You dont have javascript enabled! Please enable it!

পাহাড়তলী বধ্যভূমি (চট্টগ্রাম মহানগর)

পাহাড়তলী বধ্যভূমি (চট্টগ্রাম মহানগর) চট্টগ্রাম মহানগরে অবস্থিত। এখানে মার্চের মাঝামাঝি সময় থেকে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাহাড়তলীতে ১১ হাজারের বেশি লোককে হত্যা করা হয়। হত্যার ধরনও ছিল অত্যন্ত পৈশাচিক। সবচেয়ে বেশি লোক হত্যা হয় ১০ই নভেম্বর। এদিন ৪০০ জনের মতো লোককে হত্যা করা হয়। যাদের হত্যা করা হয় তাদের অধিকাংশই ছিল স্থানীয় মাস্টার লেন, পাঞ্জাবী লেন (বর্তমানে শহীদ লেন), গোয়ানিজ কোয়ার্টার্স, ঝাউতলা ও সরাইপাড়া এলাকার বাসিন্দা। গণহত্যার শিকার লোকজনের একটি বড় অংশই চট্টগ্রাম রেলওয়েতে চাকরি করত। মূলত চাকরির কারণেই তারা পাহাড়তলীতে থাকত। এছাড়া নাজিরহাট, হাটহাজারী ও দোহাজারী রুটের ট্রেনগুলো যেত • পাহাড়তলীর ওপর দিয়ে। এসব ট্রেন থেকে নামিয়ে বহু লোককে এখানে হত্যা করা হয়। স্থানীয়ভাবে এটি জল্লাদখানা নামে পরিচিত। এখানে পাহাড়ের ওপরে ছিল ব্রিটিশ আমলে নির্মিত সুরম্য একটি দোতলা ভবন। বর্তমানে বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের বিপরীতে অবস্থিত এ বাড়িটি বাগানবাড়ি নামে পরিচিত ছিল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এটিকে দখল করে নির্যাতনকেন্দ্রে পরিণত করে। এ নির্যাতনকেন্দ্রে অনেক যুবতি নারীকে আটকে রেখে হানাদাররা নিয়মিত ধর্ষণ করত। এখানে দুটি পাথরখণ্ড ছিল, যা ছুরি ও রামদা ধার দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হতো এবং একটি। বড় পাথরের ওপর শুইয়ে মানুষকে পশুর মতো জবাই করা হতো। এসব হত্যাকাণ্ডের হোতা ছিল স্থানীয় অবাঙালি = বিহারিরা। বিহারিদের একটি বড় অংশ চাকরি করত চট্টগ্রাম রেলওয়েতে। তারাও এসব এলাকায় বসবাস করত।। ঝাউতলা, শেরশাহ কলোনি, ফিরোজশাহ কলোনি ও ওয়ারলেস কলোনি এলাকায় বিহারিদের বসবাস ছিল সবচেয়ে বেশি। তাই পাহাড়তলী পূর্ব থেকেই অবাঙালি বিহারি অধ্যুষিত ছিল।
মুক্তিযুদ্ধকালে পাহাড়তলী বধ্যভূমি পাঁচলাইশ থানার অংশ ছিল। ২০০০ সালের ২৭শে মে পাহাড়তলী ও পাঁচলাইশ থানার অংশবিশেষ নিয়ে খুলশী থানা গঠিত হয়। পাহাড়তলী বধ্যভূমির অবস্থান বর্তমান খুলশী থানা থেকে কিছুটা পশ্চিমে বাংলাদেশ টেলিভিশনের চট্টগ্রাম কার্যালয় ও ইউএসটিসি-র বিপরীত দিকে। এলাকাটি ফয়েজ লেক নামেই পরিচিত। মূলত ফয়েজ লেক (বর্তমানে যেটা ‘কনকর্ড এমিউজমেন্ট পার্ক) পাহাড়তলী বধ্যভূমিরই একটি অংশ।
মার্চের শুরু থেকে পাহাড়তলীতে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়। বিহারিরা ৩রা মার্চ অসহযোগ আন্দোলন-এর শুরুতে বাঙালিদের ওপর হামলা চালায়। ঐদিন সকাল সাড়ে ৭টায়
ছাত্রলীগ-এর একটি মিছিল ওয়ারলেস কলোনির মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় মিছিলকারীরা বিভিন্ন অফিস ও দোকানের উর্দু সাইনবোর্ডগুলো নামিয়ে ফেলে। একই সময়ে আওয়ামী লীগ-এর পাহাড়তলী থানা শাখার সভাপতি খলিল সওদাগর ও মঞ্জুর নেতৃত্বে একটি মিছিল ওয়ারলেস কলোনির দিকে অগ্রসর হতে থাকে। মিছিল দুটি সেগুনবাগান কলোনির মাথায় একত্রিত হয়ে আবার ওয়ারলেস কলোনিতে ফিরে যায়। তারা বর্তমান পাহাড়তলী কলেজের সামনের একটি লাকড়ি ও একটি চায়ের দোকান থেকে উর্দু সাইনবোর্ড নামাতে গেলে বিহারিরা তলোয়ার, রামদা, কুড়াল ও বল্লম নিয়ে নিরস্ত্র মিছিলকারীদের ওপর হামলা করে। খলিল সওদাগরসহ অনেক বাঙালিকে বিহারিরা আটকে রেখে মারধর করে। তারা সিটি কলেজের একজন ছাত্রকে হত্যা করে। আটককৃত বাঙালিদের উদ্ধারের জন্য পলিটেকনিক কলেজের ছাত্রসহ সরাইপাড়া ও পাহাড়তলী এলাকার লোকজন ঘটনাস্থলের দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করলে বিহারি ও বেলুচ বাহিনীর প্রতিরোধের মুখে পড়ে। এ-সময় পাকিস্তানি বেলুচ সৈন্যরা সরাসরি মিছিলের ওপর গুলি বর্ষণ করে। এতে ঘটনাস্থলেই ২ জনের মৃত্যু হয়। বিহারিদের সঙ্গে সাদা পোশাকে সামরিক বাহিনীর অনেক সদস্য ছিল। তাদের হাতে ছিল অত্যাধুনিক অস্ত্র। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগিতা পেয়ে বিহারিরা আরো মারমুখি হয়ে ওঠে। এমনকি তারা ওয়ারলেস কলোনিতে যেসব বাঙালি বসবাস করত, তাদের ওপরও হামলা শুরু করে। ঐদিন তারা সেগুনবাগান ও পাঞ্জাবী লেনে ৩ জন বাঙালি যুবককে হত্যা করে। ৩রা মার্চ বিকেল ৩টায় বিহারিরা সংঘবদ্ধ হয়ে সেগুনবাগান এলাকা থেকে ৩০০ জন বাঙালিকে ধরে বর্তমান বিনোদন ক্লাব সংলগ্ন মাঠে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। ৪ঠা এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ওয়ারলেস কলোনির উত্তরে পুরনো মসজিদের পাশে ক্যাম্প স্থাপন করে। ৭ই এপ্রিল ক্যাম্পের অদূরে বিবিসি-র সংবাদ শোনার জন্য অনেক লোক জড়ো হয়। এর মধ্যে খ্রিস্টান ধর্মালম্বী এস কে সিং নামে ব্যারেজ সপের একজন কর্মচারীও ছিলেন। বিহারি গামা তাকে ডেকে রাস্তার পাশে নিয়ে গিয়ে কিছু বুঝে ওঠার আগেই তলপেটে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে। রাত ৮টার দিকে বিহারিরা মুহাম্মদ মহিউদ্দিনের পরিবারের ওপর আক্রমণ করে। ২০-২৫ জন বিহারি ঘরের দরজা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে খান সাহেবকে টেনে-হিঁচড়ে ঘর থেকে বের করে রাস্তার ওপর নিয়ে জবাই করে হত্যা করে। এভাবে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে রাত ১১টার দিকে কয়েকটি ঠেলা গাড়িতে করে ২৫ জনের মতো বাঙালির লাশ আমবাগান রেললাইনের পাশে ফেলে দেয়।
