মৌলভীবাজার জেলার বীরাঙ্গনা প্রভা রানী মালাকার
প্রভা রানী মালাকার মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার মির্জাপুর গ্রামের এক বীরাঙ্গনা রানী। তাঁর ওপর পরিচালিত পাশবিক নির্যাতনের হৃদয়বিদারক ঘটনা পাকবাহিনী ও রাজাকার দের নির্মমতার এক নিদর্শন কেবল মুক্তিযুদ্ধের সময় নয়, স্বাধীনতার পরও রাজাকারদের হাতে তাঁকে যে-নিষ্ঠুরতা ও অত্যাচারের মোকাবেলা করতে হয়, তাও কম মর্মস্পর্শী নয়। মুক্তিযুদ্ধে জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ সম্ভ্রম হারিয়ে তিনি এখনো সামাজিক অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্য ও দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত।
প্রভা রানীর জন্ম কমলগঞ্জ উপজেলার বিক্রম কলস গ্রামে। ১৯৭১ সালে প্রভা রানীর বয়স ছিল ১৫ বছর। দরিদ্র পিতা এ বয়সে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন পার্শ্ববর্তী মির্জাপুর গ্রামের কামিনী রাম মালাকারের সঙ্গে। তাদের বিয়ে হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ শুরুর তিন মাসে আগে। যুদ্ধের প্রথমদিকে কামিনী রাম ভারতে চলে যান। নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে প্রভা রানী আশ্রয় নেন পিতৃবাড়ি বিক্রম কলস গ্রামে মায়ের কাছে। এখান থেকে একদিন সন্ধ্যায় রাজাকার নজির মিয়া (পিতা হাজী কুরফান আলী, বিক্রম কলস, কমলগঞ্জ) ও জহুর মিয়া (পিতা জানু উল্যা, বনগাঁও, ইউনিয়ন মুন্সীবাজার, কমলগঞ্জ) প্রভা রানীকে তার মায়ের সামনে থেকে জোরপূর্বক বাদল মাস্টারের বাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। সেদিন পাকিস্তানি হানাদারদের একটি দল সেই বাড়িতেই অবস্থান করছিল। এক সময় তিনি এখান থেকে পালাবার কথা ভেবেছিলেন, কিন্তু পাকসেনা ও রাজাকারদের ভয়ে নিজেকে নিরস্ত করেন। রাতে পাকসেনারা প্রভা রানীর ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়।
পরদিন পাকিস্তানিরা তাকে ছেড়ে দিলে তিনি জাঙ্গাল হাটি গ্রামে তার বোনের বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখানে তিনি আত্মগোপন করে থাকেন। কিন্তু ২০-২৫ দিন পর রাজাকার কাদির মিয়া (পিতা আব্দুল করিম চৌধুরী, সরিষকান্দি, ইউনিয়ন মুন্সীবাজার, কমলগঞ্জ), রইছ মিয়া (পিতা রিয়াছত উল্যা, মইডাইল, ইউনিয়ন মুন্সীবাজার, কমলগঞ্জ), ইন্তাজ মিয়া (পিতা সোনা উল্যা, ভূমিগ্রাম, ইউনিয়ন মুন্সীবাজার, কমলগঞ্জ), জহুর প্রমুখ প্রভা রানীর সন্ধান পায়। রাজাকারদের হাত থেকে বাঁচার জন্য তিনি ধানের বীজতলার আইলের নিচে আশ্রয় নেন। শত চেষ্টা করেও প্রভা রানী তাদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারেননি। রাজাকার কাদির, রইছ, ইন্তাজ ও জহুর সেখান থেকে তাকে জোর করে ধরে নিয়ে আসে। জাঙ্গাল হাটির গফুর মিয়া প্রভা রানীকে বাঁচাতে গিয়ে রাজাকারদের হাতে লাঞ্চিত হন। রাজাকাররা তাকে ধরে নিয়ে আসার সময় তার পালিত কুকুরটি প্রভা রানীর কাপড় ধরে এক দিকে টানতে থাকে। সোনারার দিঘীর পার পর্যন্ত কুকুরটি আসার পর সেটিকে তারা গুলি করে মেরে ফেলে। রাজাকাররা প্রভা রানীকে শমশেরনগর ডাকবাংলোয় অবস্থিত পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সারারাত পাকিস্তানি সেনারা তাকে পর্যায়ক্রমে ধর্ষণ করে। নিজেকে বাঁচানোর সকল চেষ্টা করেও তিনি রক্ষা পাননি। অনেক কাকুতি-মিনতি করেছিলেন হানাদারদের কাছে, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। এক সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন প্রভা রানী। সারারাত পাশবিক নির্যাতনের পর সবাই চলে গেলে ভোর রাতে তিনি পাকসেনাদের ক্যাম্প থেকে পালিয়ে কোনোরকমে হেঁটে বোনের বাড়িতে যান।
নয় মাস যুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হয়। প্রভা রানীর স্বামী ভারত থেকে দেশে এসে তাকে স্ত্রী হিসেবে নিজ বাড়িতে আনতে গেলে প্রথমে তিনি আসতে রাজি হননি। সবকিছু খুলে বললে স্বামীর জবাব ছিল, ‘তোমার মতো লাখ লাখ নারী ইজ্জত দিয়েছেন দেশের জন্য। তুমিও তাদের একজন। তাই কোনো দুঃখ নেই।’ ১৯৭২ সালে প্রভা রানীর একমাত্র ছেলে কাজল মালাকারের জন্ম হয়। জন্ম থেকে কাজল কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন। স্বাধীনতার পর প্রভা রানীর ইজ্জত লুণ্ঠনকারী দলের নজির, ইন্তাজ, ইদ্রিছ (পিতা হাজির মোহাম্মদ, গ্রাম সতিজিরগাঁও, ইউনিয়ন শমশেরনগর, কমলগঞ্জ) ও রইছ কারাভোগ করে। কারাগার থেকে বের হয়ে রাজাকার ইদ্রিছ প্রভা রানীর স্বামীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করলে তিনি কারারুদ্ধ হন। রাজাকারদের নানা রকম শত্রুতা ও অত্যাচারের কারণে কয়েক বছর পর প্রভা রানীর স্বামী কামিনী রাম মারা যান।
স্বামীর মৃত্যুর পর প্রভা রানীর কষ্ট ও যন্ত্রণার নতুন অধ্যায় শুরু হয়। একদিকে অসুস্থ সন্তানের লালন-পালন, চিকিৎসা ও সংসার চালানোর সকল দায়িত্ব তার ওপর পড়ে, অন্যদিকে তিনি সামাজিক বঞ্চনা ও নিগ্রহের শিকার হতে থাকেন। তার অসুস্থ সন্তানটিকে কেউ-কেউ ‘পাঞ্জাবির সন্তান’ ও তাকে ‘পাঞ্জাবির বউ’ বলে বিদ্রুপ করতে থাকে। স্বামীর রেখে যাওয়া বসতবাড়ি ও জমিজমা নিয়ে বিবাদ ও মামলা-মোকদ্দমা চলতে থাকে প্রভাবশালীদের সঙ্গে। এক সময় স্থানীয় ভূমিদস্যুরা দখল করে নেয় তাদের শেষ ভিটেমাটি। নিঃস্ব প্রভা রানী জীবন বাঁচানোর জন্য ফেরিওয়ালার কাজ বেছে নেন। এখনো মাথায় টুকরি নিয়ে নানা সামগ্রী এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে ফেরি করেন। এভাবে অর্জিত সামান্য আয় থেকে পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করেন। ছেলে কাজল বড় হলে তার বিয়ে দেন। ছেলের ঘরে এখন প্রভা রানীর ছয় নাতনি। অসুস্থ কাজল রিক্সা চালিয়ে ও মা ফেরি করে যা আয় করেন, তা দিয়ে কোনোক্রমে ৯ সদস্যের সংসার চলে।
নির্যাতিত ও নিগৃহীত প্রভা রানী দীর্ঘদিন হলো বীরাঙ্গনার স্বীকৃতির জন্য লড়াই করছেন। এখনো তার লড়াই থামেনি। যদিও তার জানা নেই কবে তিনি এ স্বীকৃতি পাবেন অথবা আদৌ পাবেন কিনা। [মুজিবুর রহমান রঞ্জু]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড