ১৯৬ জনের মতো সদস্য। তাঁর প্লাটুন কমান্ডারগণ হলেন- আলী হোসেন ভূঁইয়া (খাজুরিয়া), আবুল হোসেন পাটোয়ারী (কড়ইতলী) ও মোবারক হোসেন পাটোয়ারী (খাজুরিয়া)।
ফরিদগঞ্জের আরো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা বিভিন্ন সেক্টরে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁরা হলেন- ৮নং সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল আবু ওসমান চৌধুরী (মদনেরগাঁও), কুমিল্লা জেলার এফএফ কমান্ডার খালেকুজামান ভূঁইয়া (বর্তমানে বাসদ নেতা, রূপসা) এবং সহকারী কমান্ডার আবদুল আজীজ, (সকদী রামপুর), চাঁদপুর মহকুমা এফএফ কমান্ডার খান মো. বেলায়েত হোসেন (চিরকাচাঁদপুর), নৌ-কমান্ডো দলের নেতা সাবমেরিনার আমিনুল্লাহ শেখ (পাইকপাড়া)। ঢাকা মহানগরের কমান্ডার আবদুল্লা হিল বাকি (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা) এবং তাঁর অধীনে প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন ইসমাইল হোসেন বেঙ্গল (ষোল্লাবাড়ি)।
২৬শে মার্চ মহকুমা সংগ্রাম কমিটির সরাসরি তত্ত্বাবধানে এ বি সিদ্দিকি সরকার এমপিএ-র নেতৃত্বে ইপিআর, নৌ, বিমান, পুলিশ, আনসার ও সেনাবাহিনীর সদস্যদের সমন্বয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল গঠন করা হয়। এ দলে প্রথম দিকে ছিলেন লেফটেন্যান্ট সিরাজুল আলম, সুবেদার আব্দুল করিম, সুবেদার লুৎফর রহমান (রামগঞ্জ), নায়েক সুবেদার নুর মোহাম্মদ গাজী, এম এ ওয়াদুদ (মতলব) প্রমুখ। কিন্তু পরবর্তীতে তাঁরা কেউ ভারতে, কেউ নিজ এলাকায় চলে যান। ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে বি এম কলিমউল্যা ভূঁইয়ার নেতৃত্বে একটি রেগুলার বাহিনী গঠিত হয়। এ বাহিনী কৌশলে হাজিগঞ্জ থানার ৬টি রাইফেল ও কিছু বুলেট সংগ্রহ করে বলাখাল ওয়ারলেসের কাছে এম্বুশ করে কয়েকজন পাকসেনাকে হত্যা করে প্রচুর বুলেট এবং ৩টি অস্ত্র সংগ্রহ করে। ৭ই মার্চের পর বি এম কলিমউল্যা ভূঁইয়া কাঠ দিয়ে রাইফেল বানিয়ে বৃহত্তর হাজিগঞ্জ থানার টোয়াগড়, বারিংপুর, নোটরা প্রভৃতি স্থানে ৬০ জনের মতো মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু করেন। ভূঁইয়া বাহিনী-র প্রথম হেডকোয়ার্টার্স ছিল ওঘারিয়া চৌধুরী বাড়িতে। পরে এ বাহিনীকে চেড়িয়ারকর মণ্ডল বাড়িতে স্থানান্তরিত করা হয়। বি এম কলিমউল্যা ভূঁইয়া দ্বিতীয়বার হাজীগঞ্জ থানা থেকে ১২টি অস্ত্র সংগ্রহ করেন। এছাড়া তিনি মতলব ও কচুয়া থানা থেকেও অস্ত্র এবং অর্থ সংগ্রহ করে মুক্তিবাহিনীর তহবিলে জমা দেন। সুবেদার জহিরুল হক পাঠানের নেতৃত্বে ফরিদগঞ্জে একটি বাহিনী গড়ে ওঠে যা পাঠান বাহিনী নামে পরিচিত। এ বাহিনীর নেতৃত্বে পাইকপাড়া, দয়াগঞ্জ ও ভাটিরগাঁওসহ কালিবাজার, রূপসা, খাজুরিয়া, বাজারা, ধানুয়া, বালিথুবা, চান্দ্রা, রায়পুর, আলগী, কাউনিয়া বাজার, মুন্সির হাট প্রভৃতি স্থানে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গড়ে ওঠে এবং এখান থেকে দলে-দলে ছাত্র-যুবকরা প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে গমন করে। প্রতিরোধ যুদ্ধের সূতিকাগার ছিল পাইকপাড়া। এখানেই পাঠান বাহিনীর সৃষ্টি হয়।
থানা থেকে সংগৃহীত অস্ত্র, ব্যক্তিগত বন্দুক এবং কিছু বোমাকে সম্বল করে ফরিদগঞ্জে প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। অবসরপ্রাপ্ত সামরিক বাহিনী, ইপিআর, নৌ-সেনা, বিমান বাহিনীর সদস্য, আনসার ও স্থানীয় সেচ্ছাসেবক বাহিনী দ্বারা একটি স্কোয়াড গঠন করা হয়। এর নেতৃত্বে ছিলেন সুবেদার করিম (কেরোয়ারচর)। হাজিগঞ্জের মিঠানিয়া ব্রিজের কাছে বি এম কলিমউল্যা ভূঁইয়ার নেতৃত্বে হাজীগঞ্জ, ফরিদগঞ্জ, চাঁদপুর ও কচুয়ার হাজার-হাজার জনতা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ৩০০ ফুটের মতো রাস্তা কেটে জমির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। উদ্দেশ্য ছিল কুমিল্লা থেকে অগ্রসরমাণ পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করা। সেদিন ফরিদগঞ্জের শতশত মানুষ এতে অংশগ্রহণ করে এবং মুন্সির হাট নদীর পাড়ে একটি সশস্ত্র গ্রুপ মোতায়েন করে পাহারার ব্যবস্থা করা হয়, যাতে পাকবাহিনী তাদের স্থানীয় দোসরদের সহায়তায় বলাখাল নদী পার হয়ে রামচন্দ্রপুর ও গল্লাক হয়ে ওয়াপদা বেড়িবাধে অবস্থান নিতে না পারে। সংগ্রাম কমিটির সহায়তায় ইচলী নদীর পাড়ে ফরিদগঞ্জের একটি গ্রুপ প্রস্তুত রাখা হয়। তাছাড়া রামগঞ্জের রায়পুর বর্ডারেও সড়ক অবরোধ করা হয়। জনতা বড়বড় গাছ কেটে রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। ইতিমধ্যে রামগঞ্জ থানার পালপাড়া গ্রামের সুবেদার আলী আকবর পাটোয়ারী তিনজন সিপাহিসহ সেনা ছাউনি থেকে পালিয়ে আসেন এবং ১টি এলএমজি, ৩টি রাইফেল ও ৩ বক্স রাইফেল-এর গুলি নিয়ে আসেন। এদিকে চাঁদপুরে পাকবাহিনীর প্রবেশপথে টেকনিক্যাল স্কুলের কাছে ব্রিজ ভেঙ্গে আর রাস্তা কেটে যে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়, সেখানেও ফরিদগঞ্জ উপজেলার মানুষ একটি গ্রুপের সঙ্গে দেশি অস্ত্র নিয়ে প্রতিরোধে অংশ নেয়। প্রতিরোধকারীরা পাকবাহিনীর ভারী অস্ত্রের কাছে টিকতে না পেরে পিছু হটতে বাধ্য হয়। পাকবাহিনী যেদিন এ উপজেলায় প্রবেশ করে, সেদিন প্রতিরোধকারীদের একটি দল ইচলী চৌ-রাস্তার কাছে তাদের ট্রাকের বহরে আক্রমণ করলে পাকবাহিনী তাৎক্ষণাৎ ট্রাক থেকে লাফিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে এবং ১০ মিনিট ধরে ব্যাপকভাবে গুলিবর্ষণ করে। প্রতিরোধ অতিক্রম করে তারা বাগাদী হয়ে ফরিদগঞ্জ আসে। এ সময় পাকবাহিনী রাস্তার আশপাশের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে। তাদের একটি গ্রুপ গ্রামের ভেতর দিয়ে চান্দ্রা বাজার চলে আসে।
২৩শে এপ্রিল পাকবাহিনী ফরিদগঞ্জে প্রবেশ করে ডাকবাংলো (নদীর পাড়) ও ওয়াপদা রেস্ট হাউজে অবস্থান নেয়। পরের দিন তারা ফরিদগঞ্জ হাইস্কুল মাঠে ক্যাম্প স্থাপন করে। রাতারাতি পরিখা খনন করে ফরিদগঞ্জের চতুর্দিকে নিজেদের অবস্থান মজবুত করে। পরের দিন পাকবাহিনী চতুরা, রূপসা রাস্তা, নদীর পাড় ও হাইস্কুলের ছাদে বালি ও কাদামাটি দিয়ে ভারী মেশিনগান নিয়ে অবস্থান নেয়।
ফরিদগঞ্জ উপজেলা পাকবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার পূর্বে পাকিস্তানপন্থী দলগুলোর নেতা-কর্মীরা চাঁদপুরসহ বিভিন্ন গ্রামে আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি বা নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেয়।
মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামী জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র সংঘ-এর সংগঠন এলাকায় থাকলেও সংগ্রাম কমিটির ভয়ে তারা নিষ্ক্রিয় ছিল। সংগ্রাম কমিটির লোকজন আলতাফ খাঁসহ কয়েকজন পাকিস্তানপন্থীকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করার কারণে তারা আতঙ্কে থাকে এবং লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যায়। পরে ২৩শে এপ্রিল ফরিদগঞ্জ পাকবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে গেলে তারা প্রকাশ্যে চলে আসে। এরপর একত্রিত হয়ে এই অপপ্রচার চালায় যে, আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি -ন্যাপ ইত্যাদি দলগুলো বিচ্ছিন্নতাবাদী ও ভারতের দালাল; তাদের উদ্দেশ্য পাকিস্তানকে হিন্দুস্তানের হাতে তুলে দেয়া। তাই ইসলামকে রক্ষা ও শান্তির জন্য পাকবাহিনীর সহায়তায় কমিটি গঠন করতে হবে। ফরিদগঞ্জ উপজেলায় কীভাবে ‘ইসলাম রক্ষা’ কমিটি গঠন করা যায় তা নিয়ে আলাপ-আলোচনার জন্য মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দ চাঁদপুর সালাম মোক্তারের বাসায় এক বৈঠকে মিলিত হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, ইসলাম রক্ষার জন্য পাকবাহিনীর সহায়তায় প্রতিটি গ্রাম, ওয়ার্ড, ইউনিয়ন ও থানায় শান্তি কমিটি গঠন করতে হবে; প্রতিটি ইউনিয়নে গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে কমিটি গঠন করে ‘ভারতের দালাল’ আওয়ামী লীগ ও ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’দের তালিকা তৈরি করতে হবে। অল্প কয়েক দিনের মধ্যে খলিল চেয়ারম্যান (গৃদকালিন্দিয়া, বর্তমানে নওগাঁয় বসবাসরত), ডা. ফয়েজ (কাচিয়াড়া), ছেলামত উল্যা ভূঁইয়া (কাচিয়াড়া), মাওলানা আজিজুল হক (কেরোয়ারচর), ছেলামত উল্যা পন্ডিত (কেরোয়ারচর), ছায়েদ কোম্পানী (ফরিদগঞ্জ), এলাহী বক্স বেপারী (কেরোয়ারচর) প্রমুখকে নিয়ে এবং স্থানীয় জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, পিডিপি- নেজামে ইসলামী ইত্যাদি পাকিস্তানপন্থী দলগুলোর সমন্বয়ে শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। শান্তি কমিটির অধীনে রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠন করা হয়। ফরিদগঞ্জের উল্লেখযোগ্য রাজাকাররা হলো- খলিল চেয়ারম্যান, তাফাজুল হোসেন ওরফে তাফু খলিফা (কেরোয়ারচর), মোখলেছুর রহমান (রাজাকার কমান্ডার ও জল্লাদ, বর্তমানে ব্যবসায়ী, কেরোয়ারচর), নুর মোহাম্মদ দরদী (কড়ইতলী), সামছু (বারপাইকা ফকির বাড়ি), ইব্রাহীম বরকন্দাজ, রহিম মাওলানা, আবদুল মান্নান, আবুল কালাম, মকবুল (আদশা), মোহাম্মদ সোলেমান, আব্দুস সাত্তার সোলাইমান (চরমথুয়া), আব্দুল গণি, বিল্লাল হোসেন, ডা. সালাম (গাজীপুর), হেলাল মিয়া, দুলাল মিয়া (বড়ালী), ফারুক হোসেন, মহসিন মিয়া, রফিক, শাহজাহান, মোহাম্মদ জামাল (মিরপুর), সোনাবান (ধানুয়া), দিদার উল্যা, আলী আকবর (ধানুয়া) প্রমুখ। পাকবাহিনীর হেডকোয়ার্টার্স ছিল ওয়াপদা রেস্টহাউজ এবং নদীর পাড়ে ডাকবাংলোয়। বারপাইকা ফকির বাড়ির শতকরা ৯৫ জন ছিল রাজাকার ও পাকবাহিনীর দোসর। কুখ্যাত রাজাকার সামছু কমান্ডার তার বাড়ি থেকে ২৫ জনকে রাজাকার বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে। কেরোয়ারচর গ্রাম থেকে বহু লোক রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয়। কেরোয়ারচর, আদশা অজিবাড়ি ও ষোলদানা হেজাবাড়ির অধিকাংশ লোকই ছিল দালাল, রাজাকার ও লুটেরা। এছাড়া রুস্তমপুর, লাউতলী, গৃদকালিন্দিয়া, মিরপুর, ধানুয়া, সোবহান, টুবগী, সকাদি, গল্লাক, রূপসা, কামতা, বাঁশারা, মুন্সিরহাট, রসুলপুর, গজারিয়া, কালিবাজার, রামপুরের চর প্রভৃতি গ্রাম থেকেও অনেকে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয়। মাদ্রাসার ছাত্র ও শিক্ষকদের অনেকেই আলবদর ও আলশামস বাহিনীতে যোগদান করে। রাজাকারদের মধ্যে বেশি তৎপর ছিল সামছু, তাফু খলিফা, নুর মোহাম্মদ দরজী ও মোখলেছ। এরা বহু মানুষকে হত্যা করে। হিন্দু সম্প্রদায়ের বহু বাড়িঘর ও দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ করে। এদের সহযোগিতায় পাকবাহিনী বহু মানুষকে হাইস্কুল ক্যাম্পে ধরে এনে নির্যাতন করে হত্যা করে। বিশেষ করে তারা রামগঞ্জ, কালিবাজার, রায়পুর ও রূপসা আসা-যাওয়ার পথে বহু যাত্রীকে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহ করে হত্যা করে। যাত্রীদের ধরে নিয়ে প্রথমে কালিমা পড়তে বলত, এরপর উলঙ্গ করে দেখত হিন্দু, না মুসলিম। পাকবাহিনী ও রাজাকাররা যুবতীদের ধরে নিয়ে তাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালাত। রাজাকাররা আওয়ামী লীগ, মুক্তিযোদ্ধা ও হিন্দুদের বাড়িঘরের আসবাবপত্র, টিনের চাল, ঘর, গরু-ছাগল ও গোলার ধান লুট করে নিয়ে যেত। ফরিদগঞ্জ উপজেলার মাছ বাজার নদীর পাড়ে বহু হিন্দু পরিবারের দোকানপাট ও সহায়-সম্বল রাজাকাররা লুট করে নিয়ে যায়। বহু বাসা-বাড়ি, দোকানপাট আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। আওয়ামী লীগ নেতা, সংগ্রাম কমিটির সদস্য ৬৫ বছর বয়স্ক দুর্গাপুরের আব্দুল মজিদ পাটোয়ারীর ওপর নির্মম নির্যাতন চালায়। ৫ই জুলাই পাকবাহিনী স্থানীয় দালালদের সহযোগিতায় তাকে বাড়ি থেকে ধরে থানায় এনে পিটিয়ে আধমরা করে এবং এরপর তাকে ছাদ থেকে ফেলে দিলে তিনি মারা যান। এটি আব্দুল মজিদ পাটোয়ারী হত্যাকাণ্ড নামে পরিচিত।
পাকবাহিনীর দোসর মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর নেতারা কিছু লোককে নিয়োগ দিয়েছিল ফরিদগঞ্জের বাজার ও গ্রাম-গঞ্জে মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী- সমর্থক এবং নারীদের অবস্থান খুঁজে বের করার জন্য। এরা অর্থের লোভে পড়ে নারীদের পাকবাহিনীর হাতে তুলে দিত। গজারিয়া খাঁ বাড়ির গাইনা ও গাজী বাড়ির লতিফ গাজী ছিল পাকবাহিনীর দোসর। এদের অধীনে ছিল একটি কুখ্যাত রাজাকার গ্রুপ। এরা ফরিদগঞ্জ দক্ষিণ ও পশ্চিম এবং নোয়াখালীর কিছু অংশে পাকহানাদার ও রাজাকারদের লেলিয়ে দেয়। লতিফ গাজী মজিদ পাটোয়ারীকে ধরিয়ে দেয়। গাইনার সহযোগিতায় গজারিয়ার সংগ্রাম কমিটির সদস্য কাজল খাঁর বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে দেয় এবং তার ৩ বছরের শিশু কন্যাকে জলন্ত অগ্নিতে নিক্ষেপ করে। রাজাকার লতিফ গাজী এক নারীকে ধরে পাকবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে যায়। হানাদাররা তাকে গণধর্ষণ করে। দুদিন পর সে কৌশলে ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আসে। কিন্তু ঘটনাটি জানাজানি হয়ে গেলে লোক-লজ্জার ভয়ে সে আত্মহত্যা করে। জুলাই মাসের শেষদিকে রাজাকাররা দত্রা বেপারী বাড়ি ও সরকার বাড়ি, খাজুরিয়া মোল্লা বাড়ি ও খাজুরিয়া বাজার এবং মুক্তিযোদ্ধা আলী হোসেন ভূঁইয়ার চৌচালা টিনের ঘর জ্বালিয়ে দেয়। পাকবাহিনীর তাণ্ডবে আলী হোসেন ভূঁইয়ার চাচা আবদুস সোবহান ভূঁইয়া হৃদযন্ত্রের ক্রীয়া বন্ধ হয়ে সঙ্গে- সঙ্গে মারা যান। পাকবাহিনী খাজুরিয়া মিজিবাড়ির ৭ জনকে গুলি করে হত্যা করে, যা মিজিবাড়ি গণহত্যা নামে পরিচিত। তারা ঘোলাবাড়ি, কড়ইতলী বাজার, গাজীপুর বাজার, সূত্রধরবাড়ি, পাঠানবাড়ি, পাইকপাড়া, কামতা বাজার, মুন্সির হাট ও ফরিদগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় হাট-বাজার ও বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয় এবং বহু মানুষকে নির্যাতন ও গুলি করে হত্যা করে।
রাজাকারদের মধ্যে কুখ্যাত ও সবচেয়ে অত্যাচারী ছিল সামছু, মোখলেছ, তাফু খলিফা, গাইনা ও লতিফ। এরা জল্লাদ হিসেবে পরিচিত ছিল। আগস্ট মাসের ২ তারিখ পাকবাহিনী কামালপুর পাটোয়ারী বাড়ি ও তার আশপাশের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে। তারা গ্রামে ঢুকে বাড়িঘরের আসবাবপত্র ও গরু-ছাগল লুট করে। কড়ইতলী গ্রামের দুজন হিন্দু নারীকে গুলি করে হত্যার পর আগুনে নিক্ষেপ করে। এ সময় জহিরুল হক পাঠান ও বি এম কলিমউল্যা ভূঁইয়া কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে সঙ্গে করে হুগলী পাটোয়ারী বাড়ির সিপাহি শহীদ ফারুকের বাড়িতে এক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে এসেছিলেন। পাকবাহিনীর কাছে এ খবর পৌছে গেলে সঙ্গে-সঙ্গে তারা কয়েকটি গাড়ি নিয়ে পাটোয়ারী বাড়ির দিকে অগ্রসর হয়। পথে তারা কামালপুর পাটোয়ারী বাড়ি ও আশপাশের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে। পাকবাহিনীর আগমনের খবর পেয়ে জহিরুল হক পাঠান ও বি এম কলিম উল্যা ভূঁইয়ার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের প্রতিরোধ করেন। ফলে পাকসেনারা সেখান থেকে ভাওয়াল হয়ে যাওয়ার পথে একজন রাজাকার ভাওয়াল গ্রামের বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিপাহি করিমের বাড়ি দেখিয়ে দেয়। সেখানে করিমকে না পেয়ে তারা তার সহোদর ভাই শহীদকে রাইফেল দিয়ে আঘাত করে। করিমের বৃদ্ধ বাবা সিদ্দিকুর রহমান ছেলেকে ছেড়ে দেয়ার জন্য অনুনয়-বিনয় করতে থাকলে পাকসেনারা তাকে রাস্তার পাশে খেজুর গাছের নিচে দাঁড় করিয়ে গুলি করে রাস্তায় ফেলে চলে যায় (সিপাহি করিম তখন জহিরুল হক পাঠান গ্রুপে যুদ্ধরত)। পাকসেনাদের সামনে যে-ই পড়তো তাকেই তারা ধরে প্রথমে নির্যাতন করত এবং তারপর কখনো তাদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ বহন করতে বাধ্য করত। অধিকাংশ সময় বেয়নট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে নদীতে ফেলে দিত।
২৯শে সেপ্টেম্বর পাকবাহিনী খুব ভোরে গাজীপুর বাজারের ১০-১২ খানা টিনের ঘর জ্বালিয়ে দেয় এবং কেরোয়ারচরের কিছু রাজাকার দোকানের আসবাবপত্র লুট করে নিয়ে যায়। তারা গাজীপুর পাঠানবাড়ি, দৈয়ালবাড়ি, মাঝিবাড়ি, তিনার বাড়ির বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। সেদিন পাকবাহিনীর গুলিতে মো. সোলাইমান পাঠান (গাজীপুর), দেবেন্দ্র সূত্রধর ও চাঁন খাঁ (কড়ইতলী), আনার খাঁ (রেঢ়িবাড়ি) ও উপাদিক গ্রামের দুজন কৃষক নিহত হয়।
ফরিদগঞ্জ উপজেলায় পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ছিল নদীর পাড়ের ডাকবাংলো, ফরিদগঞ্জ হাইস্কুল ও ওয়াপদা রেস্টহাউজ। ডাকবাংলোর নারিকেল গাছ এবং হাইস্কুল মাঠের পাশে কাঠাল গাছগুলো এখনো কালের সাক্ষী হয়ে আছে। পাকবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকাররা লোকজন ধরে এনে নির্যাতনের পর গাছে ঝুলিয়ে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারত। এরপর মৃতদেহগুলো নদীতে ফেলে দিত। গ্রাম থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী তরুণদের ডাকবাংলো-ফরিদগঞ্জ হাইস্কুল-রেস্টহাউস নির্যাতনকেন্দ্র-এ ধরে এনে অমানবিক নির্যাতন করত। নির্যাতনকেন্দ্রের পাশে নদীর পাড় ছিল পাকবাহিনীর বধ্যভূমি। তারা লোকজনদের নির্যাতন করে নদীর পাড়ে এনে হাত-পা-চোখ বেঁধে গুলি করে হত্যার পর নদীতে ফেলে দিত।
ফরিদগঞ্জে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়। ২৭শে এপ্রিল পাঠান বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা গাজীপুর বাজারের কাছে খাদ্য ও অস্ত্র বোঝাই পাকবাহিনীর একটি কার্গো লঞ্চে আক্রমণ করেন। এ অপারেশনে নেতৃত্ব দেন জহিরুল হক পাঠান এবং তাঁর সহযোগী বি এম কলিমউল্যা ভূঁইয়া। আধাঘণ্টা স্থায়ী এ-যুদ্ধে পাকবাহিনীর লঞ্চটি ডুবে যায় এবং চালকসহ ৭-৮ জন পাকসেনা নিহত হয়। গাজীপুর বাজার যুদ্ধ-এ বহু খাবার, ৪ পেটি হ্যান্ড গ্রেণেড ও প্রচুর গোলা-বারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। খাজুরিয়া বাজার সিংহবাড়ি গেটের সামনে প্রকাণ্ড একটি কড়াই গাছ ছিল। ২০শে জুলাই এ গাছের নীচে বসে পাকবাহিনী দুপুরের খাবার খাচ্ছিল। খবর পেয়ে পাঠান গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল তাদের তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে। পাকবাহিনী পজিশন নিয়ে পাল্টা আক্রমণ করে। উভয় পক্ষের মধ্যে ২০ মিনিট ধরে গুলি বিনিময় হয়। -খাজুরিয়া যুদ্ধ- এ কয়েকজন পাকসেনা আহত হয়। এরপর পাকবাহিনী দুই ভাগ হয়ে একটি গ্রুপ ওয়াপদা রাস্তা এবং অপর গ্রুপ গল্লাকের দিকে অগ্রসর হয়। গল্লাক বাজারে বি এম কলিমউল্যা ভূঁইয়ার গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তাদের তুমুল লড়াই হয়। গল্লাক যুদ্ধ-এ ৭-৮ জন পাকসেনা নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়। ২ ঘণ্টা যুদ্ধের পর পাকবাহিনী তাদের মৃত সেনাদের দেহগুলো নিয়ে লঞ্চে হাজিগঞ্জ ফিরে যায়।
২৯শে জুলাই শুক্রবার শাসিয়ালী মাদ্রাসাওয়ালা বাড়িতে (হাজী বাড়ি) পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। পাকবাহিনী ফেনী থেকে নোয়াখালী হয়ে ১৫-১৬টি নৌকায় শাসিয়ালীর দিকে আসতে থাকে। খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা এম্বুশ করেন। অতর্কিত মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে নৌকায় থাকা কয়েকজন পাকসেনা পানিতে পড়ে হাবুডুবু খেতে থাকে। পেছনের নৌকায় থাকা কিছু পাকসেনা পালতালুক রাস্তায় ওঠে একটানা গুলিবর্ষণ করতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারাও থেমে-থেমে গুলি করছিলেন। এখানে দীর্ঘক্ষণ যুদ্ধ হয়। শাসিয়ালী যুদ্ধ-এ ১৫-২০ জন পাকসেনা ও পুলিশ হতাহত হয়। এদিকে হানাদারদের একটি দল পায়ে হেঁটে কামালপুরের দিকে আসছিল। তখন তারা মুক্তিযোদ্ধা হাবিলদার রশিদ গ্রুপের এম্বুশে পড়ে। সেখানে উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড গোলাগুলি হয়। কামালপুর যুদ্ধে ৫-৬ জন পাকসেনা নিহত হয়। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে টিকতে না পেরে পাকবাহিনী মৃতদেহগুলো রাস্তার পাশে ধান খেতে রেখে শাসিয়ালী গ্রামের ভেতর ঢুকে পড়ে। সেখানেও উভয় পক্ষের মধ্যে এক ঘণ্টার মতো যুদ্ধ হয়। পাকবাহিনী সেখান থেকে পাটারী বাজারের কাছে পৌছলে জহিরুল হক পাঠান ও কলিমউল্যা ভূঁইয়ার নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে তাদের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। পাটারী বাজার যুদ্ধও ঘণ্টাখানেকের মতো স্থায়ী হয়। ৭-৮ জন পাকসেনা এ-যুদ্ধে নিহত হয়। পাকবাহিনীর অন্য একটি গ্রুপ পথ হারিয়ে কামালপুর ধোপাবাড়ির আখক্ষেতে ঢুকে পড়লে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ওপর আক্রমণ করেন। সেখানে ১৫ মিনিটের মতো তুমুল যুদ্ধ হয় এবং পাকবাহিনীর এ গ্রুপের সকল সদস্য নিহত হয়। কামালপুর যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা ল্যান্স নায়েক ফারুক শহীদ হন। এরপর থেমে-থেমে পাটারী বাজার, শাসিয়ালী ও কামালপুরে খণ্ডখণ্ড যুদ্ধ চলে। এসব যুদ্ধে ৪০ জনের মতো পাকসেনা নিহত ও বহু আহত হয়। আহত ও নিহতদের মৃতদেহ নিয়ে বাকি পাকসেনারা চাঁদপুর চলে যায়। ৫ই আগস্ট বৃহস্পতিবার খুব ভোরে কমান্ডার জহিরুল হক পাঠান বিভিন্ন অবস্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের এনে গল্পাক-বাঁশারা বিরাট এরিয়া নিয়ে এবং কলিমউল্যা ভূঁইয়া দুই প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে এম্বুশ করেন। পাকবাহিনী সকাল ৭টায় বাদারা বাজারে এসে ব্রাশ ফায়ার ও মর্টার শেলিং শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা গুলি চালান। উভয় পক্ষের মধ্যে ২ ঘণ্টার মতো গুলি বিনিময় হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের ত্রিমুখী আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পাকসেনারা পিছু হটে। বাদারা বাজার যুদ্ধ-এ ২ জন পাকসেনা নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হয়। এরপর তারা দ্রুত লঞ্চে করে হাজিগঞ্জ চলে যায়। ১০ই আগস্ট ভোরে ওটতলীতে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। ওটতলীর যুদ্ধ-এ ৩ জন পাকসেনা নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হয়। পরে পাকবাহিনী ওটতলী থেকে হাজিগঞ্জ হয়ে পাইকপাড়ার দিকে অগ্রসর হয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপ পাইকপাড়া এবং অন্য আর একটি গ্রুপ কড়ইতলীর পাইচাখালীতে অবস্থান নেয়। পাইকপাড়া হাইস্কুলের সামনে রাস্তার ওপর পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক গুলি বিনিময় হয়। দেড় ঘণ্টা স্থায়ী পাইকপাড়া যুদ্ধে ৪ জন পাকসেনা নিহত ও বহু আহত হয়। অতঃপর পাকবাহিনী পিছু হটে রূপসা হয়ে ফরিদগঞ্জ চলে যায়। যুদ্ধের পর জনতা একটি চাইনিজ রাইফেল ও কিছু বুলেট কুড়িয়ে পায়।
৩১শে আগস্ট রূপসা বাজার এবং রূপসা দীঘির দুইপাড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে ৫ জন পাকসেনা নিহত ও কয়েকজন আহত হয়। রূপসা যুদ্ধ-এ মুক্তিযোদ্ধা হারেছ ওস্তাদ আহত হন। এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা ২টি রাইফেল ও প্রচুর গুলি উদ্ধার করেন। ২৫শে সেপ্টেম্বর খুব ভোরে গাজীপুরে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের থেমে-থেমে কয়েক দফা প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। -গাজীপুর যুদ্ধ-এ ৩০-৩৫ জনের অধিক পাকসেনা নিহত ও বহু আহত হয়। এরপর তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। কয়েকজন সাধারণ মানুষ এ যুদ্ধে শহীদ হন। ১৮ই অক্টোবর খুব ভোরে পাকবাহিনী খাদ্য ও ঔষধ বোঝাই একটি লঞ্চ নিয়ে গাজীপুরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা তিনদিক থেকে লঞ্চটির ওপর আক্রমণ চালান। অবস্থা বেগতিক দেখে পাকবাহিনী ডান দিকে মোড় ঘুরে লঞ্চ নিয়ে দ্রুত সরে পড়ে। কয়েকজন পাকসেনা নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ধানুয়া হয়ে ফরিদগঞ্জ চলে যায়। ২৫শে অক্টোবর পাকবাহিনীর একটি গ্রুপ কিছু অস্ত্র ও গুলি নিয়ে বেশ কয়েকটি রিকশায় করে ধানুয়া হয়ে ফরিদগঞ্জের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ভাটিরগাঁও ব্রিজের গোড়ায় তাদের ওপর আক্রমণ করেন। পাকসেনারাও পাল্টা গুলি চালায়। গোলাগুলির এক পর্যায়ে পাকসেনারা পিছু হটে চাঁদপুর ফিরে যায়। ভাটিরগাঁও ব্রিজ যুদ্ধে বেশ কয়েকজন রিকশাচালক হতাহত হন। ১৭ই নভেম্বর বুধবার খুব ভোরে গাজীপুরে পুনরায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। পাকবাহিনীর খাদ্য বোঝাই একটি লঞ্চ গাজীপুরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে এ খবর পেয়ে পাঠান বাহিনীর দুই প্লাটুন এবং এফএফ ও বিএলএফ গ্রুপের সদস্যরা একত্রিত হয়ে আক্রমণের প্রস্তুতি নেন। পাকবাহিনীর লঞ্চটি গাজীপুর বটগাছ বরাবর আসার সঙ্গে-সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারা একযোগে আক্রমণ চালান। পাকবাহিনীও পাল্টা আক্রমণ করে। এখানে ২ ঘণ্টার মতো উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হয়। এযুদ্ধে বেশ কয়েকজন পাকসেনা ও রাজাকার নিহত হয়। খাদ্যবোঝাই লঞ্চটি ডুবে গেলেও মুক্তিযোদ্ধারা সেখান থেকে কিছু খাদ্য উদ্ধার করতে সক্ষম হন।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন— আমিন উল্লাহ শেখ, বীর বিক্রম (পিতা নোয়াব আলী শেখ, পাইকপাড়া), আব্দুস সবুর খান, বীর বিক্রম- (পিতা সুজাত আলী খান, চর রাঘবরা), এ বি মো. আব্দুল হাকিম, বীর প্রতীক- (পিতা সোনামিয়া পাটোয়ারী, মদনগাঁও), ল্যান্স নায়েক ফারুক আহমেদ পাটোয়ারী, বীর প্রতীক (পিতা সোনামিয়া পাটোয়ারী, হুগলি), কর্নেল অবসরপ্রাপ্ত মোহাম্মদ বজলুল গনি পাটোয়ারী, বীর প্রতীক- (পিতা আব্দুর রহিম পাটোয়ারী, মদনগাঁও)।
ফরিদগঞ্জ উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- ল্যান্স নায়েক ফারুক আহমেদ পাটোয়ারী, বীর প্রতীক (শাশিয়ালী এম্বুশে শহীদ), স্যাপার আবুল বাসার (পিতা মোবারক পাটোয়ারী, মদনগাঁও), হাবিলদার হাসমত উল্যা (পিতা মোহাম্মদ ফরমান আলী, রামদাসের বাগ), সিপাহি আবদুর রশিদ ওয়াকিম (পিতা আবু তাহের, উত্তর রাজাপুর), সিপাহি আবুল কালাম (পিতা সামসুল হক, বালিথুবা), সুবেদার নুরুল হক (পিতা আব্দুস সামাদ, বালিথুবা), নায়েক মঞ্জুর আহমেদ (পিতা মোহাম্মদ আব্দুল মতিন, সাহেবগঞ্জ), সিপাহি মোহাম্মদ মান্নান খান (পিতা আফাজউদ্দিন ভূঁইয়া, ষোলদানা), নায়েক নুরুল ইসলাম (পিতা মোহাম্মদ ইব্রাহীম খান, সুবিদপুর), নায়েক আলী আকবর (পিতা কলিমউল্যা মিজি, উত্তর নদোনা), হাবিলদার মো. ফজর আলী (পিতা আব্দুল গফুর দফাদার, পূর্ব কাওনিয়া), সিপাহি মো. আব্দুস সাত্তার ভূঁইয়া (পিতা আব্দুস সামাদ ভূঁইয়া, হোগলী), সিপাহি আবুল হাসেম (পিতা মুসলিম পাটোয়ারী, সুবিদপুর), সিপাহি এরশাদুর রহমান (পিতা আব্দুল মতিন মুন্সি, সকদী রামপুর), নায়েক সামছুল হক সাউদ (পিতা নুর বক্স সাউদ, ভাটিরগাঁও; বিমান বাহিনীর সদস্য), সার্জেন্ট মোহাম্মদ হেদায়েত উল্যা (পিতা রমজান আলী বেপারী, সকদিরামপুর, বাংলাদেশ রাইফেলস-এর সদস্য), হাবিলদার সৈয়দ আহমেদ (পিতা মুন্সী আলম উল্লা, সানকি সাইর), হাবিলদার সালামত উল্যা (পিতা আহম্মদ উল্যা পাটোয়ারী, কামালপুর), নায়েক আফসার উদ্দিন (পিতা রেহান উদ্দিন পাটোয়ারী, লাড়ুয়া), সিপাহি আনোয়ার উল্যা (পিতা মোস্তফা পাটোয়ারী,। রুস্তমপুর), সিপাহি ফজলুর রহমান (পিতা আব্দুর রশিদ, দেইঢ়র), হাবিলদার বেলায়েত হোসেন (পিতা মোহাম্মদ হাতেম মুন্সী, আষ্ট্রা), সিপাহি লুৎফর রহমান (পিতা মৌলভী খলিলুর রহমান, হাসা), সিপাহি দেলোয়ার হোসেন (পিতা নজির আহমেদ, হরিনা), সিপাহি আবুল কালাম (পিতা আক্তারুজ্জামান, বদরপুর), সিপাহি আবুল হোসেন (পিতা আব্দুল মতিন খান, মানিকরাজ), সিপাহি আলী আহম্মেদ পাটোয়ারী (পিতা চানসরি, উভারামপুর; পুলিশ বাহিনীর সদস্য), আনোয়ার হোসেন (পিতা ইউনুস আলী, সন্তোষপুর), মদন কৃষ্ণ সেন (পিতা জ্যাসাকে কৃষ্ণ সেন, গৃদকালিন্দিয়া), লুকাস ডি সিলভা (পিতা গুনভিন সিলভা, সাহেবগঞ্জ), মোহাম্মদ ফরিদউদ্দিন (পিতা আহম্মদ আলী, ভুলাচৌ), আব্দুল মান্নান (পিতা নুর মিয়া লাল, ডোমরা), আব্দুর রব পাটোয়ারী (পিতা জিন্নাত আলী, চর বড়ালী; আনসার সদস্য), আবু তাহের পাঠান (পিতা হাকিমউদ্দিন পাঠান, কাছিয়া পাড়া), আব্দুল মোতালেব (পিতা হেদায়েত উল্লাহ, সাহেবগঞ্জ), আবুল কালাম মোল্লা (পিতা আবদুর রব মোল্লা, বাঁশারা), সাঈন উদ্দিন খান (পিতা আলী আকবর খান, শোভান), জাবেদ আলী (পিতা মোবারক আলী, রূপসা), লাল মিয়া তালুকদার (পিতা কলিম মিয়া তালুকদার, শোভান), লোকমান মিয়া পাটোয়ারী (পিতা ছেলামত উল্যা পাটোয়ারী, সন্তোষপুর), পেয়ার আহমেদ (পিতা আলী বক্স মিয়া, ভাটিরগাঁও), আবুল হাসেম বেপারী (পিতা করিম বক্স বেপারী, লাড়ুয়া; পুলিশ সদস্য), আব্দুর রশিদ খান (পিতা ইসলাম বক্স খান, গৃদকালিন্দিয়া), ক্বারী মোহাম্মদ সোলেমান পাঠান (গাজীপুর), দেবেন্দ্র সূত্রধর (গাজীপুর হুতারবাড়ি), চাঁন খাঁ (কড়ইতলী, মসজিদ বাড়ি), আনার খান (গাজীপুর নেভি বাড়ি), আব্দুর রশিদ রাঢ়ি (উপাদিক), মো. সিদ্দিকুর রহমান (ভাওয়াল, পাইকপাড়া), আয়ুব আলী (কাসারা), হাবিব উল্যা ভূঁইয়া (পিতা হাসমত উল্যা ভূঁইয়া, কাউনিয়া), মো. আনোয়ার হোসেন (পিতা মক্রম দর্জি, দায়নরা), মো. মফিজুল হক (পিতা আবদুল জব্বার, কাসারা), মো. মঈন উদ্দিন খান (পিতা আলী আকবর খান, শোভান), আবদুল খালেক (পিতা নাছির উদ্দিন খান, ধানুয়া), আবদুল মজিদ পাটোয়ারী (কালির বাজার, হর্ণিদুর্গাপুর) এবং আব্দুল খালেক (পিতা নোয়াব আলী পাটোয়ারী, দায়চরা)।
শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে ফরিদগঞ্জ উপজেলা সদরে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হাবিব উল্যা ভূঁইয়ার নামে ভূঁইয়া বাড়ির সামনে একটি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। [মো. দেলোয়ার হোসেন খান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!