You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে পিরোজপুর সদর উপজেলা

পিরোজপুর সদর উপজেলা ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-এর অভূতপূর্ব বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে বাঙালিদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণের সুযোগ সৃষ্টি হয়। কিন্তু অচিরেই পশ্চিম পাকিস্তানিদের চক্রান্তে সে স্বপ্ন নস্যাৎ হতে শুরু করে। তারা বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা না দিয়ে উল্টো দমননীতি চালায়। ফলে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মাধ্যমে বাঙালিরা বুঝতে পারে যে, এখন চূড়ান্ত স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। পিরোজপুর সদর উপজেলার মানুষের কাছেও সেটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
২৫শে মার্চ রাতে বরিশাল থেকে নূরুল ইসলাম মঞ্জুর এমএনএ টেলিফোনে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার সংবাদ দেন। ২৬শে মার্চ বিকেলে জাতীয় পরিষদ সদস্য এডভোকেট এনায়েত হোসেন খানের নেতৃত্বে পিরোজপুর শহরের টাউন ক্লাব মাঠে এক জনসভার আয়োজন করা হয়। সভায় বক্তব্য রাখেন এডভোকেট এনায়েত হোসেন খান এমএনএ, ডা. ক্ষিতীশ চন্দ্র মণ্ডল এমপিএ, ডা. আব্দুল হাই এমপিএ, খালেদ রবি, ওমর ফারুক, এডভোকেট এম এ মান্নান, এডভোকেট আলী হায়দার খান, ইয়াকুব আলী সিকদার, বদিউজ্জামান চৌধুরী, আমোদ রঞ্জন গুহ, আজিজুর রহমান সিকদার, মালেক খান আবু প্রমুখ গণ্যমান্য ব্যক্তি। এডভোকেট এনায়েত হোসেন খান এমএনএ ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর নারকীয় হত্যাকাণ্ডের বিবরণ দেন। জনসভা চলাকালে এক পর্যায়ে ‘অস্ত্র চাই” বলে স্লোগান ওঠে। এডভোকেট এনায়েত হোসেন খান তাদের অস্ত্র দেয়া হবে বলে আশ্বস্ত করেন। সভা শেষে উত্তেজিত জনতা পিরোজপুর অস্ত্রাগারে হামলা চালায় এবং ৩০০-৪০০ অস্ত্র ও প্রচুর গুলি হস্তগত করে। ২৭শে মার্চ নবগঠিত মুক্তিফৌজ স্থানীয়ভাবে তাৎক্ষণিক গঠিত ‘বিপ্লবী সরকার’এর প্রধান এডভোকেট এনায়েত হোসেন খান এমএনএ-কে গার্ড অব অনার প্রদান করে। ২৮শে মার্চ পিরোজপুর সরকারি বালক বিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে আগ্রহীদের জন্য একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। এ ক্যাম্পের প্রশিক্ষক ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তরুণ বাঙালি অফিসার ও পরবর্তীতে ৯ নম্বর সেক্টরের সুন্দরবন অঞ্চলের সাব-সেক্টর কমান্ডার লে. জিয়াউদ্দিন আহমদ। ফজলুল হক খোকন ও খালেদ রবির নেতৃত্বে আরেকটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করা হয় শহরের করিমুন্নেছা বালিকা বিদ্যালয়ে। ওয়াপদা এলাকায়ও একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ছিল। এ ক্যাম্পের নেতৃত্বে ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক শফিজ উদ্দিন আহম্মদ। এছাড়া রায়েরকাঠি জমিদার বাড়িতে একটি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। পিরোজপুরের উপকণ্ঠে কদমতলা জর্জ হাই স্কুলে আরেকটি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। এসব ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। লে. জিয়াউদ্দিন ৩০-৩৫ নারীকেও প্রশিক্ষণ দেন।
পিরোজপুর সদর উপজেলায় যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- এডভোকেট এনায়েত হোসেন খান এমএনএ, ডা. ক্ষিতীশ চন্দ্র মণ্ডল এমপিএ, ডা. আ. হাই এমপিএ, এডভোকেট এম এ মান্নান, ওমর ফারুক, আজিজুর রহমান সিকদার, নূরুল ইসলাম মঞ্জুর এমএনএ, খালেদ রবি, এডভোকেট আলী হায়দার খান, মালেক খান আবু প্রমুখ। এঁরা মুক্তিফৌজ গঠন ও গেরিলা যুদ্ধ শুরু করতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পিরোজপুর অঞ্চলে যাঁরা কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন, তাঁরা হলেন- লে. জিয়াউদ্দিন আহমদ (পরবর্তীতে মেজর), এডভোকেট শামসুল হক, আবুল কালাম মহিউদ্দিন, হারুনুর রশিদ, গাজী নূরুজ্জামান বাবুল, মো. লিয়াকত আলী শেখ বাদশা ও মেজর জেনারেল নূরুল ইসলাম শিশু। পাকবাহিনী পিরোজপুরে প্রবেশের আগেই মুক্তিবাহিনী তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে। পিরোজপুর, কাঁঠালিয়া ও সুন্দরবন অঞ্চলের সাব-সেক্টর কমান্ডার লে. জিয়াউদ্দিন আহমদ প্রতিটি থানায় একজন করে কমান্ডার নিয়োগ করেন। পিরোজপুর সদরে কমান্ডার নিয়োগ করা হয় আব্দুল মান্নানকে। ৯ নম্বর সেক্টরের অধীনে থেকে মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন কমান্ড অনেকবার পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ করে। ১৭ই এপ্রিলের পর থেকে পুরোদমে চালু হয়ে যায় স্বাধীন বাংলাদেশের সিল মোহর। ট্রেজারি অফিসার সাইফ মিজানুর রহমান ট্রেজারির সমস্ত টাকা-পয়সা মুক্তিবাহিনীর হাতে তুলে দেন। তৎকালীন মহকুমা পুলিশ প্রশাসক ফয়জুর রহমান আহমদ (সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমদের পিতা) তাঁর পুলিশ বাহিনী নিয়ে মুক্তিবাহিনীর সাহায্যে এগিয়ে আসেন।
হুলারহাট নদী বন্দর দিয়ে ৩রা মে পাকবাহিনী পিরোজপুরে প্রবেশ করে। কর্নেল আতিক ও ক্যাপ্টেন এজাজের নেতৃত্বাধীন এ বাহিনীকে সংবর্ধনা জানায় পিরোজপুর শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান সৈয়দ আফজালসহ স্বাধীনতাবিরোধী চক্র। পাকবাহিনী পিরোজপুর সরকারি বালক বিদ্যালয়ে ক্যাম্প স্থাপন করে। পাকবাহিনীর টর্চার সেলও স্থাপন করা হয় সরকারি বালক বিদ্যালয়ে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ক্যাপ্টেন এজাজ মহকুমা প্রশাসকের বাসভবনে অবস্থান করত।
পাকবাহিনী পিরোজপুরে প্রবেশের আগেই পিরোজপুর শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল সৈয়দ মোহাম্মদ আফজাল ও সেক্রেটারি আ. ছাত্তার মিয়া। এছাড়া আলশামস বাহিনীর চেয়ারম্যান ছিল সরদার সুলতান মাহমুদ এবং রাজাকার বাহিনীর নেতা ছিল মোসলেমউদ্দিন। এদের সহায়তায় জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী, মুসলিম লীগ, এনএসএফ ও ইসলামী ছাত্র সংঘ-এর সদস্যরা শান্তি কমিটি, আলশামস ও রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয়। উপজেলা সদর থেকে ইউনিয়ন পর্যন্ত শান্তি কমিটির কার্যক্রম বিস্তৃত ছিল। এরা উপজেলার বিভিন্ন স্থানে হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও নারীনির্যাতন চালায়। হুলারহাট লঞ্চ টার্মিনালে রাজাকার আশ্রাফ আলী চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে হত্যাকাণ্ড চালানো হয়। সিকদারমল্লিক ইউনিয়ন গণহত্যায় পাকবাহিনীর দোসর হিসেবে ইয়াকুব আলী খান, মান্নান শেখ, মালেক সর্দার প্রমুখ জড়িত ছিল। এছাড়া পাকবাহিনীর দোসর হিসেবে উল্লেখযোগ্য ছিল— আনিস ফকির, ইসমাইল খান, ইয়াকুব আলী ফকির, ডা. ইউনুছ, আব্দুল আজিজ মল্লিক, এ বি এম আজিজুল হক মোক্তার, এস এম মোফাজ্জল হোসেন, সেকেন্দার কমান্ডার, আতাহার চাপরাশি, হারুন-অর-রশিদ, আব্দুল আলী এডভোকেট, ভদ্দর মৌলভী, মোজাহার মল্লিক, হাশেম চেয়ারম্যান, মোজাম্মেল হোসেন খান, আলতাফ হোসেন আবু, দেলোয়ার হোসেন মল্লিক, সৈয়দ সালেহ আহমদ, জিন্নাত আলী মোক্তার, এডভোকেট আ. মজিদ প্রমুখ।
পাকবাহিনী ৩রা মে পিরোজপুর শহরে প্রবেশের পর থেকেই হত্যাকাণ্ড শুরু করে। তাদের দোসর হুলারহাটের আশ্রাফ আলী চেয়ারম্যান ও নরখালির মোনতাজ চৌকিদারের নেতৃত্বে হুলারহাটে নারায়ণ দাস, ননী দাস, ট্যাডন দাস সহ ৭-৮ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়, যা হুলারহাট গণহত্যা নামে পরিচিত। একই দিন পাকবাহিনী পিরোজপুর শহরের উপকণ্ঠে মিস্ত্রীবাড়ি ও মণ্ডলবাড়িতে হত্যাকাণ্ড চালায়। মিস্ত্রীবাড়িতে সুরেন্দ্রনাথ মিস্ত্রী, মতি মিস্ত্রী, উপেন মিস্ত্রী, বিজয় মিস্ত্রী ও রাজেন মিস্ত্রীকে হত্যা করা হয়। মণ্ডলবাড়িতে খগেন্দ্রনাথ মণ্ডল, দেবেন্দ্রনাথ মণ্ডল, পুলিন মণ্ডল, শরৎ মণ্ডল, সুরেন্দ্রনাথ মণ্ডল, মহেন্দ্র মণ্ডল ও সুরেন মণ্ডলকে হত্যা করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে শহরের বলেশ্বর খেয়াঘাট ছিল এক বিভীষিকাময় বধ্যভূমি। এখানে সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ড চালানো হয়। ৬ই মে থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ ধরে এনে এখানে হত্যা করা হতো। হত্যার পর তাদের লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হতো। ৬ই মে মহকুমা প্রশাসক আব্দুর রাজ্জাক, মহকুমা পুলিশ প্রশাসক ফয়জুর রহমান আহমদ, ট্রেজারি অফিসার সাইফ মিজানুর রহমান এবং দুর্নীতি দমন দারোগা হীরেন্দ্র মহাজনকে পাকবাহিনী বলেশ্বর খেয়াঘাটে হত্যা করে। সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা তেজদাসকাঠী গ্রামে প্রবেশ করে ব্যাপক নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগ করে। তেজদাসকাঠী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে খালের পাড়ে বিভিন্ন গ্রাম থেকে ধরে আনা ২৩ জন (অনেকের মতে আরো বেশি) নিরীহ গ্রামবাসীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এটি তেজদাসকাঠী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গণহত্যা নামে পরিচিত। ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে সিকদারমল্লিক ইউনিয়ন থেকে মোসলেম আলী শেখ, আবদুর রহমান সরদার, আব্দুল গাফফার মাস্টার, শামসুল হক ফরাজী, জলিল হাওলাদারসহ ১২ জনকে ধরে এনে বলেশ্বর খেয়াঘাট বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয়। ২০শে মে পাকবাহিনী জুজখোলা গ্রামে প্রবেশ করে আইয়ুব আলী মেম্বারের বাড়িতে আ. জব্বার শেখ, আফসার শেখ, ইসমাইল শেখ, আব্দুল ওয়াহেদ শেখ, মহসীন আলী মোল্লা, তবেজান মোল্লা, ইউনুছ মোল্লা, হেমায়েত মোল্লা, আরজ শেখ, সুলতান শেখ, সাহেব আলী শেখ ও হাবীব শেখকে হত্যা করে। এটি জুজখোলা গণহত্যা নামে পরিচিত। ১০ই মে মঠবাড়িয়া থেকে ধরে আনা ৮ জন তরুণকে বলেশ্বর খেয়াঘাটে হত্যা করা হয়। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মঠবাড়িয়া কলেজের ভিপি আনোয়ারুল কাদির, আজম খান কমার্স কলেজের ছাত্রনেতা জিয়াউজ্জামান, গোলাম মোস্তফা, আ. মালেক, বীরেন মণ্ডল, নারায়ণ চন্দ্র (শিক্ষক), নুরুল ইসলাম বিএসসি (শিক্ষক), জাকির হোসেন (শিক্ষক) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের ছাত্র গণপতি হালদার।
পিরোজপুর সদর উপজেলায় নারীনির্যাতনের সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা হলো ভাগীরথী সাহা- (কদমতলা, পিরোজপুর)-কে নির্যাতন ও হত্যা করা। অসম সাহসী এ নারী মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে থালাবাসন ধোয়ার কাজ করতেন। আসলে তিনি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে একজন গোয়েন্দা। পাকবাহিনীর গতিবিধি, তাদের পরিকল্পনা ইত্যাদি বিষয় তিনি আগেভাগে মুক্তিযোদ্ধাদের জানিয়ে দিতেন। কিন্তু এক সময় তাঁর পরিচয় প্রকাশ হয়ে পড়ে। ফলে পাকবাহিনীর ক্যাপ্টেন এজাজ তাঁকে সবার সামনে হত্যার আদেশ দেয়। ১৩ই সেপ্টেম্বর সুবেদার সেলিম ভাগীরথীকে মোটর সাইকেলের পেছনে বেঁধে টেনে-হিঁচড়ে সারা শহর চক্কর দেয়। ভাগীরথীর শরীর থেকে মাংস খসে পিরোজপুর শহরের রাস্তায় পড়ে থাকে। শেষ পর্যন্ত তাঁর নিষ্প্রাণ দেহকে বলেশ্বর নদীতে নিক্ষেপ করা হয়।
পাকবাহিনীর পিরোজপুর সরকারি বালক বিদ্যালয় ক্যাম্প ছিল তাদের বন্দিশিবির ও নির্যাতনকেন্দ্র। উপজেলার বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষজন ধরে এ শিবিরে আনা হতো। প্রায় প্রতিদিন ১০-১২ জনের একেকটি দলকে এখানে আনা হতো। স্থানীয় রাজাকার ও স্বাধীনতাবিরোধী চক্র তাদের ধরে আনত। সারারাত ধরে তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হতো। পরদিন তাদের বলেশ্বর খেয়াঘাট বধ্যভূমিতে নিয়ে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি ও বেয়োনেট চার্জ করে হত্যা করা হতো।
উপজেলার সবচেয়ে বড়ো বধ্যভূমি ছিল বলেশ্বর খেয়াঘাট। ৬ই মে থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিদিন এখানে ১০-১২ জন করে মানুষ হত্যা করা হতো। পিরোজপুরের মহকুমা প্রশাসক, পুলিশ প্রশাসক, ট্রেজারি অফিসারসহ অসংখ্য মানুষকে এখানে হত্যা করা হয়, যা পূর্বে উল্লিখিত। অনেকের মৃতদেহ আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। পাকবাহিনী কোনো- কোনো দিন সামরিক ট্রাক ভর্তি করে মানুষ নিয়ে আসত এবং গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে তাদের হত্যা করা হতো। হুলারহাট লঞ্চ টার্মিনাল ছিল আরেকটি বধ্যভূমি। হুলারহাট আনসার ক্লাবে পাকবাহিনী ও রাজাকার বাহিনী অবস্থান করত। তারা লঞ্চ টার্মিনালকে হত্যাকাণ্ডের অন্যতম স্থান হিসেবে ব্যবহার করে। এ টার্মিনাল দিয়ে যারা যাতায়াত করত তাদের মধ্য থেকে সন্দেহভাজনদের ধরে হত্যা করত। এছাড়া পিরোজপুরের বিভিন্ন স্থান থেকে স্বাধীনতাকামীদের এবং নিরপরাধ হিন্দু ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের ধরে এনে এখানে হত্যা করা হতো। পিরোজপুর শহরের পূর্বদিকে কালীগঙ্গা ও কচা নদীর সংযোগস্থলে ছিল হুলারহাট লঞ্চ টার্মিনাল বধ্যভূমি। এখন আর তার অস্তিত্ব নেই, নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। উপজেলায় কোনো গণকবর নেই, কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা নদী বা খালের পাড়ে হত্যাকাণ্ড চালাত। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মৃতদেহ পানিতে ভেসে যায়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় কদমতলার বাঘমারা ও একপাই জুজখোলা 1 গ্রামে আব্দুল আলী সরদারের নেতৃত্বে এক দুর্ধর্ষ রাজাকার বাহিনী গড়ে ওঠে। তাদের অত্যাচারে মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। ১৩ই আগস্ট পার্শ্ববর্তী নাজিরপুর উপজেলা থেকে মুক্তিযোদ্ধা সারোয়ার হোসেন ১৭ জন সঙ্গী নিয়ে একপাই জুজখোলা গ্রামে আসেন। তাঁর আগমনের খবর পেয়ে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মতিউর রহমান সরদার তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। সারোয়ার হোসেন তখন মতিউর রহমানের হাতে এডভোকেট এনায়েত হোসেন এমএনএ-এর একটি চিঠি তুলে দেন। চিঠিতে যুদ্ধ পরিচালনা সংক্রান্ত নির্দেশনা ছিল। ঐদিন রাতে মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকার আব্দুল আলী সরদারকে ধরে আনেন এবং গণআদালতে বিচারের মাধ্যমে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেন। এর ফলে রাজাকাররা সাময়িকভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। তবে কিছু দিনের মধ্যেই পাকবাহিনীর সহায়তায় তারা শক্তি সঞ্চয় করে কদমতলা, বাঘমারা প্রভৃতি গ্রামে অত্যাচার-নিপীড়ন চালাতে থাকে। পরবর্তীতে ২৯শে আগস্ট পাকবাহিনী বাঘমারায় অভিযান চালায়। এ সংবাদ ভাগীরথী আগেই মুক্তিযোদ্ধাদের জানিয়ে দিয়েছিলেন। ফলে মুক্তিযোদ্ধারা আগে থেকেই ঝোপঝাড়ে অবস্থান নেন। পাকবাহিনী বাঘমারায় পৌঁছলে উভয় পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা না থাকায় পাকবাহিনী বিপাকে পড়ে। মুক্তিবাহিনীর গুলিতে তাদের বেশকিছু সৈন্য মারাত্মকভাবে আহত হয়। ফলে তারা দিশেহারা হয়ে পালাতে শুরু করে। পালানোর সময় তারা এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে বেশকিছু মানুষকে হত্যা করে। এ-সময় শহীদ হন ধনঞ্জয় সাহা, কৈলাস সাহা, রসিক লাল সাহা, অরুণ প্রমুখ। পরবর্তীতে ৮ ও ৯ই সেপ্টেম্বর পাকবাহিনী আবারো আক্রমণ চালায়। কিন্তু এবারো মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তারা নাজেহাল হয়। ৮ই ডিসেম্বর পিরোজপুর সদর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
পিরোজপুর সদর উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন (ডুমরীতলা), বিধান চন্দ্র হালদার (বসন্তপুল), মণীন্দ্রনাথ হালদার (মণ্ডলপাড়া), মো. নূরুল আলম সেলিম, ওমর ফারুক, ফজলুল হক খোকন, মাহতাব উদ্দিন সরদার (মধ্যরাস্তা), পঙ্কজ কর্মকার, লুৎফর রহমান হাওলাদার (ছোট খলিশাখালী), আব্দুল সালেক সেখ (ঝাটকাঠী), দুলাল চন্দ্ৰ ঘোষ (কালীবাড়ি রোড), অশ্রাব আলী (সিও অফিস রোড), হুমায়ুন কবির (পিরোজপুর), সালে আহম্মেদ (পাড়েরহাট রোড), আ. মালেক খান (কৈবর্তখালী), বিজয় কৃষ্ণ মিস্ত্রী (মণ্ডলপাড়া), নাছির উদ্দিন (নামাজপুর), সিপাহি আবুল কালাম ফকির (টোনা, চলিশা), এ বি এম রফিকুল ইসলাম, গণেশ চন্দ্র বসু (ভিটাবাড়িয়া, ভান্ডারিয়া), পুনেন্দ্র সরকার (পিরোজপুর), আমজাদ হোসেন (শংকরপাশা) ও ভাগীরথী সাহা (কদমতলা)।
বলেশ্বর খেয়াঘাট বধ্যভূমিতে শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হয়েছে। শহরের কৃষ্ণচূড়া মোড়ের নামকরণ করা হয়েছে শহীদ ভাগীরথী চত্বর। এখানে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ আছে (শহীদদের নাম সংবলিত)। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামে যেসব সড়কের নামকরণ করা হয়েছে, সেগুলো হলো— শহীদ ওমর ফারুক সড়ক, শহীদ লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন সড়ক, শহীদ ফয়জুর রহমান আহমদ সড়ক, শহীদ বিধান সড়ক, শহীদ সাইফ মিজানুর রহমান সড়ক, শহীদ ফজলুল হক সড়ক, শহীদ প্রবীর বাচ্চু সড়ক, শহীদ সেলিম সড়ক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. আ. হাই সড়ক। এছাড়া শহীদ সেলিমের স্মরণে পাড়ার নামকরণ করা হয়েছে শহীদ সেলিম পাড়া। [মুহাম্মদ শাহীন রেজা]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!