You dont have javascript enabled! Please enable it!

পুরিখ্যা ক্যাম্প আক্রমণ (লামা, বান্দরবান)

পুরিখ্যা ক্যাম্প আক্রমণ (লামা, বান্দরবান) পরিচালিত হয় ১৮ই নভেম্বর। এতে পুরিখ্যা বাহিনীর একজন আহত হয় এবং তারা ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যায়।
মুক্তিযোদ্ধাদের লামা থানা অপারেশনের পর পাকিস্তানি হানাদারদের পক্ষে মেজর (অব.) জামানের নেতৃত্বে বিপুল সংখ্যক পুরিখ্যা বাহিনীর সমাবেশ ঘটানো হয়েছিল সেখানে। থানা অপারেশন হয়েছিল ১৫ই অক্টোবর। মাতামুহুরী নদী পথের দুঃখ্যা-সুখ্যা পাহাড় এলাকার সুখ্যা নামক পাহাড়ের পাদদেশে করা হয় পুরিখ্যা বাহিনীর ক্যাম্প।
‘অপ্রয়খ্যা’ রাখাইন শব্দ, যার অর্থ রাষ্ট্রদ্রোহী বা বিদ্রোহী গ্রুপ। ‘অপ্রয়খ্যা’ থেকে প্রয়খ্যা বা পুরিখ্যা। পুরিখ্যা বাহিনী মিয়ানমারের রাষ্ট্রদ্রোহী বা বিদ্রোহী গ্রুপ। এ বাহিনী পাকহানাদারদের পক্ষে কাজ করত।
মাতামুহুরী নদীর দুকূলের শীলামাটি বেষ্টিত পাহাড় দুটিকে বলা হয় ‘দুঃখ্যা-সুখ্যা পাহাড়’। দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে মাতামুহুরী নদী। নদীপথে লামা থেকে চকরিয়া ভাটিতে বামে দুঃখ্যা এবং ডানে সুখ্যা পাহাড়। বামের পাহাড়টি খাড়া উঁচু। এছাড়া পাহাড় সংলগ্ন মাতামুহুরী নদীতে রয়েছে কূপ সদৃশ প্রায় ৩০ ফুট গভীরতা। বর্ষাকালে এ জায়গায় নৌকা/বোট ঘুরপাকে পড়ে অনেকে দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে। এসব কারণে উক্ত পাহাড়ের নাম দুঃখ্যা পাহাড়। পক্ষান্তরে, ডানের পাহাড়টি নিচু, সহজেই ওঠা যায়। তাই এটি সুখ্যা পাহাড় হিসেবে পরিচিত।
দুঃখ্যা-সুখ্যা পাহাড়ের মাটি খুবই শক্ত বিধায় এর কূল ভাঙ্গে না। বর্ষা মৌসুমে বন্যার পানি দুই পাহাড়ের চিপা দিয়ে সরতে অনেক সময় লাগে। ফলে, লামা প্রশাসনিক ভবনসহ বাজার ১৫ ফুট পানির নিচে তলিয়ে যায়। লামা পৌরবাসীর দীর্ঘদিনের দুঃখ বর্ষা মৌসুমের জলাবদ্ধতা।
সুখ্যা পাহাড়ের নিচে প্রায় ৫০০ মিটার পরিখা করে পুরিখ্যা বাহিনী ক্যাম্পটি স্থাপন করেছিল। তারা সংখ্যায় ছিল ৩২ জন। তখনকার থানা থেকে এর দূরত্ব প্রায় ২শ মিটার। এ পুরিখ্যা বাহিনীই মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রুপ কমান্ডার আবদুল হামিদকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে পাকহানাদারদের হাতে তুলে দেয়। ভারত থেকে গেরিলা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আবদুল হামিদের বাড়ি ক্যাম্প সংলগ্ন বমু গ্রামে। তিনি মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন ৩রা নভেম্বর রাতে। সে রাতেই তাঁকে আটক করা হয়। পরদিন তাঁর বড় ভাই মৌলানা তমিজ উদ্দিন (প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক) ও ভগ্নিপতি আজমল হোসেনসহ তাঁকে কক্সবাজার পাকসেনা ক্যাম্পে পৌঁছানো হয়। এজন মাতামুহুরী নদীপথে কঠোর পাহারা ছিল। তাঁর ভাই ও ভগ্নিপতিকে ছেড়ে দেয়া হলেও পাকসেনারা তাঁকে ছাড়েনি। অমানবিক নির্যাতনের পর টেকনাফের বধ্যভূমিতে তাঁকে ১৯শে নভেম্বর গুলি করে হত্যা করা হয়। আবদুল হামিদ চট্টগ্রাম সরকারি বাণিজ্য মহাবিদ্যালয়ের শেষ বর্ষ অনার্সের মেধাবী ছাত্র ছিলেন আবদুল হামিদের অমর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সরকারি বাণিজ্য মহাবিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর নামে একমাত্র ছাত্রাবাসের নামকরণ করে ‘শহীদ আবদুল হামিদ ছাত্রাবাস’। চকরিয়া কলেজের ছাত্রাবাসেরও নামকরণ করা হয় ‘শহীদ আবদুল হামিদ ছাত্রাবাস’। চকরিয়া বাস টার্মিনালের নামকরণ করা হয় ‘শহীদ আবদুল হামিদ বাস টার্মিনাল’ লামা বাজার থেকে তাঁর নিজ গ্রামে যাওয়ার রাস্তা এবং ছিকলঘাট-মানিকপুর সড়কের নামকরণ করা হয় “শহীদ আবদুল হামিদ সড়ক’।
পুরিখ্যা বাহিনী কর্তৃক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবদুল হামিদকে পাকসেনাদের হাতে তুলে দেয়া, নদীপথে চলাচলকারীদের ওপর নির্যাতন মুক্তিযোদ্ধাদের ভীষণভাবে বিক্ষুব্ধ করে। এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে গ্রুপ কমান্ডার সৈয়দ নূর মোহাম্মদের নেতৃত্বে পরিকল্পনা নেয়া হয়। সে অনুযায়ী ১৮ই নভেম্বর ভোর ৪টায় পুরিখ্যা ক্যাম্পের দুদিক থেকে অতর্কিতে আক্রমণ করা হয়। শত্রুপক্ষ পাল্টা আক্রমণের সুযোগ পায়নি। মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র আক্রমণে তারা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এ-সময় তাদের একজন আহত হয়। এ আক্রমণে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল মাত্র ১১ জন। সেই থেকে পুরিখ্যা বাহিনী ঐ সীমানায় আর আসেনি। [এস কে এইচ সাব্বির আহমদ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!