রেলওয়ের এসিস্ট্যান্ট কন্ট্রোলার অব স্টোরস এল আর খান, সিনিয়র একাউন্টস অফিসার মোহাম্মদ আবদুল হামিদ এবং সিনিয়র ইলেকট্রিক্যল ইঞ্জিনিয়ার মোজাম্মেল হক চৌধুরী সপরিবারে পাহাড়তলীতে অবস্থান করছিলেন। তাদের বাংলোগুলো নীরব এলাকায় হওয়ায় কলোনি থেকে বাঙালিরা যে দলে-দলে শহর ছাড়ছে তা তাদের জানা ছিল না। রেলের বড় কর্মকর্তা হওয়ার সুবাদে এ তিন পরিবারের কাছে ডাবল ব্যারেল বন্দুকসহ মোট ১১টি বৈধ অস্ত্র ছিল। নিরাপত্তার কথা ভেবে তারা মোজাম্মেল হক চৌধুরীর বাংলোয় থাকার সিদ্ধান্ত নেন। তিন পরিবারের মোট সদস্য সংখ্যা ছিল ২২ জন (৫ জন পুরুষ সদস্য, ৬ জন বাংলোর কর্মচারী ও ১১ জন মহিলা)। এদিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ওয়ারলেস অফিসে ক্যাম্প স্থাপনের পর বৈধ্য অস্ত্রের মালিকদের অস্ত্র জমা দেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়। ৫ই এপ্রিল খুব সকালে বিহারিরা মোজম্মেল হক চৌধুরীর বাসায় গিয়ে অস্ত্রগুলো তাদের কাছে হস্তান্তর করার জন্য চাপ দিতে থাকে। কিন্তু চৌধুরী সাহেব রাজি হননি। একজন কর্মচারী দরজা খুলতেই বিহারিরা তড়িৎগতিতে ঘরে ঢুকে মহিলাদের সকলকে বেডরুমে ঢুকিয়ে তালা বন্ধ করে দেয়। তারা মো. আবদুল হামিদ ও চট্টগ্রাম কলেজে অধ্যয়নরত তাঁর পুত্র সাদেকুর রহমান বাবু, এল আর খান ও কমার্স কলেজে অধ্যয়নরত তাঁর পুত্র জাহিদুর রহমান খান (শামীম) এবং মুজিবর, শফি, জাবেদ আলী, ১০-১১ বছরের শিশু হাবিব, বাসার ৬ জন কর্মচারী ও অন্য ২ জন সহ মোট ১৬ জনকে দ্রুত বিভিন্ন রুমে নিয়ে জবাই করে হত্যা করে। এল আর খান পাশের বাসায় পালানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু তাঁকে সিড়ির নিচে নিয়ে জবাই করা হয়। সাদেকুর রহমান বাবু ঘাতকদের হাত থেকে ছুটে গিয়ে দেয়াল টপকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার আশফাকের বাসায় তার পুত্রের কাছে আশ্রয় চান। ঘাতকরা তাকে খুঁজতে এলে আশফাকের পুত্র তাকে ধরিয়ে দেয়। বিহারি জল্লাদরা আশফাকের বাসার সামনেই সাদেকুর রহমান বাবুকে জবাই করে হত্যা করে। হত্যাকাণ্ড শেষে বিহারিরা ঐ বাসা থেকে ৫০ ভরির মতো সোনাসহ মূল্যবান জিনিসপত্র লুটে নেয়। এই গণহত্যার নীলনকশা তৈরি করে সিগন্যাল ইঞ্জিনিয়ার বিহারি ইউসুফ।
১০ই নভেম্বর (২০শে রমজান বুধবার) ভোরে কয়েকজন মুসল্লি পাঞ্জাবী লেন মসজিদ থেকে বাসায় ফিরছিলেন। পথে একজন বিহারি তাদের জানায় যে, মসজিদের পূর্ব দিকে পাহাড়ের কিনারে সমতল জায়গায় ৪ জন বিহারিকে বাঙালিরা মেরে ফেলে রেখেছে। লাশ ৪টি দেখার জন্য সে মুসল্লিদের আহ্বান জানায়। তার কথার সত্যতা যাচাই করার জন্য মুসল্লিরা এগিয়ে যান। মুসল্লিদের মধ্যে ছিলেন এ কে এম আফসার উদ্দিন, আকবর হোসেন, আবদুল গফুর ইয়াজদানি, মো. মোতাহেরুর রহমান ও মসজিদের মুয়াজ্জিন। দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী রাস্তা পাড় হয়ে যখন তারা খোলা জায়গায় যান, তখন তারা দেখেন সেখানে বহু বিহারি অস্ত্রশস্ত্রসহ লাশগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে আছে এবং আরো বহু লোক পূর্বদিক থেকে অগ্রসর হচ্ছে। তাদের অধিকাংশই রেলওয়ের কর্মচারী। তারা ‘বাঙালিদের খতম করো’ বলে চিৎকার করছে। মুসল্লিরা দ্রুত স্থান ত্যাগ করে পাহাড়তলী পুলিশ ফাঁড়িতে এসে পুলিশের সাহায্য চান। কিন্তু পুলিশের কোনো সাহায্য না পেয়ে তারা বাসার দিকে অগ্রসর হন। আকবর হোসেন বাসার সামনে আসতেই বিহারিরা তাকে ধরে নিয়ে যায়। একইভাবে সেদিন বিহারিরা পাঞ্জাবী লেন ও মাস্টার লেনে বসবাসরত বাঙালি পরিবারসমূহ থেকে ১২ বছরের বেশি বয়সের সকল পুরুষকে ধরে নিয়ে যায় জল্লাদখানায়। তাদের মধ্যে ছিলেন আবদুল গোফরান, আবদুল মান্নান, গাজী কামাল উদ্দিন, কাসেম, গোলাম ইয়াজদানী, গোলাম হোসেন চৌধুরী, আবদুল খালেক, আহমদ আলী মোড়ল, মোসলেম আলী তালুকদার, আলী আজম মুন্সি, সুলতান, আবুল হাশেম, মাহতাব রহমান, সৈয়দুর রহমান, কাজী মাহবুব ইয়াজদানী, আনসার আলী, হায়দর আলী, জুনাব আলী, ফজল মিয়া, মো. জয়নাল আবেদীন, সিরাজ আলী নওয়াব, সরাফত আলী, মো. ফসিউল আলম, কাজী নজরুল ইসলাম, নুরুল হক, আবদুল মান্নান, আবদুল হামিদ, মমতাজ মিয়া, মো. আকবর হোসেন, ওজিউল্লাহ, কফিল উদ্দিন, আবদুল মজিদ, মো. সফিকুল ইসলাম, মো. নজির আহমদ, কবির আহমদ, নূরুল হক, মোয়াজ্জেম, সৈয়দ আমীর আলী, আলী হোসেন, আবদুল গোফরান, আবদুল আজিজ, শামসুল হক, আবদুল করিম, আবদুল ওয়াহাব, আবদুল মতিন, মহরম আলী, মুজিবুল হক, মো. ইসহাক, গোফরান মিয়া, সোহরাব আলী, আবদুল গফুর, আবদুল শফিক মিয়া, আমিনুল ইসলাম, নোয়াব আলী, বাদশা মিয়া ও তার শিশুপুত্র মোজাম্মেল হক প্রমুখ।
রেলওয়ের কর্মকর্তা আলী করিম অফিসে বসে জানতে পারেন যে, তাঁর ভাই ও পুত্রকে বিহারিরা ধরে নিয়ে গেছে। তাদের উদ্ধার করার জন্য তিনি প্রথমে ডবলমুরিং থানায়, পরে চট্টগ্রাম জেলা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান নবী চৌধুরীর কাছে যান। কিন্তু তাতে কোনো কাজ না হওয়ায় আলী করিম, মো. আলী ও নাদেরুজ্জামান সাহস করে কলোনিতে নিজেদের বাসায় ফিরতে থাকেন। বাসায় পৌঁছার আগেই বিহারিরা আলী করিম ও মো. আলীকে ধরে নিয়ে যায়। ঐ সময় তাদের সঙ্গে বিভিন্ন স্থান থেকে আরো ৮-১০ জনকে ধরে জল্লাদখানায় জড়ো করা হয়। জল্লাদখানায় প্রথমে তাদের দিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে গর্ত খোঁড়া হয়। পরে তাদেরসহ বহু বাঙালিকে জবাই করে ঐ গর্তে ফেলে দেয়া হয়। এভাবে সেদিন বিভিন্ন কলোনি থেকে ধরে এনে ৩০০ জনের মতো বাঙালিকে হত্যা করে বিহারিরা। একই দিন তারা পাঞ্জাবী লেন, মাস্টার লেন ও ঝাউতলা স্টেশনে ট্রেন থেকে নামিয়ে ৪ শতাধিক ট্রেনযাত্রীকে হত্যা করে।
প্রতিদিনের মতো ১০ই নভেম্বর নির্দিষ্ট সময়ে নাজিরহাট, দোহাজারী ও ফেনী থেকে ট্রেন ছাড়ে। ট্রেনগুলো থামবে বটতলী স্টেশনে। কিন্তু সশস্ত্র বিহারিরা পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে পাঞ্জাবী লেন, মাস্টার লেন ও ঝাউতলা স্টেশনে ট্রেনগুলো থামিয়ে দেয়। যাত্রীদের নামিয়ে লাইন করে নিয়ে যায় পাহাড়তলী বধ্যভূমিতে। যাত্রীদের একসঙ্গে ৮-১০ জন করে রশিতে বেঁধে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যায় বধ্যভূমির মাঝখানে। সেখানে অর্ধ শতাধিকের মতো বিহারি জল্লাদ মহা উৎসবে তাদের হত্যা করে। এদিন পাহাড়তলী বধ্যভূমিতে যারা গণহত্যার শিকার হন, তাদের মধ্যে যাদের নাম পাওয়া গেছে, তারা হলেন- গোলাম ইয়াজদানী (সহকারী কন্ট্রোলার অব স্টোরস, বাংলাদেশ রেলওয়ে, পাহাড়তলী), কাজী নজরুল ইসলাম (ছাত্র; পিতা গোলাম ইয়াজদানী, পাহাড়তলী), কাজী মাহবুব ইয়াজদানী (প্রবেশিকা পরিক্ষার্থী; পিতা গোলাম ইয়াজদানী, পাহাড়তলী), গোলাম হোসেন চৌধুরী (সাব হেডক্লার্ক, চট্টগ্রাম রেলওয়ে, পাহাড়তলী), আবদুল খালেক (কর্মচারী, চট্টগ্রাম রেলওয়ে, পাহাড়তলী), আহমদ আলী মোড়ল (কর্মচারী, শিপিং; গোবিন্দপুর, ঢাকা), আলী করিম (সিএমই অফিস, চট্টগ্রাম রেলওয়ে, পাহাড়তলী), মোসলেম আলী তালুকদার (একাউন্টস অফিস, চট্টগ্রাম রেলওয়ে), আলী আজম মুন্সি (হেড ক্লার্ক, ডিজেল সপ, চট্টগ্রাম রেলওয়ে), আনছার আলী (কর্মচারী, চট্টগ্রাম রেলওয়ে), হায়দর আলী (শ্রমিক), আলী (শ্রমিক), ফজল মিয়া (শ্রমিক), মো, জয়নাল আবেদীন (শ্রমিক), মো. সিরাজ (শ্রমিক), আলী নওয়াব (শ্রমিক), সরফত আলী (শ্রমিক), মো. ফসিউল আলম (প্রবেশিকা পরীক্ষার্থী, পাহাড়তলী), নূরুল হক (শ্রমিক), আবদুল মান্নান (শ্রমিক), মমতাজ মিয়া (শ্রমিক), মো. আকবর হোসেন (কর্মচারী, চট্টগ্রাম রেলওয়ে, পাহাড়তলী), ওজিউল্লাহ (শ্রমিক, চট্টগ্রাম রেলওয়ে), কফিল উদ্দিন (শ্রমিক, চট্টগ্রাম রেলওয়ে), আবদুল মজিদ (ব্যবসায়ী, পাহাড়তলী), মো. সফিকুল ইসলাম (আইকম পরীক্ষার্থী, চট্টগ্রাম কমার্স কলেজ, পাহাড়তলী), মোহাম্মদ নজীর আহমদ, কবির আহমদ, মো. নূরুল হক (স্থানীয় মসজিদের মুয়াজ্জিন, পাহাড়তলী), সৈয়দুর রহমান (কন্ট্রাক্টর, চট্টগ্রাম রেলওয়ে), মোতহারুর রহমান (কন্ট্রাক্টর, চট্টগ্রাম রেলওয়ে), সৈয়দ আমীর আলী (বীমা কর্মচারী, পাহাড়তলী), আলী হোসেন (শ্রমিক, চট্টগ্রাম রেলওয়ে), মো. আবদুল গোফরান (শ্রমিক, চট্টগ্রাম রেলওয়ে), আবদুল মান্নান, (শ্রমিক, চট্টগ্রাম রেলওয়ে), সৈয়দুর রহমান (শ্রমিক, চট্টগ্রাম রেলওয়ে), আবদুল আজিজ (শ্রমিক, চট্টগ্রাম রেলওয়ে), শামসুল হক (শ্রমিক, চট্টগ্রাম রেলওয়ে), আবদুল করিম (শ্রমিক, চট্টগ্রাম রেলওয়ে), আবদুল ওহাব (শ্রমিক, চট্টগ্রাম রেলওয়ে), আবদুল মালেক (কর্মচারী, কন্ট্রোলার অব স্টোরস, চট্টগ্রাম রেলওয়ে), মহরম আলী (শ্রমিক, চট্টগ্রাম রেলওয়ে), মুজিবুল হক (শিশু, পাহাড়তলী), মো. ইসহাক (শ্রমিক, চট্টগ্রাম রেলওয়ে), আলী হোসেন (শ্রমিক, চট্টগ্রাম রেলওয়ে), গোফরান মিয়া (শ্রমিক, চট্টগ্রাম রেলওয়ে), আবদুল মান্নান (শ্রমিক, চট্টগ্রাম রেলওয়ে), সোহরাব আলী (শ্রমিক, চট্টগ্রাম রেলওয়ে), আবদুল গফুর (শ্রমিক, চট্টগ্রাম রেলওয়ে), আবদুল সফিক মিয়া (শ্রমিক, চট্টগ্রাম রেলওয়ে), আমিনুল ইসলাম (কন্ট্রাক্টর, চট্টগ্রাম রেলওয়ে), আবুল কাসেম (ব্যবসায়ী, পাহাড়তলী), নোয়াব আলী (পিয়ন, এক্স এ এন অফিস), বাদশা মিয়া ও তার নাবালক পুত্র (পাহাড়তলী), সুলতান আলম (কর্মচারী, ইঞ্জিনিয়ার্স লি. পাহাড়তলী), মোজাম্মেল হক (ওয়ার্কশপ শ্রমিক, চট্টগ্রাম রেলওয়ে), মো. ছায়েদুল হক (বিডি শ্রমিক, চট্টগ্রাম রেলওয়ে), সামশুল হক (ভীমপুর, রামগঞ্জ, নোয়াখালী), ছালে আহমদ (ড্রাইভার, সরাইপাড়া, মধ্য পাহাড়তলী), নূরুজ্জামান ও তার পুত্র (মধ্য মাদার্শা), মো. ফখরুল ইসলাম (ড্রাইভার, চট্টগ্রাম রেলওয়ে, পাহাড়তলী), রমণী কুমার দাস (জমাদার, চট্টগ্রাম রেলওয়ে; হাসপাতাল কলোনি, পাহাড়তলী), এল আর খান (এসিস্ট্যান্ট কন্ট্রোলার অব স্টোরস, চট্টগ্রাম রেলওয়ে; সেগুনবাগান, পাহাড়তলী), জাহিদুর রহমান খান শামিম (ছাত্র, পাহাড়তলী), এম এ চৌধুরী (ডিইই কটেজ, চট্টগ্রাম রেলওয়ে; সেগুনবাগান, পাহাড়তলী), মো. শফি (চাকরিজীবী, চট্টগ্রাম রেলওয়ে; সেগুনবাগান, পাহাড়তলী), মো. ইউসুফ (চাকরিজীবী, চট্টগ্রাম রেলওয়ে; টাইগারপাস), আবুল কালাম (ছাত্র, টাইগারপাস), আবদুল আলিম মিন্টু (ছাত্র, ২২নং বিল্ডিং, পাহাড়তলী), আবদুস সামাদ মিয়া (চাকরিজীবী, চট্টগ্রাম রেলওয়ে; ঝাউতলা কলোনি, পাহাড়তলী), সৈয়দ মাহবুব আলী (কর্মকর্তা, চট্টগ্রাম রেলওয়ে, স্টেশন কলোনি, পাহাড়তলী), আবদুস সামাদ মিয়া (টেলিং ইন্সপেক্টর, চট্টগ্রাম রেলওয়ে, পাহাড়তলী), হাসিনুর রহমান (ফোরম্যান, চট্টগ্রাম রেলওয়ে; টিপিপি কলোনি, পাহাড়তলী), নূরুল আমীন (ফোরম্যান, চট্টগ্রাম রেলওয়ে), মো. আবদুল গফুর (কর্মকর্তা, চট্টগ্রাম রেলওয়ে), এ বড়ুয়া (কর্মকর্তা, চট্টগ্রাম রেলওয়ে; মামু ভাগিনার মাজার, পাহাড়তলী, মাস্টার লেইন), আহমদ শাহ হারু (ব্যবসায়ী, মাস্টার লেইন), ফখরুল আলম (চাকরিজীবী, চট্টগ্রাম রেলওয়ে; ডিজেল শপ, পাহাড়তলী), মো. কদম আলী (চাকরিজীবী, পাহাড়তলী রেলওয়ে ওয়ার্কশপ), মো. কাসেম (একাউন্ট্যান্ট, চট্টগ্রাম রেলওয়ে; ৫০/বি উত্তর আমবাগান, পাহাড়তলী), আমানত আলী খান (একাউন্ট্যান্ট, চট্টগ্রাম রেলওয়ে; টাইগারপাস কলোনি, পাহাড়তলী), দেলোয়ার হোসেন খান (করণিক, চট্টগ্রাম রেলওয়ে; টাইগারপাস কলোনি, পাহাড়তলী), গোফরান আলী (করণিক, বাংলাদেশ রেলওয়ে; টাইগারপাস কলোনি, পাহাড়তলী), মো. আবদুল হাই (একাউন্ট্যান্ট, চট্টগ্রাম রেলওয়ে, টাইগারপাস কলোনি; পাহাড়তলী), শেখ মো. আবদুল আজিজ (কর্মকর্তা, চট্টগ্রাম রেলওয়ে), শেখ মো. আলী রেজা (ছাত্র, টাইগারপাস কলোনি, পাহাড়তলী), মো. মাজেদ আলী (ছাত্র), সৈয়দা লায়লা বেগম (ছাত্রী), আবু (চাকরিজীবী; আমবাগান, পাহাড়তলী), মো. হাফেজ উল্লাহ (পিয়ন; আমবাগান, পাহাড়তলী), মো. সুজাউদ্দিন (সিকেপি; আমবাগান, পাহাড়তলী), মো. ইসহাক (সিকেপি, পাহাড়তলী), ছাবেদ আলী (রেলওয়ে কর্মচারী; আমবাগান, পাহাড়তলী), হামিদুর রহমান (কর্মচারী, চট্টগ্রাম রেলওয়ে), মো. বাহার, হামিদুর রহমান (কর্মচারী, চট্টগ্রাম রেলওয়ে), মওদুদুর রহমান (ছাত্র), মো. মিয়া চৌধুরী (ডিএসএস, পাহাড়তলী রেলওয়ে ওযার্কশপ), বজল আহমদ (জোলার হাট, পাহাড়তলী), মোস্তাফিজুর রহমান লেদু (ফোরম্যান, চট্টগ্রাম রেলওয়ে; জোলারহাট, পাহাড়তলী), আবদুল মিয়া, (কর্মচারী, চট্টগ্রাম রেলওয়ে), মো. এস এম কামাল উদ্দিন (সিডিএ মার্কেট, পাহাড়তলী), ছালে আহমদ (সরাইপাড়া, পাহাড়তলী), ইদ্রিচ মিয়া (লোহারপোল, পাহাড়তলী), হাবিবুর রহমান (লোহারপোল, পাহাড়তলী), বাদশা মিয়া (লোহারপোল, পাহাড়তলী), আবুল হোসেন (লোহারপোল, পাহাড়তলী), মো. ইসহাক (ছাত্র; টাইগারপাস কলেীন, পাহাড়তলী), মো. আলী (পলিটেকনিক ছাত্র, পাহাড়তলী), রওশন আলী খান (কর্মচারী, চট্টগ্রাম রেলওয়ে), এম এ খান (কর্মচারী, চট্টগ্রাম রেলওয়ে), মো. ইউনুচ (কর্মচারী, চট্টগ্রাম রেলওয়ে), আলী আজম (প্রাক্তন সৈনিক, পাহাড়তলী), আবদুল গফুর (ইঞ্জিনিয়ার, চট্টগ্রাম রেলওয়ে), নিরঞ্জন বিকাশ বড়ুয়া (গার্ড, চট্টগ্রাম রেলওয়ে, পাহাড়তলী), বুলু (ছাত্র, রেলওয়ে স্কুল, পাহাড়তলী), আরফিন (পাহাড়তলী) প্রমুখ। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে এ এলাকাটি জল্লাদখানা নামেই বহুল পরিচিত। বিহারি জল্লাদরা শহরের নানা স্থান থেকে বাঙালিদের ধরে এনে এখানে জবাই করে হত্যা করত। এটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বৃহত্তম বধ্যভূমি নামে পরিচিত। এ বধ্যভূমিকে কেন্দ্র করে বিহারিরা নিকটস্থ পশু খামারে একটি নির্যাতনকেন্দ্র গড়ে তোলে। বিহারিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত উক্ত নির্যাতনকেন্দ্রের প্রায় সবাই ছিল রেলওয়ের অবাঙালি কর্মচারী। পাহাড়তলী রেলওয়ে ওয়ার্কশপের পাঞ্জাবী ক্যাপ্টেন আহমদ সামশুদ্দীনের তত্ত্বাবধানে এটি গড়ে ওঠে। বধ্যভূমির প্রথম ঘাতক হিসেবে নিয়োগ পায় অবাঙালি মকবুল খান। পেশায় সে ছিল পাহাড়তলী রেলওয়ে ওয়ার্কশপের মেকানিক। জামায়াতে ইসলামী-র মধ্যম সারির নেতা মকবুল রেল শ্রমিক সংঘের সঙ্গে জড়িত ছিল। মার্চের প্রথম দিকে সে সৈয়দপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে বদলি হয়ে আসে। তার নেতৃত্বেই পরিচালিত হতো এ বধ্যভূমির হত্যাকাণ্ড। তার সহযোগী ছিল বিহারি আলী আকতার গামা, জসিম খান, নাটো, খুরশিদ, আপুয়া, ঈসা, ইউনুস, কাইয়ুম প্রমুখ।
পাহাড়তলী বধ্যভূমির হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন হতো রাতের বেলায়। বিহারি জল্লাদরা রাজনৈতিক কর্মী বা মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যর পূর্বে পুরো দেহ চিড়ে লবণ-মরিচ মেখে লোহার পাতের সাথে হাত-পা-মাথা শক্ত করে বেঁধে রাখত। এরপর পাথরের ওপর রেখে জবাই করে মাথা আলাদা করে দেহ গর্তের ভেতর ফেলে দিত। প্রায় প্রতিদিনই সে গর্তে এক ধরনের ক্যামিক্যাল ছিটিয়ে দিত। এ বধ্যভূমির কয়েক গজের মধ্যেই পাহাড়তলী ওয়ারলেস কলোনির মোড়ে টিএন্ডটি অফিসে ২০ বেলুচ রেজিমেন্টের ক্যাম্প ছিল। বধ্যভূমির পেছনের পাহাড়ের ওপর ছিল টিএন্ডটি-র রেস্টহাউজ। সেখানে নজির আহমদ চৌধুরীর একটি সাদা বাংলো ছিল, যেখানে মেয়েদের ধরে এনে ধর্ষণ করার পর হত্যা করে জল্লাদখানায় ফেলে দেয়া হতো। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে এখানে কত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। ১৬ই ডিসেম্বর দেশ হানাদারমুক্ত হলে লোকজন ফিরে এসে এখানে অসংখ্য মৃতদেহ দেখতে পায়, যার মধ্যে বিপুল সংখ্যক নারী ও শিশুর গলিত দেহও ছিল। বধ্যভূমির একটি গর্ত থেকেই প্রায় ১১০০০ মাথার খুলি উদ্ধার করা হয়। পাহাড়ের চূড়ায় মহিলাদের শাড়ি, ব্লাউজ ও পেটিকোট পড়ে থাকতে দেখা যায়।
স্থানীয় বাসিন্দাদের পাশাপাশি পাহাড়তলী বধ্যভূমিতে পটিয়া, হাটহাজারী, ফটিকছড়ি, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া এবং চট্টগ্রামের বাইরের অনেকেই গণহত্যার শিকার হন। এছাড়া অসংখ্য ট্রেনযাত্রীকে এখানে হত্যা করা হয়, যাদের পরিচয় খুঁজে পাওয়া যায়নি। ফলে তাদের সুনির্দিষ্ট তালিকা তৈরি করা সম্ভব হয়নি। মার্চের শেষ থেকে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এখানে বিপুল সংখ্যক মানুষকে হত্যা করা হয়। এ বধ্যভূমিকে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। [জামাল উদ্দিন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!