You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.06 | পেরুয়া গণহত্যা (দিরাই, সুনামগঞ্জ) - সংগ্রামের নোটবুক

পেরুয়া গণহত্যা (দিরাই, সুনামগঞ্জ)

পেরুয়া গণহত্যা (দিরাই, সুনামগঞ্জ) সংঘটিত হয় ৬ই ডিসেম্বর। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর রাজাকার বাহিনী এ গণহত্যা চালায়। এতে ২৩ জন সাধারণ মানুষ শহীদ হন।
ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে একদল রাজাকার সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার দৌলতপুর গ্রামের খালেক মিয়ার বাড়িতে আশ্রয় নেয়। খালেক মিয়া সত্তরের নির্বাচনে দিরাই-শাল্লা- জামালগঞ্জ আসন থেকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য পদে পিডিপি দলের পক্ষে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং পরাজিত হয়। সে শাল্লার আটগাঁও ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিল। দৌলতপুরের পার্শ্ববর্তী দিরাই উপজেলার শ্যামারচর বাজারে এসব রাজাকার ক্ষমতার দাপট দেখাতে শুরু করে। রাজাকারদের এই উপস্থিতি প্রতিরোধের লক্ষ্যে কমান্ডার সুধীর দাশের নেতৃত্বে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ৬ই ডিসেম্বর ভোরে সুরমা নদীর পশ্চিম তীরসংলগ্ন পেরুয়া গ্রাম থেকে তাদের ওপর আক্রমণ করেন। সুধীর দাশের সঙ্গে ঐদিন মুক্তিযোদ্ধাদের আরো দুটি গ্রুপ যোগদানের কথা থাকলেও কোনো কারণে তাঁরা যোগদান করতে পারেননি। এ সময় রাজাকারদের সংঘবদ্ধ আক্রমণে ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং সুধীর দাশসহ ৩ জন গুলিবিদ্ধ হন। শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মো. আব্দুল হান্নান, মো. আব্দুল কুদ্দুস, মো. আব্দুল হামিদ ও হেমেন্দ্র পুরকায়স্থ।
মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারদের মধ্যে যুদ্ধ শেষে রাজাকাররা পেরুয়া গ্রামে গণহত্যা চালায়। এতে ২৩ জন সাধারণ মানুষ শহীদ হন। তারা হলেন- ব্রজেন্দ্রগঞ্জ রামচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা রামকুমার রায়, ডা. রামানন্দ রায়, চিত্তরঞ্জন রায়, সমরেন্দ্র রায়, সিলেটের এমসি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র হিমাংশু শেখর রায়, মিলন চন্দ্র রায়, ব্রজেন্দ্রগঞ্জ রামচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক উপেন্দ্র কুমার রায়, কালীচরণ দাশ, সুখলাল দাশ, আখালী দাশ, কুঞ্জলাল দাশ, রাজেন্দ্র দাশ, সুখলাল রায়, আওয়ামী লীগ নেতা সুখলাল পুরকায়স্থ, চরনারচর ইউনিয়নের প্রাক্তন চেয়ারম্যান নূর হোসেন মিয়ার পিতা মো. আবু মিয়া, নগেন্দ্র চন্দ্র শীল, সতীশ চন্দ্র রায়, রামচন্দ্র শুক্লবৈদ্য, মন্মথ রায় (সমীপুর, আজমিরিগঞ্জ, হবিগঞ্জ), হরেকৃষ্ণ দাশ (দাউদপুর, শাল্লা), রামকৃষ্ণ দাশ, অশ্বিনী কুমার রায় (বাহারা) ও অনিল দাশ (শতানন্দপুর)। পেরুয়া গণহত্যার দিন ভোরে ডা. রামানন্দ রায়ের স্ত্রী পরিমল বালা একটি মেয়ে সন্তানের জন্ম দেন। সন্তান জন্ম দেয়ার কয়েক ঘণ্টা পর রাজাকাররা তাদের বাড়িতে লুটপাট চালায় এবং ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। রামানন্দ রায়ের ভাই রামকুমার রায় তাঁর জীবনের বিনিময়ে পুত্র চিত্তরঞ্জনকে বাঁচানোর আবেদন করলেও পিতার সামনে পুত্রকে তারা নির্মমভাবে হত্যা করে। এ-সময় চিত্তরঞ্জনের মা কনকপ্রভা রায় পুত্রকে বাঁচানোর জন্য রাজাকারদের নিকট অনুনয়-বিনয় করলে তারা তাকে লক্ষ করে গুলি করে তার মুখমণ্ডল ঝাঁঝরা করে দেয়। তারা মুক্তিযোদ্ধা ধীরেন্দ্র পুরকায়স্থের পিতা সুখলাল পুরকায়স্থকে রূপশি গাছে ঝুলিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।
জমিতে কাজ করার সময় রাজাকারদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন রামকৃষ্ণ দাশ ও হরেকৃষ্ণ দাশ। রাজাকাররা মানুষের ঘরবাড়িতে আগুন লাগায় এবং পুরুষদের রামচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ধরে নিয়ে আসে। সেখানে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কলেমা পড়িয়ে ধর্মান্তরিত করা হয়। পরে সবাইকে পিছমোড়া করে বেঁধে আমির উদ্দিন মিয়ার রাইস মিলের সামনে আনা হয়। সেখানে এক লাইনে সারিবদ্ধভাবে সবাইকে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। বয়সে ছোট হওয়ায় পাঁচজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তাদের একজন হীরেন্দ্র শেখর রায়।
যেসব রাজাকার পেরুয়া গণহত্যায় নেতৃত্ব দেয়, তাদের বাড়ি দিরাই উপজেলার কার্ত্তিকপুর, মাউতি, সেচনি, শ্যামারচর এবং শাল্লা উপজেলার দৌলতপুর, উজানগাঁও, শশারকান্দা ও সুলতানপুর গ্রামে। [বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড