মুক্তিযুদ্ধে পূর্বধলা উপজেলা (নেত্রকোনা)
পূর্বধলা উপজেলা (নেত্রকোনা) অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার জন্য খ্যাত। ফকির-সন্যাসী বিদ্রোহের মাধ্যমে এখান থেকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন গড়ে ওঠে। পাকিস্তান আমলে বাঙালিদের স্বাধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনে পূর্বধলার মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল।
৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ঐতিহাসিক ভাষণের মূল বার্তা সন্ধ্যার মধ্যে লোকমুখে পূর্বধলার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সাধারণ মানুষের মধ্যে পৌছে যায়। এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, দেশ দ্রুত সশস্ত্র যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মার্চ মাসের প্রথম ভাগ পর্যন্ত পূর্বধলা আওয়ামী লীগ অফিসে দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে নিয়মিত বৈঠক হতো। মার্চের দ্বিতীয় ভাগের প্রথমদিকে পাকিস্তানিদের অশুভ তৎপরতার কথা গ্রাম পর্যায়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় নিরস্ত্র মানুষের ওপর হামলার কথা শুনে পূর্বধলার মানুষ আরো বিক্ষুব্ধ হয়।
পূর্বধলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরা হলেন- সদিরউদ্দিন আহমেদ এমএনএ, নাজমুল হুদা এমপিএ, থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মফিজ উদ্দিন খান, সাধারণ সম্পাদক কাজী ফজলুর রহমান, ছাত্রলীগের সভাপতি আবদুল কুদ্দুস তালুকদার ও সাধারণ সম্পাদক আবুল হাসিম। গ্রামের যুবকদের সংগঠিত করতে ইউনুস আলী মণ্ডল, মফিজ উদ্দিন খান, আমানত খান, আবদুল ওয়াদুদ খান, মারফত খান, আবদুল আওয়াল আকন্দ, আবদুল মান্নান খান, মফিজ উদ্দিন মাহফুজ, আশরাফ উদ্দিন খান আশু, মাহফিজ উদ্দিন, আবদুল হেলিম তালুকদার, নাজিম উদ্দিন প্রমুখ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাতে নেতৃত্ব দেন ১১নং সেক্টরের কমান্ডার কাজলা গ্রামের কর্নেল আবু তাহের, বীর উত্তম। উত্তর ময়মনসিংহে গোয়েন্দা বিভাগের দায়িত্ব পালন করেন মুহ. আবদুল হান্নান খান। কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন আবদুল গণি, উদ্দিন, মুজিবুর রহমান ভূঁইয়া। প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন মোহাম্মদ আলী, সিরাজুল ইসলাম, মহিউদ্দিন পান্না, গিয়াস উদ্দিন, হাফিজ উদ্দিন, আকবর আলী, আইয়ুব আলী, শামছুদ্দীন আহমেদ, মারফত আলী, আবদুল জব্বার, হাসমত আলী ও হারুন-অর-রশিদ।
ইপিআর-এর সদস্য সুবেদার আজিজুল হক জারিয়া হাইস্কুল মাঠে স্থানীয় যুবকদের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এক পর্যায়ে আজিজুল হককে ঢাকা- ময়মনসিংহ সড়কে পাকিস্তানিদের প্রতিরোধ করতে মধুপুর চলে যেতে হয়। তখন প্রশিক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন স্থানীয় স্কাউট প্রশিক্ষক মনির উদ্দিন সরকার। একইভাবে শ্যামগঞ্জ হাইস্কুল মাঠে একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গড়ে ওঠে। এ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ প্রদান করেন খেলোয়াড় আবদুল আজিজ। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এসব ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ চলে। এপ্রিলের শেষদিকে পূর্বধলার ছাত্র-যুবক- কৃষকদের অনেকে প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের মেঘালয়ের গারো পাহাড়ে যান। তারা গারো পাহাড়ের বাঘমারা, নেউলাগিরি ও শিববাড়িতে আশ্রয় নেন। এরপর তুরায় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
যে-কোনো সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অনুপ্রবেশের আশংকায় পূর্বধলার ছাত্র-যুবক-কৃষকদের উদ্যোগে শ্যামগঞ্জ-বিরিশিরি সড়ক ও পূর্বধলা-নেত্রকোনা সড়কের ওপর গাছের গুড়ি ফেলে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। ২৩শে এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দুটি যুদ্ধ বিমান নেত্রকোনার ওপর টহল দিয়ে পূর্বধলায় ফিরে যায়। সেদিন বিকেলে নেত্রকোনা থেকে আসা কয়েকজন যুবক পূর্বধলা বাজার সংলগ্ন রেল সেতুটির ফিসপ্লেট সরিয়ে দেয়। তবে শেষ পর্যন্ত পূর্বধলায় পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সফল না হওয়ায় তারা অনুপ্রবেশ করতে সক্ষম হয়।
২৯শে এপ্রিল বৃহস্পতিবার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পূর্বধলায় অনুপ্রবেশ করে। তারা সড়ক ও রেলপথে একযোগে প্রবেশ করে তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে শহরের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। একটি দল পূর্বধলা বাজারে যায়। অপর দুটি দল সার্কেল অফিস ও পুলিশ স্টেশনে অবস্থান নেয়। কয়েকদিনের মধ্যে জারিয়া হাইস্কুল, গোহালাকান্দা ইউনিয়ন পরিষদ অফিস, শ্যামগঞ্জ থেকে জারিয়া পর্যন্ত রেলপথের পাবই রেলসেতু, একিয়ারকান্দা রেলসেতু, পূর্বধলা বাজারের পাশের রেলসেতু-সহ সবকটি রেলসেতুতে তারা পাহারা বসায়। পাকবাহিনী পাবই একিয়ারকান্দা রেলসেতুর পাশে ক্যাম্প স্থাপন করে।
পূর্বধলায় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দল নেজামে ইসলামীর সাংগঠনিক কার্যক্রম ছিল। তখন এ অঞ্চলে নেজামে ইসলামীর সঙ্গে কনভেনশন মুসলিম লীগ – যুক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনা করে। থানা সদরে প্রবেশের পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অধিনায়ক মেজর সুলতান পূর্বধলা থেকে ৭০-এর নির্বাচনে নেজামে ইসলামীর প্রার্থী শরাফ উদ্দিন মাস্টার, পূর্বধলা জগৎমণি উচ্চ বিদ্যালয়ের ধর্মীয় শিক্ষক ফজলুর রহমান, পূর্বধলা বাজারের প্রভাবশালী ব্যক্তি বশির উদ্দিন আকন্দ প্রমুখকে নিয়ে একটি গোপন বৈঠক করে। এ বৈঠকে পাকিস্তানিদের সহযোগীদের সংগঠিত করতে কবির খাঁ, জালাল উদ্দিন-সহ বেশ কয়েকজনকে দায়িত্ব দেয়া হয়। পূর্বধলা থানা রাজাকার- বাহিনীর কমান্ডার ছিল ইদ্রিস মিয়া। রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে ছিল কবির খাঁ (নয়াপাড়া, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত), জালাল উদ্দিন (শালমারকান্দা), লালমিয়া (কুতিউড়া), সাহেব আলী (হোগলা), সুরুজ আলী (পূর্বধলা), ফজর আলী (পুকুরিয়াকান্দা), মোখলেছুর রহমান (পুকুরিয়াকান্দা), জয়মত আলী (শালমারকান্দা), আবদুল খালেক (শালমারকান্দা), মহর আলী, শাহজাহান (পূর্বধলা), হোসেন আলী (চকপাড়া, খলিশাপুর), আলকাছ উদ্দিন (চকপাড়া, খলিশাপুর), শামসুদ্দিন (একিয়ারকান্দা), আবদুল খালেক (কুতিউড়া), আবু চান (কুতিউড়া), গিয়াসউদ্দিন (কুতিউড়া), আবদুল গফুর (পাজুনিয়া), আবুল হাসেম খান (খানপাড়া, খলিশাউড়), আবদুর রহমান (বাড়হা, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-এ মামলায় বিচারধীন অবস্থায় কারাগারে মৃত্যু), নূরউদ্দিন (মৌদাম, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-এ মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত, ফেরারি অবস্থায় মৃত্যু), আবদুস সালাম বেগ (মৌদাম, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-এ মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত), আহমেদ আলী (সোনাইকান্দা, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-এ মামলায় বিচারধীন অবস্থায় কারাগারে মৃত্যু), আবদুল মালেক (পশ্চিম পূর্বধলা), আবদুল খালেক (পশ্চিম পূর্বধলা), আবু জাহেদ খান (খানপাড়া, খলিশাউড়), কলিম উল্লাহ খান (খানপাড়া, খলিশাউড়), আবদুল হান্নান খান (খানপাড়া, খলিশাউড়), আবদুল হান্নান (জামুদ), সৈয়দ আনিছুর রহমান (খলিশাউড়), ওয়ালী উল্লাহ (খানপাড়া, খলিশাউড়), সিরাজুল হক (খানপাড়া, খলিশাউড়), তাজুল ইসলাম (বালুচরা), মনু খন্দকার (নয়াপাড়া), ইলিয়াস মিয়া (নয়াপাড়া), আবদুল কাউয়ুম (নয়াপাড়া), শহীদ তালুকদার (ঘাগরা), গিয়াসউদ্দিন (কালডোয়ার) প্রমুখ। পশ্চিম পাকিস্তানি ঈদ মাহমুদ পাকসেনাদের অত্যন্ত বিশ্বস্ত ছিল। সে পূর্বধলায় তুলার ব্যবসা করত।
পূর্বধলা আলবদর বাহিনীর কমান্ডার ছিল মৌলানা আবুল হাসিম (বারহা)। এ বাহিনীর অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিল- আবুল খায়ের (বর্তমান ফেনী জেলার অধিবাসী; ভাইয়ের ব্যবসা সূত্রে পূর্বধলায় থেকে পড়ালেখা করে; পরবর্তীকালে ইসলামী ফাউন্ডেশনের বড় কর্মকর্তা হয়), মিজানুর রহমান (মুন্সীগঞ্জ), আবদুল খালেক তালুকদার (খারছাইল; আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যানালে যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত), আবদুর রহিম (পশ্চিম পূর্বধলা), সব্দুল হোসেন (শালদিঘা), সাদত আলী (পশ্চিম পূর্বধলা), হাফিজ উদ্দিন (পশ্চিম পূর্বধলা), রুস্তম আলী (কালডোয়ার), গিয়াস উদ্দিন (ধারা), আবদুল মতিন, মোফাজ্জল হোসেন খান (শিষকান্দী), আবদুর রশিদ (শালথী), আবুল হাশিম (ঘাগরা), আবদুল সালাম তালুকদার (বিশকাকুনী), আবদুল গনি (আতকাপাড়া), প্রমুখ।
নেজামে ইসলামীর শরাফ উদ্দিন মাস্টারকে উপদেষ্টা করে পূর্বধলা থানা শান্তি কমিটি গঠিত হয়। কমিটির সভাপতি ছিল বশির উদ্দিন আকন্দ। এ কমিটির অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিল- মওলানা ফজলুর রহমান (খলিশাউড়), মওলানা মুসলেম উদ্দিন সুফী (বারহা), মওলানা হোসেন আহমেদ (বারহা), আলী হোসেন মাস্টার (ইলাশপুর), মওলানা আবদুল মজিদ (মৌদাম; আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুানালে যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত), ইব্রাহিম তালুকদার (পূর্বধলা বাজার), আবদুল হামিদ মেম্বর (বর্নাকান্দা) আবদুর রহমান বিএ (বাট্রা), প্রিন্সিপাল সিরাজুল ইসলাম (ধলা), হাবিবুর রহমান চান মিয়া (নারায়ণডহর), আবদুল মান্নান কুলু (তারাকান্দা) প্রমুখ। ঘাগড়া ইউনিয়ন কমিটির আহ্বায়ক ছিল ইব্রাহিম আকন্দ। এর সদস্য ছিল মৌলভী আবদুল হেকিম, আবদুল হাই-সহ আরো অনেকে। হোগলা ইউনিয়ন শান্তি কমিটির সদস্যদের মধ্যে আদম আলী মীর, কুবাদুজ্জামান খান ও হেলালুজ্জামান খান-এর নাম উল্লেখযোগ্য। জারিয়া ইউনিয়ন কমিটির সদস্য ছিল আহম্মদ হোসেন তালুকদার, তোরাব আলী মিয়া, মিয়া হোসেন প্রমুখ ধলামূলগাঁও ইউনিয়ন শান্তি কমিটির সদস্যদের মধ্যে তজ্জমল হোসেন, আবদুল গফুর, তরিকুল ইসলাম প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। বিশকাকুনী ইউনিয়নে আবদুল মান্নান তালুকদারের নেতৃত্বে শান্তি কমিটি গঠিত হয়। খলিশাউড় ইউনিয়ন শান্তি কমিটি গঠিত হয় শুক্কুর মামুদ চেয়ারম্যান ও ফজলুল হকের নেতৃত্বে।
১লা মে সকাল ১০টার দিকে রাজাকার কবির খাঁ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে নিয়ে পূর্বধলা সদরের ডা. হেম বাগচীর বাড়িতে হানা দেয়। বৃদ্ধ ডা. হেম বাগচী ও তাঁর আত্মীয় হরিদাস সিংহকে হিন্দু হিসেবে রাজাকার কবির খাঁ সনাক্ত করিয়ে দিলে পাকিস্তানিরা নৃশংসভাবে তাঁদের হত্যা করে। কাজের লোক মেঘুকেও তারা হত্যা করে। স্থানীয় লোকজন রাজপাড়া গ্রামে তাদের মাটিচাপা দেয়। স্বাধীনতার অনেক পর রাজপাড়া গণকবর আবিস্কৃত হয়। হানাদাররা ঐ সময় তাদের বাড়ির মালামালও লুট করে। কয়েকদিনের মধ্যে আলবদর আবদুল খালেক পূর্বধলা রাজবাড়ি লুট করে। ইলাশপুরের নিরদ শীলের হালের বলদ-সহ তার বাড়ি লুট হয়।
রাজাকার ও আলবদরদের সহায়তায় পাকসেনারা পূর্বধলায় হত্যাযজ্ঞ চালায়। হাটধলা গ্রামের উপেন্দ্রচন্দ্র দাস, সুবোধচন্দ্র দাস, বারধার গ্রামের নিশিকান্ত দাস, অশ্বিনীকান্ত দাস, খারছাইল গ্রামের আব্দুল কাদির, নাহেরকোণা গ্রামের জলধর সূত্রধর, আছর আলী, বাড়হা গ্রামের ব্রজেন্দ্র বর্মণ, জারিয়া পূর্বপাড়া গ্রামের সদরজমা খাঁ, সব্দুল বিশ্বাস, হাফানিয়া গ্রামের কছিম উদ্দিন, মৌদাম গ্রামের চান্দু হাজী, ছোছাউড়া গ্রামের যতীন্দ্র সরকার, তার ছেলে সুবোধ সরকার, জাগীর গ্রামের ফজর আলীকে পাকবাহিনী নৃশংসভাবে হত্যা করে। ধোবারুহী গ্রামের আবু সিদ্দিককে রাজাকার লাল মিয়া পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়। তাকে পাকিস্তানিরা গুলি করে হত্যা করে। পাকসেনারা রাজাকার ও আলবদরদের সহযোগিতায় ধলামূলগাঁও-এর আবদুল গণির বাড়িতে আগুন দেয়। আবদুল গণি ছিলেন মুক্তিবাহিনীর কোম্পানি কমান্ডার। ১৫ই নভেম্বর রাজাকারআলবদররা পূর্বধলার পাবই গ্রামের ১০- ১২টি বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। বাড়িগুলো ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত সাধারণ মানুষের। ১০ই সেপ্টেম্বর দুপুরে হোগলা ইউনিয়নের গোপীনাথখিলা গ্রামের কোম্পানি কমান্ডার এখলাছ উদ্দিনের বাড়িতে হানাদাররা আগুন দেয়। নাজমুল হুদা এমপিএ-এর বাড়িও পাকহানাদাররা পুড়িয়ে দেয়। ৭ই ডিসেম্বর তারা ধারা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা সুলতান নাসির উদ্দিন (নবম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন) ও নূরুজ্জামানের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। রাজাকার ফজলুর রহমান তাদের সহায়তা করে।
পূর্বধলা পুলিশ স্টেশন ও জারিয়া হাইস্কুল এ দুটিকে পাকিস্তানি সেনারা নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির হিসেবে ব্যবহার করত। এছাড়া জারিয়া রেল স্টেশনের বিশ্রামাগার ও জারিয়া বাজারের পূর্বপাশে অবস্থিত সাদামাটি শোধনাগারটিকে নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হতো। পূর্বধলা সদরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সুবেদার সাজি এবং সিপাহি মোহাম্মদ আলী বহু নিরপরাধ মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এখানকার উল্লেখযোগ্য দুটি বধ্যভূমি হলো- -পুকুরিয়াকান্দা বধ্যভূমি- এবং জারিয়া বধ্যভূমি।
১৮ই আগস্ট মুক্তিযোদ্ধা হারুন-অর-রশিদ ও ননী গোপালের নেতৃত্বে ১৮ জনের দুটি মুক্তিযোদ্ধা দল পূর্বধলার শ্যামগঞ্জ অঞ্চলে প্রবেশের সময় তাঁদের হাতে দুজন দালাল ধরা পড়ে এবং তারা নিহত হয়। ৯ই সেপ্টেম্বর এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা জারিয়া-শ্যামগঞ্জ রেলপথের কুকুয়াখালী ব্রিজ ধ্বংসের উদ্দেশ্যে পূর্বধলার গোয়াতলা বাজার ত্যাগ করে চিকনিকান্দা গ্রামে অবস্থান নেয়। কিন্তু দুর্ঘটনার কারণে ঐ অপারেশন সফল হয়নি। ১০ই সেপ্টেম্বর ভোরের দিকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর একটি কোম্পানি গোয়াতলা বাজারে অবস্থানরত অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর ত্রিমুখী আক্রমণ চালায়। অতর্কিতে আক্রান্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণের চেষ্টা চালান। কিন্তু বেশিক্ষণ টিকতে না পেরে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যান। মুক্তিযোদ্ধাদের ফেলে যাওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদ পাকবাহিনী তাদের দখলে নিয়ে নেয়। সেদিন পাকহানাদারদের আক্রমণে ৫ জন সাধারণ মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন।
অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধারা ময়মনসিংহ- জারিয়া রেলপথের কুকুয়াখালী ও একিয়ারকান্দা ব্রিজে কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়েন। এতে পাকিস্তানি সেনারা ভীত হয়ে পাল্টা গুলি ছোড়ে। প্রায়ই মুক্তিযোদ্ধারা এভাবে গুলি ছুড়ে পাকহানাদারদের ব্যতিব্যস্ত করে রাখতেন।
১৪ই নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধা দীপক সাংমার কোম্পানি ময়মনসিংহ-জারিয়া রেলপথে পূর্বধলার পাবই ব্রিজে আক্রমণ চালায়। তাঁদের এ আক্রমণ দেড় ঘণ্টা স্থায়ী হয়। ১৭ই নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের আলতাব, দীপক ও এখলাছ কোম্পানি একত্রিত হয়ে পূর্বধলা থানা সদর আক্রমণ করে। এ আক্রমণে পূর্বধলা রেল ব্রিজের বাংকারে অবস্থানরত ৩ জন পাকসেনা নিহত হয়।
৯ই ডিসেম্বর পাকবাহিনীর একটি দল গৌরীপুর থেকে ট্রেনযোগে পূর্বধলায় প্রবেশের চেষ্টা করে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল প্রতিরোধে ট্রেনটি পূর্বধলা বাজারসংলগ্ন ব্রিজ অতিক্রম করতে পারেনি। ট্রেনটি পেছনে ফিরে যায়। যাবার পথে পাকসেনারা বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পাবই রেল ব্রিজটি ধ্বংস করে দেয়। এদিনই পূর্বধলা উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন— কর্নেল আবু তাহের, বীর উত্তম (পিতা মহিউদ্দীন আহমেদ, কাজলা), মো. আবু ইউসুফ খান, বীর বিক্রম- (পিতা মহিউদ্দীন আহমেদ, কাজলা), তারাব উদ্দিন, বীর বিক্রম- (পিতা খোদা নেওয়াজ খান, নারায়ণডহর), ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল, বীর প্রতীক- (পিতা মহিউদ্দীন আহমেদ, কাজলা) ও সাখাওয়াত হোসেন বাহার, বীর প্রতীক (পিতা মহিউদ্দীন আহমেদ, কাজলা)।
পূর্বধলা উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- তারাব উদ্দিন, বীর বিক্রম (২রা ডিসেম্বর সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের ছাতক যুদ্ধে শহীদ), বিনোদ আলী (পিতা দেনত আলী, জারিয়া), আমিরুল ইসলাম ফেরদৌস (পিতা আমির উদ্দিন, ধলা), গোকুল দেবনাথ (পিতা শচীনচন্দ্র দেবনাথ, শাহবাজপুর), আক্রাম আলী মীর (পিতা আমছর আলী মীর, হোগলা), আলী নেওয়াজ (পিতা আবদুল গফুর, হোগলা), আবদুল জব্বার (পিতা করিম উদ্দিন, হোগলা), আবদুল মতিন (পিতা তাহির উদ্দিন, নিজ হোগলা), জসীম উদ্দিন (পিতা শেখ মিয়াসর আলী, হাফানিয়া), আবদুল আজিজ (পিতা শেখ মনির উদ্দিন, পাগলাকান্দা), শহর আলী (পিতা মনফর আলী, শালদিঘা), শামছুদ্দীন (পিতা গুঞ্জল অলী, পাইকুড়া), সুরুজ আলী (পিতা ছমেদ আলী দর্জি, দত্তকুনীয়া) এবং মিয়া হোসেন (পিতা আলী হোসেন, গড়োয়াকান্দা; ইপিআর সদস্য)।
শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আমিরুল ইসলাম ফেরদৌসের স্মৃতি রক্ষার জন্য ১৯৭২ সালে পূর্বধলা সদরে শহীদ ফেরদৌস সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হান্নান খান পূর্বধলা থানার রামপুর কাছিয়াকান্দা গ্রামে শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। [আলী আহাম্মদ খান আইয়োব]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড