পুটিয়া যুদ্ধ (শিবপুর, নরসিংদী)
পুটিয়া যুদ্ধ (শিবপুর, নরসিংদী) ১৪ই আগস্ট ও ৮ই ডিসেম্বর দুবার সংঘটিত হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথমবারের যুদ্ধে পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন সেলিম ও সুবেদার ইসকান্দারসহ ৩১ জন সৈন্য নিহত হয় এবং একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। দ্বিতীয়বারের যুদ্ধে ৫- ৭ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। অন্যদিকে ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাত বরণ করেন।
শিবপুর উপজেলার পুটিয়া ব্রিজ পার হয়ে পাকিস্তানি বাহিনী শিবপুর হয়ে নরসিংদী যাতায়ত করত। ১৪ই আগস্ট শিবপুর থানা গেরিলা ইউনিট কমান্ডার পুবেরগাঁও-এর আব্দুল মান্নান খানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পুটিয়া ব্রিজ ডিনামাইট দিয়ে ধ্বংস করেন। এর কিছুক্ষণ পর পুটিয়া বাজার থেকে ৪০ থেকে ৫০ জন পাকিস্তানি সৈন্য সামনের দিকে এগোতে থাকে। এ-সময় কমান্ডার আব্দুল মান্নান খান পুটিয়া ব্রিজের উত্তর পাড়ে বাজার সংলগ্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে অবস্থান নেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা গোলাগুলি শুরু করলে মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা গুলিবর্ষণ করেন। দুপক্ষের মধ্যে ঘণ্টাখানেক প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। পাকিস্তানি সেনা কমান্ডার ক্যাপ্টেন সেলিম ব্রিজের উল্টো দিকের সড়ক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ্য করে এলএমজি থেকে অবিরাম গুলি ছুড়তে থাকে। মুক্তিযোদ্ধা মজনু মৃধার চাইনিজ এসএমজির ছোড়া গুলিতে পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন সেলিম নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের মারমুখী আক্রমণে এ-সময় সুবেদার ইসকান্দারসহ আরো ৩০ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। অপরদিকে পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিতে কানাহোটা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হক শহীদ হন। তাঁর মরদেহ কমান্ডার আব্দুল মান্নান খানসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শিবপুর থানায় নিয়ে আসেন। সেখানে শহীদ ফজলুল হককে গার্ড অব অনার প্রদান করে তাঁর গ্রামের বাড়িতে পারিবারিক গোরস্তানে সমাহিত করা হয়। যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনা ক্যাপ্টেন সেলিমের শোল্ডার থেকে ব্যাজ খুলে নেন এবং প্রচুর অস্ত্র হস্তগত করেন। ৮ই ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানি সৈন্যদের ২য় বার যুদ্ধ হয়। ৩ নম্বর সেক্টরের বাঘাইবাড়ি সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন এজাজ আহমেদ চৌধুরীর নির্দেশে শিবপুর থানা প্রধান গেরিলা কমান্ডার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে আব্দুল হাই, হিরন, জয়নাল, হাফিজ, সোনা মিয়াসহ প্রায় ২০০ মুক্তিযোদ্ধা, কমান্ডার সাদেকুর রহমানের সাতপাইকা গ্রামের মিয়ারউদ্দিন, মিন্নত আলী, আইজউদ্দীন, ফাইজল ইসলাম এবং কমান্ডার বজলুর রহমান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে কামারটেকের আমজাদ হোসেন, যোশর ইউনিয়নের নুরুল ইসলাম ভূঁইয়া, আরমান মিয়া, হিরণ ভূঁইয়া, জয়নগর ইউনিয়নের মোতালিব খান প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এ ৩ গ্রুপের সঙ্গে ভারত থেকে আগত নতুন প্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধারাও যুদ্ধে অংশ নেন।
পুটিয়া গরুরবাজারে কলাগাছিয়া নদীর পূর্ব পাশে সাদেকুর রহমানের গ্রুপ এবং চৈতন্য গ্রামের বজলুর রহমান ভূঁইয়ার গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সৈন্যদের ক্যাম্প আক্রমণের জন্য পজিশন নেন। তাঁদের পজিশন নেয়ার পরই পাকিস্তানি সৈন্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান টের পেয়ে তাঁদের ওপর আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি ক্যাম্পের ওপর চারদিক থেকে আক্রমণ করেন। পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিতে দুলালপুর ইউনিয়নের সাতপাইকা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মিয়ার উদ্দিন ও মানিকদি গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা সাদেকুর রহমান মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। যুদ্ধে ৫ থেকে ৭ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হলে অবশিষ্টরা পালিয়ে নরসিংদী চলে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা পুটিয়া গরুরবাজারের পাকিস্তানি ক্যাম্প নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন। ১২ই ডিসেম্বর শিবপুর থানা পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত হয়। [রীতা ভৌমিক]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড