You dont have javascript enabled! Please enable it!

পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল) বাহিনী (মনিরামপুর, যশোর)

পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল) বাহিনী (মনিরামপুর, যশোর) মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা পালনকারী স্থানীয় বাহিনী। পার্টির যশোর ও খুলনা জেলা কমিটির উদ্যোগে স্থানীয়ভাবে এ অঞ্চলে একটি নিয়মিত ও একটি গেরিলা বাহিনী গড়ে ওঠে। মাগুরা জেলার শালিখা থানার পুলুম ও খুলনা জেলার ডুমুরিয়া এলাকায় এ বাহিনীর ঘাঁটি স্থাপিত হয়। বাহিনীর প্রধান ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির যশোর জেলা কমিটির সদস্য নূর মোহাম্মদ (১৯৬৩ সালে অবিভক্ত ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, ছাত্রজীবন শেষে যশোরের বন্দবিলা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক)।
মুক্তিযুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির (ইপিসিপি) ভুমিকা কী হবে এ বিষয়ে কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় না থেকে যশোর ও খুলনা জেলা কমিটি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার সিদ্ধান্ত নেয়। যশোর জেলা কমিটি রাজনৈতিক ও সামরিক কমিশন গঠন করে। সামরিক কমিশনের আহ্বায়ক নির্বাচিত হন নূর মোহাম্মদ। কমিশনের অন্যতম সদস্য ছিলেন পার্টির যশোর জেলা কমিটির সদস্য বিমল বিশ্বাস। পার্টির যশোর জেলা সম্পাদক শামসুর রহমানের নির্দেশনায় বাহিনীর সদস্যরা বিভিন্ন থানা ও ফাঁড়িতে অভিযান চালিয়ে অস্ত্র সংগ্রহ এবং তা দিয়ে। হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। তাঁদের একের পর এক অভিযানে মনিরামপুর ছাড়াও বৃহত্তর যশোর-খুলনার বেশকিছু
এলাকা শত্রুমুক্ত হয়। অক্টোবর মাস পর্যন্ত যশোর জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা পার্টির বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকে। মাগুরার পুলুম এলাকায় ঘাঁটি গাড়লেও সারা জেলায় পার্টির যোদ্ধারা পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। মনিরামপুর থানার কপালিয়ায় পাকবাহিনীর সঙ্গে পার্টির বাহিনীর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়।
অক্টোবর মাসে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির যশোর জেলার একটি গেরিলা দল ডুমুরিয়া থেকে যশোর ফেরার পথে মনিরামপুরের একটি গ্রামে অবস্থানকালে রাজাকার বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। ২৩শে অক্টোবর রাজাকাররা তাঁদের চিনাটোলা বাজারের পাশে হরিহর নদীর সেতুর পাশে নিয়ে প্রথমে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে এবং পরে গুলি করে হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী এ দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন মাশুকুর রহমান তোজো (যশোর শহরের ষষ্টিতলা পাড়ার হাবিবুর রহমানের পুত্র)। তিনি ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ অনার্স ও ১৯৬২ সালে এমএ এবং ১৯৬৩ সালে লন্ডন থেকে অ্যাকচুয়ারি ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর ১৯৬৯ সালে লন্ডন থেকে দেশে ফিরে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন ফেডারেল ইন্সুরেন্স কোম্পানির স্পেশাল অফিসার পদে যোগ দেন। ৭১ সালে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা দ্রুত পরিবর্তিত হতে থাকলে তিনি পার্টিতে কাজ শুরু করেন। শরণার্থীদের নিরাপদে ভারত গমনে তিনি নিজের গাড়ি ব্যবহারের মাধ্যমে ভূমিকা রাখেন। অফিসের গাড়ি নিয়ে তিনি এক পর্যায়ে যশোর হয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ভারতে যান। স্বাধীনতা সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করতে ভারতে তিনি আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করেন। কলকাতায় কংগ্রেস ও সিপিএম নেতাদের সঙ্গেও তিনি এ বিষয়ে আলাপ করেন। তোজো তাঁর অফিসের গাড়িটি বাংলাদেশ সরকার এর ব্যবহারের জন্য রেখে আসেন। এরপর দেশে ফিরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। মনিরামপুরে শহীদ তোজোর সহযোদ্ধারা হলেন- আসাদুজ্জামান আসাদ (৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলনে স্থানীয় পর্যায়ে গঠিত সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ও যশোর এম এম কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি), আহসানউদ্দিন খান মানিক (ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের যশোর জেলা শাখার সভাপতি), সিরাজুল ইসলাম শান্তি (যশোর জেলা কৃষক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক), ফজলুর রহমান ফজলু (সেনাবাহিনীর সদস্য) প্রমুখ।
মনিরামপুর, কেশবপুর, ঝিকরগাছা, অভয়নগর সাতক্ষীরার কলারোয়া এলাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যেসব গেরিলা যুদ্ধ হয়, তাতে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল)-এর গেরিলা বাহিনীর অন্য সদস্যরা ভূমিকা রাখেন। পার্টির অনেক কর্মী-সমর্থক ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে পার্টির বাহিনীতে যোগ না দিয়ে মুক্তিবাহিনী মুজিব বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তাঁদের অনেকেই জীবন দেন। বিমান বাহিনীর তরুণ অফিসার ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ফজলুল হক (এলাকায় পাইলট ফজলু নামে পরিচিত; বামপন্থী মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ) একটি শক্তিশালী বাহিনী গঠন করে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেন। তাঁর বাহিনীর উল্লেখযোগ্য সদস্যরা ছিলেন- জামাল উদ্দীন খান (১১ই নভেম্বর ঝিকরগাছার উজ্জ্বলপুর যুদ্ধে শহীদ), আবু সুফিয়ান, হামিদ গাজী, হাফিজুর রহমান, শামসুল হক প্রমুখ। এছাড়া মুজিব বাহিনীতে ছিলেন আব্দুল মমিন মাস্টার ও লুৎফর রহমান। এঁরা সবাই পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল) অথবা ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপের)-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। মনিরামপুর এবং ঝিকরগাছা এলাকায় এম এম কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ও ইপিসিপি (এমএল) নেতা নজরুল ইসলাম সক্রিয় ছিলেন। তিনি ও অপর ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মাহফুজুর রহমান হেম বাগআঁচড়া এলাকায় একটি খণ্ডযুদ্ধ শেষে ১৪ই জুলাই হরিদ্রাপোতা গ্রামে শত্রুপক্ষের হাতে গ্রেপ্তার হন। পরে যশোর সেনানিবাসে তাঁদের হত্যা করা হয়। [আমিনুর রহমান মামুন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!