You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে ফটিকছড়ি উপজেলা (চট্টগ্রাম)

ফটিকছড়ি উপজেলা (চট্টগ্রাম) দেশের বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছে। ১৯৬২ সালে এ এম এম শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে এখানে শিক্ষা আন্দোলন হয়েছে। চট্টগ্রাম শহরের নিকটবর্তী হওয়ায় ‘৬৬ থেকে ‘৭১ সাল পর্যন্ত এখানে প্রতিটি আন্দোলনের কর্মসূচি পালিত হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচন-পরবর্তী আন্দোলন-সংগ্রামে ফটিকছড়ির মানুষ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর এখানে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এর আহ্বায়ক ছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি মীর্জা আবু মনসুর এমপিএ এবং সম্পাদক জহুরুল হক। এর পাশাপাশি আরো একটি পরিষদ গঠিত হয়, যার আহ্বায়ক ছিলেন বাদশা আলম বিএ (দৌলতপুর ইউনিয়ন), যুগ্ম আহবায়ক ছালে আহমদ চৌধুরী (রোসাংগিরি ইউনিয়ন), সদস্য আফতাব উদ্দিন চৌধুরী (পাইন্দং ইউনিয়ন), জয়নাল আবেদীন (সুন্দরপুর ইউনিয়ন, স্বেচ্ছাসেবক লীগ), এ এম এম শহীদুল্লাহ (দৌলতপুর ইউনিয়ন, মোজাফ্ফর ন্যাপ), সৈয়দ আবুল হোসেন (মাইজভাণ্ডার, মোজাফ্ফর ন্যাপ), এডভোকেট রফিকুল আনোয়ার চৌধুরী (ধর্মপুর ইউনিয়ন), মাস্টার ইউসুফ (বক্তপুর), হারেছ আহমদ চৌধুরী (নারায়ণহাট ইউনিয়ন), ইছাক মেম্বার (সুন্দরপুর ইউনিয়ন), নূরুল আলম আজাদ (ভূজপুর ইউনিয়ন), আখতারুজ্জামান ইউনুছ (দৌলতপুর ইউনিয়ন), শেখ আবদুল রশিদ মাস্টার, বজল আহমদ সওদাগর (সুন্দরপুর, মোজাফ্ফর ন্যাপ), আবদুল মান্নান চৌধুরী ও আবদুল ওয়াহাব মাস্টার (জাফতনগর ইউনিয়ন), আবু তাহের মাস্টার (সুন্দরপুর ইউনিয়ন), কবির আহমদ সওদাগর (ভূজপুর ইউনিয়ন), ননী গোপাল দে (হারুয়ালছড়ি ইউনিয়ন), মোজাহেরুল আলম চৌধুরী (হারুয়ালছড়ি ইউনিয়ন), এডভোকেট মোহাম্মদ লোকমান (রোসাংগিরি ইউনিয়ন), নূরুল ইসলাম তালুকদার (সুয়াবিল ইউনিয়ন), ওমর সিদ্দিকী (নানুপুর ইউনিয়ন), আফছার আহমদ চৌধুরী (ধুরং ইউনিয়ন), সরওয়ার কামাল (রাঙ্গামাটিয়া ইউনিয়ন), ফজল বারী সিদ্দিকী (নানুপুর), পরিতোষ পাল (ধুরং), এস এম ফারুক (রোসাংগিরি), মাস্টার ইসমাইল ভাণ্ডারী প্রমুখ। এছাড়া ছাত্র সংগ্রাম পরিষদও গঠিত হয়। এর নেতারা হলেন আনোয়ারুল আজিম (২ছাত্রলীগ- সভাপতি), আলমগীর চৌধুরী (ছাত্র ইউনিয়ন–মতিয়া সভাপতি), খায়রুল বশর চৌধুরী প্রমুখ। এরপর স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলে তার আহ্বায়ক হন আনোয়ারুল আজিম।
ফটিকছড়ি উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরা হলেন— নানুপুর ইউনিয়ন: সৈয়দ দেলোয়ার হোসেন মাইজভাণ্ডারী, শাহজাদা ডা. সৈয়দ দিদারুল হক, মীর্জা আবু আহমদ, ডা. মাহবুবুল আলম, শাহজাদা সদরউল্লাহ, গুরা মিয়া চৌধুরী, ওমর সিদ্দিকী, দেলোয়ার হোসেন চৌধুরী, নাসির মাস্টার; বক্তপুর ইউনিয়ন: শেখ আলমগীর, শেখ মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর, মাস্টার ইউছুপ; পাইন্দং ইউনিয়ন: তাজুল ইসলাম, ইদ্রিছ মিয়া, আবুল বশর তালুকদার; সুয়াবিল ইউনিয়ন: নূরুল ইসলাম তালুকদার, সুজাউদ্দৌলা, কাজী নূরুল ইসলাম; ভূজপুর ইউনিয়ন: নূরুল আলম আজাদ, আবদুল আউয়াল, কবির আহমদ সওদাগর, আহমদ ছফা চৌধুরী মাস্টার, ফজল আহমদ সওদাগর; নারায়ণহাট ইউনিয়ন: আমীন সত্তার, হাবিবুর রহমান সিকদার, আলী আহমদ কবিরাজ; ধর্মপুর ইউনিয়ন: বকিয়তউল্লাহ, আবদুল মান্নান চৌধুরী-১, আবদুল ওয়াহাব চৌধুরী, আবদুল মান্নান চৌধুরী-২; রোসাংগিরি ইউনিয়ন: ফ্লাইট সার্জন দবির আহমদ, জেবল মেম্বার, দেলা মিয়া মেম্বার, হুমায়ুন কবির চৌধুরী, শহীদুল আলম চৌধুরী; রাঙ্গামাটিয়া ইউনিয়ন: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, কামাল পাশা, নেজাম পাশা, শামসুল আলম চৌধুরী; সুন্দরপুর ইউনিয়ন: হাজী বজল আহমদ সওদাগর, ইছহাক মেম্বার, নজরুল ইসলাম চৌধুরী, নূর হোসেন, জয়নাল আবেদীন, জামাল আহমদ সিকদার; কাঞ্চনপুর