You dont have javascript enabled! Please enable it!

প্রশিক্ষণ শিবির

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ। এ-যুদ্ধে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিভিন্ন নিয়মিত সৈনিক ছাড়া বিপুলসংখ্যক ছাত্র-যুবক-তরুণ-কৃষক-শ্রমিক-সাধারণ মানুষ অংশগ্রহণ করেন। এ বিরাট সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মুখ বা গেরিলা যুদ্ধে পাঠানোর পূর্বে প্রশিক্ষিত করা হয়। তাঁদের প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য প্রথমদিকে দেশের ভেতরে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের উদ্যোগ ও সহায়তায় এবং পরে ভারতের বিভিন্ন স্থানে অনেক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বা প্রশিক্ষণ শিবির গড়ে তোলা হয়। এসব প্রশিক্ষণ শিবির থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশের বহু এলাকা শত্রুমুক্ত করেন। মুক্তিযুদ্ধের সফলতার পেছনে এসব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সাতই মার্চের ভাষণ-এ বাঙালি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তাঁর এ ভাষণের পরপর সারাদেশে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়। আর এ প্রস্তুতির একটি বড় ও গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ প্রদান। রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, ন্যাপকমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়ন-এর নেতা-কর্মীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদান শুরু করেন।
১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মানচিত্র লক্ষ করলে জনযুদ্ধের ব্যাপকতা এবং প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। মার্চ মাসে দেশের প্রতিটি নগর, জেলা শহর, মহকুমা, থানা, বড়বড় গঞ্জ-বন্দর, প্রত্যন্ত অঞ্চল, টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, মেহেরপুর থেকে তামাবিল, কুয়াকাটা থেকে পঞ্চগড় সর্বত্র মানুষ এক সঙ্গে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে জ্বলে উঠেছিল। গোটা বাঙালি জাতি ফুঁসে উঠেছিল হানাদারদের নৃশংস আক্রমণের খবর পেয়ে। জাতির ঐ ক্রান্তিলগ্নে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে ওঠা জনগণের বাহিনী, সামরিক- আধাসামরিক বাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসন পরস্পরের পাশে এসে দাঁড়ায়। তখন কোনো ভেদাভেদ ছিল না। জনগণের বিভিন্ন স্তর থেকে নেতৃত্বও আসে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। কখনো রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ-জনপ্রতিনিধিরা, কখনো সেনানায়করা, আবার কখনো স্থানীয় প্রশাসন বা স্থানীয় ব্যক্তিবর্গ এগিয়ে আসেন নেতৃত্ব প্রদানে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মোট কতগুলো প্রশিক্ষণ শিবির ছিল, তার সঠিক পরিসংখ্যান দেয়া দুরূহ। তবে অনুমান করা হয়, যতগুলো যুব শিবির ছিল, ঠিক ততগুলো প্রশিক্ষণ শিবিরও ছিল। ভারতের অভ্যন্তরে স্থাপিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রশিক্ষণ শিবির হলো- ১. হরিণা প্রশিক্ষণ শিবির: এ প্রশিক্ষণ শিবির ছিল ভারতের দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলায়। এখানে ১ হাজার তরুণকে প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা ছিল। এ শিবিরের দায়িত্বে ছিলেন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক; ২. সোনামুড়া প্রশিক্ষণ শিবির এটি ভারতের পশ্চিম ত্রিপুরা জেলার অন্তর্গত। সোনামুড়ায় ৪টি প্রশিক্ষণ শিবির ছিল। সেগুলো হলো- কাঁঠালিয়া, বক্সনগর, হাতিমারা ও মেলাঘর; ৩. ছোটখোলা প্রশিক্ষণ শিবির: এটি একিনপুর সংলগ্ন; এ শিবিরে ৪০০ মুক্তিযোদ্ধাকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এ শিবিরের প্রধান ছিলেন খাজা আহমেদ এমএনএ; ৪. রাধানগর প্রশিক্ষণ শিবির: এ শিবির ত্রিপুরা রাজ্যভুক্ত ছিল। এটি বাংলাদেশের সীমান্তের কাছাকাছি বলে প্রশিক্ষিত যুবকরা খুব সহজেই এখান থেকে কার্যক্রম চালাতে পারতেন। এখানে ১ হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে প্রশিক্ষণ দেয়ার সুযোগ থাকলেও ৪০০ জনকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এখানে বহু প্রতিকূলতার মধ্যে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এখানে শিবির প্রধান ছিলেন অধ্যাপক এ হানিফ এমএনএ; ৫. উদয়পুর প্রশিক্ষণ শিবির: এ প্রশিক্ষণ শিবিরও ত্রিপুরা রাজ্যে ছিল। এটি মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। ক্যাপ্টেন এম আলী এমএনএ এ শিবিরের প্রধান ছিলেন; ৬. মোহনপুর প্রশিক্ষণ শিবির: এখানে অনেক মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এখানকার প্রধান ছিলেন শরীফুদ্দীন আহমেদ এমপিএ; ৭. সিলেট প্রশিক্ষণ শিবির: এখানে ৩টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল। শিবিরগুলো হলো পাথারকান্দি, খোয়াই ও কৈলাশহর। এ ৩ শিবিরের প্রধান ছিলেন যথাক্রমে আবদুল মোমেন (সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক), মুস্তাফা শহীদ এমপিএ ও মানিক চৌধুরী এমএনএ। সিলেট অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা এখানে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
উপর্যুক্ত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো ছাড়া আরো কিছু স্থানে প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। যেমন, পশ্চিমবঙ্গের— মাজদিয়া, ডোমপুকুর, বঙ্কিমপুর, রানাঘাট, কল্যাণী, বনগাঁও, হাবড়া, বসিরহাট, – টাকিপুর, হিঙ্গালগঞ্জ ও কাদিহাটি; মেঘালয়ের— মানকেরচর, তেলঢালা, ছাইমাড়া, বরাকশিয়া, মহেন্দ্রগঞ্জ, ডালু, মাচাংপানি, গাচুয়া পাড়া, বাঘমারা, শিববাড়ি, রংড়া, উদয়পুর, আলম বাজার, ধুবড়ি ও মেথালী; ত্রিপুরার শিলাছড়া, ধর্মনগর, কৈলাশহর, কমলাপুর, আশারামবাড়ি, মনতালা, জয়নগর, গোকুলনগর, সাবরুম, শ্রীনগর, হরিষমুখ, পালাটানা, হাপানিয়া, হাজিমারা ও কোনাবলে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল।
মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে অনেক স্থানে পাকিস্তানিদের। প্রতিরোধ করা গেলেও পরে তাদের ভারী কামান, ট্যাংক ইত্যাদি উন্নততর অস্ত্রের সম্মুখে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব হয়নি। ইতোমধ্যে সমুদ্রপথে নিয়ে আসা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ইউনিটগুলো চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পূর্ব বাংলায় প্রবেশ করে। তারা সংখ্যায় ছিল অধিক। দ্বিতীয়ত, তাদের বিমান বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের শক্ত অবস্থানগুলোতে অবিরাম বোমা ও গুলিবর্ষণ করে। ফলে অনেক প্রতিরোধযোদ্ধা শহীদ হন। বিপুলসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। এ পর্যায়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হলেও মুক্তিযোদ্ধারা শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টা করেন। নতুন-নতুন মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুট হন, তাঁদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয় এবং অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করা হয়। এপ্রিল থেকে জুলাই এ সময়ে পাকিস্তানিরা সারা বাংলাদেশে হত্যা, লুটতরাজ, ধর্ষণ ও ব্যাপক গণহত্যায় মেতে উঠেছিল পৈশাচিক উন্মত্ততায়। আর তখন অগণিত মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটে যায় ভারতে। সেখানে নামে শরণার্থীর ঢল।
জুলাই থেকে মুক্তিবাহিনীর পাল্টা আক্রমণ শুরু হয়। এ- সময় এবং এর পূর্বে অগণিত ছাত্র-যুবক মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তখন অস্ত্র ও অন্যান্য সাহায্য আসতে থাকে। বাংলাদেশ সরকার- প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় অসংখ্য যুব শিবির ও প্রশিক্ষণ শিবির। সুশৃঙ্খল সেনাকমান্ড সৃষ্টি হয়। প্রধান সেনাপতি, চিফ অফ স্টাফ, উপ-চিফ অব স্টাফ এবং সেক্টর কমান্ডারদের নিয়ে চেইন-অব-কমান্ড প্রতিষ্ঠিত হয়। সামরিক পরিকল্পনা কেন্দ্রীয়ভাবে সমন্বিত হয়। সামরিক শক্তির পাশাপাশি বেসামরিক প্রশাসন, আঞ্চলিক পরিষদ, যুব শিবির ইত্যাদি সৃষ্টি করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল ধরনের সদস্যকে সে-সময় প্রধানত তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়। ছাত্র-তরুণ- অসামরিক ব্যক্তি সমন্বয়ে গঠিত হয় মুক্তিযোদ্ধা (freedom fighters) বা গণবাহিনী। তাঁদের একটি অংশ বিশেষ করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষার্থীদের নিয়ে মুজিব বাহিনী বা বিএলএফ (Bangladesh Liberation Force) গঠিত হয়। মুক্তিবাহিনী (Mukti Fouz) গঠিত হয় নিয়মিত বাহিনীর সদস্য, বিশেষ বাহিনীর সদস্য ও ব্যাটালিয়ন সমন্বয়ে। যুদ্ধ পরিচালনার জন্য সমগ্র দেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। জুলাই মাস ও এরপর বাংলাদেশ সরকার তিন সেনা অফিসার যথা মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর খালেদ মোশাররফ ও মেজর কে এম সফিউল্লাহর নামের আদ্যক্ষর নিয়ে নিয়মিত বাহিনী হিসেবে ৩টি অতিরিক্ত ব্যাটালিয়ন প্রতিষ্ঠা করে। এ তিন বাহিনী ‘জেড ফোর্স”, “কে ফোর্স’ ও ‘এস ফোর্স’ নামে পরিচিত ছিল। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধকালে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নৌ-কমান্ডো বাহিনী ও ছোট আকারে একটি বিমান বাহিনী গঠিত হয়েছিল। বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে ভারত সরকার ছাত্র-যুবক ও সাধারণ মানুষদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। ভারতীয় সেনাবাহিনী মুক্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে। বাংলাদেশের সেনা-কর্মকর্তাদের মধ্যে যাঁরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনী থেকে বিদ্রোহ করে চলে এসেছিলেন, তাঁরাও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেন। সৈনিকরা গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে সাধারণ মানুষদের, যাদের অনেকেই কোনো দিন আগ্নেয়াস্ত্র চোখে দেখেননি, তাদের সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণের পর একেকজন বিচক্ষণ ও সাহসী যোদ্ধায় রূপান্তরিত হয়েছিলেন। সীমান্ত এলাকায় মুক্তিবাহিনীর অপারেশনকালে ভারতীয় সেনাবাহিনী সহায়তা করত এবং শেষের দিকে বিমান সাহায্য দেয়। মুক্তিবাহিনীর আঞ্চলিক অফিস ছিল সীমান্ত এলাকায়। আর প্রধান দপ্তর ছিল কলকাতায়। প্রধান সেনাপতি এম এ জি ওসমানী কলকাতা অফিসে বসতেন। ভারতীয় বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান অফিস ছিল কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতেন। প্রথমে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল অনকার সিং কালকাট। পরে এ দায়িত্ব পান মেজর জেনারেল বি এন সরকার। ভারতের বেশ কয়েকটি স্থানে ও