মনিরামপুর উপজেলায় স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ বাহিনী ফজলু বাহিনী (মনিরামপুর, যশোর)
ফজলু বাহিনী (মনিরামপুর, যশোর) মনিরামপুর উপজেলায় স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বিশেষ বাহিনী। এর নেতৃত্বে ছিলেন মনিরামপুর উপজেলার ঝাঁপা গ্রামের বাসিন্দা পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ফজলুল হক। ছাত্রজীবনে বামপন্থী রাজনীতির সমর্থক ফজলুল হক শিক্ষাজীবন শেষে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে যোগ দেন। ৭১-এর ২৫শে মার্চ পাকবাহিনী এদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে তিনি এপ্রিল মাসে নৈমিত্তিক ছুটি নিয়ে দেশে এসে আর কর্মস্থলে ফিরে যাননি। এরপর তিনি দেশমাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করতে মে মাসে নিজ এলাকায় একটি গেরিলা ইউনিট গঠন করেন, যা ফজলু বাহিনী নামে পরিচিত।
ফজলুল হক পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ঢাকা বিমান বন্দরে নামলে সেখানে নিয়োজিত পাকিস্তান সরকারের অনুগত নিরাপত্তা কর্মীরা তাঁকে জানিয়ে দেন যে, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া তারা তাঁকে যেতে দেবে না। এরপর তারা ফজলুল হকের লাগেজ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে তাঁকে বসিয়ে রেখে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে যায়। পরিণতি বুঝতে পেরে ফজলুল হক লাগেজ রেখেই কৌশলে সেখান থেকে পালিয়ে এসে নিজ এলাকা মনিরামপুরের ঝাঁপা গ্রামে গেরিলা ইউনিট গঠন করেন। পরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে তিনি সেখানে দায়িত্বরত ৮নং সেক্টরের প্রতিষ্ঠাতা ও সেক্টর কমান্ডার মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচলিত যুদ্ধ প্রস্তুতির প্রশিক্ষণ দেখে তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তাই তিনি দেশে ফিরে এসে নিজেই গেরিলা যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন।
ফজলু বাহিনীতে প্রথমে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও বামপন্থী দলের নেতা-কর্মীরা যোগ দেন। পরে অন্য এলাকার লোকজনও এর সঙ্গে যুক্ত হন। এ বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল কয়েক শত। ফজলুল হকের নেতৃত্বে তাঁর বাহিনী পাকবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকারদের তটস্থ করে তোলে। তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা মনিরামপুর, ঝিকরগাছা, শার্শা, কেশবপুর এবং কলারোয়া অঞ্চলে যুদ্ধ করেন। তিনি এ অঞ্চলের সাব-সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। প্রতিটি যুদ্ধে তাঁর বাহিনী দুঃসাহসী ভুমিকা রাখে। ২০শে আগস্ট ডুমুরখালি গ্রামে এক বীরত্বপূর্ণ অভিযান চালিয়ে এ বাহিনীর গেরিলারা ২১ জন পাকসেনাকে হত্যা করেন। এ বাহিনীকে ধ্বংস করার জন্য পাকবাহিনী দুটি মারাত্মক অভিযান পরিচালনা করে। এর একটিতে বাহিনী প্রধান ফজলু নিহত হয়েছে বলে হানাদাররা প্রচার করে, যদিও তা ছিল অসত্য। তবে ঐ দুটি অভিযানে ৪ জন গেরিলা শহীদ হন। অন্যদিকে ১০ জন হানাদার নিহত হয়। ফজলু বাহিনীর উল্লেখযোগ্য কয়েকজন সদস্য হলেন- মতিয়ার রহমান (রামপুর), আবুল কালাম আজাদ (খানপুর), আবুল হোসেন (খালিয়া), কলিম উদ্দিন মুন্সি (রোহিতা), আব্দুল খালেক (মঙ্গলকোর্ট), আব্দুস সামাদ (হানুয়ার), মোশাররফ হোসেন খান (গৌরিপুর), আবুল কাশেম, আব্দুল হান্নান, গাজি আব্দুল হামিদ (পোড়াডাঙ্গা), শওকত আকবর ও মশিউর রহমান (ব্রাহ্মণডাঙ্গা), সুবাস চন্দ্র (কেশবপুর), আনিসুর রহমান, আব্দুস সামাদ ও ইকবাল হোসেন (মল্লিকপুর), হাতেম আলী (ডুমুরখালি), জালালউদ্দিন ও ক্যাপ্টেন সফিকউল্লাহ (ঝাঁপা)। স্বাধীনতার পর ফজলুল হক বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে যোগ দেন এবং চাকরির মেয়াদ শেষে অবসরে যান। [আমিনুর রহমান মামুন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড