You dont have javascript enabled! Please enable it!

পেয়ারা বাগানের যুদ্ধ (ঝালকাঠি সদর)

পেয়ারা বাগানের যুদ্ধ (ঝালকাঠি সদর) সংঘটিত হয় জুন মাসে। এ-সময় পাকবাহিনী ঝালকাঠি ও স্বরূপকাঠি থানার মধ্যবর্তী আটঘর-কুড়িয়ানায় তাদের আক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধি করে। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, এখানকার পেয়ারা বাগানে মুক্তিবাহিনীর শক্ত ঘাঁটি রয়েছে। তাই তারা পেয়ারা বাগান ধ্বংসের পরিকল্পনা করে। অবশ্য পেয়ারা বাগান ধ্বংসের অন্য দুটি কারণও ছিল। তার একটি হলো, পাকবাহিনী যখন পটুয়াখালী দখল করে তখন সেখানকার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন সি আর দত্ত। তিনি পরিবার- পরিজন নিয়ে পালিয়ে এসে ঝালকাঠির অঞ্জন ডাক্তারের পরিবারের সঙ্গে এ পেয়ারা বাগানে অবস্থান করছেন এমন একটি খবর পাকবাহিনীর কাছে ছিল। তাই তাঁকে ধরার জন্য পাকিস্তানি মেজর পারভেজ পটুয়াখালী থেকে কয়েকজন সেনাকে সেখানে পাঠায়। পাকসেনাদের দলটি স্পিডবোটে সেখানে পৌছে মাইকযোগে সি আর দত্তের পরিবারের অনুসন্ধান চালায়। ঐ সময় সিরাজ সিকদারের বাহিনী ঐ দলটিকে আক্রমণ করে পাকসেনাদের হত্যা করে স্পিডবোটটি দখল করে নেয়। এতে পাকবাহিনী অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে।
অপর কারণটি ছিল, পাকিস্তানি বাহিনীর ঘোর সমর্থক শর্ষিণার পীরকে নিরাপদ রাখা। তিনি মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তার এলাকায় পাকসেনা পাঠানোর অনুরোধ করেন। তার অনুরোধে পাকসেনাদের একটি দল দ্বিতীয়বার দুটি লঞ্চযোগে কুড়িয়ানা খাল দিয়ে শর্ষিণার দিকে অগ্রসর হয়। আরেকটি দল বরিশাল থেকে দুটি লঞ্চে করে আটঘর-কুড়িয়ানার মধ্য দিয়ে শর্ষিণার দিকে অগ্রসর হয়। এ সংবাদ পেয়ে নৌ-কমান্ডো বাহিনীর মাহফুজ বেগ, শচীন কর্মকার, সেন্টু, টিপু, জি এম কবির ভুলু, তোফাজ্জেল হক চৌধুরী প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা লঞ্চদুটি আক্রমণ করেন। কিন্তু ভারী অস্ত্রে সজ্জিত পাকবাহিনীকে হালকা অস্ত্র দিয়ে প্রতিরোধ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় মুক্তিবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। এ অভিযানে অংশ নিতে গিয়ে সিরাজ সিকদার বাহিনীর মুজিবুল হক মেহেদী-সহ আরো কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ধরা পড়েন। তাঁদের আটক করে ঝালকাঠি নিয়ে যাওয়া হয়। এসময় পাকবাহিনী মেহেদীকে পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য স্বীকারের বিনিময়ে মুক্তিদানের প্রস্তাব দিলে তিনি তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে থাকেন। শহরের রাস্তা দিয়ে তাঁকে টর্চার সেলে নিয়ে যাওয়ার সময়ও তিনি দৃপ্তকণ্ঠে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে-দিতে যান। পরে পাকবাহিনী তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
উল্লিখিত দুটি ঘটনার পর পাকবাহিনী আটঘর-কুড়িয়ানা থেকে মুক্তিবাহিনী নির্মূল করার লক্ষ্যে পেয়ারা বাগান ধ্বংস করার পরিকল্পনা করে। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী পাকবাহিনী পেয়ার বাগান এলাকা আক্রমণ করে। সিরাজ সিকদারের বাহিনী সম্মুখ যুদ্ধ পরিহার করে বিভিন্ন এলাকায় চলে যায়। নৌ-বাহিনীর মাহফুজ বেগ ভারতে চলে যান। শর্ষিণার পীর পরিচালিত মাদ্রাসার কয়েকশ ছাত্র, ঝালকাঠির বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত মুসলিম লীগ-এর নেতাকর্মী, রাজাকার ও আলবদররা পেয়ারা বাগান কাটার কাজে লেগে যায়। এ কাজে পাকবাহিনী বিভিন্ন এলাকার কৃষক- শ্রমিকদের অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ব্যবহার করে। দিনের পর দিন পেয়ার বাগান কেটে পরিষ্কার করে ফেলা হয়। ধ্বংস হয়ে যায় বাংলার অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম চালিকা শক্তি বিশাল পেয়ারা বাগান। তারা শুধু পেয়ার বাগান ধ্বংস করেই ক্ষান্ত হয়নি। এলাকার জনগণের ওপরও অত্যাচার করে। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে দলে-দলে লোকজন দেশ ত্যাগ করে। এ-এলাকায় পাকবাহিনীর হাতে কমপক্ষে ১০ হাজার মানুষ নিহত হয়। [শ্যামল চন্দ্র সরকার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!