সেনা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। মুক্তিযুদ্ধকালে রণাঙ্গনে নিয়োজিত মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ছিল এরূপ- মুক্তিবাহিনী বা গণবাহিনী ১ লক্ষ ৫৭ হাজার ৫০০, নিয়মিত বাহিনী (বাঙালি সেনাসস্য, ইপিআর, পুলিশ ইত্যাদি) ২৯ হাজার ২৫৬, নৌ-কমান্ডো ৫ শতাধিক, বিএলএফ ১০ হাজার, ন্যাপকমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন মিলে ৫ হাজার মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির (চীনপন্থী দলসমূহ) ৩ হাজার। এছাড়া, দেশের অভ্যন্তরে স্থানীয়ভাবে বেশ কয়েকটি মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী গড়ে উঠেছিল। সেসব বাহিনীর মধ্যে কাদেরিয়া বাহিনী (১৭,০০০), হেমায়েত বাহিনী (১,০০০), বাতেন বাহিনী (৫,০০০), আকবর বাহিনী (১,১২৮), আফসার বাহিনী (৪,৫০০), সুন্দরবনে জিয়াউদ্দিনের বাহিনী (১৬,০০০), আফতাব বাহিনী (১৮,০০০), পলাশডাঙ্গা যুব শিবির- (৫০০) উল্লেখযোগ্য। শিক্ষক, শিল্পী, ছাত্র, যুবক, শ্রমিক, কৃষক-সহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র-সহ বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে অনেককে প্রশিক্ষণ দিয়ে বিভিন্ন সেক্টরে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। তাঁদের মধ্য থেকে ছাত্র-যুবক-তরুণদের সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছিল গেরিলা বাহিনী। গেরিলা বাহিনীর সদস্যদের বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। তাঁরা আড়ালে, আবডালে থেকে গোপন ও ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র আক্রমণ পরিচালনা করতেন। তাঁরা শত্রুসেনা-দখলকৃত এলাকাগুলোতে পৌঁছে বিস্ফোরক জ্বালিয়ে, গ্রেনেড ছুড়ে, হাতবোমা ফাটিয়ে, দেশীয় অস্ত্র নিয়ে এবং সুযোগমতো পিস্তল দিয়ে গুলি ছুড়ে পাকিস্তানি সৈনিকদের ঘাঁটি ও ছাউনিগুলো ধ্বংস করতেন। গেরিলারা শহরের সরকারি বিভিন্ন স্থাপনায় অপারেশন চালিয়ে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর তৎপরতায় বিঘ্ন ঘটিয়ে তাদের জন্য অস্বাভাবিক অবস্থা সৃষ্টি করতেন বলে পাকিস্তানি সৈনিকরা সর্বদা অস্থির অবস্থায় থাকত। গেরিলা বাহিনীর এসব কৌশল এবং তাদের। দুঃসাহসিক অভিযান ও বিস্ময়সৃষ্টিকারী অপারেশন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে বিপর্যস্ত করেছিল। গেরিলা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বীরযোদ্ধারা স্ব-স্ব এলাকায় এসে বিশ্বস্ত ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের তরুণদের সংগঠিত করে স্বল্প সময়ের মধ্যে তাঁদের অস্ত্র চালনা বিষয়ক শিক্ষা দিয়ে পাকিস্তানি দালালদের ঘরবাড়ি ও আস্তানায় আক্রমণ চালাতেন। ফলে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর মেরুদণ্ড ভেঙ্গে পড়তে থাকে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলা বাহিনীর মধ্যে ক্র্যাক প্লাটুন-এর সদস্যদের দুঃসাহসিক অপারেশন ঢাকাবাসীর কাছে এখনো স্মরণীয় হয়ে আছে। [মোনায়েম সরকার]
তথ্যসূত্র: এইচ টি ইমাম, বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১, বাংলা একাডেমি, ঢাকা ২০১২; হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদিত), বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, ৯ম, ১০ম, ১১শ খণ্ড, ঢাকা ১৯৮২; বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ-এর পক্ষে মোনায়েম সরকার কর্তৃক প্রকাশিত থিমেটিক ম্যাপ : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ (মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ শিবির), ঢাকা ২০০০

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!