You dont have javascript enabled! Please enable it! শহীদ বুদ্ধিজীবী ফজলে রাব্বী - সংগ্রামের নোটবুক

শহীদ বুদ্ধিজীবী ফজলে রাব্বী

ফজলে রাব্বী (১৯৩২-১৯৭১) শহীদ বুদ্ধিজীবী, ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিসিনের অধ্যাপক, স্বনামধন্য চিকিৎসক ও চিকিৎসা বিজ্ঞানী এবং ৭১-এর ১৫ই ডিসেম্বর রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে রাজাকার আলবদর বাহিনীর হাতে নৃশংস হত্যার শিকার।
১৯৩২ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর পাবনা জেলার হেমায়েতপুর উপজেলার ছাতিয়ানি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আফসার উদ্দিন আহমেদ এবং মাতার নাম সুফিয়া খাতুন। ৪ ভাই ও ৪ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। তিনি সম্মিলিত মেধা তালিকায় স্থান অধিকার করে ১৯৪৮ সালে পাবনা জেলা স্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৫০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ১৯৫৫ সালে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। পরীক্ষায় কৃতিত্বের জন্য তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বর্ণপদক লাভ করেন। তিনি লন্ডনের এডিনবরা রয়েল কলেজ অব ফিজিসিয়ানস থেকে ১৯৬০ সালে এমআরসিপি (কার্ডিওলজি) এবং ১৯৬২ সালে এমআরসিপি (ইন্টারনাল মেডিসিন) ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৬৩ সালে দেশে ফিরে ডা. ফজলে রাব্বী ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি এ বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। একজন স্বনামধন্য চিকিৎসা বিজ্ঞানী হিসেবে প্রফেসর ডা. ফজলে রাব্বীর একাধিক গবেষণা পত্র ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল এবং ল্যান্সেট-এ প্রকাশিত হয়। মাত্র ৩০ বছর বয়সে দুটি বিষয়ে এমআরসিপি ডিগ্রি অর্জন এবং ৩৬ বছর বয়সে মেডিকেল কলেজে অধ্যাপক হওয়া এ দুটি রেকর্ডই তিনি অর্জন করেন। শুধু ভালো ছাত্র, স্বনামধন্য চিকৎসক বা ভালো শিক্ষকই নন, একজন ভালো মানুষ হিসেবেও ইতোমধ্যে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৯৭০ সালে তিনি Pakistan best Professor award-এর জন্য মনোনীত হন। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের শোষণের প্রতিবাদে এ পুরস্কার গ্রহণে তিনি অস্বীকৃতি জানান।
ডা. ফজলে রাব্বী ঢাকা মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নকালে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ৫২-র ভাষা- আন্দোলন-এ তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। চাকরিরত অবস্থায়ও সব ধরনের প্রগতিশীল কর্মকাণ্ডে তাঁর ভূমিকা ছিল। মার্চের অসহযোগ আন্দোলন-এর সময় তিনি সহকর্মীদের নিয়ে রাজপথে নেমেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালে ঢাকা মেডিকেলের চিকিৎসক হিসেবে তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষার্থী ও নির্যাতনের শিকার নারীদের গোপনে প্রয়োজনীয় অর্থ সাহায্য করতেন এবং আহতদের ওষুধ ও চিকিৎসা সেবা দিতেন। অনেককে সীমান্ত পাড় হতে সহায়তা করেন। তাঁর বাসায় মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকেরই আসা-যাওয়া ছিল। তিনি বুঝতেন, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকারআলবদরদের নজরে তিনি রয়েছেন। তারপরও বিপদের আশঙ্কা তুচ্ছ করে তিনি অসীম সাহসিকতার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তৎপরতা চালিয়ে যান। এ-সময় তিনি সিদ্ধেশ্বরী রোডের ৭৫নং বাড়ি ‘জলপাইগুড়ি হাউজে’ থাকতেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের আগের দিন ১৫ই ডিসেম্বর বিকেল ৪টায় একটি সাদা মাইক্রোবাস ও একটি জিপে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্য, রাজাকার ও আলবদর তাঁর বাসা ঘিরে ফেলে। তারা ক্যান্টনমেন্টে রোগী দেখতে যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে ড. ফজলে
রাব্বিকে তুলে নিয়ে যায়। তারা এদিন রাত ৩টায় মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং কলেজ থেকে গাড়িতে রায়ের বাজারের বধ্যভূমিতে নিয়ে তাঁকে চোখ ও হাত বেঁধে অত্যন্ত নির্মমভাবে হত্যা করে। ১৮ই ডিসেম্বর তাঁর মৃতদেহ এক আত্মীয় খুঁজে পান। আজিমপুর নতুন করবস্থানে তাঁর লাশ সমাহিত করা হয়।
ডা. ফজলে রাব্বী ১৯৫৭ সালে তাঁর এক সহপাঠীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর স্ত্রীর নাম ডা. জাহান আরা রাব্বী। এ দম্পতির ১ পুত্র ও ২ কন্যা সন্তান রয়েছে। এ শহীদের নামে ঢাকা মেডিকেল কলেজের একটি ছাত্রাবাসের নামকরণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার তাঁর স্মরণে স্মারক ডাকটিকেট প্রকাশ করেছে। [মনিরুজ্জামান শাহীন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড