You dont have javascript enabled! Please enable it! পিটিআই নির্যাতনকেন্দ্র (জামালপুর সদর) - সংগ্রামের নোটবুক

পিটিআই নির্যাতনকেন্দ্র (জামালপুর সদর)

পিটিআই নির্যাতনকেন্দ্র (জামালপুর সদর) জামালপুর সদরে অবস্থিত। হানাদার বাহিনী তাদের স্থানীয় দোসরদের সহায়তায় জামালপুর শহর এবং আশপাশের এলাকা থেকে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন-এর নেতা-কর্মী, প্রগতিশীল ব্যক্তিবর্গ, হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক ও মুক্তিকামী সাধারণ মানুষকে এখানে ধরে এনে বন্দি করে রাখত এবং তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালাত। নির্যাতনের পর শেরপুর ঘাট সংলগ্ন শ্মশানঘাটে নিয়ে গুলি করে হত্যার পর ব্রহ্মপুত্র নদে ভাসিয়ে দিত।
১৯৭১ সালের ২২শে এপ্রিল ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী জামালপুর শহরে প্রবেশ করে এবং জামালপুর রেলগেটের অনতিদূরে জামালপুর-মধুপুর সড়কের ডানপাশে অবস্থিত পিটিআই (প্রাইমারি টিচার্স ইনস্টিটিউট)-এ ক্যাম্প স্থাপন করে। এরপর শুরু হয় তাদের অত্যাচার-নির্যাতন-অগ্নিসংযোগ আর গণহত্যা। পিটিআই ক্যাম্প ছিল হানাদার বাহিনীর বন্দিশিবির ও নির্যাতনকেন্দ্র। জামালপুরে পাকবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপনের কিছুদিনের মধ্যেই জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ-এর স্থানীয় নেতা আশরাফ হোসাইনের নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী এবং ইউসুফ মাস্টার ও মক্তব কবিরাজের নেতৃত্বে শান্তি কমিটি গঠিত হয়।
এরপর শান্তি কমিটির উদ্যোগে গঠিত হয় রাজাকার বাহিনী। আলবদর, রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যদের সহযোগিতায় হানাদার বাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতন-হত্যা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা আরো বৃদ্ধি পায়। তারা জামালপুর শহর এবং আশপাশের এলাকা থেকে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মী, প্রগতিশীল ব্যক্তিবর্গ, হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক ও মুক্তিকামী সাধারণ মানুষকে ধরে এনে পিটিআই ক্যাম্পে বন্দি করে রাখত এবং তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালাত। এ ক্যাম্পে একবার যাদের ধরে নিয়ে আসা হয়েছে, তাদের মধ্যে থেকে দু-একজন ছাড়া আর কেউ ফিরে যায়নি, মৃত্যুই ছিল তাদের জন্য অবধারিত। পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী ধরে নিয়ে আসা লোকজনের ওপর বিভিন্ন উপায়ে নির্যাতন চালাত, যেমন হাত-পা বেঁধে উল্টো করে ঝুলিয়ে রেখে বেধড়ক পেটানো, হাত-পায়ের নখ উপড়ে ফেলা, হাত-মুখ বেঁধে গরম পানি ঢালা, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে লবণ দেয়া, সিগারেটের ছ্যাকা দেয়া, পানি খেতে না দেয়া, মেঝেতে ফেলে বুট জুতা পায়ে মাড়ানো, বুকে-পিঠে লাথি মারা ইত্যাদি। তাদের নির্যাতনে বহু মুক্তিকামী মানুষ শহীদ হয়েছেন। তাছাড়া পিটিআই ক্যাম্পে নির্যাতন করার পর হানাদার বাহিনী তাদের শেরপুর ঘাট সংলগ্ন শ্মশানঘাটে নিয়ে চোখ-হাত বেঁধে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যার পর ব্রহ্মপুত্র নদে ভাসিয়ে দিত।
পিটিআই ক্যাম্পেই মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মোহাম্মদ শাহনেওয়াজের পিতা সাবেক প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য আবদুল হামিদ মোক্তারকে তাঁর গ্রামের বাড়ি সরিষাবাড়ীর ভাটারা থেকে ধরে এনে বন্দি করে রাখা হয়। পরে শ্মশানঘাটে নিয়ে তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ক্যাম্পেই বন্দি করে রাখা হয় ন্যাপ (ভাসানী)-এর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বজ্রাপুরের আবদুল ওয়াহাবকে। তাঁকেও শ্মশানঘাটে নিয়ে গুলি করা হয়। কিন্তু ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান। এ ক্যাম্পেই জামালপুর আশেক মাহমুদ কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক, কবি, প্রগতিশীল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সৈয়দ ইমামুর রশীদকে ধরে এনে সপ্তাহখানেক আটকে রেখে তাঁর ওপর নির্যাতন চালানো হয়। পরে তাঁকে জামালপুর জেলখানায় স্থানান্তর করা হয়। সেখান থেকে দুমাস পর তিনি ছাড়া পান। এভাবে পিটিআই ক্যাম্পে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বহু মানুষকে নির্যাতন করেছে। [আহমদ আজিজ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড