মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি ও বিদেশীদের ভূমিকা
প্রবাসী বাঙালি ও বিদেশীদের ভূমিকা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দুটি ফ্রন্টের একটি হচ্ছে অভ্যন্তরীণ আর অপরটি বহির্দেশীয়। দ্বিতীয় বা বহির্দেশীয় ফ্রন্টের পুনরায় দুটি দিক -কূটনৈতিক তৎপরতা ও প্রবাসী বাঙালিদের ভূমিকা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ, অর্থাৎ এ-যুদ্ধে দেশের ভেতরে ও দেশের বাইরে প্রবাসে বসবাসরত প্রায় সকল বাঙালি কোনো-না-কোনোভাবে যুক্ত হয়ে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধ যখন জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ে পরিণত হয়, তখন অনুরূপ ব্যাপার বেশি করে ঘটে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুধু এখানকার ভৌগোলিক সীমার মধ্যে আবদ্ধ ছিল না, সমগ্র বিশ্বসম্প্রদায় কোনো-না-কোনোভাবে এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। প্রবাসী বাঙালিদের পাশাপাশি তারাও পালন করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
জাপান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যবর্তী ইউরোপীয় দেশসমূহের যেখানেই বাঙালিদের বসবাস ছিল, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সেখানেই তারা কোনো-না-কোনোরূপ ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসে। তবে এসব দেশের মধ্যে ঐতিহাসিক কারণেই সবচেয়ে বেশি প্রবাসী বাঙালি ছিল যুক্তরাজ্যে। সে- সময় ব্রিটেনে তাদের সংখ্যা ছিল এক লক্ষাধিক। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি সংখ্যার বসবাস ছিল লন্ডন শহরে। ৭১-এর ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ ও তাঁর আহ্বানে ২-২৫শে মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলায় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন- চলাকালে দেশের ভেতরের মতো বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাঙালিরাও আসন্ন মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা লাভ করতে সক্ষম হয় এবং সে-লক্ষ্যে প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করে। বিভিন্ন দেশে ও সেসব দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন শহরে বাঙালিদের উদ্যোগে মার্চ- এপ্রিল মাসে একশন কমিটি বা অনুরূপ সংগঠন প্রতিষ্ঠা পেতে থাকে। বাস্তব কারণেই গ্রেট ব্রিটেন, আরো নির্দিষ্ট করে বললে, লন্ডন শহর হয়ে দাঁড়ায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রবাসী বাঙালিদের তৎপরতার কেন্দ্রবিন্দু। ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অপারেশন সার্চলাইট নামে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর গণহত্যা শুরু হলে পরের দিন ২৬শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও হাইকোর্টের বিচারপতি জাস্টিস আবু সাঈদ চৌধুরী জেনেভা থেকে লন্ডন চলে আসেন। তিনি জেনেভায় অবস্থানকালে পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিতে ২ জন সাধারণ শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ১৫ই মার্চ উপাচার্যের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ২৬শে মার্চ লন্ডনে ফিরে আসার পরের দিন, অর্থাৎ ২৭শে মার্চ তিনি ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের প্রধান ইয়ান সাদারল্যান্ডের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পাকিস্তানের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক সম্পূর্ণ ছেদ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন। এরপর থেকে তাঁর নেতৃত্বেই যুক্তরাজ্য ও এর বাইরে অন্যান্য দেশের প্রবাসী বাঙালিরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। উল্লেখ্য, ১০ই এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-কে রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদ-কে প্রধানমন্ত্রী করে ৬ সদস্যবিশিষ্ট বাংলাদেশ সরকার- (যা মুজিবনগর সরকার নামে বহুল পরিচিত) গঠিত হওয়ার ১২ দিন পর ২৩শে এপ্রিল বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে সরকারের বহির্দেশীয় বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। এরপর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কূটনৈতিক তৎপরতা পরিচালনার পাশাপাশি তিনি প্রবাসী বাঙালিদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কর্মকাণ্ডের প্রধান সমন্বয়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।
যুক্তরাজ্য
এদিকে ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অপারেশন সার্চলাইট নামে বাঙালিদের ওপর গণহত্যায় ঝাঁপিয়ে পড়লে প্রতিবাদে বাঙালি ছাত্র সামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি) ও আফরোজ আফগান চৌধুরী (হবিগঞ্জ, সিলেট) ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট বাসভবনের রাস্তার ফুটপাতে অনশন শুরু করেন। পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার প্রতিবাদে লন্ডনে ৪ঠা এপ্রিল হ্যামস্টেড টাউন হলে প্রথম সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। তাতে প্রবাসী বাঙালিরা ছাড়াও ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য, ইংরেজ বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক কর্মীরা যোগদান করেন। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ- (প্রতিষ্ঠা ১৯৬৯) সে-সময় দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। একটি অংশের নেতৃত্বে ছিলেন গাউস খান এবং অপরটির নেতৃত্বে ছিলেন মিনহাজউদ্দিন। মিনহাজউদ্দিনের আওয়ামী লীগ ছিল লন্ডনভিত্তিক। বামপন্থীরাও মস্কোপন্থী ও পিকিংপন্থী এ দু-ধারায় তখন বিভক্ত ছিল। মার্চ-এপ্রিল মাসে লন্ডন এবং লন্ডনের বাইরে ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে একশন কমিটি গড়ে উঠতে থাকে। ব্রিটেনের বাইরে বিভিন্ন দেশেও অনুরূপ কমিটি গঠিত হয়। একশন কমিটি গঠন নিয়ে কোথাও- কোথাও দ্বন্দ্ব বা বিভক্তি দেখা দেয়। যুক্তরাজ্যে ‘কাউন্সিল ফর দ্য পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠন গড়ে উঠেছিল। এর সভাপতি ছিলেন গাউস খান এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শেখ আবদুল মান্নান। এ সংগঠনও প্রথম দিকে বেশকিছু বড়বড় সভা-সমাবেশ ও বিক্ষোভের আয়োজন করে।
যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে যারা নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন, তাঁরা হলেন— লন্ডনে গাউস খান, মিনহাজউদ্দিন, সুলতান শরীফ, ব্যারিস্টার সাখাওয়াত হোসেন, শেখ আব্দুল মান্নান, ড. সামসুল হুদা হারুন, আমীর আলী, মিম্বার আলী, আবদুল মতিন, মোহাম্মদ হোসেন মঞ্জু, শফিউদ্দিন বুলবুল, এনামুল হক, নজরুল ইসলাম আলো, খোন্দকার মোশারফ হোসেন, রাজিয়া চৌধুরী, আব্দুল হাই, বেগম লুলু বিলকিস বানু, জেবুন্নেসা বস, ফেরদৌসী রহমান, মুন্নি রহমান, বি করিম, আলী আশরাফ, শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, ডা. আবু হেনা সাঈদুর রহমান ওরফে ডা. খসরু, ডা. জাফর উল্লাহ চৌধুরী, মোশারফ হোসেন জোয়ারদার, ডা. আব্দুল হালিম, ডা. মবিন, ডা. আলতাফুর রহমান, রাজিউল হাসান রঞ্জু, জাকারিয়া চৌধুরী, তোসাদ্দুক আহমেদ, সামসুল মোর্শেদ, বি এইচ তালুকদার, নূরুল হক, ড. কবির আহমেদ, মতিউর রহমান, সুরাইয়া খানম, শিল্পী আব্দুর রউফ প্রমুখ; বিবিসি-তে সিরাজুর রহমান, শ্যামল লোধ, কমল বোস; ম্যানচেস্টারে হাজী আব্দুল মতিন; বার্মিংহামে তোজাম্মেল হক ওরফে টনি হক, জগলুল পাশা, আজিজুল হক ভূঁইয়া, আফরোজ মিয়া (রেস্তোরাঁর মালিক), ইসরাইল মিয়া; ব্রাডফোর্ডে মু. সাব্বির তরফদার, আব্দুস সোবহান মাস্টার, আব্দুল কাদের, বদরুজ্জামান, মাহমুদুল হক, মির্জা লুৎফুর রহমান ও এ কে এম এনায়েতুল্লাহ; গ্লাসগোতে ডা. সামসুদ্দিন এমআরসিপি, মোজাম্মেল হক, কাজী এনামুল হক; লিডসে মকসুদ আলী সিএসপি ও তাঁর স্ত্রী; বেজ ওয়াটার অঞ্চলে মনজুর মোর্শেদ তালুকদার, কাজী নজিবুর রহমান; লুটনে দবির উদ্দিন এবং শেফিল্ডে প্রীতিস মজুমদার।
মার্চের অসহযোগ আন্দোলন ও তৎপরবর্তী মুক্তিযুদ্ধকালে বিশেষ করে যুক্তরাজ্যে একশন কমিটি গঠনের পাশাপাশি আরো কতিপয় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- বাংলাদেশ স্টুডেন্টস একশন কমিটি, বাংলাদেশ উইমেন্স এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন, সাংস্কৃতিক সংগঠন ইত্যাদি।
মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে লন্ডনে উচ্চ শিক্ষার্থে আগত বাঙালি ছাত্রদের উদ্যোগে ১১ সদস্যবিশিষ্ট বাংলাদেশ স্টুডেন্টস একশন কমিটি গঠিত হয়। এর ৫ জন যুগ্ম-আহ্বায়ক ছিলেন। তাঁরা হলেন- মোহাম্মদ হোসেন মঞ্জু, খোন্দকার মোশাররফ হোসেন, নজরুল ইসলাম আলো, শফিউদ্দিন বুলবুল ও শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন সুলতান শরীফ। আফরোজ আফগান চৌধুরী ছিলেন অন্যতম সদস্য।
২৮শে মার্চ মিসেস জেবুন্নেসা বস ও মিসেস লুলু বিলকিস বানুর উদ্যোগে গঠিত হয় বাংলাদেশ উইমেন্স এসোসিয়েশন। এর সভানেত্রী ছিলেন জেবুন্নেসা বস। অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন- ফেরদৌসী রহমান, আনোয়ারা জাহান, মুন্নি রহমান, সোফিয়া রহমান, জেবুন্নেসা খায়ের ও ড. হালিমা মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য দানের লক্ষ্যে এপ্রিল মাসে লন্ডনে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন। এর সভাপতি ছিলেন ডা. আবু হেনা সাঈদুর রহমান। সহ-সভাপতি ছিলেন ডা. এম এ হাকিম, সাধারণ সম্পাদক ডা. জাফর উল্লাহ চৌধুরী। অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন ডা. মোশাররফ হোসেন জোয়ারদার, ডা. আহমেদ, ডা. মোবিন (জয়েন্ট সেক্রেটারি), ডা. আলতাফুর রহমান (জয়েন্ট সেক্রেটারি) ও ডা. কাজী।
একই সময়ে লন্ডনে দুটি সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা লাভ করে। একটি বাংলাদেশ কালচারাল এসোসিয়েশন। এর উদ্যোক্তা ছিলেন মোহাম্মদ আলী। অপরটি এনামুল হকের (অক্সফোর্ডে পিএইচডি গবেষক ও স্বাধীনতাপরবর্তী জাদুঘরের মহাপরিচালক) বাংলাদেশ গণসংস্কৃতি সংসদ। উল্লেখ্য, ১৮ ও ১৯শে সেপ্টেম্বর লন্ডনের কনওয়ে হলে গণসংস্কৃতি সংসদ নৃত্যনাট্য ‘অস্ত্র হাতে তুলে নাও’ পরিবেশনের মাধ্যমে দর্শক- স্রোতাদের বিপুলভাবে উদ্বুদ্ধ করে।
ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে গড়ে ওঠা একশন কমিটিগুলোর মধ্যে সমন্বয় ও ঐক্য সৃষ্টির লক্ষ্যে ২৪শে এপ্রিল কভেন্ট্রি শহরে সকল এলাকার একশন কমিটির ১২৫ জন প্রতিনিধি ও ২৫ জন পর্যবেক্ষকের উপস্থিতিতে বেগম লুলু বিলকিস বানুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে ৫ সদস্যের একটি কেন্দ্রীয় স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হয়। এর সদস্যরা হলেন- আজিজুল হক ভূঁইয়া (বার্মিংহাম, আহ্বায়ক), কবীর চৌধুরী (ম্যানচেস্টার), মনোয়ার হোসেন (ব্রাডফোর্ড), শেখ আবদুল মান্নান (লন্ডন) ও শামসুর রহমান (পূর্ব লন্ডন)। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ছিলেন এর উপদেষ্টা। ছাত্রনেতা রাজিউল হাসান রঞ্জু ছিলেন তাঁর অবৈতনিক একান্ত সচিব। আজিজুল হক ভূঁইয়া ৩ মাসের জন্য মুজিবনগরে গেলে তখন শেখ আবদুল মান্নান স্টিয়ারিং কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন। স্টিয়ারিং কমিটির মাধ্যমে একশন কমিটিগুলোর কার্যক্রম পরিচালনা ও সমন্বয়ের জন্য লন্ডনের ১১ নম্বর গোরিং স্ট্রিটে ‘বাংলাদেশ হাউজ’ নামে একটি অফিস প্রতিষ্ঠা করা হয়। অফিস পরিচালনার জন্য শিল্পপতি জহুরুল ইসলামসহ অনেক বাঙালি স্বেচ্ছায় আর্থিক সহায়তা দান করেন। স্টিয়ারিং কমিটির উদ্যোগে লন্ডন শহর, অক্সফোর্ড, ম্যানচেস্টার, বার্মিংহাম, কার্ডিফ, ব্রাডফোর্ড, রেচলি, গ্লাসগো, শেফিল্ড, লুটন প্রভৃতি স্থানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে একাধিক সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সভা শুরুর প্রাক্কালে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করা হতো। সেসব সভায় প্রবাসী বাঙালি ছাড়াও বহু ব্রিটিশ নাগরিক উপস্থিত থাকতেন। সমাবেশে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, স্টিয়ারিং কমিটির অন্যান্য সদস্য এবং কখনো-কখনো ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী জন স্টোনহাউজ, ফেনার ব্রুকওয়ে, রেস প্রেন্টিস, জন পার্ডো, পিটার শোর, ব্রুস ডগলাস-ম্যান, মাইকেল বার্নস, একশন বাংলাদেশের পল কনেট ও মেরিয়েটা প্রকোপ এবং বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা-র শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা বক্তব্য রাখতেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীসহ তাঁর সঙ্গী স্টিয়ারিং কমিটির সদস্যবৃন্দকে সভা-সমাবেশ উপলক্ষে স্থানীয় রেস্তোরাঁর বাঙালি মালিকগণ প্রায়শই আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতেন। ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক পাকিস্তানকে অস্ত্র ও অন্যান্য সাহায্য দেয়া, বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা, নারীনির্যাতন ও ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম, পাকিস্তানে বন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সামরিক আদালতে প্রহসনমূলক বিচার অনুষ্ঠান ইত্যাদি বন্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের দাবিতে প্রবাসী বাঙালিরা বিভিন্ন সময় শোভাযাত্রা সহকারে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে স্মারকলিপি প্রদান করে। পাকিস্তান এইড কনসোর্টিয়ামের সভা চলাকালে স্টুডেন্টস একশন কমিটির সদস্যবৃন্দ প্যারিসে গিয়ে সাহায্য বন্ধের দাবিতে মানববন্ধন করেন। এপ্রিল মাসে পাকিস্তানি ক্রিকেট টিম ব্রিটেনে খেলতে গেলে স্টুডেন্টস একশন কমিটি ও প্রবাসী বাঙালিরা এর বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ-সমাবেশের আয়োজন করে। পাকিস্তানের প্রতি চীনের সাহায্য ও সমর্থন বন্ধের দাবিতে প্রবাসী বাঙালিরা লন্ডনস্থ চীনের দূতাবাসের সামনে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। বাংলাদেশ উইমেন্স এসোসিয়েশনও একাধিক সমাবেশের আয়োজন করে। এর সদস্যরা ব্যানার- প্লাকার্ডসহ শোভাযাত্রা নিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়া বাঙালি শরণার্থী বিশেষ করে নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের করুণ অবস্থার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণপূর্বক তাদের সহায়তা দানে ‘সেভ দ্য চিল্ড্রেন ফান্ড’ চ্যারিটি অর্গানাইজেশনের নিকট স্মারক লিপি পেশ করেন। তাঁরা অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গেও অনুরূপ যোগাযোগ করেন। মহিলা সমিতি মুক্তিযুদ্ধে আর্থিক সহায়তা দানে প্রবাসী বাঙালিদের নিকট থেকে ফান্ড সংগ্রহ করে। মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র সংগ্রহের লক্ষ্যে স্টিয়ারিং কমিটিও বাংলাদেশ ফান্ড নামে একটি তহবিল গড়ে তোলে।
পল কনেটের নেতৃত্বে ব্রিটিশ তরুণদের নিয়ে গঠিত Action Bangladesh-এর উদ্যোগে ১লা আগস্ট লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারে ২০ হাজার লোকের উপস্থিতিতে এক বিরাট জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে বিপুল সংখ্যক প্রবাসী বাঙালি ছাড়াও অনেক ইংরেজ উপস্থিত ছিলেন। এতে পল কনেট ছাড়াও বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য জন স্টোনহাউজ, পিটার শোর, ব্রুস ডগলাস-ম্যান, ফেনার ব্রুকওয়ে, লর্ড শিফার্ড, রেজ প্রেন্টিস, বেগম লুলু বিলকিস বানু, অশোক সেন, গাউস খান প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে বক্তারা পূর্ব বাংলায় গণহত্যা বন্ধ, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রত্যাহার এবং সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধুর তথাকথিত বিচারের পরিকল্পনা অনতিবিলম্বে বন্ধ করে তাঁর নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেন। এ অনুষ্ঠানে লন্ডনে পাকিস্তান হাইকমিশনে কর্মরত বাঙালি সেকেন্ড সেক্রেটারি মহিউদ্দিন আহমেদ পাকিস্তানের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। উল্লেখ্য, সভাশেষে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানি সেনাদের দখলকৃত এলাকায় ত্রাণ- সামগ্রী বিতরণের উদ্দেশ্যে Operation Omega-র একটি দল ভ্যান গাড়িতে করে ঐ স্থান ত্যাগ করে।
আগস্টের প্রথম সপ্তাহে সামরিক আদালতে পাকিস্তানে বন্দি বঙ্গবন্ধুর বিচারকার্য শুরু হবে মর্মে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে বাঙালিরা ভীষণভাবে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। প্রতিবাদে লন্ডনসহ বিভিন্ন দেশের প্রবাসী বাঙালিরা সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভের আয়োজন ও স্মারকলিপি পেশ করে। ১১ই আগস্ট লন্ডনের হাইড পার্কে এক বিরাট সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে ব্রিটেনের সর্বাঞ্চল থেকে বিপুল সংখ্যক বাঙালি যোগ দেয়। সভায় বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, স্টিয়ারিং কমিটি ও আঞ্চলিক একশন কমিটির নেতৃবৃন্দ বক্তৃতা করেন। তাঁরা বঙ্গবন্ধুর প্রহসনমূলক বিচারের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। সমাবেশ শেষে এক বিরাট শোভাযাত্রা সহকারে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে প্রধানমন্ত্রীর বাসভাবনে গিয়ে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে ব্রিটিশ এমপি পিটার শোর, মাইকেল বার্নস, ব্রুস ডগলাস-ম্যান, সাবেক মন্ত্রী জন স্টোনহাউজ প্রমুখ শোভাযাত্রার অগ্রভাগে ছিলেন।
বাংলাদেশের পক্ষে প্রচারণার অংশ হিসেবে স্টুডেন্টস একশন কমিটি ও স্টিয়ারিং কমিটি পত্রিকায় বিভিন্ন সময় বিজ্ঞাপন দেয়া ছাড়াও পোস্টার, লিফলেট, হ্যান্ডবিল, অন্যান্য প্রচারপত্র, পুস্তিকা ইত্যাদি প্রকাশ ও প্রচার করে। ২৪শে জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাউস অব কমন্সের হারকোট কক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ডাকটিকিট প্রকাশ বিভিন্ন গণমাধ্যমে গুরুত্বসহকারে প্রচার পায়। পরবর্তী মাসের ২৭শে আগস্ট লন্ডনে বাংলাদেশের হাইকমিশনের অফিস আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন ছিল আরো একটি বহুল আলোচিত ঘটনা (দেখুন মুক্তিযুদ্ধে কূটনীতিকদের ভূমিকা)। গণসংযোগের অংশ হিসেবে ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষায় একাধিক সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করা হয়। এর মধ্যে ওয়ালি আশরাফের সাপ্তাহিক জনমত, আমীর আলীর সম্পাদনায় জয়বাংলা পত্রিকা, স্টিয়ারিং কমিটির উদ্যোগে বাংলাদেশ টুডে ও সংবাদ পরিক্রমা, আব্দুল মতিনের সম্পাদনায় নিউজলেটার (পরবর্তীতে বাংলাদেশ নিউজলেটার) উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারের অংশ হিসেবে টাই, ব্যাজ, পতাকা ইত্যাদি তৈরি ও তা বিতরণ করা হয়।
প্রবাসী বাঙালিদের নানামুখী তৎপরতার ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে রিলিফ অপারেশনের নাম করে নদীমাতৃক বাংলাদেশে সৈন্য চলাচলের সুবিধার্থে যন্ত্রচালিত ছোট-ছোট নৌযান ক্রয়ের পাকিস্তানি প্রচেষ্টা সংশ্লিষ্ট দেশের শ্রমিকদের অসহযোগিতার কারণে ব্যর্থ হয়ে যায়।
বাংলাদেশ প্রশ্নে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের বিপুল সংখ্যক সদস্য খুবই সহানুভূতিশীল ছিলেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ-এর নেতৃত্বাধীন কনজার্ভেটিভ সরকারের অবস্থানও ছিল তদ্রূপ। কূটনৈতিক পর্যায়ে যুদ্ধের ৯ মাস ব্রিটিশ সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রবাসী বাঙালিদের সভা- সমাবেশে বেশকিছু ব্রিটিশ এমপি প্রায় নিয়মিত যোগদান ও বক্তব্য রাখতেন। মে মাসে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য ব্রুস ডগলাস- ম্যান ৩০০ সদস্যের স্বাক্ষরসহ পূর্ব বাংলায় যুদ্ধবিরতির জন্য সরকারের প্রতি ব্রিটিশ আহ্বান জানিয়ে এক প্রস্তাব আনেন। পার্লামেন্টের কার্যবিধির স্টান্ডিং অর্ডার নং ৯-এর আওতায় ১৪ই মে এ বিষয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে দীর্ঘ আলোচনা হয়। এছাড়াও অন্য সময় একই ধারায় পার্লামেন্ট সদস্যগণ বাংলাদেশ বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠানের সুযোগ গ্রহণ করেন। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, ৩০শে জুন ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ২১৬ জন এমপি বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের একটি প্রস্তাব পার্লামেন্টে উত্থাপন করেন। অন্যান্যের মধ্যে যুক্তরাজ্যে বিপুল সংখ্যক প্রবাসী বাঙালির উপস্থিতি ও তাদের সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার ফলে এরূপ অর্জন সম্ভব হয়েছিল।
লন্ডনে পাকিস্তানের হাইকমিশনার সালমান আলী বাঙালিদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির অপচেষ্টা চালায়। জনৈক আবুল হায়াত নামে একজন সিলেটিকে দিয়ে Pakistan Solidarity Front নামে একটি সংগঠন দাঁড় করাবার চেষ্টা করে। মুক্তি নামে একটি বাংলা সাপ্তাহিক প্রকাশ করে তাতে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা চালানো হয়, যেমন- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ভারতের ইন্ধনে পরিচালিত, মুজিবনগর সরকার ভারতের – পাশাপাশি ইসরাইলের নিকট থেকে অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য নিচ্ছে, বিবিসি-কে ‘ভারতীয় ব্রডকাস্টিং কোম্পানি’ হিসেবে আখ্যায়িত করা ইত্যাদি। যদিও বাঙালিদের মধ্যে তদ্রূপ কোনো সাড়া মেলেনি, তথাপি যুক্তরাজ্যে প্রবাসী বাঙালিদের একশন কমিটির এ্যাপেক্স বডি স্টিয়ারিং কমিটি এবং বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি আবু সাঈদ চৌধুরীকে পাকিস্তান হাইকমিশনের এসব অপতৎপরতাও শক্ত হাতে মোকাবেলা করতে হয়। পাকিস্তান হাইকমিশনের উদ্যোগ ও অর্থায়নে জুলাই মাসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইন (৫ই আগস্ট ১৯৬৯-১৮ই জুলাই ১৯৭১, এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে ইয়াহিয়া সরকার কর্তৃক নিযুক্ত), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহর আলী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কন্যা ও পাকিস্তানি নাগরিক এস সোলায়মানের স্ত্রী বেগম আখতার সোলায়মান ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তার পক্ষে সাফাই গাইতে যুক্তরাজ্যে গেলে প্রবাসী বাঙালিরা তাদের নির্জলা মিথ্যাচারের জোর প্রতিবাদ জানান। অপরদিকে তারা লন্ডনে স্থায়ীভাবে বসবাসরত হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর একমাত্র পুত্র রাশেদ সোহরাওয়ার্দীকে উপর্যুক্তদের মিথ্যাচারের তীব্র প্রতিবাদ করে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ সরকারের প্রতি দ্ব্যর্থহীন সমর্থনসূচক এক দীর্ঘ পত্র লিখতে উদ্বুদ্ধ করেন এবং ঐ পত্রের বক্তব্য বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়।
যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন প্রশাসন মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে। তারা বাংলাদেশ সংকটকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হিসেবে দেখে আসে। তখন বিশ্ব রাজনীতিতে চলছিল স্নায়ুযুদ্ধকাল। উল্লেখ্য একই সময় দুটি পরাশক্তি (যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন)-এর মধ্যে ভূ-র –রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ধারায় পাকিস্তানের সহায়তায় সে দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত ও মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানের সমর্থক চিনের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের নতুন এক যুগের সূচনা হয়। তবে মার্কিন জনমত, কংগ্রেস ও সিনেটের অনেক সদস্য, এমনকি নিক্সন প্রশাসনের কারো- কারো সহানুভূতি-সমর্থন বাংলাদেশের পক্ষে ছিল। নিক্সন প্রশাসনের ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে মার্কিন জনমত সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রবাসী বাঙালি, মার্কিন নাগরিক ও মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
যুক্তরাষ্ট্রে তখন প্রবাসী বাঙালিদের সংখ্যা ছিল খুবই কম (আনুমানিক ৪ হাজার)। তাদের মধ্যে ছিল বিভিন্ন অঙ্গরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাসরত কিছু বাঙালি, রেস্তোরাঁর মালিক, ছোটখাটো ব্যবসায়ী, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষা ও শিক্ষকতায় নিয়োজিত কিছু সংখ্যক ছাত্র-শিক্ষক-গবেষক, বাঙালি কূটনীতিক ও কিছু পেশাজীবী। প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, তাঁরা হলেন- কাজী শামসুদ্দীন আহমেদ (রেস্তোরাঁর মালিক, নিউ ইয়র্ক), স্থপতি ড. এফ আর খান (শিকাগো), এ এইচ মাহমুদ আলী (পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগকারী যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম বাঙালি কূটনীতিক), গাউসউদ্দিন আহমেদ (কূটনীতিক), আব্দুর রাজ্জাক (কূটনীতিক), হারুন আর রশিদ (প্রেষণে বিশ্বব্যাংকে কর্মরত পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগকারী সিএসপি), মুহিদ এ চৌধুরী, ফজলুল বারী, মোস্তাক আহমেদ, ডা. খন্দকার এম আলমগীর (নিউ ইয়র্ক), ড. রেজাউর রহমান (বোস্টন), ড. মাহবুব আলম (বোস্টন), রফিকুর রহমান (স্ট্যানফোর্ড), ফজলে বারী মালিক (ইন্ডিয়ানা), এম মোজহারুল হক (ফিলাডেলফিয়া), মিসেস আমেনা পন্নী (সানফ্রানসিস্কো), ড. এনায়েতুর রহিম (জর্জটাউন ইউনিভার্সিটি), জয়সী রহিম (ড. এনায়েতুর রহিমের স্ত্রী), ড. মোহম্মদ ইউনুস (টেনেসি), এনায়েত করিম (কূটনীতিক), এ এম এ মুহিত (কূটনীতিক), এম আর সিদ্দিকী (মুক্তিযুদ্ধকালে ওয়াশিংটন ডিসি-তে স্থাপিত বাংলাদেশ মিশনের প্রধান), এস এ করিম (কূটনীতিক), শাহ এ এম এস কিবরিয়া (কূটনীতিক), প্রফেসর রেহমান সোবহান (বাংলাদেশ সরকারের ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি), ড. এ আর মল্লিক (বাংলাদেশ সরকারের ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি), খোরশেদ আলম, মুহিউদ্দীন আলমগীর, হাবিবুর রহমান (ছাত্র, টেনেসি), শামসুল বারী (শিকাগো), ডা. এম হাসান (ওহিও) প্রমুখ।
মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে পূর্ব বাংলায় অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাঙালিরা ঘটনা প্রবাহের প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখছিলেন। পাকিস্তান মিশনের বাঙালি কূটনীতিক ও প্রবাসী বাঙালিরা নিজেদের মধ্যে বৈঠকে মিলিত হচ্ছিলেন। ২৫শে মার্চ নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সশস্ত্র আক্রমণ ও গণহত্যার খবর পাওয়ার পরপর যুক্তরাষ্ট্রে বাঙালি ছাত্র ও প্রবাসী বাঙালিরা স্বল্প সময়ের জন্য হলেও নিউইয়র্কে পাকিস্তান কনসাল জেনারেলের অফিস দখল করে নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। ২৯শে মার্চ ওয়াশিংটনে আমেরিকার কংগ্রেস ও স্টেট ডিপার্টমেন্টের সম্মুখে বাঙালিদের একটি বড় বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিভিন্ন অঙ্গরাষ্ট্র থেকে বহু সংখ্যক বাঙালি যোগ দেয়। প্রথম দিকে কাজী শামসুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন নিউইয়র্কভিত্তিক বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকা (পূর্বে, পাকিস্তান লীগ ও তৎপরবর্তী পূর্ব পাকিস্তান লীগ) বাঙালিদের বিক্ষোভ-সমাবেশ আয়োজনে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করে। এরপর যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহরে গড়ে ওঠা একশন কমিটির মতো যুক্তরাষ্ট্রেরও বিভিন্ন অঙ্গরাষ্ট্রে বিভিন্ন নামে প্রবাসী বাঙালিদের সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। জুন মাসে বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকা এরূপ ১৪টি সংগঠনের কর্মকর্তাদের নামের তালিকা প্রকাশ করে। তাঁরা হলেন- নিউইয়র্কে সভাপতি কে এস আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক ফাইজুর রহমান, কোষাধ্যক্ষ আব্দুল হক; লস এ্যাঞ্জেলেসে সভাপতি এস এম এস দোহা, সাধারণ সম্পাদক চন্দন দাস; বোস্টনে সভাপতি খোরশেদ আলম, সাধারণ সম্পাদক এম এ আলমগীর; ওয়াশিংটন ডিসিতে সভাপতি এনায়েতুর রহিম, সাধারণ সম্পাদক মোহসিন সিদ্দিক; শিকাগোতে সভাপতি এফ আর খান, সাধারণ সম্পাদক এম শামসুল বারী; কলোরাডোতে সভাপতি জেরাল্ড আর হ্যান্ড্রিক্স, সাধারণ সম্পাদক এম শের আলী; আরবানা ইলিনয়সে সভাপতি এইচ রহমান, সাধারণ সম্পাদক এ এস সাহাবুদ্দীন; পেনসিলভেনিয়াতে সভাপতি কিউ এম আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক আইয়ুব ইকবাল; টেক্সাসে সভাপতি হাফিজুর রহমান; ডেট্রয়েট মিশিগানে সভাপতি আব্দুস শহীদ, সাধারণ সম্পাদক মুস্তাফিজুর রহমান; নর্থ ক্যারোলিনাতে সভাপতি এ লতিফ চৌধুরী; ডেটন ওহিওতে সভাপতি এ কে এম আমিনুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক এ এইচ জাফরউল্লাহ; টেনেসিতে সভাপতি জিল্লুর রহমান আতাহার; কেন্টাকিতে সভাপতি জর্জ এইচ বায়েদবইস জুনিয়র, সাধারণ সম্পাদক শামসুল এইচ মোল্লা।
প্রবাসী বাঙালিদের কর্মতৎপরতার মধ্যে ছিল বাংলাদেশের ব্যাজ ধারণ করে পতাকা, ব্যানার ও প্লাকার্ড হাতে হোয়াইট হাউস, স্টেট ডিপার্টমেন্ট, কংগ্রেস ও বিশ্ব ব্যাংকের সম্মুখে বিক্ষোভ-সমাবেশ ও র্যালির আয়োজন, ছাত্র-শিক্ষক- গবেষকদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা ও ভারতে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের অবস্থা ইত্যাদি বিষয়ে সেমিনার ও আলোচনা সভার আয়োজন, পোস্টার, লিফলেট ও নিউজলেটার প্রকাশ, সিনেট সদস্য ও কংগ্রেসম্যানদের মধ্যে লবিং ও তাঁদের কাছে চিঠি লেখা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অর্থ সংগ্রহ ইত্যাদি। সংগ্রহকৃত অর্থ দিয়ে রেডিও ট্রান্সমিটার ও অন্যান্য কমিউনিকেশন যন্ত্র ক্রয় করে প্রবাসী বাঙালিরা মুজিবনগর সরকারের নিকট প্রেরণ করেন।
পাকিস্তানি সামরিক জান্তার পক্ষে সাপাই গাইতে ৭ জন বাঙালি তাবেদার যথা- সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন (উপাচার্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; জুলাইয়ের শেষে টিক্কা খান কর্তৃক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত), হামিদুল হক চৌধুরী (রাজনীতিবিদ ও ইংরেজি পত্রিকার মালিক), মাহমুদ আলী (রাজনীতিতে একসময় সক্রিয়), কাজী দীন মোহাম্মদ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান), বিচারপতি নুরুল ইসলাম, ড. মোহর আলী (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক) এবং বেগম আখতার সোলায়মান (প্রয়াত হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কন্যা ও পাকিস্তানি সিএসপি-র স্ত্রী) নিয়ে গঠিত একটি প্রতিনিধি দল জুলাই মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে গেলে প্রবাসী বাঙালিরা তাদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিক্ষোভের আয়োজন করে তাদের উদ্দেশ্য পণ্ড করে দেয়।
প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে স্থপতি ড. ফজলুল রহমান খান (এফ আর খান)-এর নাম সর্বজনবিদিত। তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর সকল প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রয়োগ করে মূল্যবান ভূমিকা পালন করেন। শিকাগোতে তিনি এ উপলক্ষে দুটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। একটি Bangladesh Defense League অপরটি Bangladesh Emergency Welfare Appeal। দ্বিতীয় সংগঠনের মাধ্যমে তিনি তাঁর মার্কিন সহকর্মী ও বিত্তবানদের নিকট থেকে ফান্ড সংগ্রহ করে মুজিবনগর সরকার ও ভারতে বাঙালি শরণার্থীদের জন্য তা প্রেরণ করেন। যুক্তরাজ্যসহ বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের প্রতিনিধি ও জাতিসংঘে স্থায়ী প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এবং বাংলাদেশ সরকারের ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি প্রফেসর রেহমান সোবহান প্রবাসী বাঙালি ও তাদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দের পাশাপাশি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন এবং পাকিস্তানকে কোনোরূপ সাহায্য-সহযোগিতা না দেয়ার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তব্য প্রদান, সিনেট ও কংগ্রেসম্যান এবং পাকিস্তান এইড কনসোর্টিয়াম সদস্যরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন।
৪ঠা আগস্ট ওয়াশিংটন ডিসি ও নিউইয়র্কের পাকিস্তান মিশনের সকল বাঙালি কর্মকর্তা ও সদস্যবর্গ একযোগে পদত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। এটি ছিল বাংলাদেশ সরকার ও প্রবাসী বাঙালিদের দীর্ঘ প্রতিক্ষিত। এ ঘটনা সর্বত্র চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। পরের দিন ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এম আর সিদ্দিকী এমএনএ ওয়াশিংটনে নতুন বাংলাদেশ মিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
মার্কিনীদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, যুদ্ধবিরোধী ছাত্র, শান্তিকর্মী, ধর্ম যাজক, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মী, সমুদ্র বন্দর শ্রমিক, সঙ্গীত শিল্পী, মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে পূর্ব বাংলায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বপালনরত ব্যক্তিবর্গ, সিনেট ও কংগ্রেস সদস্য প্রমুখের মধ্যে বাংলাদেশের পক্ষে একটি শক্তিশালী সমর্থন বলয় সৃষ্টি হয়। ফিলাডেলফিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও চার্চ নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল Friends of East Bengal নামে একটি শক্তিশালী সংগঠন। পূর্ব বাংলায় Cholera Research Labrotory-তে দায়িত্বপালনকারী একদল মার্কিন চিকিৎসক/বিজ্ঞানী যুদ্ধ শুরুর পর দেশে ফিরে এপ্রিল মাসে ওয়াশিংটন ডিসিতে Bangladesh Information Centre নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। সিনেটর ও কংগ্রেস সদস্যদের মধ্যে বাংলাদেশের পক্ষে লবিং, গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ, সংশ্লিষ্টদের নিকট প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ ও মার্কিন জনগণের মধ্যে জনমত গঠনে এ সংগঠন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত আন্না টেইলর নামে এক নারীর হোয়াইট হাউসের সামনে অনশন পালন মিডিয়াসহ ব্যাপক মার্কিনী জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। The Friends of East Bengal 4 Bangladesh Information Centre এবং অন্যান্যদের সমর্থন ও সহযোগিতায় ১৪ই অক্টোবর থেকে ১০ দিন ধরে হোয়াইট হাউসের পার্শ্ববর্তী দ্য লাফায়েত পার্কে ভারতে আশ্রয় নেয়া বাঙালি শরণার্থীদের অনুকরণে অস্থায়ী রিফিউজি ক্যাম্প স্থাপন ও বড়বড় পয়ঃনিষ্কাশন পাইপের মধ্যে আয়োজকদের অনেকে আশ্রয় নিয়ে একটি ভিন্নধর্মী প্রতিবাদের আয়োজন করে, যা গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পায়। প্রচুর প্রবাসী বাঙালি এতে যোগ দেয়। সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডিও পরিদর্শনে আসেন।
বাংলাদেশের সমর্থনে মার্কিন সঙ্গীত শিল্পীদের পক্ষ থেকে একটি বড় আয়োজন ছিল নিউইয়র্কের মেডিশন স্কোয়ারে বাংলাদেশ কনসার্ট। ১লা আগস্ট সেটি অনুষ্ঠিত হয়। প্রখ্যাত লোকসঙ্গীত শিল্পী জর্জ হ্যারিসন, রিংগো স্টার, লিওন রাসেল, বিলি প্রেস্টন, বব ডিলেন এবং বিশ্বখ্যাত সেতার বাদক পণ্ডিত রবি শংকর- ও ওস্তাদ আলী আকবর খান তাতে অংশ গ্রহণ করেন। ৪০ হাজারেরও অধিক লোক কনসার্টে যোগ দেয়। টিকেট বিক্রয়লব্ধ অর্থ ভারতে বাঙালি শরণার্থীদের জন্য দান করা হয়।
মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের মধ্যে সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি, সিনেটর উইলিয়াম স্যাক্সবি, সিনেটর ফ্রাঙ্ক চার্চ, – সিনেটর ফুলব্রাইট, সিনেটর ফ্রেড হ্যারিস, হাউস অব রিপ্রেজেন্টিটিভ সদস্য কর্নেলিয়াস গ্যালাহার প্রমুখ বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। এডওয়ার্ড কেনেডিসহ এঁদের কয়েকজন ভারতে বাঙালি শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শনে আসেন।
প্রবাসী বাঙালি ও মার্কিনীদের মধ্যে বাংলাদেশের বন্ধুদের তৎপরতার ফলে বেশকিছু সাফল্য অর্জিত হয়। এর মধ্যে বিভিন্ন সমুদ্র বন্দরে পাকিস্তানি জাহাজে অস্ত্র তুলতে মার্কিন শ্রমিকদের অস্বীকৃতি, পাকিস্তানের পক্ষত্যাগী বাঙালি নাবিকদের যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয়দানে আইনী সহায়তাদান, পাকিস্তানে মার্কিন সাহায্যের ক্ষেত্রে স্যাক্সবি-চার্চের যৌথ উদ্যোগে আইনী বিধানে পরিবর্তন এনে তা কংগ্রেসে পাস ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
জাপান
মুক্তিযুদ্ধকালে জাপানে প্রবাসী বাঙালিদের সংখ্যা খুবই সামান্য ছিল। সব মিলিয়ে কয়েকশ হবে মাত্র। রাজধানী টোকিও শহরে এ সংখ্যা ২ ডজনের বেশি নয়। প্রায় সবাই ছিলেন হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-গবেষক, না হয় প্রশিক্ষণার্থী। টোকিওর বাইরে অন্য শহরেও ছিল অনুরূপ অবস্থা। কর্ম-পেশায় নিয়োজিতদের সংখ্যা ছিল হাতে গোণা। এরপরও জাপানে প্রবাসী বাঙালিরা নীরব থাকেনি। ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর বর্বরোচিত আক্রমণ ও নির্বিচার হত্যা আর ধ্বংসযজ্ঞের খবর পৌছার পরপর টকিওতে বাঙালি ছাত্ররা মিলিত হয়ে বাংলাদেশ এসোসিয়েশন গঠন করে। ইস্কান্দার আহমেদ চৌধুরী ও মমতাজ ভূঁইয়া ছিলেন এর যুগ্ম-আহ্বায়ক। আমিনুল ইসলাম-কে নির্বাচিত করা হয় প্রতিনিধি বা মুখপাত্র। অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন- মুস্তাফিজুর রহমান, সৈয়দ মকবুল মর্তুজা, আনওয়ারুল করিম, আব্দুর রহমান প্রমুখ। এঁদের বিরুদ্ধে পাকিস্তান দূতাবাসের পক্ষ থেকে নানা অপতৎপরতা ও তাদের স্ব-স্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিকট শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি করা হলে বাঙালি ছাত্ররা ইস্কান্দার আহমেদ চৌধুরী-কে সভাপতি ও আমিনুল ইসলাম- কে সাধারণ সম্পাদক করে বাংলাদেশ সলিডারিটি লীগ নামে আরো একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে। উভয় সংগঠন পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার প্রতিবাদে পোস্টার, প্লা-কার্ড হাতে সড়কের পাশে অবস্থান, জাপানের গণমাধ্যমের সঙ্গে যোগাযোগ ও তথ্য সরবরাহ, জাপানের পার্লামেন্ট (ডায়েট) সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে পাকিস্তানকে সাহায্য দেয়া বন্ধের দাবি, মার্কিন সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানদের সঙ্গে পত্র যোগাযোগ ও পাকিস্তানি জান্তা সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগের অনুরোধ, ভারতে আশ্রয় নেয়া বাঙালি শরণার্থীদের সাহায্যার্থে ফান্ড সংগ্রহ ইত্যাদির মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। জাপানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন, জাপান সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ, গণমাধ্যমে প্রচার ইত্যাদি ক্ষেত্রে দীর্ঘ জাপান প্রবাসী ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তর কূটনীতিক পেশায় যোগ দেয়া শেখ আহমেদ জালাল (মৃত্যু ২০০৩) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ষাটের দশকের প্রথম দিকে তিনি মনবসু স্কলারশিপ নিয়ে জাপানে পড়াশুনা করতে যান। তখন থেকে দীর্ঘদিন তিনি দৈনিক ইত্তেফাক ও ইংরেজি দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার-এর টোকিও প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি রেডিও জাপানের বাংলা অনুষ্ঠানের সঙ্গেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি পাকিস্তান স্টুডেন্টস এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন। সাংবাদিকতা পেশাসহ তাঁর অবস্থানগত কারণে জাপানে তিনি বেশ প্রভাবশালী ছিলেন। জাপান সরকারের বিভিন্ন মহলে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল। তিনি জাপানি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ১১ই মে এক পত্রে জাপানে জনমত গঠন, সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ, পাকিস্তানি প্রোপাগান্ডার জবাব, ফান্ড সংগ্রহ ইত্যাদি ব্যাপারে তাঁকে দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে জাপানে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তাঁর ঐ দায়িত্ব পালন করেন।
২রা নভেম্বর টোকিও পাকিস্তান দূতাবাসের দুই বাঙালি কর্মকর্তা প্রেস এটাসি এস এম মাসুদ ও থার্ড সেক্রেটারি এম এ রহিম পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। তাঁরা সন্তানসহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে প্রচার অভিযানে অংশ নেন। তাঁদের এ অবস্থান প্রবাসী বাঙালিদের তৎপরতায় নতুন মাত্রা যোগ করে। এ-সময় বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এস এম মাসুদকে জাপানে বাংলাদেশের কূটনীতিক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। অন্যান্য দেশের মতো জাপানেও ভারতীয় নাগরিকগণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি খুবই সহানুভূতিশীল ছিলেন। তাঁরা বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজনের মাধ্যমে বাংলাদেশের পক্ষে ফান্ড সংগ্রহে সহায়তা করেন।
জাপানি নাগরিকদের মধ্যে দ্রুত বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতির সৃষ্টি হয়। সে দেশের বুদ্ধিজীবীদের অনেকে সক্রিয় ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসেন। আগস্ট মাসে ওসাকায় প্রফেসর সুরুসিমার নেতৃত্বে Bangladesh Solidarity Front গঠিত হয়। টোকিও-তে প্রফেসর ইউসি নারার উদ্যোগে গঠিত হয় Japan-Bangla Friendship Association। বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠন, জাপান সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ, পাকিস্তানে জাপানি সাহায্য বন্ধ, ভারতে বাঙালি শরণার্থীদের অর্থ সহায়তাদান ইত্যাদি ব্যাপারে এ সংগঠন প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে জাপানি নাগরিকদের উদ্যোগে ভারতে বাঙালি শরণার্থীদের সহায়তাদানে কমিটি গঠিত হয়।
জাপানে বাংলাদেশের এক অকৃতিম বন্ধু ছিলেন সর্বজনশ্রদ্ধেয় বর্ষিয়ান রাজনীতিক, ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৮২ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৭ বছর ধরে পার্লামেন্ট (ডায়েট)-এর সদস্য, সাবেক কেবিনেট মন্ত্রী তাকাশি হায়াকাওয়া (১৯১৬-১৯৮২)। ১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বর পূর্ব বাংলার উপকূলীয় অঞ্চলে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে কয়েক লক্ষ মানুষের প্রাণহানিসহ ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটে। সে-সময় তিনি ক্ষতিগ্রস্তদেরসাহায্যার্থে জাপানের রাস্তায় অর্থ সংগ্রহ করেন। ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময়ও তিনি সর্বাত্মক সাহায্য-সহানুভূতি নিয়ে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ান। তিনি জাপানবাসীর নিকট ‘মি. বাংলাদেশ’ নামে পরিচিত ছিলেন।
প্রকাশ্যে বক্তব্য-বিবৃতি দেয়া থেকে বিরত থাকলেও শুরু থেকেই প্রধানমন্ত্রী ইসাকু সাটোর জাপান সরকার বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। পাকিস্তানে জাপানি সাহায্য কার্যত বন্ধ রাখা হয়। এস এম মাসুদ ও এম এ রহিম নামে জাপানে যে দুজন বাঙালি কূটনীতিক ২রা নভেম্বর পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন, জাপান সরকার বিশেষ বিবেচনায় তাঁদের ২ মাসের জন্য সে দেশে থাকার অনুমতি দেয়। ডিসেম্বর মাসে জাপান জাতিসংঘে উত্থাপিত একাধিক প্রস্তাবের সহ-প্রস্তাবক ছিল। জাপান ছিল স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানকারী প্রথমদিকের দেশসমূহের মধ্যে অন্যতম (১০ই ফেব্রুয়ারি ১৯৭২)।
অন্যান্য দেশ
যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের বাইরেও বিভিন্ন দেশের প্রবাসী বাঙালিরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। মাত্র ৬-৭ জন বাঙালি যুবক একত্রিত হয়ে নরওয়েতে কমিটি গঠন করে তৎপরতা চালায়। সুইডেনে আব্দুর রাজ্জাক (পাকিস্তান পররাষ্ট্র দপ্তরের সাবেক কর্মকর্তা), দীপক লাহিড়ী; ডেনমার্কে মতিউর রহমান ও লিয়াকত; নরওয়েতে রকিবুজ্জামান, হামিদুল ইসলাম, আলী ইউসুফ; কানাডায় এস এম হোসাইন (কুইবেক), এম মিজানুর রহমান (টরেন্টো), শাজাহান কবির (ভ্যানকুবার) মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধকালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রবাসী বাঙালিরা অনন্যসাধারণ ভূমিকা পালন করেন। তবে তাঁদের মধ্যে যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাঙালিদের ভূমিকা ছিল সর্বাধিক ও সুসংগঠিত। ব্রিটেনে বিপুল সংখ্যক প্রবাসী বাঙালির বসবাস এর অন্যতম কারণ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে সমর্থনে যেসব একশন কমিটি বা সংগঠন বিভিন্ন দেশে গড়ে উঠেছিল, তাতে শুধু প্রবাসী বাঙালিরাই নয়, কোথাও- কোথাও বিদেশীরাও তার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। যেমন সুইডেনের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও পরবর্তীতে নভেল লরেট গুনার মীর্জাল সেদেশে বাংলাদেশ একশন কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। ডেনমার্কে কিস্টেন ওয়েস্ট গার্ড ও মিমি খ্রিস্টিয়ান সেন-এর নেতৃত্বে একদল ডেনিস মহিলা প্রায় সর্বস্ব পণ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নিজেদের যুক্ত করেন। তাঁরা ডেনমার্কের ভাষায় একটি সংবাদ বুলেটিনও প্রকাশ করেন। লন্ডনে পল কনেট নামে একজন তরুণ ব্রিটিশ শিক্ষকের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল ব্রিটিশ তরুণ-তরুণীদের ‘একশন বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠন, যা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। (দ্রষ্টব্য মুক্তিযুদ্ধে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার ভূমিকা- এবং পল কনেট)।
উল্লেখ্য যে, ১৭ই সেপ্টেম্বর ফরাসি সাহিত্যিক, বামপন্থী রাজনীতিবিদ ও সরকারের সাবেক মন্ত্রী আঁদ্রে মালরো (বয়স ৭১) এক বিবৃতিতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালিদের সঙ্গে মিশে মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণের ঘোষণা দিয়েছিলেন, যা তখন সর্বত্র চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্রঃ হারুন-অর-রশিদ, “British perspectives, pressures and publicity regarding Bangladesh, 1971”, Contemporary South Asia 1995, 4 (2), 139-149; A M A Muhith, American Response to Bangladesh Liberation War, Dhaka, University Press Limited 1996; আবু সাঈদ চৌধুরী, প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি, ঢাকা, ইউপিএল ২০১২; শেখ আবদুল মান্নান, মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাজ্যের বাঙালীর অবদান, ঢাকা, জ্যোৎস্না পাবলিশার্স ১৯৯৮; আবদুল মতিন, স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙালী, বাংলাদেশ : ১৯৭১, লন্ডন, র্যাডিক্যাল এশিয়া পাবলিকেশন্স ১৯৯১; Sukumar Biswas, JAPAN AND THE EMERGENCE OF BANGLADESH, Dhaka, Agamee Prakashani 1998; Sheikh Ahmed Jalal, Japan’s Contribution in the Independence of Bangladesh, Dhaka, Hakkani Publishers 2002; বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক-এর সঙ্গে সাক্ষাৎকার, ৫ই মে ২০১৯
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড