You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে পীরগঞ্জ উপজেলা (ঠাকুরগাঁও)

পীরগঞ্জ উপজেলা (ঠাকুরগাঁও) বৃহত্তর দিনাজপুরের সর্বাধিক রাজনীতি সচেতন একটি এলাকা। শিক্ষায় এগিয়ে থাকা এ অঞ্চল প্রগতিশীল রাজনীতি চর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। গণমানুষের প্রতিবাদ ও আন্দোলনের স্থান হিসেবেও পীরগঞ্জ পরিচিত। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এখানকার মানুষ বাঙালিদের অধিকার আদায়ের বিভিন্ন পর্যায়ের সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান-এর সময় পীরগঞ্জ আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে উত্তাল রূপ নেয়। এ অঞ্চলের মানুষকে অধিকার আদায়ে সচেতন করে তুলেছিলেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ, ডা. আব্দুর রাজ্জাক, ডা. আব্দুল মালেক প্রমুখ নেতা। এর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নেতৃত্বে দেশব্যাপী পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলন-এর পটভূমিতে পীরগঞ্জের তরুণ সমাজ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তোলে এবং সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।
উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান পীরগঞ্জের বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তিকে তীব্রভাবে প্রভাবিত করে। ৭১-এর মার্চের শুরুতে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন- ও বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের নেতারা বড়গোলায় অবস্থিত আওয়ামী লীগ অফিসে এক জরুরি সভায় মিলিত হন। এ সভায় পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা হয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন মো. ইকরামুল হক এমপিএ, ডা. আব্দুর রাজ্জাক, অধ্যক্ষ গোলাম মোস্তফা, আব্দুল জব্বার, ফয়জুল ইসলাম, আব্দুল হাই, মকলেসুর রহমান, ইয়াকুব আলীসহ আরো অনেকে।
১লা মার্চ থেকেই পীরগঞ্জ উত্তাল ছিল। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ এর পর এখানে ছাত্র সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। মনসুরুল আলম, আব্দুল আজিজ, নুরুল ইসলাম, নুরুজ্জামান, নুরুন নবী, আনসারুল আলম ময়নাসহ আরো অনেকে এর নেতৃত্বে ছিলেন। পীরগঞ্জ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে তা পুড়িয়ে দেয়া হয় এবং জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে মানচিত্রখচিত বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। এরপর মিছিল নিয়ে তারা উপজেলা সদর প্রদক্ষিণ করে।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের পর স্থানীয় নেতৃবন্দের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, যুদ্ধ আসন্ন এবং তাঁরা বঙ্গবন্ধুর ভাষণে প্রদত্ত নির্দেশনা অনুযায়ী প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। ২৫শে মার্চ ঢাকায় গণহত্যার খবর শোনার পর এখানকার ছাত্র-যুবকরা লাঠি মিছিল সহকারে এর প্রতিবাদ জানায়।
পীরগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্তি যুদ্ধপ্রস্তুতিকে বেগবান করে। রাজনীতিবিদরা সংগঠিত হওয়া শুরু করলে তরুণরা আরো শক্তি নিয়ে মাঠে নামে। রাজনীতিবিদদের মধ্যে মো. ইকরামুল হক এমপিএ, ডা. আব্দুর রাজ্জাক, ডা. সুজাউদ্দীন, অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা, জব্বার মাহজন, শমশের মাহজন, মকলেসুর রহমান, আব্দুর রহমান, কসির চেয়ারম্যান, মোসাদ্দেক চেয়ারম্যান, ডা. আইনুল, ওয়াজেদ আলী, ইয়াকুব চেয়ারম্যান, ফজলুল চেয়ারম্যান, আব্বাস, মানিক, আব্দুল মতিন, আব্দুল সালাম প্রমুখ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মার্চের শুরু থেকে মো. ইকরামুল হক এমপিএ, ডা. আব্দুল রাজ্জাক, অধ্যক্ষ গোলাম মোস্তফাসহ আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ছাত্র- যুবকদের সংগঠিত করতে থাকেন। তাঁরা যুদ্ধের জন্য তৈরি করতে ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। পীরগঞ্জ থানায় পুলিশের একজন সুবেদার নায়েক প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। পরে পীরগঞ্জ হাইস্কুলে এ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলে।
দিনাজপুর এস এম কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক ক্লাসের ছাত্র সালাউদ্দীন কোষারাণীগঞ্জ থেকে রাতে কয়েকজন বন্ধুসহ ভারতের মালন ক্যাম্পে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণে অংশ নেন। তারা প্রশিক্ষণ শেষ করে অপারেশন ক্যাম্পে ফিরে আসেন। এখান থেকে তারা পরে সীমান্তবর্তী বিভিন্ন অপারেশনে অংশগ্রহণ এবং সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন। পীরগঞ্জে মোজাহিদ ফোর্স (এমএফ)-এর প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন ফুল মোহাম্মদ, খুরশেদ আলী চৌধুরী ও সুবেদার সফিউল্লাহ। সেকশন কমান্ডার ছিলেন আব্দুল হালিম ও জিকরুল হক। গেরিলা বাহিনীর প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন আক্তারুজ্জামান, মকিমউদ্দীন আহম্মেদ, আব্দুল আজিজ, তালেবুর রহমান, দর্শন আলী, আব্দুল রাজ্জাক, কৃষ্ণমোহন রায় এবং আলতাফুর রহমান। মুজিব বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন সিরাজুল ইসলাম, মোতালেব, ইব্রাহিম ও মোখলেসুর রহমান। মুক্তিবাহিনীর সেকশন কমান্ডার ছিলেন আনছারুল আলম ময়না।
পীরগঞ্জে স্থানীয় বিশেষ কোনো বাহিনী ছিল না। প্রথমদিকে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন ও অন্যান্য ছাত্র সংগঠন আলাদা-আলাদাভাবে সংগঠিত হলেও সংগ্রাম কমিটি গঠিত হলে সবাই একত্রিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। তবে তরুণদের মধ্যে শহীদুল্লাহ শহীদ ছিলেন অত্যন্ত সাহসী গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা।
পীরগঞ্জে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু হয়েছিল ২৫শে মার্চের পরপর। ঢাকায় গণহত্যা শুরু হলে এখানে ছাত্র সংগঠনগুলো স্বাধীন বাংলার মানচিত্রখচিত পতাকা নিয়ে লাঠি-মিছিল করে। সেখান থেকে পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার আহ্বান জানানো হয়। এ পর্যায়ে প্রতিরোধ গড়ার ক্ষেত্রে ছাত্র সংগঠনগুলোর ভূমিকাই ছিল মুখ্য।
পাকবাহিনীর পীরগঞ্জে ঢোকার পথ ছিল পীরগঞ্জ-বীরগঞ্জ সড়ক। এ সড়ক দিয়ে পাকবাহিনী সৈয়দপুর থেকে পীরগঞ্জে যাতে অনুপ্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য কমপক্ষে দুই দফায় গাছ কেটে রাস্তায় বেরিকেড তৈরি করা হয়। প্ৰথম দফায় শহীদুল্লাহ শহীদ এবং আবুল হোসেনের নেতৃত্বে চাপোড়ে গাছ কেটে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। মার্চের শেষ সপ্তাহে আরো একটি উল্লেখযোগ্য প্রতিরোধ প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছিল ইবরাহিম খান এবং ইসহাকের নেতৃত্বে।
পীরগঞ্জে পাকবাহিনীর অনুপ্রবেশ ঠেকাতে মুক্তিযোদ্ধারা থানার খানসাম, দশমাইল, ভাতগাঁ ইত্যাদি স্থানে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। প্রতিরোধ পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে দিনাজপুর ইপিআর ক্যাম্প আক্রমণ করা হলে আবু ইসাহাক নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা কুঠিবাড়িতে শহীদ হন। এদিকে ছাত্রনেতারা অস্ত্র সংগ্রহের ওপর জোর দেন। তারা তিন দফায় পীরগঞ্জ থানা থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করেন। প্রথম দফায় শহীদুল্লাহ শহীদ ২২শে মার্চ ৬টি থ্রি-নট-থ্রি ও কয়েকটি এসএলআর কৌশলে থানা থেকে নিজেদের দখলে নেন দ্বিতীয় দফায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা ২৮শে মার্চ থানার ওসি আব্দুর রশিদের কাছ থেকে ২৯টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল সংগ্রহ করেন। তৃতীয় দফায় ১২ই এপ্রিল পীরগঞ্জ থানায় জমাকৃত মোজাহিদ বাহিনীর ১২০টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল ওসির কাছ থেকে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা বন্ডসই দিয়ে নিয়ে আসেন। যাঁরা এসব অস্ত্র সংগ্রহ করেন তাঁদের মধ্যে শাহাজাহান, বাচ্চু, নান্নু, ফুল মোহাম্মদ, মাইনুদ্দীন, আব্দুর হালিম, নজরুল ইসলাম, কলিম, মো. হাসেম, তালিবুর রহমান তালি, খয়রাত, আব্দুল সবুর খান প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এসব অস্ত্র প্রথম অবস্থায় বড়গোলায় আওয়ামী লীগ অফিসে সংরক্ষিত রাখা হয়। এখানে নিরাপদ নয় মনে করে অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা নিজে একটি ট্রাক্টর চালিয়ে অস্ত্রগুলো সীমান্তের ওপারে মালন ক্যাম্পে নিয়ে যান। সঙ্গে ছিলেন তাঁর সহযোদ্ধারা। ৫ই এপ্রিল সীমান্তের ওপারে সংগঠিত হয়ে হাবিলদার মোস্তাফিজুরের নেতৃত্বে পীরগঞ্জের তরুণ যোদ্ধারা সেই ট্রাক্টর নিয়ে পয়েনধা বেগুনগাঁও-এ বিহারি ক্যাম্প আক্রমণ করেন। দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষে বিহারিদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
৭ই এপ্রিল মোজাহিদ বাহিনী পীরগঞ্জে সংগঠিত হয়ে একই ট্রাক্টরে ঠাকুরগাঁও-এর দিকে রওনা হয়। তরুণ যোদ্ধাসহ ট্রাক্টরটি ঠাকুরগাঁও অভিমুখে শিবগঞ্জ বিমান ঘাঁটি পর্যন্ত গেলে উল্টো দিক থেকে পাকবাহিনীর ফায়ারিং শুরু হয় এবং সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ১৪ই এপ্রিল পীরগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে পোড়ানোর পর এক বিরাট লাঠি-মিছিল বের হয়। মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন ছাত্রনেতা আব্দুল কালাম, আনছারুল আলম ময়না, মনসুরুল আলম, রাজ্জাক (চিনা), নুরন্নবি, মোজাহারুল ইসলাম, রিয়াজুল ইসলাম চৌধুরী, আব্দুস সাত্তার প্রমুখ।
১৭ই এপ্রিল সকাল ১০টার দিকে পাকবাহিনীর ১৪টি সাঁজোয়া যান সৈয়দপুর সেনানিবাস থেকে পীরগঞ্জে অনুপ্রবেশ করে। সাঁজোয়া যানগুলো শহরে টহল দেয়া শুরু করলে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এদিন তারা পীরগঞ্জ কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ গোলাম মোস্তফাসহ শহরের বিভিন্ন স্থানে কয়েকজনকে হত্যা করে ও কয়েকটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে চলে যায়। ২৫শে এপ্রিল পাকবাহিনী আবার পীরগঞ্জে আসে এবং কলেজে ক্যাম্প স্থাপন করে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন জাহিদ এ ক্যাম্পের দায়িত্ব গ্রহণ করে। কলেজ ছাড়া তারা গোদাগাড়ী, শিয়ালগাজী, বাঘমারা, মাশালডাঙ্গী, মিলন বাজার ও সাগুনীতেও ক্যাম্প স্থাপন করে। থানার কুঠিবাড়ি ও মাশালডাঙ্গীতে রাজাকারদের ক্যাম্প ছিল। এছাড়া পাকবাহিনী পীরগঞ্জ শহরে ৮টি বড় বাংকার তৈরি করে প্রতিরক্ষাব্যূহ সৃষ্টি করেছিল।
পীরগঞ্জের জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগ-এর নেতা-কর্মীরাই প্রধানত রাজাকার ও আলবদর বাহিনী এবং শান্তি কমিটি – গঠন করে। কিছু অরাজনৈতিক মানুষও এসব সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। তারা পাকবাহিনীর দালালি, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে খবরাখবর প্রদান, পাকসেনাদের মনোরঞ্জনের জন্য বাঙালি নারীদের জোরপূর্বক তাদের হাতে তুলে দেয়া, তাদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা এবং বাঙালিদের ওপর নির্যাতন ও তাদের হত্যায় অংশগ্রহণ করত। পীরগঞ্জে রাজাকারদের বিরাট বাহিনী গড়ে উঠেছিল। মার্চ থেকেই তারা পাড়ায়-মহল্লায় সংগঠিত হতে শুরু করে।
পীরগঞ্জ থানায় বিহারি ও মালদইয়াদের অনেকের বসবাস ছিল। এখানে বিহারি ও মালদইয়াদের দুটি পৃথক কলোনি ছিল। এই দুই গোষ্ঠী বাঙালিদের স্বাধীনতা আন্দোলনের ঘোর বিরোধী ছিল। পাকবাহিনী পীরগঞ্জে অবস্থান নেয়ার পর তাদের প্রভাব অনেক বেড়ে যায়। পাকিস্থানিদের সহযোগী হিসেবে তারা হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ ইত্যাদি অপকর্মে লিপ্ত হয়।
পাকিস্তানি বাহিনীর এসব সহযোগীর মধ্যে রহিম মালদইয়া, শুক্রধুনাই, কাশেম বিহারি, হাতেম বিহারি, হাকিম বিহারি, কালাম বিহারি, খালেক দেউনিয়া, মোহাম্মাদ আলী, নিজাম, হাশেম, রহিম বিহারি (বিশমাইলের মালদইয়া), ঈসা, মুসলিম প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
যাদের নিয়ে পীরগঞ্জে রাজাকার বাহিনী ও শান্তি কমিটি গঠিত হয় তারা হলো— মোবারক ডাক্তার, আলতাফ মৌলভী, সামাদ মহাজন, আইজুল ফকোটিয়া, সমীর ডাক্তার, খোকা, ইজ্জত আলী, মোকলেসুর, হোসেন, আব্দুল হক, হাসান, শামসু, মোটা হক, হালীম, দাইমদ্দিন, রহমান ডাক্তার, রফিকুল, নুরুল ডাক্তার, আজিজুল হক, আবুল হোসেন, আব্দুর রহমান (কুশারিগাও), গোয়াল, আক্তার, টেমকু, শামসুল হক, তমিজ, হাতেম, মুক্তারুল, আইনুল, খোরশেদ আলী হেড মাস্টার প্রমুখ।
১৭ই এপ্রিল পাকবাহিনী পীরগঞ্জে অনুপ্রবেশ করে ঘণ্টাখানের মধ্যেই বিভিন্ন জায়গায় আগুন দিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। তারা আওয়ামী লীগ অফিস, মুক্তিযোদ্ধা শওকত আলী ও ছাত্রনেতা শহীদুল্লাহ শহীদের বাড়িঘরসহ কয়েকটি জায়গায় আগুন দেয়। নিজেদের শক্তি প্রদর্শন ও আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য তারা এসব করে। একই দিন তারা আওয়ামী লীগ অফিসের পাশে কাঁঠালতলায় নৌকা তৈরিরত ৩ জন কাঠমিস্ত্রিকে তাদের গাড়িতে তুলে নেয়। তাদের একজন ছিল মানিকগঞ্জ জেলার সুনীল। এরপর তারা আওয়ামী লীগ সভাপতি ডা. সুজাউদ্দীন, তাঁর বড়ভাই মুজাফর আহম্মেদ, আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ আব্দুল জব্বারকে ধরে তাদের গাড়িতে তুলে নেয়। পীরগঞ্জ কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অধ্যাপক গোলাম মোস্তফাকে বাড়িতে না পেয়ে পাকবাহিনী যখন ফিরে যাচ্ছিল, তখন রাজাকাররা তাঁকে ধরিয়ে দেয়। এ-সময় হানাদাররা রাস্তার পাশ থেকে আতিয়র রহমানকে গাড়িতে তুলে নিয়ে বেয়নেট ও ব্রাশ ফ্রায়ারে সবাইকে হত্যা করে ঠাকুরগাঁও চলে যায়। পরের দিন পীরগঞ্জের অদূরে জামালপুর ফার্মের আখক্ষেতের পাশে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় তাদের লাশ পাওয়া যায়।
পাকবাহিনীর স্থানীয় দোসররা শুরু থেকেই এলাকায় লুঠপাটের রাজত্ব কায়েম করে। তারা শহীদ অধ্যাপক গোলাম মোস্তফার নিজস্ব একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে সহাস্রাধিক বস্তা ধান, চাল ও সরিষা লুট করে নিয়ে যায়। তারা অন্যত্রও লুণ্ঠন চালায়। বিভিন্ন বাড়ি থেকে গরু-ছাগল ধরে নিয়ে তারা পাকসেনাদের সরবরাহ করত। পীরগঞ্জে অনেক নারী পাকবাহিনী ও রাজাকারদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হন।
পাকবাহিনী পীরগঞ্জ কলেজ, রাইসমিল, গোদাগাড়ি, শেয়ালবাড়ী, মাশালডাঙ্গী, মিলন বাজার, বাগমারা ইত্যাদি জায়গায় স্থাপিত ক্যাম্পকে নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে। তবে তারা সবচেয়ে বেশি নির্যাতন করে পীরগঞ্জ কলেজ ক্যাম্পে। এখানে হাজার-হাজার মানুষকে ধরে এনে নির্যাতন শেষে হত্যা করা হয়। এরপরে ছিল রাইসমিল নির্যাতনকেন্দ্র। এখানেও অসংখ্য মানুষকে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়। এছাড়া থানা নির্যাতনকেন্দ্র, গোদাগাড়ি নির্যাতনকেন্দ্র এবং মৌলানা কাফির নিয়ন্ত্রণে থাকা দানারহাট রাজাকার ক্যাম্প ছিল কুখ্যাত নির্যাতনকেন্দ্র। তাদের বিভিন্ন ক্যাম্পকে তারা বন্দিশিবির হিসেবেও ব্যবহার করে। প্রতিদিন অনেক মানুষকে ধরে এনে এসব স্থানে বন্দি করে রাখা হতো। বন্দিদের অনেককে দুই-তিন দিন ধরে নির্যাতনের পর হত্যা করা হতো। এভাবে প্রতিদিন ৫০-৭০ জন মানুষকে ধরে নিয়ে আসা হতো এবং পর্যায়ক্রমে হত্যা করা হতো। নয়মাসে পাকসেনা ও রাজাকাররা পীরগঞ্জে ২০ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করে।
এখানকার উল্লেখযোগ্য বধ্যভূমিগুলো হলো- রাইসমিল থেকে ব্রিজ পর্যন্ত স্থান, কলেজের পুকুর, ছাত্রাবাস সংলগ্ন পুকুর, বিশ মাইল, জগথা, জামালপুর ফার্ম, খামার সেনুয়া (দেশিয়া পাড়া), আজাদ স্পোটিং ক্লাবের পার্শে ভাস্কর্য ও শহীদ মিনার সংলগ্ন স্থান, লোহাগাড়া চার্চ, শিমুল বাড়ি, পয়েনধা এবং চানপুর। সবচেয়ে বড় গণকবর রয়েছে পীরগঞ্জ পাবলিক ক্লাব মাঠের পূর্বপার্শ্বে মুক্তিযোদ্ধা পুকুরের স্থানে এবং কলেজের হোস্টেলের দক্ষিণ পাশের পুকুরে। এছাড়া রাইসমিলের পেছন দিকে নদীর পূর্বধার দিয়ে উত্তর দিক ব্রিজ পর্যন্ত স্থানে, রেজিস্ট্রি অফিসের সামনে, জগথা কশিরের বাড়ির সামনে, চাঁদপুর রাস্তা সংলগ্ন জায়গায়, গোদাগাড়ি ভূমি অফিসের পেছনে পুকুরের পাশে, লোহাগাড়া চার্চ সংলগ্ন স্থানে, লাচ্ছি নদীর ওপর ব্রিজের কাছে ইমদাদ মাহজনের পুকুর সংলগ্ন জায়গায়, মধ্য গুয়াগাঁও পাকা রাস্তার পশ্চিম পাশে এবং আংরা হাটে গণকবর রয়েছে।
পাকবাহিনীকে প্রতিহত করার জন্য ২৮শে মার্চ পীরগঞ্জ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি দল বের হয়। একটি দল দিনাজপুরের দিকে যায় সেতাবগঞ্জ হয়ে, অপরটি বীরগঞ্জ খানসামা ঝাড়বাড়ি ও দশমাইল ডিফেন্সের উদ্দেশে যায়। খানসামা দলের নেতা ছিলেন আব্দুল আজিজ। তাঁর সঙ্গে ছিলেন খোকা চৌধুরী, শাহজাহান, তফাজ্জল, বাচ্চু, নান্নু, ফুল মোহাম্মদ, তালেবুর, খয়রাত, সবুরসহ আরো কয়েকজন। ২৮শে মার্চ ঝাড়বাড়িতে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণে পিছু হটে মুক্তিযোদ্ধাদের দল দশমাইলে যায়। সেখানে পূর্ব থেকেই মুক্তিযোদ্ধা ও ইপিআর সদস্যরা প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কাশিয়াডাঙ্গায় ইপিআর সদস্য মুকবুলকে পাকবাহিনী হত্যা করলে মুক্তিযোদ্ধারা সেখান থেকে পিছু হটে নিরাপদ জায়গায় চলে যান।
পীরগঞ্জে দুর্ধর্ষ রাজাকার হাতেম বিহারি, কালাম বিহারি, রহিম মালদইয়া প্রমুখ বাঙালিদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিলে ও বাঙালি হত্যা শুরু করলে মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ শুরু করেন। এভাবে সংঘর্ষ ব্যাপক রূপ লাভ করলে বাঙালি যোদ্ধারা টিকতে না পেরে সীমান্তের ওপারে আশ্রয় নেন। বিহারি এবং মালদইয়া নেতাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা পীরগঞ্জের ওপারে ভারতে অবস্থান নেয়া সশস্ত্র যুবকরা দিনের বেলায় এসে অপারেশন করে আবার রাতে ওপারে চলে যেতেন। ২৯শে মার্চ তরুণ বাঙালি যোদ্ধাদের সঙ্গে বিহারিদের এক সংঘর্ষ হয়। এতে বিহারিদের এক নেতার নিকটআত্মীয় ও সোনালী ব্যাংকের এক বিহারি গার্ডের মৃত্যু হয়। এর ফলে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা আরো বৃদ্ধি পায়। ২রা জুন পীরগঞ্জে পাকবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে প্রচণ্ড গুলি বিনিময় হয়। মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের পরাস্ত করতে না পেরে ইপিআর সদস্য আনিসের নেতৃত্বে গ্রেনেড দিয়ে সাগুনি ব্রিজ উড়িয়ে দেন। এর পূর্বে এ ব্রিজ ধ্বংসের জন্য খোকা চৌধুরী, ফুল মোহম্মদ, শহীদুল্লাহ, দবিরুল (ইপিআর), নবিরউদ্দীন প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা ব্রিজের কাছে পৌঁছালে রাজাকাররা তাঁদের সবাইকে ঘিরে ফেলে। এখান থেকে দবিরুল (ইপিআর) ও শহীদুল্লাহকে ধরে নিয়ে তারা দিনাজপুর ইপিআর কুঠিবাড়ি ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়। শহীদুল্লাহকে পরে ছেড়ে দিলেও দবিরুলকে সেখানে নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়।
সৈয়দপুর-পীরগঞ্জ সড়কে অবস্থিত মাশালডাঙ্গী ব্রিজ পাকবাহিনীর চলাচলের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে এ অঞ্চলে যাতায়াতের জন্য এ ব্রিজ তাদের ব্যবহার করতে হতো। মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির জন্য এ ব্রিজ ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেন। পাকবাহিনী এটা বুঝতে পেরে ব্রিজের সন্নিকটে একটি রাজাকার ক্যাম্প স্থাপন করে। ক্যাম্প থেকে রাজাকাররা বেশ কড়াকড়িভাবে ব্রিজ পাহারা দিতে থাকে। এরপরেও গেরিলা যোদ্ধা শহীদুল্লাহ শহীদ কয়েকজন সহযোদ্ধা নিয়ে এক গভীর রাতে ব্রিজের নিচে কয়েকটি ডেটোনেটর ও মাইন পুতে রাখেন। কিন্তু পাকসেনারা টের পেয়ে ডেটোনেটর ও মাইনগুলো অপসারণ করে ফেলে। তবে ২রা ডিসেম্বর পাকবাহিনী পলায়নের সময় ব্রিজটি গুঁড়িয়ে দিয়ে যায়।
জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দলের পীরগঞ্জ থেকে দিনাজপুর যাওয়ার সময় সেতাবগঞ্জ অতিক্রম করার পর ঢেড়াপাটিয়া নামক স্থানে পাকবাহিনীর সঙ্গে তাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধা দলের নেতৃত্বে ছিলেন ইপিআর সৈনিক হাবীব। দলের অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন তোফাজ্জল, শাহজাহান, আসমত আলী বাচ্চু, নান্নু, ফুল মহাম্মদ মাইনুদ্দিন, খয়রাত, আব্দুল হালীম, খোকা চৌধুরী, নজরুল ইসলাম, কলিম হাসেম, তালেবুর সবুর, নায়েক কালু এবং নায়েক ফিরোজ। মুক্তিযোদ্ধারা সন্ধ্যা ৬-টায় ঢেড়াপাটিয়া ত্রিমুখী মোড়ে পৌঁছালে পাকসেনারা কয়েকটি সাজোয়া যান থেকে তাঁদের লক্ষ্য করে এলোপাতারি গুলি ছুড়তে শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারা দলনেতা হাবীবের নির্দেশে দুটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পাকবাহিনীর প্রতি পাল্টা আক্রমণ করেন। দুই ঘণ্টা ধরে উভয় পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় হয়। পাকসেনারা শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকলে মুক্তিযোদ্ধারা এক সময় পিছু হটেন। এ-যুদ্ধে পাকবাহিনীর কয়েকজন সেনা আহত হয়।
গেরিলা যোদ্ধা শহীদুল্লাহ শহীদ পীরগঞ্জ শহরে বিদ্যুতের ট্রান্সফর্মারে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে, মাইন পুতে রেখে ও অন্যান্য উপায়ে পাকবাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিলেন। তিনি সাধারণ মানুষের মতো সারাদিন শহরে চলাফেরা করে খবর সংগ্রহ করতেন। রাতে সব খবর মালন ক্যাম্পে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরকে দিতেন। এ সাহসী যোদ্ধা গুয়াগাঁও মোড়ে বিদ্যুতের ১১০০০ ভোল্টের ট্রান্সফরমারটিতে গুলি করে আগুন লাগিয়ে দেন। তিনি জুলাই মাসের শেষদিকে রাতের বেলা হবিতেল মেলের সামনে থাকা ১১০০০ কেবি ট্রান্সফরমারটিতে ডেটোনেটর দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে অকেজো করে দেন। পীরগঞ্জ কলেজের পাশে পাকসেনাদের চলাচলের রাস্তায় একাধিকবার তিনি স্থল মাইন পুতে রাখেন। পাকবাহিনীর গোদাগাড়ি যাওয়ার পথের কয়েকটি স্থানেও তিনি মাইন পুতে রাখেন। মাইন বিস্ফোরণ থেকে রক্ষার্থে কৌশল হিসেবে হানাদার বাহিনী নিরীহ মানুষকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করে। এক সময় তারা সাধারণ মানুষের গরুর গাড়ি সামনে পিছনে রেখে যাতায়াত করতে থাকে। পুতে রাখা মাইনে পাকসেনা বা রাজাকাররা সরাসরি আক্রান্ত না হলেও বীরযোদ্ধা শহীদুল্লাহর কারণে পাকসেনা ও রাজাকাররা সারাক্ষণ ভীত-সন্ত্রস্ত থাকত। ফলে তাদের কার্যক্ষমতা ও চলাচল অনেকটা সীমিত হয়ে পড়ে। এ গেরিলা যোদ্ধা জুন মাসে ৮৫ জন ও আগস্টে ৫০ জন রাজাকারকে অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেন। শহীদুল্লাহ শহীদ অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে দিনের বেলায় ছদ্মবেশে সাবসেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরকে নিয়ে পীরগঞ্জ কলেজে পাকবাহিনীর ক্যাম্প রেকি করেছিলেন। এ রাতেই ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর পাকবাহিনীর ক্যাম্পটি উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেটি সম্ভব হয়নি।
আগস্ট মাসের মধ্যভাগে পীরগঞ্জ এবং এর পার্শ্ববর্তী এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় দল নিয়ে দিনাজপুর কুঠিবাড়িতে অবস্থিত পাকক্যাম্পে আক্রমণ করার পরিকল্পনা করা হয়। ইপিআর সদস্য আব্দুল গনি হাওলাদার এ দলের নেতৃত্বে ছিলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী আক্রমণে যাওয়ার পথে মুক্তিযোদ্ধারা মঙ্গলপুর নামক স্থানে পাকবাহিনীর ঘেরাও-এর মধ্যে পড়েন। দলনেতা গণি পুরো দলকে পজিশন নিতে নির্দেশ দেন। তিনি নায়েক ফিরোজ, নায়েক কালু এবং ইপিআর সৈনিক হাবীবকে পাল্টা আক্রমণ করার নির্দেশ দিয়ে নিজে ফায়ার করতে-করতে এগুতে থাকেন। আক্রান্ত হয়ে পাকবাহিনী পাল্টা জবাব দিলে দুই পক্ষের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ হয়। এক সময় লড়াইয়ে টিকতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন। বীরযোদ্ধা গণি হাওলাদার একা সামনের দিকে এগুতে থাকলে শত্রুদের একটি গোলা এসে তাঁর বুকে লাগে। তিনি ঘটনা স্থলে শহীদ হন।
আগস্ট মাসের মাঝামাঝি এক সন্ধ্যায় মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল মালন ক্যাম্প থেকে গোদাগাড়ি এসে পৌঁছে। স্থানীয় লোকজন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গোদাগাড়ি স্কুলে রাতের খাবারের আয়োজন করে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের আসার খবর রাজাকাররা পাকসেনাদের পৌঁছে দেয় এবং পাকবাহিনী এসে তাঁদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। এতে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা ঘটনা স্থলে শহীদ ও কয়েকজন আহত হন। এ ঘটনার
প্রতিশোধ নিতে পরের সপ্তাহে মালন ক্যাম্প থেকে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা এসে পাকবাহিনীকে খবর দেয়া ১১ জন রাজাকারকে ধরে নিজেদের ক্যাম্পে নিয়ে আসেন।
মল্লিকপুর ও বলাইড়হাটে পাকবাহিনীর দুটি ক্যাম্প ছিল। ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর এ দুটি ক্যাম্পে আক্রমণ পরিচালনার পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি আগস্ট মাসের শেষদিকে মালন ক্যাম্প থেকে বহু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে হাটপাড়া করনাই-এ আসেন। সবমিলে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে ২২৭ জনের বড় একটি মুক্তিযোদ্ধা দল মল্লিকপুর ও বলাইড়হাট পাকক্যাম্প অপারেশনে অগ্রসর হয়। পুরো দলকে তিনি কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করে মূল অংশটিকে শফি হাওলাদারের নেতৃত্বে রাখেন। একটি দলকে আনিস হাওলাদারের নেতৃত্বে বলাইড়হাটে পজিশন নেয়ার নিদের্শ দেন। বৃদ্ধিকা লোঙ্গরখানা থেকে আগত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে তিনি করনাই নদীর ধার দিয়ে মল্লিকপুর ক্যাম্পের কাছে অবস্থান নেন। ইতোমধ্যে শফি হাওলাদারের নেতৃত্বাধীন অংশ তামলাই পুকুরে এম্বুশ করে পাকবাহিনীর মুখোমুখি অবস্থান নেয়। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের সঙ্গে থাকা অপর একটি অংশ বলাইড়হাটের দিকে গিয়ে তামলাই দিঘীর পারে এম্বুশ করে। বেলা ৩টার দিকে শফি হাওলাদারের দল ফায়ার শুরু করলে ভয়াবহ যুদ্ধ শুরু হয়। উভয় পক্ষ এসএলআর, এলএমজি, চাইনিজ রাইফেল এবং স্টেনগান ইত্যাদি অস্ত্র ব্যবহার করে। গোলাগুলিতে মল্লিকপুর এলাকা প্রকম্পিত হয়। প্রায় ১ ঘণ্টা চলা এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা নাজির হোসেন শহীদ হন। বেশ কয়েকজন পাকসেনা আহত হয়।
পাকবাহিনীর মল্লিকপুরের দলকে সহায়তার জন্য অপর একটি দল পীরগঞ্জ থেকে আসার পথে বলাইড়হাটে আনিস হাওলাদাদের নেতৃত্বে লুৎফর ঘুন্টিসহ বেশকিছু মুক্তিযোদ্ধা দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়। ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের দল ফায়ার শুরু করলে এখানে যুদ্ধ শুরু হয়। বিকেল ৪টা থেকে রাত পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। এ-যুদ্ধে ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। যুদ্ধে আব্দুল মকিম, ইব্রাহিম খান, আক্তার, নুরুল, বশির, তালেবুর, আলতাফুর, জমির, আশরাফ, হরি গোপাল, ইকরামুল, নুরুল প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। বলাইড়হাট যুদ্ধে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর আহত হন। এ- যুদ্ধে বেশ কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়। পক্ষান্তরে ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এখানে আহত জাহাঙ্গীরকে মুক্তিযোদ্ধা লুৎফর ঘুন্টি রাতেই মালন ক্যাম্পে নিয়ে যান। সেখান থেকে তাঁকে বাঘড়গড়া হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বলাইড়হাট যুদ্ধ- এ এলাকার যুদ্ধের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে স্বীকৃত।
পীরগঞ্জ থানার সীমান্তবর্তী গোদাগাড়িতে পাকবাহিনীর একটি বড় ক্যাম্প ছিল। এ ক্যাম্পে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা সেপ্টেম্বর মাসের প্রথমদিকে আক্রমণ করলে দুপক্ষে তীব্র যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। অপরপক্ষে ৫৬ জন পাকসেনা নিহত হয়। গোদাগাড়ি যুদ্ধ – মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে স্বীকৃত।
পীরগঞ্জ উপজেলার ৯ নম্বর ইউনিয়ন পরিষদের দেওধা কানারি নামক স্থানে সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে আব্দুল আজিজের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা ইব্রাহিম খান, ইকরামুল হক, মানিক, নুরুলসহ আরো কয়েকজন পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালান। হঠাৎ পরিচালিত এ গেরিলা আক্রমণে পাকসেনারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ৩ জন পাকসেনা মারাত্মকভাবে আহত হয়।
নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে শফি হাওলাদার, আব্দুল মকিম ও আব্দুল আজিজের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের ৩টি পৃথক দল আমতলিয়ানি নদীর তীর ঘেঁষে তিনদিক থেকে পজিশন নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ করতে থাকে। পাকবাহিনীও নদীর অপর পাড় থেকে এলোপাথারি গুলি শুরু করে। সুবিধা করতে না পেরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে ৩ দলের মুক্তিযোদ্ধারাই অক্ষত অবস্থায় নিরাপদ জায়গায় ফিরে যান। ৭নং সেক্টরের সাবসেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের নির্দেশে পীরগঞ্জ শহরের কাছাকাছি অবস্থিত মাশালডাঙ্গী ব্রিজ উড়িয়ে দেয়ার জন্য ৪ঠা নভেম্বর রাতে ৩৬ জনের একটি দল থুমনিয়া শালবনে অবস্থান গ্রহণ করে। পরের দিন তাঁদের ১৭ জন পানিঘাটায় অবস্থান নেন। ১৯ জনের অপর একটি দল এক্তিয়াপুরে অবস্থান নেয়। এই ১৯ জনের দলে মুক্তিযোদ্ধা আক্তার, হাই, তালি, রফিকুল, জিন্না, অখিল, গিরিধারী, লেফটেন্যান্ট ইকবাল (খানকা), ইয়াসিন, ফুল মোহাম্মদ, আলতাফুর, জমির, তালেবুর, ইয়াকুব, আশরাফ, নুরুল, সালাউদ্দীন প্রমুখ ছিলেন। সালাউদ্দীন অপর দুই সহযোদ্ধা তালেবুর ও ইয়াকুবকে নিয়ে পার্শ্ববর্তী গ্রাম কোষারাণীগঞ্জে তাঁর বাবা-মার সঙ্গে দেখা করতে যান। সালাউদ্দীন আসার খবর পেয়ে পাকবাহিনী বাড়ি ঘেরাও করে তাঁকে ধরে ফেলে। বাবা-মার কাছ থেকে তারা তাঁকে হাত- চোখ বেঁধে পীরগঞ্জ ক্যাম্পে নিয়ে যায়। বাবা পিছু-পিছু ছুটে আসেন। তিনি প্রতিদিন খাবার নিয়ে ছেলের সঙ্গে দেখা করতেন ও সেই সঙ্গে ক্যাপ্টেন সাহেবকে ছেলেকে ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ করতেন। এভাবে ৫ দিন সন্তানকে দেখতে পেরেছিলেন সালাউদ্দীনের বাবা। ৬ষ্ঠ দিন ১০ই নভেম্বর ক্যাম্পে গিয়ে সন্তানকে আর পাননি, সেই সঙ্গে দেখা মেলেনি ক্যাপ্টেনের। ক্যাম্পে ৫ দিন তাঁর ওপর অমানবিক নির্যাতন করা হয়। তাঁর হাত-পায়ে পেরেক মেরে ক্ষতবিক্ষত করা হয়। পরে তাঁকে ঠাকুরগাঁও ক্যাম্পে ক্যাপ্টেন জাহিদের কাছে পাঠানো হয়। ১১ই নভেম্বর পাকবাহিনীর ক্যাপ্টেন জামান ক্যাম্পের ভেতর থেকে সালাউদ্দীনকে রক্তাক্ত অবস্থায় খালি গায়ে বাঘের খাঁচার মধ্যে নিক্ষেপ করে (দেখুন বাঘের খাঁচায় মানুষ হত্যা)। মুহূর্তের মধ্যে খাঁচায় থাকা দুটি বাঘ সালাউদ্দীনের সমস্ত শরীর ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে। এভাবে বীর মুক্তিযোদ্ধা সালাউদ্দীন শহীদ হন। পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্প প্রধান মেজর মাহমুদ হাসান বেগ তেরে এসে ক্রুদ্ধ কণ্ঠে লোকজনের উদ্দেশে যা বলে, বাংলায় তা এরূপ: ‘দেখলে সবাই মুক্তিযোদ্ধার কি দশা? যেসব বাঙাল মুক্তিযুদ্ধে যাবে, সবার এই পরিণতি বরণ করতে হবে।’
নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে মিত্রবাহিনী এবং মুক্তিবাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণের মুখে পাকবাহিনী এলাকার সব ক্যাম্প বন্ধ করতে শুরু করে। সম্মিলিত বাহিনীর কাছে টিকতে না পেরে তারা অনেককে বিভিন্ন নির্যাতন কেন্দ্রে বন্দি রেখে ৩রা ডিসেম্বর ভোরে সৈয়দপুরের দিকে পালিয়ে যায়। এইদিনই মুক্তিযোদ্ধারা পীরগঞ্জে প্রবেশ করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।
পীরগঞ্জের শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- গোলাম মোস্তফা (অধ্যক্ষ, পীরগঞ্জ কলেজ), আবু ইসহাক (কুঠিবাড়ি; ২৯শে মার্চ দিনাজপুরে শহীদ), জয়নাল আবেদীন (পালিগাঁও; ১৪ই ডিসেম্বর হিলিতে শহীদ), ফিরোজ (কুমিল্লা; দিনাজপুরের কুঠিবাড়িতে শহীদ), শফিক আহম্মেদ (নারায়ণপুর; গোদাগাড়ি যুদ্ধে শহীদ), বশিরুল (ভেলাতৈড়; দিনাজপুর মহারাজা স্কুলে বোমা বিস্ফোরণে শহীদ), সালাউদ্দীন (কোষারাণীগঞ্জ; ১১ই নভেম্বর পাকসেনা ক্যাম্প ঠাকুরগাঁও-এ বাঘের খাচায় শহীদ), জয়নাল (ভোমরাদহ), আব্দুল গনি (হাবিলদার, ইপিআর; মঙ্গলপুর), সুরেন (মহারাজ; দিনাজপুর মহারাজা স্কুলে বোমা বিস্ফোরণে শহীদ), দবিরুল (ইপিআর; সাত্তনায় ধৃত ও কুঠিবাড়িতে শহীদ) এবং নাজির হোসেন (মল্লিকপুরে শহীদ)। পীরগঞ্জের একমাত্র রাষ্ট্রীয় ক্ষেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন রফিজ উদ্দীন, বীর প্রতীক।
পীরগঞ্জে বিভিন্ন শহীদ পরিবারের উদ্যোগে কিছু প্রতিষ্ঠান নির্মিত হয়েছে, যেমন- শহীদ সালাউদ্দীনের পরিবার এক্তিয়াপুরে শহীদ সালাউদ্দীন উচ্চ বিদ্যালয়, শহীদ আব্দুল জব্বারের পরিবার নাককাটি নামক জায়গায় শহীদ আব্দুল জব্বার উচ্চ বিদ্যালয়, শহীদ আতিউরের পরিবার চাপোড়ে শহীদ আতিউর রহমান উচ্চ বিদ্যালয়, শহীদ গোলাম মোস্তফার পরিবার জাবরহাট কলেজে শহীদ অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা স্মৃতি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেছে। পৌর প্রশাসক মজিবর রহমান কয়েকজন শহীদের নামে পৌর এলাকার কয়েকটি সড়কের নামকরণ করেছেন।
পীরগঞ্জের শহীদ সন্তান আসাদ নিজ উদ্যোগে পৌরসভায় শহীদ অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা সড়কের পাশে আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের সঙ্গে একটি শহীদ মিনার, মুক্তিযুদ্ধে শহীদের তালিকা সম্বলিত একটি বোর্ড এবং মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ‘অদম্য ৭১’ নির্মাণ করেছেন। উল্লেখ্য, ভাস্কর্য এবং শহীদ মিনার যে জায়গায় নির্মিত হয়েছে সেখানে ১৯৭১ সালে ১১ জন বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছিল। [মো. আসাদুজ্জামান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!