ইউনিয়ন: নজরুল ইসলাম কাঞ্চন, ইলিয়াছ চৌধুরী, এনায়েতুল হক; দাঁতমারা ইউনিয়ন: আবু তালেব চৌধুরী কাঞ্চন, আবদুল মালেক চৌধুরী, হাজী এস এম ইউছুফ, আবুল বশর মাস্টার; হারুয়ালছড়ি ইউনিয়ন: আবুল বশর চৌধুরী, মৌলভী কবির আহমদ, মজহারুল আলম চৌধুরী; দৌলতপুর ইউনিয়ন: আবদুস সত্তার, আনসার কমান্ডার, মনির আহমদ, আকতার কামাল, ইলিয়াছ মানিক, আবা মিয়া মাস্টার, এ এস এম সহিদউল্লাহ; ধুরং ইউনিয়ন: মাস্টার ইউসুফ আহমদ চৌধুরী, মওলানা মো. ইউসুফ, জাকির আহমদ সওদাগর, মাস্টার ইসমাইল ভাণ্ডারী; লেলাং ইউনিয়ন: এস এম হোসেন চৌধুরী, সেরখান (কালু), আয়ুব আলী চৌধুরী এবং আবদুল মান্নান।
১৯৭১ সালের ২রা মার্চ থেকে শুরু হওয়া অসহযোগ আন্দোলন- বাঙালিদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রত করে এবং বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর তারা মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। ফটিকছড়ি উপজেলার জনগণও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নেয় এবং তাদের প্রশিক্ষণের জন্য ধর্মপুর স্কুল-সংলগ্ন মাঠে একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র খোলা হয়। এখানে শতশত যুবক প্রাথমিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। সেনাবাহিনীর প্রাক্তন সদস্য বশর ছিলেন ট্রেনিং কমান্ডার। পরে তাঁরা উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যান। হাটহাজারীর ফতেপুরের বাসিন্দা হাফিজ কামাল উদ্দিন থাকতেন ফটিকছড়ির জাফতনগরে। তিনি ধর্মপুর ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক আবদুল ওয়াহাব চৌধুরীর সংস্পর্শে এসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতে প্রশিক্ষণ নিতে যাওয়া এবং সেখান থেকে দেশে ফিরে আসার ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেন। তিনি জাফতনগর থেকে মুক্তিযুদ্ধে গমনেচ্ছু ৪টি দলকে ভারতের সাবরুমে পৌছান এবং সেখান থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ৪টি দলকে ফটিকছড়ির বিভিন্ন এলাকায় পৌছে দেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় এ উপজেলায় যাঁরা কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন, তাঁরা হলেন- জোনাল কমান্ডার মীর্জা আবু মনসুর এমপিএ, থানা বিএলএফ কমান্ডার আনোয়ারুল আজিম, ডেপুটি কমান্ডার সৈয়দ সরফুল হাসনাইন, থানা এফএফ – কমান্ডার আবদুল হালিম সিইনসি; গ্রুপ কমান্ডার- এফএফ: নূরুল গণি (ছোট, বক্তপুর), নূরুল গণি (বড়, বক্তপুর), আহমদ ছফা (বাবুনগর, পরে শহীদ), গৌরী শঙ্কর চৌধুরী, ভারতচন্দ্র বড়ুয়া (জাফতনগর), শেখ আবু আহমদ, নূর উদ্দিন খালেদ বাবু (রোসাংগিরি), নেছারুল হক (গাপালঘাট্টা, চারালিয়াহাট), নূর আহমদ (পাইন্দং), আমীর হোসেন (বাগান বাজার), জানে আলম, আমিনুল হক, তপন দত্ত (বারমাসিয়া), শফিউল আলম (৬নং ইউনিয়ন, পাইন্দং), জহুরুল হক, আমজাদ সত্তার (নারায়ণহাট), আবু তাহের (কাঞ্চনপুর ইউনিয়ন), আলমগীর চৌধুরী (৮নং ইউনিয়ন, রাঙ্গামাটিয়া), ছৈয়দ সাইফুল হাসনাইন (ছৈয়দপুর, নানুপুর), মো. সোলায়মান (বক্তপুর), আকতার উদ্দিন (নানুপুর), সাম্ভন্দী প্রসাদ বড়ুয়া (আবদুল্লাপুর ইউনিয়ন), মো. ইছহাক (আমতলী, চারালিয়াহাট), নাছির উদ্দিন আলমগীর (নানুপুর), নজরুল ইসলাম (ফরহাদাবাদ), মো. ছরওয়ার কামাল (পাইন্দং), বদিউল আলম (সমিতির হাট), জয়নাল আবেদীন চৌধুরী মিন্টু (ফটিকা), আবু বক্কর চৌধুরী (পাইন্দং), মোহাম্মদ খালেদ (লেলাং), রফিকউদ্দিন আহমদ সিদ্দিকী, সৈয়দ আখতার বিএলএফ: আমান উল্লাহ চৌধুরী (৬নং ইউনিয়ন, পাইন্দং), এস এম শাহনেওয়াজ এবং মাঈনুদ্দিন।
বিএলএফ থানা কমান্ডার আনোয়ারুল আজিমের নেতৃত্বে ছিলেন সৈয়দ সরফুল হাসনাইন (ডেপুটি কমান্ডার), আবদুল কাদের চৌধুরী, রফিকুল ইসলাম, মো. ইলিয়াস, মীর আহমদ, আবু আহমদ, রণধীর দাশ, জহুরুল হক, বাবু, বাবুল সেন, জানে আলম, আহমদ ছফা, আবদুল মাবুদ, শামসুল আলম, নূরুল গণি, ইদ্রিস, হাশেম, আহমদুর রহমান সিদ্দিকী, হাবিবুর রহমান, শওকত, শাহনেওয়াজ, আনোয়ার হোসেন, মো. ইউসুফ, মাঈনুদ্দিন, মো. খালেদ, মো. মুছা ওরফে শুক্কুর, দিদারুল আলম প্রমুখ।
এফএফ গ্রুপ কমান্ডার মো. নূরুল গণির নেতৃত্বে ছিলেন সৈয়দ জালালউদ্দিন (ডেপুটি কমান্ডার), ফজলুল কাদের বাঙালি, আফসারউদ্দিন আহমদ, ওসমান গণি, আলতাফ হোসেন, চাঁদু বড়ুয়া, নায়েক সুবেদার সৈয়দ শামসুল আলম, হাবিলদার আবদুল মালেক, হাবিলদার আবদুল মোনাফ, আবদুস সালাম, নুরুল আলম, আবু তাহের, আনোয়ার হোসেন, তহীদুল আলম, শাহনেওয়াজ চৌধুরী, মো. শফি, হেলালউদ্দিন আহমদ, মো. জহুরুল ইসলাম, মো. হারুন, তোফায়েল আহমদ, আলী আকবর, রফিকুল আলম, আবদুস শুক্কুর, নুর মিয়া, মাজহারুল ইসলাম, ফজলুল হক, দবির আহমদ, মুছা আহমদ, আমির হোসেন, আবু আহমদ, বাদশা মিয়া, মো. জাকারিয়া, আবদুল মাবুদ, আবদুল খালেক, আবদুস সালামসহ মোট ৪৪ জন।
এফএফ গ্রুপ কমান্ডার আহমদ ছফার নেতৃত্বে ছিলেন ডা. শহীদুল আনোয়ার (ডেপুটি কমান্ডার)সহ ২৬ জন। এ গ্রুপটি দেশে ফেরার দুদিন পর শহীদুল আনোয়ার দল ত্যাগ করে নিজ বাড়িতে চলে যান এবং বাবুনগর মাদ্রাসার আলবদর আলশামস ক্যাম্পে অপারেশনের পর আহমদ ছফা নিরুদ্দেশ হয়ে যান। এরপর গ্রুপের দায়িত্ব দেয়া হয় গৌরী শঙ্কর চৌধুরীকে। তাঁর নেতৃত্বে ছিলেন মীর আহমদ (সুয়াবিল), মোহাম্মদ ইলিয়াছ (শাহনগর), রণধীর দাশ (কাঞ্চননগর), একরামুল হক, সৈয়দ আলমগীর (নানুপুর) বোরহান উদ্দিন (পাইন্দং), আবু তাহের (সুয়াবিল), এডভোকেট আহমদ ছফা (রোসাংগিরি), রমজান আলী-১, রমজান আলী-২, দিদারুল আলম, আলতাফ হোসেন, সেলিম চৌধুরী, ওসমান খান, শের খান, আবু তাহের (ওহারা), আলাউদ্দিন, কাদের চৌধুরী, শাহ আলম, নূর ছফা, মহিউদ্দিন, আশরাফউদ্দৌলা শহীদ (নানুপুর), পরাণ হরি, সাধন শীল, মধুসূদন দাশ, আবু আহমদ, দুলু (কাঞ্চননগর), মোহাম্মদ আলী (রোসাংগিরি) প্রমুখ। এ গ্রুপটি খিরাম পাহাড়ে অবস্থান নিয়ে ফটিকছড়ি থানা অপারেশন ও নাজিরহাট যুদ্ধে যৌথ কমান্ডে অংশগ্রহণ ছাড়াও মীর্জা আবু মনসুরের সঙ্গে বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নেয়।
এফএফ গ্রুপ কমান্ডার আমানুল্লাহর নেতৃত্বে অন্যান্যরা ছিলেন আলমগীর (ডেপুটি কমান্ডার), আহমদ ছফা-১, রফিক, গিয়াসউদ্দিন-১, গিয়াসউদ্দিন-২, এমদাদ, মাহবুব, শফি, আহমদ ছফা-২ নেপাল প্রমুখ। ফটিকছড়িতে আসার পর এ গ্রুপের কমান্ডে যুক্ত হন সিইসি আবদুল হালিম।
এফএফ গ্রুপ কমান্ডার শেখ আবু আহমদের নেতৃত্বে অন্যন্যরা ছিলেন বাবুল সেন (রোসাংগিরি), বাবুল বড়ুয়া (নানুপুর), নুরুল আনোয়ার (ধর্মপুর), সুনীল বড়ুয়া (পাইন্দং), তৈয়ব (বক্তপুর) প্রমুখ।
এফএফ গ্রুপ কমান্ডার তপন দত্তের নেতৃত্বে অন্য যাঁরা ছিলেন তাঁরা হলেন- অধ্যাপক অমর নন্দী (ডেপুটি কমান্ডার), আবুল ফজল মাইজভাণ্ডারী, সফিউল আলম, নেপাল বড়ুয়া, খোরশেদুল আলম, নাথুরাম বড়ুয়া, নরেশ বড়ুয়া, অনুজ কুমার দে, নাফু চক্রবর্তী, ধীলন ধর, কাজল দে, আবদুল গণি, প্রকাশ বড়ুয়া, আবদুল বারী, ফসিউদ্দোল্লাসহ ২৫ জন। এফএফ গ্রুপ কমান্ডার বদিউল আলমের নেতৃত্বে ছিলেন আমিনুল হক (ডেপুটি কমান্ডার), মো. ইসহাক, নুরুস ছফা, মাহবুবুল আলম, নুরুল ইসলাম।
ফটিকছড়ির নৌকমান্ডো দলের সদস্য ছিলেন আবু মুছা চৌধুরী, শফিকুন নুর মাওলা, এস এম খায়রুল বশর, গিয়াসউদ্দিন, শফিউল আলম প্রমুখ। এছাড়াও বিভিন্নভাবে যুদ্ধে জড়িত ছিলেন বাদশা আলম, নুরুল আলম চৌধুরী, রফিকুল আলম, এস এম ফারুক, হারেছ আহমদ চৌধুরী, আলমগীর, আহসানউল্লাহ, আমানুল্লাহ, শওকত, এমদাদ, মাহবুব, নুর মোহাম্মদ, গোলাপ রহমান, নাজিম, পঞ্চানন বড়ুয়া, বদিউল আলমসহ আরো অনেকে। মীর্জা আবু মনসুর এমপিএ ফটিকছড়ির সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর গ্রুপ ছাড়াও তিনি বিভিন্ন গ্রুপের সমন্বয় সাধন করতেন। মূলত এ অঞ্চলে তাঁর নেতৃত্বেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়।
ফটিকছড়ি উপজেলায় বেশ কয়েকটি আশ্রয়স্থল ছিল, যেখানে মুক্তিযোদ্ধারা আশ্রয় নিতেন। এরূপ একটি আশ্রয়স্থল ছিল নারায়ণহাটে। এর দায়িত্বে ছিলেন হারেছ আহমদ চৌধুরী। খিরাম অঞ্চলের আশ্রয়স্থলটি ছিল মির্জা মনসুরের খামার বাড়িতে। এখানে ডা. ইকবাল, ডা. শাহাবুদ্দিন মাহমুদ, ডা. মোস্তফা ও ডা. কাওসারকে নিয়ে একটি মেডিকেল টিম গঠিত হয়েছিল। মেজর রফিক ও রাজনৈতিক নেতারা এখানে এসেছিলেন। ফরহাদাবাদে মোজাফ্ফর চৌধুরীর বাড়িতে একটি আশ্রয়কেন্দ্র ছিল। খিরামের বকিয়তউল্লাহর খামাইট ছিল দক্ষিণ ও উত্তরের জেলাসমূহের কয়েকটি থানার যোদ্ধাদের অন্যতম ট্র্যানজিট ক্যাম্প। ক্যাপ্টেন সুলতান আহমদ এ ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আবদুস সাত্তার ও আমিনের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত সাপমারা ক্যাম্পে মীর্জা আবু মনসুর, স্বপন চৌধুরী, এস এম ইউসুফ, এম এ মান্নান, রণবিক্রম তাতু প্রমুখ প্রায়ই আসতেন ও থাকতেন। মীর শওকত আলীসহ বাঙালি অফিসার ও সেনাসদস্যরাও আসতেন। আবদুস সালাম মাস্টার তাঁর পাহাড়ি বাড়িতে নাজিম গ্রুপকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। জামাল সিকদার নৌকা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পারাপার করতেন। শাহনগরে ইলিয়াসের বাড়ি, লোকমান উকিলের বাড়ি, আমিন কাদেরের বাড়ি, আয়ুব বাঙালির বাড়ি, নারায়ণহাট ভূজপুরে বোরহানের বাড়ি, রথের বিলে ইমাম শরীফ সওদাগরের খামার, আর্টিস্ট এন শফিকের খামার, যুগি জমিদারের খামার, গর্জনবাগিচা খামার, হালদারপাড় রোসাংগিরির আমান আলী সওদাগরের বাড়ি, সমিতিরহাটের কবির শেখের বাড়ি, জাফতনগরের সৈয়দ বাড়ি, আবদুল্লাহপুরের বড়ুয়াপাড়া, মুশাররফ আলী কোম্পানির বাড়ি, নানুপরের ওবায়দিয়া মাদ্রাসা, মীর্জা আবু আহমদের খিরামের খামার, রথের বিল সংলগ্ন আহমদ মিয়ার খামার এসব স্থানেও যোদ্ধারা থাকতেন। বক্তপুরে মুকিম শাহ বাড়ির আবু তাহেরের খিরাম পাহাড়স্থ কাচারি ঘরে লে. মোস্তাক সেনাসদস্যদের একটি গ্রুপ নিয়ে আস্তানা গেড়েছিলেন। সুয়াবিল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সুমনছড়ি পাহাড়ে একটি আশ্রয়স্থল তৈরি করেছিলেন। এখানে বসে স্কোয়াড্রন লিডার আফাজুর রহমান ভারত থেকে খবরাখবর আনতেন এবং এলাকার খবর ভারতে পাঠাতেন। ধর্মপুরের আবদুল মজিদ ভেন্ডার, নুরুল হক মোক্তার, হাজী তোফায়েল আহমদ, ফজল আহমদ, আবু তাহের, আবু আহমদ, নুরুল ইসলাম তালুকদার ও এম এ ওহাব মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতেন। এছাড়া আশ্রয়দাতাদের মধ্যে আরো ছিলেন- নুর আলি মিয়া হাটের আবদুল জব্বার মাস্টার, উদালিয়া চা বাগানের পাহাড়ি চাকমা সম্প্রদায় ও খিরামের হাফিজুর রহমান।
জুলাই মাসের প্রথম দিক থেকে মাস্টার ইউসুফের নেতৃত্বে রফিকউল্লাহ, নুরুল আলম আজাদ, কাজী নুরুল ইসলাম তালুকদার, হারেছ আহমদ চৌধুরী, হাজী বজল আহমদ, ডা. আবদুর রহমান, সুজাউদ্দৌলা, মুন্সী ইসলাম, সিরাজুল ইসলাম, শামসুল হক, তাজুল ইসলাম, ইদ্রিস মিয়া, জহুর আহমেদ চৌধুরী, আমিন সাত্তার, ইব্রাহীম, জাকির সওদাগর, ওমদা মিয়া, ছিদ্দিক আহমেদ, কাজী ছাবেদুর রহমান, নজরুল ইসলাম কাঞ্চন, এখলাস মিয়া, মৌলভি কবির আহমদ, ডা. জহুরুল আলম, মৌলভি ইউসুফ, ডা. হুমায়ুন কবির, ইউসুফ মিস্ত্রি প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধাদের চলাচল ও নিরাপদ আশ্রয়স্থল প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব পালন করেন। আশ্রয়কন্দ্রগুলোকে সঠিকভাবে পরিচালনার ক্ষেত্রে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেন মাস্টার ইউসুফ আহমদ। তাঁকে সহায়তা করেন আলমগীর মুন্সি।
চট্টগ্রাম শহরে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে টিকতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে আসতে থাকেন। অন্যদিকে বাঙালি সেনাসদস্য, পুলিশ, আনসার ও রাজনৈতিক কর্মীদের প্রধান অংশ ভারতে আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে ফটিকছড়ি হয়ে রামগড়ের উদ্দেশে চলে যেতে থাকেন। এক পর্যায়ে হাজার-হাজার নারী-পুরুষও নিািপত্তার অভাবে দেশ ত্যাগ করে ফটিকছড়ির পথে ভারতে যেতে থাকে। ফটিকছড়ির বিভিন্ন স্থান লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। এ- সময় এলাকার সচেতন যুবক ও রাজনৈতিক কর্মীরা সেনাবাহিনীকে সহায়তা করার পাশাপাশি ভারতগামী রাজনৈতিক কর্মী, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী ও শরণার্থীদের ব্যাপকভবে সহায়তা করে।
শিল্পপতি এ কে খান, এম আর সিদ্দিকী, আব্দুল্লাহ আল হারুন, এম এ হান্নান, চৌধুরী হারুনুর রশিদ, এম এ মান্নান, এস এম ইউসুফ, আবু মো. হাশেম, সাবের আহমদ আসগরীসহ বিভিন্ন দলের নেতা-কর্মী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দসহ বুদ্ধিজীবী, চিত্রনায়িকা কবরী চৌধুরীসহ বিভিন্ন পর্যায়ের শিল্পী ও জনগণের ব্যাপক অংশ ফটিকছড়ির জনগণের আনুকূল্যে রামগড় হয়ে ভারত চলে যান।
পাকবাহিনী ফটিকছড়ি উপজেলায় ব্যাপক প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। পাহাড়ি এলাকার ভৌগোলিক সুবিধা নিয়ে বাঙালি সেনাদের একাংশ তাদের বারবার পর্যুদস্ত করে। প্রতিরোধ যুদ্ধের শুরুতেই ২৬শে মার্চ থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাঙালি সেনাদের সার্বিক সহযোগিতা প্রদান শুরু করে। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা মীর্জা আবু মনসুর এমপিএ, বাদশা আলম, ইউসুফ মাস্টার, আনোয়ারুল আজিম, জয়নাল আবেদীন, শওকত, খায়রুল বশর, আবু তাহের, মাস্টার আমানুল্লাহ প্রমুখের নেতৃত্বে সংগঠিত হয়ে যুদ্ধরত বাঙালি সশস্ত্র বাহিনীকে সহযোগিতা করেন। সেনাসদস্যদের একাংশ খিরাম পাহাড়ে একটি ট্র্যানজিট ক্যাম্প তৈরি করে। রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও সেনাবাহিনীর দায়িত্বশীল সংগঠকদের প্রধান ক্যাম্প ছিল মীর্জা মনসুরের বাড়িতে।
পাকবাহিনী ১৩ই এপ্রিল ফটিকছড়ি উপজেলায় প্রবেশ করে এবং থানা ভবনে ক্যাম্প স্থাপন করে। এ ক্যাম্প থেকেই তারা উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালায়।
ফটিকছড়ি উপজেলায় পাকবাহিনীর সহায়তার জন্য রাজাকারআলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠন করা হয়েছিল। উপজেলার কুখ্যাত রাজাকাররা হলো- আশরাফ আলী (নানুপুর), নূরুল আলম (নানুপুর), শামসুল আলম (কাঞ্চনপুর), মো. ইলিয়াছ (কাঞ্চনপুর), মো. ইসহাক (উত্তর বারমাসিয়া), আবুল হোসেন (উত্তর বারমাসিয়া), আবুল হোসেন (নিচিন্তা), শেখ আবু (নিচিন্তা), আবু তালেব (বালুখালী), নূরুল ইসলাম (বালুখালী), ফয়েজ আহমদ (সোনারখীল), বাদশা মিয়া (দাঁতমারা), মফিজুর রহমান (দাঁতমারা), জহুরুল ইসলাম (শাহনগর), জাগির আহমদ (শাহনগর), মো. ইউছুপ (রায়পুর), নূরুল হক মাস্টার (রায়পুর), আইয়ুব আলী (লেলাং), আবুল কালাম (লেলাং), মুন্সি মিয়া, পূর্ব ফরহাদাবাদ), বল্লা মিয়া (পূর্ব ফরহাদাবাদ), টুনু চৌকিদার (বাবুনগর), মফিজ উদ্দিন (সুন্দরপুর), বন্দে আলী (রোসাংগিরি), শামসুল আলম (রোসাংগিরি), ফজল হক (পশ্চিম সুন্দরপুর), শামসুল আলম (মধ্যম কাঞ্চননগর), মো. ইলিয়াছ (দক্ষিণ কাঞ্চননগর), রাজাকার কমান্ডার ফজল হক (মধ্য কাঞ্চননগর; সে হানাদার বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি-বাড়ি তল্লাশি চালাত এবং বাড়ি, দোকানপাট ও রাস্তাঘাট থেকে লোকজনকে ধরে বধ্যভূমিতে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করত), রাজাকার কবির আহমদ (মানিকপুর), রাজাকার কমান্ডার তফাজ্জল (মধ্য কাঞ্চননগর), রাজাকার কমান্ডার জাকির আহমদ (মানিকপুর), হাফেজ ছরাইয়া (মানিকপুর), আবু বক্কর (পশ্চিম কাঞ্চননগর), নূরা বলী (পাইন্দং), ফজল করিম চৌধুরী (সুয়াবিল), রবিউল হোসেন ওরফে টিক্কা খান, আবু তাহের (ধুরং), গোলাম মোহাম্মদ (ধুরং), কমান্ডার আবুল (সুন্দরপুর), আবুল হাশেম (সুয়াবিল), মুন্সি মিয়া (সুয়াবিল), ইলিয়াছ (দৌলতপুর), আহমদ ছফা (দৌলতপুর), ডা. সেকান্দর (মাইজভাণ্ডার), প্রফেসর আবুল মনসুর (সুয়াবিল), সুবেদার ইব্রাহিম (সুয়াবিল), ডা. ছালে আহমদ (ওকরা), নূরুল ইসলাম (সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান), আবদুল মজিদ (রুস্তমনগর), দোনা মিয়া চৌধুরী (রুস্তমনগর), সিরাজুল ইসলাম (ওকরা), রাজাকার কমান্ডার সেকান্দর) (মাইজভাণ্ডার), রাজাকার কমান্ডার কালু মিয়া (সাদেক নগর), মুন্সি আহমদ হোসেন (সাদেক নগর), অমলেন্দু বড়ুয়া (ছিলোনিয়া), হিরেন্দুলাল বড়ুয়া (ছিলোনিয়া), কানাইলাল বড়ুয়া (ছিলোনিয়া), রাজাকার কমান্ডার আবু তাহের (পিতা মুন্সি ইজ্জত আলী, ধুরং), কমান্ডার শাহ আলম (পিতা মো. ইব্রাহিম, ধুরং), হামদু ফকির (রাঙ্গামাটিয়া), মফিজুর রহমান ওরফে গুশা মিয়া (আজিমপুর), জহিরুল হক (রায়হান নগর), মো. জাকারিয়া (রায়হান নগর), কমান্ডার জহিরুল ইসলাম (সোনাগর), কমান্ডার ঠাণ্ডা মিয়া (হেঁয়াকো), হারুন অর রশিদ (হেঁয়াকো), কমান্ডার ভারিত্যা (আজিমপুর, ভূজপুর; এর গ্রুপে প্রায় ১১ জন রাজাকার ছিল), ফজা আহমদ (পশ্চিম ভূজপুর) প্রমুখ। আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিল ফখরী আজম (পিতা জামাল আহমদ, রাঙ্গামাটিয়া) এবং কমান্ডার ছিল মওলানা জানে আলম (কাঞ্চনপুর) ও মওলানা হারুন।
পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা বিভিন্ন স্থানে হত্যা, গণহত্যা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটায়। পাকসেনারা রোসাংগিরির আরবান আলী সওদাগরের বাড়িতে আবদুল রাজ্জাক নামে একজনকে হত্যা করে। ১১ বছরের এক বালক পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে নানারকম খবর সরবরাহ করত। এ কারণে পাকবাহিনী তাকে ধরে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে তথ্য জানার জন্য তার ওপর নির্মম অত্যাচার চালায়। কিন্তু তার কাছ থেকে কোনো তথ্য আদায় করতে না পেরে তারা তাকে হত্যা করে।
ফটিকছড়ি উপজেলায় পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা তিনটি গণহত্যা চলায়— আজিমনগর গণহত্যা-, লেলাং গণহত্যা ও কাঞ্চননগর গণহত্যা। আজিমনগর গণহত্যা সংঘটিত হয় ২১শে নভেম্বর। এতে অনেক সাধারণ মানুষ শহীদ হন। লেলাং গণহত্যা সংঘটিত হয় ২২শে নভেম্বর। এতে ৩১ জনকে হত্যা করে মাটিচাপা দেয়া হয়, যা লেলাং গণকবর- নামে পরিচিত। কাঞ্চননগর গণহত্যা সংঘটিত হয় ২৩শে নভেম্বর। এতে ১৩ জনকে হত্যা করা হয়। সৈয়দুল হক নামে একজন আহত অবস্থায় তাদের হাত থেকে বেঁচে যায়।
ফটিকছড়ি উপজেলায় পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি অপারেশন পরিচালিত হয়। ৭ই এপ্রিল, শিয়ালবুক্কা যুদ্ধ – সংঘটিত হয়। এতে ১৮ জন পাকসেনা আত্মসমর্পণ করে। লে. মাহফুজের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা ১৪ই আগস্ট বাগানবাজার থেকে রামগড় পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি পাকিস্তানি ক্যাম্পে গ্রেনেড চার্জ করে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ফটিকছড়ির শেখ আবু আহমদ, ওসমান, আনোয়ার, তৈয়ব, রাউজানের ফিরোজ, এজাহার, বড়ুয়া, বোয়ালখালীর শ্যামা প্রমুখ।
বাবুনগর মাদ্রাসা রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন- পরিচালিত হয় ১৪ই আগস্ট। এখানে আলবদরআলশামসদের ঘাঁটি ছিল। আলবদর কমান্ডার মওলানা হারুনের নেতৃত্বে মাদ্রাসার প্রায় দুহাজার ছাত্র এ বাহিনীর সদস্য ছিল। তাদের সহযোগিতা করত নাজিরহাট কলেজস্থ পাকহানাদারদের ক্যাম্পের সেনাসদস্যরা। মাদ্রাসার এই আলবদরআলসামস বাহিনীর অত্যাচারে এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। তাই তাদের শায়েস্তা করার জন্য ঘটনার দিন রাত দেড়টার দিকে আহমদ ছফা ও গৌরী শঙ্কর চৌধুরীর নেতৃত্বে ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা মাদ্রাসা আক্রমণ করেন। এতে বেশকিছু সংখ্যক আলবদরআলসামস সদস্য নিহত হয়।
কমান্ডার রফিকের গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধারা রাজবাড়ি, মানিকছড়ি, নারায়ণহাট, হাফানিয়া, পিলখানা, জজখোলা, শান্তিরহাট প্রভৃতি স্থানে কখনো সম্মুখ যুদ্ধ, কখনো বা গেরিলা পদ্ধতিতে আক্রমণ করে পাকবাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত রাখে। এ গ্রুপটি প্রধানত সেনাবাহিনীর সঙ্গে থেকে যুদ্ধে অংশ নেয়। ৭ই ডিসেম্বর এ গ্রুপ নারায়ণহাটে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে।
আহমদ ছফার গ্রুপ একবার রোসাংগিরিতে আয়ুব বাঙালির বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। পাকবাহিনী ও রাজাকাররা এ খবর পেয়ে গোটা গ্রাম ঘেরাও করে এবং ১০-১২ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করে চলে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা পরে এলাকার বেশ কয়েকজন রাজাকারের বাড়ি জ্বালিয়ে দেন।
কৈয়াবাগান হালদা ভৈলী যুদ্ধ সংঘটিত হয় নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। এতে ৪ জন পাকসেনা নিহত এবং ৮ জন পাকসেনা ও রাজাকার আহত হয়৷
উদালিয়া চা-বাগান ক্যাম্প অপারেশন- পরিচালিত হয় ১৪ই নভেম্বর। এতে কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয় এবং ক্যাম্পটি হানাদারমুক্ত হয়।
দরবার শরীফ রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন পরিচালিত হয় নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে। এদিন মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফ সংলগ্ন ক্যাম্পের রাজাকাররা নাজিরহাটে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিল। এ খবর পেয়ে কমান্ডার নূরুল গণি তাঁর গ্রুপের ৭ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ক্যাম্প আক্রমণ করেন। এ-সময় উভয় পক্ষে গোলাগুলি চলে। রাজাকাররা পরাজিত হয় এবং মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ১৪ জনকে বন্দি করে খিরাম পাহাড়ে লে. শওকতের কাছে পাঠিয়ে দেন।
আজাদীবাজার রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন পরিচালিত হয় ২রা ডিসেম্বর। কমান্ডার আহমদ ছফার গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধারা এ অপারেশনের মাধ্যমে রাজাকারদের বিতাড়িত করেন এবং পরে রশিদ চেয়ারম্যান ও ইসলাম চেয়ারম্যানের বাড়ি ঘেরাও করে অনেক অস্ত্র উদ্ধার করেন। এছাড়া তাঁরা নুর আলী মিয়া হাটে চালের গুদামে সফল অপারেশন পরিচালনা করেন।
বিনাজুরী পুল রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন পরিচালিত হয় ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। নূরুল গণি ও তাঁর দলের সদস্যরা এ পুল আক্রমণ করে ১৪ জন রাজাকারকে বন্দি করে লে. শওকতের কাছে পাঠিয়ে দেন।
নারায়ণহাট ক্যাম্প অপারেশন পরিচালিত হয় ৬ই ডিসেম্বর। এখানে পাঞ্জাবি সৈন্যদের একটি শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। লে. শওকত, বদিউল আলম, আমিনুল হক, রফিকুল আলম প্রমুখের নেতৃত্বে ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প আক্রমণ করলে পাঞ্জাবিরা পালিয়ে যায়।
ফটিকছড়ি থানা অপারেশন- পরিচালিত হয় ৮ই ডিসেম্বর। এতে নেতৃত্ব দেন জোনাল কমান্ডার মীর্জা আবু মনসুর। তাঁর সহযোগিতায় ছিলেন কমান্ডার হালিম, এস এম ফারুক, গৌরী শঙ্কর চৌধুরী, আহমদ ছফা, জয়নাল আবেদীন, নূরুল গণি, আজিম, রফিক ও তাঁদের গ্রুপের সদস্যরা। আক্রমণের পূর্বে থানার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। ঘাটারপুল, হাইদছকিয়া পুল ও হাডিপুল উড়িয়ে দেয়া হয়। থানার চারপাশের ফেনুয়া চা বাগান, নাজিরহাট বাজার, উদালিয়া চা বাগান ও নাজিরহাট রোডে এম্বুশ বসানো হয়। সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন লে. শওকত ও মীর্জা আবু মনসুর। মুক্তিযোদ্ধারা এ অপারেশন থেকে প্রায় দুশতাধিক পুলিশ ও আনসার সদস্যকে বন্দি এবং বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করেন। বাকি পাকসেনা ও তাদের দোসররা পালিয়ে যায়। নাজিরহাট পেট্রোল পাম্প ও পুল অপারেশন পরিচালিত হয় ৮ই ডিসেম্বর। এ অপারেশনের সময় সরফুল হাসনাইন গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধারা বিস্ফোরণের সাহায্যে নাজিরহাট এলাকার সকল পেট্রোল পাম্প ও একটি পুল উড়িয়ে দেন। এছাড়া তাঁরা ফেনুয়া চা বাগানস্থ মিলিশিয়া ক্যাম্প ও কর্ণফুলী টি এস্টেট ক্যাম্প আক্রমণ করে পাকিস্তানি মিলিশিয়াদের বিতাড়িত করেন।
মাদাইম্যারহাট অপারেশন পরিচালিত হয় ৯ই ডিসেম্বর। লে. শওকতের নেতৃত্বে এ অপারেশনে বদিউল আলম ও আমিনুল হকের গ্রুপসহ আরো অনেক গ্রুপ অংশ নেয়।
রামগড় ক্যাম্প অপারেশন পরিচালিত হয় ৯ই ডিসেম্বর এদিন কমান্ডার হালিমের নেতৃত্বে ফজলুল হক, আহমদ ছফাসহ বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা রামগড়স্থ পাকিস্তানি হানাদার ক্যাম্পে আক্রমণ করলে ৪ জন পাকসেনা নিহত হয়। ২ খৈয়াবাগান ক্যাম্প অপারেশন পরিচালিত হয় ৯ই ডিসেম্বর। এদিন ক্যাম্প থেকে ১৫-২০ জন পাকসেনা নদীপথে ফটিকছড়ি যাওয়ার সময় কমান্ডার হালিমের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আক্রমণ করলে তারা পিছু হটে ক্যাম্পে ফিরে যায়।
হলুদিয়া রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন- পরিচালিত হয় ১০ই ডিসেম্বর। এতে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও ৪ জন আহত হন। অপরপক্ষে ৩ জন পাকসেনা নিহত হয়।
কানখাইয়া খাল যুদ্ধ সংঘটিত হয় হয় ১১ ও ১২ই ডিসেম্বর। এতে ৩ জন পাকসেনা, ৫০-৬০ জন মিলিশিয়া, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস নিহত এবং অসংখ্য আহত হয়।
এছাড়া মুক্তিযোদ্ধারা মৌলভি হারুন, ইলিয়াস, মান্নান (টিক্কা খান), তাহের মিয়া (গুণ্ডা তাহের) প্রমুখ রাজাকারকে পাঞ্জাবিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা এবং তাদের বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মে সক্রিয় সহযোগিতা করার কারণে হত্যা করেন। ১০ই ডিসেম্বর ফটিকছড়ি উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- নায়েক তাজুল ইসলাম, বীর প্রতীক – (পিতা মো. নাদিরুজ্জামান, বাগানবাজার) এবং নৌকমান্ডো সফিকুন নূর মাওলা, বীর প্রতীক- (পিতা নূর মোহাম্মদ মাওলা)।
ফটিকছড়ি উপজেলার যেসব শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম জানা গেছে, তাঁরা হলেন— তাজুল ইসলাম, বীর প্রতীক (মিরপুর পুনরুদ্ধার যুদ্ধে শহীদ), হাবিলদার শামসু (পিতা মোহাম্মদ বক্স, দৌলতপুর; মার্চ মাসে পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), মাহবুবুল আলম (পিতা মাহমুদুর রহমান চৌধুরী, রাঙ্গামাটিয়া; মার্চ মাসে পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), শামশুল আলম (পিতা আবদুল আজীজ, ধর্মপুর; মার্চ মাসে পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), জহুরুল ইসলাম (পিতা আবদুল হামিদ, পূর্ব ফরহাদাবাদ, দৌলতপুর; এপ্রিল মাসে পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), ভবেশ চন্দ্ৰ (পিতা শিশির চন্দ্র, সুন্দরপুর, মে মাসে পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), হাবিলদার ফজল করিম (পিতা সোনা মিয়া, পাইন্দং; জুন মাসে পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), আশ্রাফউদ্দৌলা (পিতা হাজী আবদুর রশিদ, বক্তপুর; জুলাই মাসে পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), আহমদ ছফা (পিতা মকবুল আহমদ, দৌলতপুর; সেপ্টেম্বর মাসে পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), দেলোয়ার হোসেন (পিতা আবদুর রশিদ, সমিতিরহাট; সেপ্টেম্বর মাসে পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), আহমদ ছফা (পিতা বাচা মিয়া, হাসনাবাদ; অক্টোবর মাসে পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), জমাদার নূরুল ইসলাম (পিতা আবদুল গণি, জাফতনগর; অক্টোবর মাসে জাহাজে পাকবাহিনীর গোলাবর্ষণে শহীদ) এবং ইমাম হোসেন (পিতা ফয়েজ আহমদ, লেলাং; নভেম্বর মাসে হানাদাররা ধরে নিয়ে হত্যা করে)। উপজেলার শহীদদের স্মরণে লেলাং ইউনিয়নের শাহনগর ও কাঞ্চননগরে দুটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। [জামাল উদ্দিন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!