You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.01 | পোদ্দারপুকুর যুদ্ধ (সেনবাগ, নোয়াখালী) - সংগ্রামের নোটবুক

পোদ্দারপুকুর যুদ্ধ (সেনবাগ, নোয়াখালী)

পোদ্দারপুকুর যুদ্ধ (সেনবাগ, নোয়াখালী) সংঘটিত হয় ১লা নভেম্বর। নোয়াখালী জেলার সেনবাগ উপজেলার কাবিলপুর ও মইজদীপুর গ্রামের মাঝখানে পোদ্দারপুকুর অবস্থিত। এখানেই সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত রাজাকার বাহিনীর সঙ্গে এবং সাড়ে ৯টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। পোদ্দারপুকুরের চারপাশে মইজদীপুর ও কাবিলপুর গ্রামের বিভিন্ন ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান করছিলেন। ১লা নভেম্বর ভোরবেলা মাইন উদ্দিন ভূঞা নামে একজন গোয়েন্দা ছমির মুন্সিরহাট থেকে মইজদীপুর গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সোলেমান বাহারের নিকট এসে জানান যে, ৩০- ৩৫ জন রাজাকার মইজদীপুর গ্রামের দিকে আসার পরিকল্পনা করছে। এ সংবাদের ভিত্তিতে মুক্তিযোদ্ধারা তিনটি গ্রুপে ভাগ হয়ে অবস্থান নেন। হাবিলদার আবদুল খালেকের নেতৃত্বে পোদ্দারপুকুর পাড়ের উত্তরে নেয়াজ মিয়ার বাড়ির পাশে, আবদুল খালেক কমান্ডারের নেতৃত্বে বর্তমান দিলদার মার্কেটের পূর্ব পাশে এবং বেলায়েত হোসেন কমান্ডারের নেতৃত্বে পশ্চিম পাশে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নেন। কিছুক্ষণ পরেই রাজাকাররা ফায়ার করতে-করতে মইজদীপুরে প্রবেশ করে। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের বেষ্টনীর মধ্যে প্রবেশ করামাত্রই তিনদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধারা গুলিবর্ষণ শুরু করেন। রাজাকাররা আকস্মিক এ আক্রমণে দিশেহারা হয়ে এদিক- সেদিক পালাতে থাকে। ঘটনাস্থলেই তিনজন রাজাকার নিহত হয়। একজন আহত অবস্থায় পালাতে গিয়ে জনসাধারণের হাতে ধরা পড়ে নিহত হয়। তার লাশ রশি দিয়ে বেঁধে মইজদীপুর গ্রামের উত্তর পাশে শেখ সুফি খালে ভাসিয়ে দেয়া হয়। আহত রাজাকারদের মধ্যে আরো দুজনকে ছমির মুন্সির হাটের ফেনী-চৌমুহনী প্রধান সড়কে (বর্তমান মুক্তিযোদ্ধা গাজী লোকমান সড়ক) নেয়ার পর তারা সেখানে মারা যায়। রাজাকারদের ফেলে যাওয়া ৮টি রাইফেল মুক্তিযোদ্ধারা হস্তগত করেন।
রাজাকাররা পরাজিত হয়ে চলে যাওয়ার আধা ঘণ্টা পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি দল ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা চারদিক ঘেরাও করে নীরব অবস্থানে থাকেন। এমতাবস্থায় পাকিস্তানি এক অফিসার পিস্তল উঁচিয়ে ‘মুক্তি কাঁহা হ্যায়’ বলে হুংকার ছাড়ে। তার এই দাম্ভিকতা সহ্য করতে না পেরে নায়েক সফি তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। গুলির আঘাতে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এরপর শুরু হয় চারদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণ।
মুক্তিযোদ্ধারা মর্টার এবং মেশিন গান ব্যবহার করেন। পাকবাহিনী এ আক্রমণ প্রতিহত করতে না পেরে তাদের অফিসারের লাশ জীপে তুলে ছমির মুন্সিরহাটের দিকে পালিয়ে যায়। যাওয়ার পথে এলোপাথাড়ি গুলি ছোড়ে। এতে মইজদীপুর গ্রামের ইদগাহ্-এর পাশের বাড়ির মহব্বতের নেছা নামে এক মহিলা শহীদ হন।
পাকসেনাদের জীপ অনুসরণ করতে-করতে নায়েক সফি ও তাঁর দল ছমির মুন্সিরহাট পর্যন্ত চলে যায়। নায়েক সফি জীপ লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। ছমির মুন্সির হাটে গিয়েও পাকবাহিনী ভীতি সঞ্চার করার উদ্দেশ্যে ইয়ারপুর গ্রামের শেখ আহম্মদ নামে এজনকে গুলি করে হত্যা করে। নায়েক সফি তাদের ছমির মুন্সির হাট পর্যন্ত ধাওয়া করেন, কিন্তু সেনাবাহিনী পাকা রাস্তায় উঠে দ্রুত বেগে পালিয়ে যায়। বাজারের দোকানদাররা আতঙ্কিত হয়ে এদিক-সেদিক দৌড়াতে থাকে। পরে মুক্তিযোদ্ধাদের দেখতে পেয়ে এবং শত্রুবাহিনী চলে যাওয়ায় তারা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে এসে ভিড় জমান। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্বাসে তারা নিজ-নিজ প্রতিষ্ঠানে বসতে সাহস পান এবং তাদের কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুপক্ষের আহত-নিহত হওয়ার আরো খবর জানতে পারেন। এ-যুদ্ধে ৩ পাকিস্তানি সেনা ও ৬ রাজাকার নিহত হয় এবং ১০ থেকে ১৫ জন রাজাকার আহত হয়। এদিকে পোদ্দারপুকুর পাড়ে নিহত পাকিস্তানি সেনা অফিসারের পিস্তল, হেলমেট, বাঁশি এবং কিছু সংখ্যক বুলেট পাওয়া যায়। সেগুলোসহ প্রাপ্ত অন্যান্য অস্ত্র ও জিনিসপত্র জোনাল কমান্ডার রুহুল আমিন ভূঞার নিকট জমা দেয়া হয়।
পোদ্দারপুকুর যুদ্ধে খালেক কমান্ডার, বেলায়েত হোসেন কমান্ডার, আমিন উল্যা, সোলেমান বাহার, মমিন উল্যা, ছেরাজল হক, আবদুল জলিল, রুহুল আমিন, মজিবুল হক, এম এন হুদা, আফসারী, মো. মোস্তফা, গোলাম মোস্তফা চৌধুরী, আবুল কাশেম এবং ফখরুল ইসলাম সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। এঁরা সেনবাগ, সোনাইমুড়ী ও বেগমগঞ্জ উপজেলার অধিবাসী। [মুহম্মদ আবু তাহের]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড