পালবাড়ি বধ্যভূমি (ঝালকাঠি সদর)
পালবাড়ি বধ্যভূমি (ঝালকাঠি সদর) ঝালকাঠি শহরে অবস্থিত। পাকবাহিনী ২৭শে এপ্রিল বাণিজ্য বন্দর ঝালকাঠি দখল করে নেয়। এ-সময় পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের নেতা সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে পরিচালিত মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প ছিল ঝালকাঠি শহরের পালবাড়ি এলাকায়। ভারী অস্ত্রে সজ্জিত পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে হালকা ও সীমিত অস্ত্র দিয়ে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব নয় মনে করে সিরাজ সিকদার তাঁর বাহিনী নিয়ে কীর্তিপাশা চলে যান এবং সেখানে ক্যাম্প স্থাপন করেন। পরে অবশ্য সেখান থেকেও সরে যেতে হয়।
পাকবাহিনী পালবাড়িসহ শহরের চারটি স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করে। তারা পালবাড়িতে অবস্থিত খাদ্য গুদামের কিছুটা উত্তরে একটি দ্বিতল ভবনের একাংশে স্থাপন করে তাদের নির্যাতন কক্ষ। ঝালকাঠি দখল হওয়ার পর যারা জীবনের ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন, রাজকারদের সহযোগিতায় পাকসেনারা তাদের ধরে এনে এই টর্চার সেলে আটকে রেখে নির্মম নির্যাতন চালায়। নারীদের আলাদা কক্ষে রেখে দিনের পর দিন ধর্ষণ করে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে পাকবাহিনী কর্তৃক নিষ্ঠুর হত্যা সম্বন্ধে বিবরণ পাওয় যায়। একদিন পশ্চিম ঝালকাঠির এক বাড়ি থেকে এক যুবককে পাকসেনারা নারকেল গাছ থেকে ডাব পেড়ে দেয়ার জন্য ধরে নিয়ে আসে। ডাব পাড়া হয়ে গেলে তারা তাকে নামতে বলে। গাছের অর্ধেক পর্যন্ত নামলে পাকসেনারা তাকে গুলি করে পৈশাচিক অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। পালবাড়ি টর্চার সেলে ধরে নিয়ে আনা নিরপরাধ মানুষগুলো প্রায়ই জীবন ভিক্ষা চেয়ে কান্নাকাটি করত। হানাদাররা তাদের ক্যাম্প-সংলগ্ন বাসন্ডা নদীর পাড়ে নিয়ে সাঁতরে চলে যেতে বলত। বাঁচার আশায় তারা সাঁতরে মাঝ নদী পর্যন্ত গেলে পাকসেনারা তাদের গুলি করে হত্যা করত। গোডাউন ঘাটের সিঁড়ির ওপর অগণিত জনকে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে। কসাই বারেক নামে পরিচিত আজিজ পাইলটের ভাই আবদুল বারেক সেটি বেশি করে। চাচের যুদ্ধ-এ পরাজয়ের পর পাকবাহিনী এতটাই হিংস্র হয়ে ওঠে যে, এর পর কয়েকদিন ধরে শহরে যেখানেই কোনো হিন্দুকে পেয়েছে তাকেই ধরে এনে জবাই করে বাসন্ডা নদীতে ফেলে দিয়েছে। জল্লাদ আবদুল বারেককে পরে মুক্তিযোদ্ধারা ধরে নিয়ে ইছানিল স্কুলের সামনে হত্যা করেন।
পালবাড়ি ক্যাাম্পের কাছেই ছিল হিন্দুদের মনসা মন্দির। স্থানটি মনসাবাড়ি নামে পরিচিত ছিল। ক্যাম্প স্থাপনের পর পাকবাহিনী সেখানে অবস্থিত মন্দির ও মন্দিরের মূর্তি ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়। আশপাশের বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। যাকে যেখানে পেয়েছে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে। নিহতদের লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়ায় অনেকেরই পরিচয় পাওয়া যায়নি। এখানে নিহতদের কয়েকজন হলেন- রুস্তুম আলী খান, মানিক মিয়া, বরুণ কুমার শীল, শীতল চন্দ্র ডাকুয়া, ক্ষিতীশ চন্দ্র সাহা ও তার ভাই মাধব চন্দ্র সাহা, সুধাংশু কুমার, রাজেন বিশ্বাস, আনসার, রমাবতী বসু, দিলীপ কুমার বসু (ঝালকাঠি কলেজের ক্যাশিয়ার), সুরেন্দ্র নাথ কর্মকার, সমীরণ, কল্পনা রাণী দাস, কাজল রাণী দাস প্রমুখ। পরমহলের আকবর আলী এ ক্যাম্পের সেন্ট্রি হিসেবে বেশির ভাগ সময় কাজ করে।
এখানে পাকবাহিনীকে যারা সহায়তা করে তাদের কয়েকজন হলো- ব্যারিস্টার আখতার উদ্দিন, জেবালুল ইসলাম, এডভোকেট আবদুর রহমান বিশ্বাস (প্রয়াত সাবেক রাষ্ট্রপতি), শাহজাহান চৌধুরী এবং এডভোকেট আবদুল বারেক (পরবর্তীতে বিএনপি-র এমপি)। নভেম্বর মাসের শেষদিকে হানাদার বাহিনী পালবাড়ি ক্যাম্প থেকে বের হওয়া প্রায় বন্ধ করে দেয়। ডিসেম্বর মাসে ভারতীয় মিত্রবাহিনী এবং মুক্তিবাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণে পর্যুদস্ত হানাদার বাহিনী রাজাকার দের দিয়ে বিভিন্ন স্থানে ছোট- খাটো অভিযান চালালেও নিজেরা ক্যাম্পেই থাকত। ৭ই ডিসেম্বর রাতে তারা শহরে কারফিউ জারি করে ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যায়। জেবালুল ইসলাম মাইকে কারফিউর ঘোষণা প্রচার করে। পরদিন ভোরে রাজাকাররা মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলে ঝালকাঠি হানাদারমুক্ত হয়। [শ্যামল চন্দ্র সরকার]
পালবাড়ি বধ্যভূমি ও গণকবর (জকিগঞ্জ, সিলেট) সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলার পৌর এলাকার বিলেরবন্দ গ্রামে অবস্থিত। এখানকার সতীশ পাল, সুধীর পাল ও করুণা পালের বাড়িতে বিভিন্ন সময়ে বহু লোককে হত্যা করে কবর দেয়া হয়। পাকসেনারা এ এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের পিতা, মাতা, ভাই ও আত্মীয়-স্বজন মিলে ১৫ জনকে সতীশ পালের বাড়িতে ধরে এনে তাদের দিয়ে গর্ত খুঁড়িয়ে ঐ গর্তেই গুলি করে হত্যা করে। এছাড়া বারঠাকুরী ইউনিয়নের শরিফগঞ্জ এলাকায় পাকবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে শহীদ ৯ জন মুক্তিযোদ্ধা, ঐ যুদ্ধে শহীদ ঢাকা নিবাসী হাবিলদার সামছুল ইসলাম ও কেরানীগঞ্জের ইপিআর সদস্য হাসন আলীসহ অন্য কয়েকজন শহীদকেও এখানে এনে মাটিচাপা দেয়া হয়৷
যুদ্ধের সময় সুধীর পালের বাড়ির লোকজন ভারতে চলে গেলে পাকসেনা ও তাদের দোসররা সেখানে ক্যাম্প স্থাপন করে। তারা ইলাবাজ গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মুতালেব, জালাল উদ্দিন ও আবুল হোসেনের পিতা সামছুল হক ও তাঁদের চাচা, পৌর এলাকার মাইজকান্দি গ্রামের কুটু মনি, কটই মিয়া, সেনাপতি চকের মতছিম আলী, আব্দুর রহিম সরপঞ্চ, আব্দুন নূর, সুরু মিয়া, ছোয়াব আলী ও মুনিম ড্রাইভারকে ধরে এনে তাদের দিয়ে গর্ত খোঁড়ায়। পরে সেই গর্তেই গুলি করে হত্যা করে মাটিচাপা দেয়।
সুধীর পালের বাড়ির পশ্চিম পাশে করুণা পালের বাড়ি। লোহারমহলের পুরঞ্জনের বাড়িতে স্থাপিত পাকসেনাদের ক্যাম্প ও বাংকারে অভিযান পরিচালনা করায় ঐ এলাকার আওয়ামী লীগ সদস্য মিরজান আলী, নীলাম্বর আলী, হায়াত আলী, আছাই মিয়াসহ মোট ১২ জনকে এ বাড়িতে ধরে এনে তাদের দিয়ে গর্ত খুঁড়িয়ে সেই গর্তেই গুলি করে হত্যার পর মাটিচাপা দেয়া হয়। দেশ স্বাধীনের পর এ গণকবর থেকে শহীদদের কংকাল তুলে লোহারমহল পশ্চিম গোরস্তানে পুনরায় দাফন করা হয়।
এছাড়া কেছরী গ্রামের কাড়ারপাড়, বারঠাকুরী ইউনিয়নের আমলশীদ গ্রাম ও সোনাসার ব্রিজের নিচে এবং খলাছড়া ইউনিয়নের গন্ধদত্ত গ্রামের ছৈয়ব আলীর বাড়িতেও গণকবর রয়েছে। কেছরী গ্রামের উত্তর-পূর্ব দিকের মাঠে গর্ত করে ৪ জন লোককে গুলি করে হত্যা শেষে মাটি চাপা দেয়া হয়। আমলশীদ গ্রামের মসজিদের পূর্বদিকের গোরস্তানে ৪ জন ও একটু উত্তর দিকে রাস্তার পশ্চিম পার্শ্বে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধার অরক্ষিত কবর রয়েছে। এ যোদ্ধারা বিভিন্ন সময়ে শরিফগঞ্জ এলাকায় পাকসেনাদের সঙ্গে যুদ্ধে শহীদ হন। সিলেট-জকিগঞ্জ সড়কের সোনাসার ব্রিজের নিচে পাকসেনারা ৪ জন লোককে গুলি করে সোনাসার বাজারের পার্শ্বস্থ রাস্তার পশ্চিম পাশের গোরস্তানে মাটিচাপা দেয়। জকিগঞ্জ-আটগ্রাম রাস্তার পশ্চিম পার্শ্বের খলাছড়া ইউনিয়নের গন্ধদত্ত গ্রামের ছৈয়ব আলীর বাড়িতে পিরেরচক গ্রামের মো. রকিবদী ও আব্দুল ওহাব আলীসহ ৪ জনকে পাকসেনারা গুলি করে মাটিচাপা দেয়। দেশ স্বাধীনের পর স্বজনরা উপর্যুক্ত প্রথম তিনটি স্থান থেকেই শহীদদের কংকাল তুলে নিয়ে যায়। [আল হাছিব তাপাদার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড