You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে পাবনা সদর উপজেলা

পাবনা সদর উপজেলা ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন ছিল বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক মাইলফলক। আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হওয়া সত্ত্বেও নির্বাচনী ফলাফলকে বানচাল করার জন্য পাকিস্তানি শাসকচক্র নানা ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ৩রা মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ১লা মার্চ স্থগিত ঘোষণা করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলন-এর ডাক দেন। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব। পাকিস্তানি ষড়যন্ত্র মোকাবেলা এবং সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণে ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- সমগ্র জাতির প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা অনুযায়ী বাংলাদেশের সর্বত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় এবং পাকবাহিনীর যে-কোনো হামলা প্রতিরোধ করার জন্য জনগণ প্রস্তুত হতে থাকে। সারা দেশব্যাপী এ প্রতিরোধ সংগ্রামের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে উত্তর বাংলার অন্যতম জনপদ পাবনা সদরের সর্বস্তরের সাহসী – গণমানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়।
৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর পাবনা সদর উপজেলার জনগণ শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। ট্রেজারি বিভাগ এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্র ছাড়া সরকারি ও আধাসরকারি অফিস এবং দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত বন্ধ থাকে। ছাত্র ও শিক্ষকগণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বর্জন করেন। গুরুত্বপূর্ণ ভবনসমূহে কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। পৌর ট্যাক্স, পানির বিল ও ইলেকট্রিক বিল সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়। বাঙালিদের দাবি-দাওয়া পুরোপুরি আদায় না হওয়া পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত রাখার শপথ নেয়া হয়। আন্দোলনকারীরা আরো ঘোষণা করে যে, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত সকল প্রকার রাজস্ব প্রদান বন্ধ থাকবে। আওয়ামী লীগ ও স্বাধীনতার পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে পাবনা জেলা সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। আওয়ামী লীগ নেতা আমজাদ হোসেন এমএনএ-এর নেতৃত্বে আব্দুর রব বগা মিয়া এমপিএ, শহীদ এডভোকেট আমিনুদ্দিন এমপিএ, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ এমএনএ, তফিজ উদ্দিন আহমেদ এমপিএ, মোজাম্মেল হক সমাজী এমপিএ ছাড়াও পাবনার সকল এমএনএ ও এমপিএ এবং কমরেড প্রসাদ রায় (কমিউনিস্ট পার্টি), আমিনুল ইসলাম বাদশা (ন্যাপ- মোজাফ্ফর), এডভোকেট আমজাদ হোসেন, ওয়াজি উদ্দিন, গোলাম আলী কাদেরী, রণেশ মৈত্রসহ মোট ৩১ সদস্যবিশিষ্ট সংগ্রাম কমিটি পাবনা সদর থানাসহ জেলার সর্বত্র আন্দোলনকে বেগবান করে তোলে। পাবনার তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. নুরুল কাদের খান এবং পুলিশ সুপার চৌধুরী আবদুল গাফ্ফার-এঁর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত বলিষ্ঠ। তাঁরা সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। সংগ্রাম কমিটির কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পাবনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে একটি কার্যালয় স্থাপন করা হয়। নেতৃবৃন্দ পর্যায়ক্রমে সেখানে সার্বিক বিষয়ে যোগাযোগ রক্ষা করতেন এবং জেলার সর্বস্তরের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। বৃহত্তর পাবনার কৃতী সন্তান জননেতা শহীদ এম. মনসুর আলী কেন্দ্রীয় রাজনীতির গুরুদায়িত্ব পালনের পাশাপাশি পাবনার মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বেগম আমিনা মনসুরকে সভানেত্রী ও বেগম সাবিয়া খানমকে সাধারণ সম্পাদিকা করে পাবনা জেলা মহিলা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এছাড়াও তৎকালীন ইসলামিয়া কলেজের (বর্তমান শহীদ বুলবুল কলেজ) নির্বাচিত ভিপি আবদুল কাদেরকে আহ্বায়ক করে জেলা ছাত্রলীগ- স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। সশস্ত্র আন্দোলনের জন্য রফিকুল ইসলাম বকুলকে প্রধান করে গঠিত হয় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী।
মার্চের অসহযোগের দিনগুলোতে সভা-সমাবেশ ও মিছিলের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে স্বাধীনতার সংগ্রামকে আরো বেগবান করে তোলা হয়। সংগ্রামী সাংস্কৃতিক কর্মীগণ প্রায় প্রতিদিনই ট্রাকে করে গণসঙ্গীত পরিবেশন করে সারা শহর প্রদক্ষিণ করতেন। ছাত্র ইউনিয়ন – (মতিয়া গ্রুপ)-এর নেতৃত্বে পরিচালিত এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন— রইচ উদ্দিন, মতিয়ার রহমান, রবিউল ইসলাম রবি, সুলতান আহমেদ বুড়ো, মোজাম্মেল হক কিরমান, আব্দুল মতীন খান প্রমুখ। অনুষ্ঠানের রিহার্সেল হতো মুক্তার পাড়ার আনিসুজ্জামান নান্নু ও বড় বাজারের চাউল পট্টির বলাই বসাকের বাড়িতে। অনুষ্ঠানগুলোতে শিল্পী হিসেবে উপস্থিত থাকতেন বলাই বসাক, আব্দুল্লাহ্ মনাক্কা, আনিসুজ্জামান নান্নু, সোহেল আহমেদ মধু, মোহাম্মদ আলী, রেনু অধিকারী, রূপবাণী ঘোষ, রোখসানা খানম, মালেকা পারভীন জয়া, রণজিৎ বসাক, সুরজিৎ বসাক, জয়া বসাক, মাতোয়ারা সাকী, শিবানী নাগ, মাধুরী হক, স্বপন প্রমুখ। এছাড়াও ছাত্রলীগের শহীদ গোলাম সরোয়ার খান সাধনের নেতৃত্বে পরিচালিত একটি সাংস্কৃতিক দলও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জনগণকে অসহযোগ আন্দোলনে শক্তি যোগাতে ও বিপ্লবী মানসগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ছাত্র ইউনিয়নের সভানেত্রী শিরিন বানু মিতিল (মতিয়া গ্রুপ), রবিউল ইসলাম রবি, জাহিদ হাসান জিন্দান, সুলতান আহমেদ বুড়ো প্রমুখ জেলার বিভিন্ন স্থানে ঘুরে-ঘুরে সংগঠনের মিটিং করে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তা ও মেয়েদের অংশগ্রহণ, প্রস্তুতি ও করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করতেন। এসময় রফিকুল ইসলাম বকুলের উদ্যোগে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্য ও ছাত্র-যুবকদের নিয়ে পাবনা জেলা স্কুল, গোপালপুর ক্লাব ও বিভিন্ন পাড়ায়-মহল্লায় সশস্ত্র ট্রেনিং দেয়া শুরু হয়।
পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ১৯৭১ সালের ২৩শে মার্চ পাকিস্তান প্রজাতন্ত্র দিবসে সারা দেশে পাকিস্তানি পতাকা উত্তোলনের নির্দেশ দেয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঐদিন পাকিস্তানি পতাকার পরিবর্তে পাবনায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের সিদ্ধান্ত নেয়। পাবনায় এ উপলক্ষে ২৩শে মার্চ ব্যাপক মহড়া, গণমিছিল ও টাউন হলে বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। নেতৃবৃন্দের বক্তব্য শেষে বেলা ১১টায় রফিকুল ইসলাম বকুল টাউন হলের ছাদে উঠে পাকিস্তানি পতাকা টুকরো-টুকরো করে ছিঁড়ে পুড়িয়ে দেন এবং মাঠে উপস্থিত হাজার-হাজার জনতার বিপুল করতালি আর ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের মধ্য দিয়ে তিনি পাবনায় প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এসময় টাউন হলের ছাদে আরো উপস্থিত ছিলেন ইকবাল হোসেন, জহুরুল ইসলাম বিশু, গোলাম মাহমুদ, আবদুস ছাত্তার লালু, শাহাব উদ্দিন চুপ্পু, ফজলুল হক মন্টু প্রমুখ। এরপর বিকেল ৪টায় পাবনা পুলিশ লাইনের মাঠে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর এক মহড়া অনুষ্ঠিত হয়। এদিন বিকেলে ডিসি অফিসের ছাদ থেকে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম। এভাবেই চলতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের সাংগঠনিক তৎপরতা, প্রস্তুতি ও প্রথমিক প্রশিক্ষণ।
পাবনা সদর উপজেলার মুক্তিযুদ্ধের শীর্ষস্থানীয় সংগঠক ছিলেন বৃহত্তর পাবনার কৃতী সন্তান জননেতা এম মনসুর আলী, আমজাদ হোসেন এমএনএ, আব্দুর রব বগা মিয়া এমপিএ, এডভোকেট আমিনুদ্দিন এমপিএ, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ এমএনএ, তফিজউদ্দিন আহমেদ এমপিএ, মোজাম্মেল হক সমাজী এমপিএ, কমরেড প্রসাদ রায়, আমিনুল ইসলাম বাদশা, এডভোকেট আমজাদ হোসেন, ওয়াজিউদ্দিন খান, গোলাম আলী কাদেরী এবং রণেশ মৈত্র। মুক্তিযুদ্ধের শীর্ষস্থানীয় কমান্ডার ছিলেন রফিকুল আসলাম বকুল, আব্দুল কাদের প্রমুখ। মুজিব বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক রিদ্দিক (পিতা আব্দুল আজিজ প্রামাণিক, গোপালপুর, পাবনা), ডেপুটি কমান্ডার আবুল কালাম আজাদ বাবু (পিতা আলহাজ আব্দুস সামাদ, পৈলানপুর, পাবনা)।
বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি শহরের ন্যায় মুক্তিকামী বাঙালিকে দমন করার লক্ষ্যে ২৫শে মার্চ (১৯৭১) দিবাগত রাতে রাজশাহী থেকে ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের এক কোম্পানি পদাতিক বাহিনী পাবনায় এসে শহরের মাইল চারেক দূরে হেমায়েতপুর এলাকায় অবস্থিত বর্তমানের বিসিক শিল্পনগরীতে (তৎকালীন ‘ইসপিক’) প্রধান ঘাঁটি স্থাপন করে। এই সৈন্যদের কিছু অংশ শহরের ট্রেজারি ও টেলিফোন এক্সচেঞ্জ-এর (বর্তমান টেলিগ্রাম অফিস) মতো দুটি গুরুত্বপূর্ণ অফিস দখল করে। এছাড়াও তারা মোসলেম প্রামাণিকের তে-মাথা, পাবনা আলীয়া মাদ্রাসা, সার্কিট হাউস, ওয়াপদার বিদ্যুতের কন্ট্রোল রুম এবং নূরপুর ডাকবাংলোতে ঘাঁটি স্থাপন করে। রাজশাহী থেকে আগত এই কোম্পানির কমান্ডিং অফিসার ছিল ক্যাপ্টেন আসগার এবং ডেপুটি কমান্ডিং অফিসার ছিল লেফটেন্যান্ট রশিদ। এদের সঙ্গে ছিল তিনজন (জেসিও) সুবেদার ও নায়েক সুবেদার র্যাঙ্কের সেনাসদস্যসহ মোট ১৩০ জন সৈন্য। পাবনাতে আর্মি ক্যান্টনমেন্ট এবং ইপিআর ক্যাম্প না থাকাতে এখানে বাঙালি কোনো আর্মি বা ইপিআর সদস্য ছিল না। তাই হানাদার পাকবাহিনী পাবনায় এসে প্রথমেই আক্রমণ চালায় নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের ওপর। তারা সমগ্র শহরে কারফিউ জারি করে শহরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের চেষ্টা করে। এ পরিস্থিতিতে জেলা প্রশাসক নুরুল কাদের খান ও পুলিশ সুপার চৌধুরী আবদুল গাফ্ফার পাবনার আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে গঠিত জেলা সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে পরামর্শ করে পাকবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
২৬শে মার্চ রাত থেকেই বর্বর পাকসেনারা পাবনা শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেক নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষকে গ্রেফতার করতে থাকে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন পাবনা সদর মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি এডভোকেট আমিনুদ্দিন আহমেদ এমএনএ, ভাসানীপন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ডাক্তার অমলেন্দু দাক্ষী, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আবু সাঈদ তালুকদার এবং পৌরসভার কর্মচারী আবদুল খালেক তালুকদার, আলহাজ কফিল উদ্দিন আহম্মেদ, রাজেম নামে এক পাগল প্রমুখ৷ বিসিক এলাকায় আটক রেখে তাঁদের ওপর নির্মম অত্যাচার চালানো হয় এবং পরে অন্যদের সঙ্গে এডভোকেট আমিনুদ্দিন আহমেদ এমএনএ, ডাক্তার অমলেন্দু দাক্ষী, আবু সাঈদ তালুকদার ও রাজেমকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি কালে পাবনা সদরে বেশ কয়েকটি প্রতিরোধযুদ্ধ সংঘটিত হয়। তার মধ্যে পাবনা পুলিশ লাইন্স যুদ্ধ, পাবনা টেলিফোন একচেঞ্জ যুদ্ধ, লস্করপুর ময়লাগাড়ি যুদ্ধ , বালিয়াহালট যুদ্ধ, বিসিক শিল্পনগরী যুদ্ধ ও মাধবপুর যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। ২৭ ও ২৮শে মার্চ পাকবাহিনী পাবনা সদরের বিভিন্ন স্থান ও পুলিশ লাইন্স দখলে নেয়ার চেষ্টা করলে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী প্রধান রফিকুল ইসলাম বকুলের নেতৃত্বে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী পাবনা বিজার্ভ পুলিশ লাইন্সের আর আই আবুল খায়েরের নেতৃত্বে পুলিশ বাহিনীর সকল সদস্য ও আশপাশের এলাকা থেকে আগত ছাত্র, যুবক ও মুক্তিকামী জনতা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে দেশীয় বন্দুক, থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল, দা, ফালা, ট্যাটা ইত্যাদি অস্ত্রের মাধ্যমে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এ খণ্ডযুদ্ধে একজন পাকসেনা নিহত হয়। শহীদ হন একজন প্রতিরোধযোদ্ধা। পুলিশলাইন্সে প্রতিরোধযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকে। – পুলিশ লাইন্সের সকল অস্ত্র ও গোলাবারুদ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ও প্রতিরোধযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। অপরদিকে পাকবাহিনী প্রতিরোধযোদ্ধাদের আক্রমণে টিকতে না পেরে পালিয়ে এসে ২৮শে মার্চ পাবনা টেলিফোন একচেঞ্জ ভবনের ভেতরে আশ্রয় গ্রহণ করে। পুলিশ লাইন্স যুদ্ধে পাকবাহিনীর পরাজয়ের খবর দ্রুত পাবনা জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়লে গ্রামের হাজার-হাজার কৃষক, ছাত্র-যুবক ও জনতা লাঠিসোঁটা, বর্শা, বল্লম ও তীর-ধনুক নিয়ে টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবন ঘিরে ফেলে। পুলিশ বাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যগণসহ জনতা টেলিফোন একচেঞ্জ ভবন ঘেরাও কালে পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এ- যুদ্ধে পাকবাহিনীর ৩০ জন সৈন্য নিহত হয়। পাবনার জেলা প্রশাসক নুরুল কাদের খান জনতার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যুদ্ধে অংশ নেন। শিরিন বানু মিতিল- পুরুষের বেশে এ-যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
পাবনা সদর থেকে ৮-৯ কিলোমিটার পূর্বদিকে ছিল লস্করপুর ময়লাগাড়ির অবস্থান। ঢাকার দিক থেকে এটিই ছিল পাবনা শহরের প্রবেশ পথ। পাকবাহিনীর ৪-৮ জন সদস্য এখানে রাস্তার ধারের একটি ছোট্ট দ্বিতল ভবনে চেকপোস্ট বসিয়ে মাঝারি ও হালকা মেশিনগানে সজ্জিত হয়ে অবস্থান করছিল। ২৮শে মার্চ পুলিশ লাইন যুদ্ধের কথা ছড়িয়ে পড়তেই মোজাহিত ক্লাব, মহেন্দ্রপুর, ফকিরপুরঘাট, শালগাড়িয়াসহ আশপাশের জনসাধারণ তীর-ধনুক, ফলা-সড়কি ইত্যাদি নিয়ে তাদের ঘেরাও করে রাখে। খবর পেয়ে ছাত্রনেতৃবৃন্দ একদল পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর কিছু সদস্য সেখানে ছুটে যান। বিকেল চারটা থেকে রাতভর যুদ্ধ চলে। এ-যুদ্ধে ছাত্রনেতা শামসুল আলম বুলবুল, আবুল মহসিন বেগ মুকু, আমিরুল ইসলাম ফুনু, ভাটা শ্রমিক আফসারসহ ৫ জন শহীদ হন। অবশেষে গোলাবারুদ ফুরিয়ে পলায়নরত অবস্থায় পাকসেনারা জনসাধারণ কর্তৃক ধৃত ও গণপিটুনিতে নিহত হয়।
পাবনা শহর থেকে ৭-৮ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে বালিয়াহালট নামক স্থানে ওয়াপদা ভবনে পাকবাহিনীর ৮- ১০ জন সদস্য ভারী অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে অবস্থান করছিল। ২৮শে মার্চ জনতার এক বিশাল বাহিনী গগনবিদারী স্লোগান দিয়ে ওয়াপদা ভবনের চারপাশে অবস্থান নেয়। হানাদার বাহিনী এত মানুষের অবস্থান দেখে আতঙ্কিত হয়ে তাদের ওপর এলোপাথাড়ি গুলিবর্ষণ করে। জনতাও প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সন্ধ্যায় জনতার অবরোধ কিছুটা শিথিল হলে রাতের আঁধারে হানাদাররা পালিয়ে বিসিক শিল্পনগরীর পথ ধরে যেতে থাকে। কিন্তু জনতার প্রতিরোধে সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং হানাদার বাহিনী বালিয়াহালট গোরস্তানের পাকা কবরের ভেতর অবস্থান নেয়। ২৯শে মার্চ ভোরে তারা কবর থেকে বেরিয়ে হেমায়েতপুর বিসিক অঞ্চলের দিকে পালানোর চেষ্টা করলে জনতা তাদের আক্রমণ করে। উভয় পক্ষে তুমুল গোলাগুলি হয়। পাকসেনাদের ৮ জন মুক্তিকামী জনতার প্রতিরোধযুদ্ধে প্রাণ হারায়।
হেমায়েতপুরে অবস্থিত বিসিক শিল্প নগরীতে ছিল পাবনায় পাকবাহিনীর প্রধান ঘাঁটি। ২৯শে মার্চ ভোর থেকে পাবনার বিশাল ছাত্র, জনতা, স্বেচ্ছাসেবক ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যগণ কর্তৃক পাকবাহিনীর প্রধান ঘাঁটি অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। আশপাশের এলাকা থেকে জনতার বিশাল বহর আগমনের কারণে রাত্রিবেলা এ অবরোধের মাত্রা আরো বাড়তে থাকে। জনতার বিশাল সমাবেশের দিকে এবং তাদের গগনবিদারী স্লোগান শুনে পাকসেনারা প্লাটা আক্রমণ করতে সাহস পায়নি এবং জনতার সুদৃঢ় প্রতিরোধব্যূহ ভেঙ্গে তাদের পক্ষে বাইরে বেরিয়ে যাওয়াও সম্ভব হয়নি। এ পরিপ্রেক্ষিতে তারা ঢাকা ও রাজশাহীতে সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে সাহয্যের জন্য বার্তা পাঠায়। রাজশাহী থেকে ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ডেপুটি কমান্ডিং অফিসার মেজর আসলামকে ভারী অস্ত্রসস্ত্রসহ ১৮ জন সৈন্য ও ১১টি ট্রাক দিয়ে পাবনায় অবশিষ্ট সৈন্যদের উদ্ধার করে রাজশাহীতে নিয়ে যাওয়ার জন্য পাঠানো হয়। মেজর আসলামের উদ্ধারকারী দল বিসিক অবস্থান থেকে এক প্লাটুন (৩০-৪০ জন) পাকসেনাকে নিয়ে পাবনা-পাকশি কাঁচা রাস্তা দিয়ে রাজশাহীর গোপালপুরের পথে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় জনতার প্রতিরোধ চলাকালে একটি ফাইটার প্লেন এসে জনসাধারণের ওপর গুলিবর্ষণ করতে থাকে। এর ফলে জনগণের অবরোধ ভেঙ্গে পড়ে।
পাকসেনাদের পালিয়ে যাওয়ার খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়তেই হেমায়েতপুরের চরের হাজার-হাজার জনতা ঈশ্বরদী, পাকশি, রূপপুর অঞ্চলের আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বে অসংখ্য যুবক অস্ত্র, হাতবোমা ইত্যাদি নিয়ে পলায়নরত পাকসেনাদের সঙ্গে মাধপুর নামক স্থানে প্রতিরোধযুদ্ধে লিপ্ত হয়। ঈশ্বরদী ও পাবনা সদর থানার সীমান্তবর্তী দাপুনিয়া ইউনিয়নের মাধপুর গ্রামের তিন মাথার মোড়ে ইউসুফ আলীর (সাবেক চেয়ারম্যান) নেতৃত্বে একটি অসম ও দুঃসাহসিক প্রতিরোধযুদ্ধে মনজুর হোসেন বকুল, কাজী সদরুল হক সুধা, জাফর সাজ্জাদ খিচু, আবদুর রহিম টিনু, আবদুর রাজ্জাক, নবাব আলী, ওহিদুল ইসলাম, আবদুল গফুর, হাবিবুর রহমান রাজু, রবিউল, টুকু, পান্না, ইসহাক, রাসু, গাফ্ফারসহ আরো অনেকে অংশগ্রহণ করেন। জনতার গুলিবর্ষণের জবাবে পাকসেনারা বেপরোয়াভাবে পাল্টা গুলিবর্ষণ করে। ঐ যুদ্ধক্ষেত্রের কেন্দ্রভূমি ছিল মাধপুরের বিশাল বটগাছ। ছাত্রলীগ নেতা রাজু এবং সাহাপুরের ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী ওহিদ পাকসেনাদের জিপে ককটেল ছুড়ে মারলে জিপে আগুন ধরে বেশ কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়। পাকসেনারা লাশগুলো ট্রাকে তুলে রাস্তার আশেপাশের গ্রামগুলোতে অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি মেশিনগানের গুলিবর্ষণ করতে-করতে অগ্রসর হতে থাকে। তিন ঘণ্টার প্রচণ্ড এ-যুদ্ধে অনেক পাকসেনা নিহত হয়। এ-যুদ্ধে প্রথম শহীদ হন ঈশ্বরদী মহাবিদ্যালয়ের ছাত্র হাবিবুর রহমান রাজু। তিনি ছাড়াও শহীদ হন আবদুর রাজ্জাক, ওহিদুর রহমান, আবদুল গফুর, আলী আহমেদ, নুরুল ইসলাম নুরু, আবদুস সবুর, নবাব আলী, আতাউল হক আতুসহ প্রায় ১০- ১১ জন প্রতিরোধ যোদ্ধা। মাধপুরের এ-যুদ্ধে জনগণের হাতিয়ার ছিল টুটু-বোর রাইফেল, বন্দুক, ককটেল, হাতবোমা, হলঙ্গা, ফালা, সাবল, লাঠি, শর্কি ইত্যাদি। বিসিকের ঘাঁটি ছেড়ে পালিয়েও শেষ পর্যন্ত পাকসেনারা বাঁচতে পারেনি। ঈশ্বরদী থানার বিশেষ করে পাকশি, সাহাপুর, দাশুরিয়া, বাঁশেরবাদা এবং সলিমপুর ইউনিয়নের জনসাধারণ উদ্ভ্রান্ত ও দিশেহারা পলাতক পাকসেনাদের এই দলটিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য দাশুরিয়া ও মুলাডুলিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এই দুই স্থানে মুক্তিকামী জনতার সঙ্গে পাকসেনাদের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয় এবং অনেক হানাদার নিহত হয়। পলায়নরত পাকসেনাদের তাড়িয়ে মারছিল বীর বাঙালি জনতা। এ-যুদ্ধের সময় একটি যুদ্ধ বিমান পাকসেনাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। অনবরত মেশিনগানের গুলিবর্ষণের সামনে টিকতে না পেরে জনগণ সাময়িকভাবে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। এসময় বিমান থেকে বর্ষিত শেলের আঘাতে রূপপুর গ্রামের মহিউদ্দিন তার দুটি পা হারান, অনেকেই আহত হন। এরপর পাকসেনারা গোপালপুরের দিকে অগ্রসর হলে জনগণও পিছু ধাওয়া করে সেখানে পৌঁছায়। এখানে পাকসেনারা একটি বাড়ির ৬ জন সদস্যকে নৃশংসভাবে হত্যা করে সেই বাড়িতেই আশ্রয় নেয়। জনগণের প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখে পাকসেনারা এ বাড়ি থেকেও ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। এভাবে পলায়নরত পাকসেনারা প্রতিরোধ যোদ্ধাদের দ্বারা বিভিন্ন স্থানে চরম প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়ে নিহত হতে থাকে এবং তাদের গন্তব্য রাজশাহীর গোপালপুর পৌঁছা পর্যন্ত একজন পাকসেনাও আর বাঁচতে পারেনি।
প্রতিরোধের প্রথম পর্যায়ে (২৭-৩০ মার্চ) পাবনাতে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিকামী ছাত্র-যুবক, স্বেচ্ছাসেবক ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের বিভিন্ন খণ্ডযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাবনা জেলা সদর ৩০শে মার্চ প্রথমবারের মত সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত হয়। বলা যেতে পারে, এসব যুদ্ধে পাকবাহিনীর ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের প্রায় ১৫০ সৈন্য নিহত হয়। মুক্তিকামী জনসাধারণের অনেকেও শহীদ হন।
৩০শে মার্চ থেকে পাবনা সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত হলে বাংলাদেশ সরকারের নামে পাবনাতে সর্বপ্রথম বেসামরিক প্রশাসন চালু হয়। বাংলাদেশ সরকার নামে রাবার স্ট্যাম্প প্রস্তুত করা হয়। আনন্দঘন পরিবেশের মধ্য দিয়ে ৪ঠা এপ্রিল জজকোর্ট ভবনে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন আব্দুর রব বগা মিয়া এমপিএ। ট্রেজারি, ব্যাংক, পোস্ট অফিস, সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেয়া হয়। শহরে আবার প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসে। প্রশাসনিক কার্যাবলি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য রাজনৈতিক নেতা ও আমলাদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্য ছিলেন- জেলা প্রশাসক এম নুরুল কাদের খান, পুলিশ সুপার চৌধুরী আবদুল গাফ্ফার, আমজাদ হোসেন এমএনএ, আব্দুর রব বগা মিয়া এমপিএ, ন্যাপ নেতা আমিনুল ইসলাম বাদশা, আওয়ামী লীগ নেতা গোলাম আলী কাদেরী ও ওয়াজি উদ্দিন খান, ছাত্রলীগ নেতা রফিকুল ইসলাম বকুল ও ইকবাল হোসেন। সরকারি কার্যাদি পরিচালনার জন্য এরূপ দায়িত্ব বণ্টন করা হয়: সামগ্রিক কাজের সমন্বয়, সরকারি কর্মচারীদের বেতন, অর্থ সরবরাহ, ব্যাংকিং ও যোগাযোগের তত্ত্বাবধানে ছিলেন জেলা প্রশাসক এম নুরুল কাদের খান, পরামর্শক— আমজাদ হোসেন এমএনএ ও আমিনুল ইসলাম বাদশা; মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ, সমন্বয়, পুলিশ ও প্যারা মিলিটারি নিয়োগ ইত্যাদি দায়িত্বে ছিলেন পুলিশ সুপার চৌধুরী আবদুল গাফ্ফার; দপ্তর প্রধান- কফিল উদ্দিন আহমেদ, পরিকল্পনা, তত্ত্বাবধান এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়ন উপদেষ্টা— আব্দুর রব বগা মিয়া এমপিএ; স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর দায়িত্ব পালন করেন ছাত্রলীগ নেতা রফিকুল ইসলাম বকুল, তত্ত্বাবধানে- আওয়ামী লীগ নেতা গোলাম আলী কাদেরী; জরুরি খাদ্য সংগ্রহ ও বিতরণের দায়িত্বে ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা দেওয়ান ফেরদৌস ফেরু মিয়া; জেলখানা ও মানসিক হাসপাতালসহ সামগ্রিক চিকিৎসা ও ঔষধ ব্যবস্থাপনা দেখাশুনা করতেন ন্যাপ নেতা আমিনুল ইসলাম বাদশা। লিয়াজো আব্দুর রব বগা মিয়া এমপিএ। পাবনার প্রশাসনিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার সঙ্গে-সঙ্গে পরবর্তী সম্ভাব্য হামলা মোকাবেলার জন্য প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে এই বেসামরিক প্রশাসন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৩০শে মার্চ থেকে ১০ই এপ্রিল পর্যন্ত পাবনা সদর শত্রুমুক্ত ছিল। দ্বিতীয় পর্যায়ে পাকবাহিনী পাবনায় প্রবেশ করে ১১ই এপ্রিল বিকেলে। এবার পাবনায় তাদের প্রধান আস্তানা গড়ে তোলে নূরপুরে অবস্থিত বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের বিভাগীয় অফিস এলাকায়। ওয়াপদা অফিসকে অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ও খাদ্যদ্রব্যের প্রধান গোডাউন এবং জেলা পরিষদ ভবনে পাক আর্মিদের অফিস এবং বিচারিক দপ্তর স্থাপন করা হয়। এডওয়ার্ড কলেজের ডিগ্রি ভবনে শক্তিশালী ঘাঁটি স্থাপন করা হয়। নূরপুর ডাকবাংলোয় ছিল অফিস ও অফিসারদের থাকার জায়গা। পাবনা সার্কিট হাউজের আশপাশে ভারি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করে গড়ে তোলা হয় পাকবাহিনীর আরো একটি শক্তিশালী কেন্দ্র। ঊর্ধ্বতন সমরিক অফিসাররা বাইরে থেকে এসে এখানে অবস্থান নিত। সার্কিট হাউজের পেছনে গাড়ির গ্যারেজ ছিল টর্চারসেল। বালিয়াহালট ব্রিজের কাছে, লস্করপুরের তিনমাখায়, টেবুনিয়া বাজার, আতাইকুলা বাজার, কালীদহ মোড় প্রভৃতি স্থানে পাকবাহিনী চেক পোস্ট স্থাপন করে।
ক্যাপ্টেন আসগার হোসেন জায়েদীকে চেয়ারম্যান এবং মাওলানা আব্দুস সুবহানকে সেক্রেটারি করে পাবনা সদর সাব-ডিভিশন শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। জায়েদী ছিল পাকিস্তান আর্মির অবসরপ্রাপ্ত একজন বাঙালি ক্যাপ্টেন। তার বাড়ি ছিল সিলেটে। ১৯৫৪ সালে নৈতিক স্খলন ও অন্যান্য অভিযোগে তাকে চাকুরিচ্যুত করা হয়। ঘটনাক্রমে সে পাবনায় বসবাস করত। সে পাক আর্মি, রাজাকার ও নকশালদের ব্যবহার করে পাবনার বহু নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছিল। শান্তি কমিটির অন্য সদস্যরা ছিল- ওসমান গনি খান (চরতারপুর), মোফাজ্জল হোসেন ডাক্তার (লাইব্রেরি বাজার), মোজাহার হোসেন (লাইব্রেরি বাজার), এডভোকেট মোসলেম তালুকদার (বাণী সিনেমা হলের পেছনে), সাহেদ আলী প্রামাণিক (কৃষ্ণপুর), আব্দুর রাজ্জাক, আমিন উদ্দিন মিয়া, মোসলেম উদ্দিন মোল্লা (আতাইকুলা), ডা. আব্দুর রহমান (সাঁথিয়া), ডা. করিম বক্স সরদার (সাঁথিয়া), গাজিউর রহমান (দিলালপুর), খবির উদ্দিন বিশ্বাস (কৃষ্ণপুর), খন্দকার নূরুদ্দিন (রাধানগর), আনা জোয়ারদার আলী (কুঠিপাড়া), হাসান খাঁ (দিলালপুর), বদরুদ্দোজা চৌধুরী, রওশনজান চৌধুরী, কোবাদ হোসেন প্রমুখ। আব্দুল মতিন ঘেটু নামে এক লম্পট পাবনায় আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিল। তার আস্তানা ছিল শালগাড়িয়ায়। তার প্রধান সহযোগীদের মধ্যে ছিল শহরের চিহ্নিত অনেক দুস্কৃতিকারী। থানা পাড়ার বেশকিছু কশাই, সাবান মল্লিক ডাকাতসহ বহু সন্ত্রাসী ঘেটু শালগাড়িয়ায় মানুষজন ধরে এনে হত্যা করে। আলবদর বাহিনীর প্রধান মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী (যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত এবং ২০১৬-র ১১ই মে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়)-র নির্দেশে প্রতিটি এলাকায় ৩১৩ জনের একটি গ্রুপ নিয়ে আলবদর বাহিনী গঠন করা হয়। ঘাতক, দালাল, রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও নকশালরা পাকিস্তানি আর্মিদের সবসময় কুপরামর্শ দিত। তারা আওয়ামী লীগের লোকজনকে চিনিয়ে দিত, মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটির খবর এনে দিত। রাজাকার আর নকশালরা না থাকলে আর্মিরা পাবনার মানুষের ওপর এত অত্যাচার করতে পারত না। পাবনায় টিপু বিশ্বাসের নেতৃত্বে গঠিত নকশাল বাহিনী স্বাধীনতার বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিল।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যেসব রাজাকার ও দালাল তালিকাভুক্ত হয়, তারা হলো- আব্দুল হাকিম, পুলিশ কনস্টেবল সি/৭০৫ (ভাওডাঙ্গা), নাসির শেখ, পুলিশ কনস্টেবল সি/২৯৯ (সাধুপাড়া), আনসার আলী, পুলিশ কনস্টেবল সি/৪১৪ (মাদারগাছি), আব্দুর রসিদ, পুলিশ কনস্টেবল সি/৩৩৭ (কলিয়ার), সিরাজ উদ্দিন পিয়ন (চক ছাতিয়ানি), আফসার উদ্দিন (জালালপুর), লিয়াকত (মাসিমপুর), মো. আরশাদ আলী মিয়া (বোয়ালিয়া), মহিউদ্দিন (গয়েশপুর), চাঁদ আলী সরদার (মালঞ্চি), হারেজ শেখ (মালঞ্চি), গরাদি আলী পরামানিক (গয়েশপুর), আব্দুল আজিজ শেখ (রাধানগর), সরিফুন নেছা (রাধানগর), আনসার আলী (নওদাপাড়া), শমসের আলী (নওদাপাড়া), ইসকান্দার পরামানিক (নওদাপাড়া), মো. আন্তাই (বয়রা), শমসের আলী (মজিদপুর), আব্দুল হোসাইন (বয়রা), আবুল হাকিম (বাগচিপাড়া), তামেদ উদ্দিন (দক্ষিণ রাঘবপুর), ধীরেন্দ্র নাথ সেন ওরফে দেলোয়ার হোসেন (বয়রা; মুক্তিযুদ্ধকালে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম নাম ধারণ), মো. ইয়াসিন পরামানিক (বিলকুলা), ইসমাইল পরামানিক (বিলকুলা), মো. নুরুল ইসলাম (বিলকুলা), মো. নাজির শেখ (শালগাড়িয়া), মো. বসির আলী পরামানিক (বোয়া), আব্দুস সাত্তার (ব্রজেন্দ্রপুর), মো. শফিক খান (রাধানগর), মো. ইসহাক শেখ (রাধানগর), ওয়াজ আলী (সালাইপুর), মাজ্জাম আলী (সালাইপুর), হাসিনা বানু ওরফে কদ বানু (রাধানগর), ইউনুস আলী পরামানিক (শালগাড়িয়া), দয়াল শেখ (শালগাড়িয়া), আব্দুর রউফ (সিংগা), মোজিবুর রহমান (তাড়াশ), নিতাই চন্দ্র শাহা (গোপালপুর), নিমাই চন্দ্ৰ শাহা (শালগাড়িয়া), প্রদ্যুত কুমার রায় (গোপালপুর), মুসা (তারাবাড়িয়া), পীর বক্স পরামানিক (গয়েশপুর), হামিদুল হক (গোপালপুর), তোরাব আলী পরামানিক (নূরপুর), কাদের পরামানিক (শালগাড়িয়া), মজিবুর (শালগাড়িয়া), আব্দুস সাত্তার (শালগাড়িয়া), আফসার উদ্দিন (জালালপুর), মো. আফসার উদ্দিন (জালালপুর), আব্দুল মজিদ (শালগাড়িয়া), আফসার আলী (ময়নামতি), নিজাম উদ্দিন (লক্ষীপুর), চান্দু (আরিফপুর), আব্দুল হাকিম (শালগাড়িয়া), আকবর আলী (থানাপাড়া), নূর উদ্দিন নূর (থানাপাড়া), মোমতাজ (থানাপাড়া), মোস্তফা (থানাপাড়া), কিতাব আলী (থানাপাড়া), হাতেম শেখ (থানাপাড়া), আবু সিদ্দিক (সাধুপাড়া), দামালু (শালগাড়িয়া রিফিউজি ক্যাম্প), পুরি (শালগাড়িয়া রিফিউজি ক্যাম্প), লাতু (শালগাড়িয়া), আহাদ আলী (শালগাড়িয়া), নওয়াব আলী ওরফে মোজাম (আটুয়া), সরিফান (রাধানগর), নুরুল ইসলাম, ইয়াদ আলী (মেহেরচণ্ডি), মধু শেখ (কিসমত প্রতাপপুর), সালাম উদ্দিন (দিলালপুর), এস এম সলিম উল্লাহ (কাচারিপাড়া), সন্দু (হেমায়েতপুর), হিমাত শেখ (রাঘবপুর), তফিল সরদার (বয়োনাথপুর), তপন কুমার রায় (শালগাড়িয়া), আফতাব (নারায়নপুর), তোরাব আলী (সাধুপাড়া), আজাহার আলী (নাজিরপুর), জহুরুল ইসলাম (শালগাড়িয়া), মোক্তার হোসেন (শালগাড়িয়া), হাফিজ উদ্দিন (থানাপাড়া), সেকেন্দার আলী (রাধানগর), কোরবার আলী (শিবরামপুর), আজিম উদ্দিন (শিবরামপুর), আসির পরামানিক (চিতালিয়া), মো. আবু বক্কর (মধুপুর), আব্দুল আজিজ (ভাওডাঙ্গা), মো. রাজন আলী (জাফরাবাদ), আনিসুর রহমান (বনগ্রাম), আব্দুল লতিফ (বকশিপুর), আবুল হোসেন (বনগ্রাম), মোঃ আনসার হোসেন (বসুনিয়া), আব্দুস সামাদ (জাফরাবাদ), আব্দুল হাকিম মিয়া (শালগাড়িয়া), মো. আনসার আলী (জুমাপাড়া), আব্দুর রহিম (জুমাপাড়া), আলীম আহমেদ (জুমাপাড়া), লুচিয়া (কচুরি পাড়া), আসুরা খাতুন (কৈচুরি পাড়া), সোহরাব আলী (শংকরদিয়া), শাহজাহান (বলরামপুর), সেকেন্দার আলী শেখ (চর আশুতোষপুর), লাল মিয়া (আটুয়া), আব্দুল মজিদ (নারায়নপুর), রুস্তম আলী (নিয়ামত উল্লাপুর), আলতাফ (নারায়নপুর), নূর মোহাম্মদ (থানাপাড়া), মো. সাদেক (রাধানগর), নজরুল খন্দকার (রাধানগর), আব্দুল বারি (রাজাপুর), রবি চন্দ্র নাথ (জোসিপাড়া), ভোলাই (ছাতিয়ানি), কাশেম শেখ (ছাতিয়ানি), আব্দুল বারেক (রাজাপুর), মো. সফিক খান (রাধানগর), হারুনূর রশিদ (কৃষ্ণপুর), মোসলেম (হারিয়াবাড়িয়া), উকিল উদ্দিন (গোবিন্দা), আলমাস (শিবরামপুর), সাদেক আলী পরামানিক (চর ভঙ্গাবাড়ি), জোনাব মণ্ডল (চর ভঙ্গাবাড়ি), আব্দুল কাদের (সানিকদিয়ার), নায়েব আলী (ভাঙ্গাবাড়ি), ওমদে আলী মণ্ডল (ভাঙ্গাবাড়ি), জদু পরামনিক (ভাঙ্গাবাড়ি), সাহাজ আলী পরামানিক (চরাডাঙ্গা), এ এম মকসুদুল আলম (আটুয়া), খোদা বক্স (গঙ্গারামপুর), কানাই শেখ (কুচিয়ামোড়া), কাসেম পরামানিক (কাশিপুর), তাহের আলী (বইডাঙ্গানাথপুর), মো. সিরাজ উদ্দিন মোল্লা (শ্যামনগর), খান মো. আব্দুল মোমেন মুক্তার (শিবরামপুর), দায়েত শেখ (শালগাড়িয়া), মো. মোহিরুদ্দিন (গয়েসপুর), অহেদ আলী খান (তারাবাড়িয়া), আকব্বর আলী (চর কুশাখালি), জামাত আলী ওস্তাগার ওরফে জাম্বু (পৈলানপুর), নিজাম উদ্দিন খান (ভবানিপুর), আব্দুল ওহাব শেখ (দোগাছি), মো. সাগিরুদ্দিন (কাচারিপাড়া), কাশেম পরামানিক (কৃষ্ণপুর) ও মিরজান পরামানিক (বিলকালা)।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাবনা সদর উপজেলায় হত্যা, নির্যাতন ও ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যুক্ত রাজাকার, শান্তি কমিটি ও আলবদর সদস্যদের মধ্যে যাদের বিরুদ্ধে সরকার ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে গেজেটে সমন জারি করে, তারা হলো- মোহাম্মদ আবুল কালাম ইলিয়াস সরোয়ার (পিতা মো. আজিলুর রহমান, দিলালপুর), মাওলানা আব্দুস সুবহান (পিতা নইমুদ্দিন, হাজী মোহসীন রোড; বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন), মো. মোফাজ্জল আলী (পিতা মো. মগরেব আলী মুন্সি), সৈয়দ আজগর জায়েদী (পিতা মুর্তজা হোসেন জায়েদী, রোড) ও মো. ময়েজুদ্দিন (পিতা কাহার আলী, মাধবপুর, হকিমপুর)।
১১ই এপ্রিল পাকসেনারা পুনরায় পাবনা জেলা শহর দখল করলে সুযোগ সন্ধানী কিছু দালালদের সহায়তায় তারা বাঙালি হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। তারা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়, নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। পাকসেনারা পাবনা জেলায় নির্বিচারে গণহত্যা সংঘটিত করে। নয় মাসে তারা হাজার-হাজার মানুষকে হত্যা ও পাবনা শহরকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। পাকসেনাদের দোসররা পাবনা জেলার নানাস্থান থেকে শতশত নিরীহ মানুষকে ধরে এনে হত্যা করে পাবনা শহরের বিভিন্নস্থানে মাটি চাপা দিয়ে রাখে। কোনো-কোনো ক্ষেত্রে নিহতদের মৃতদেহ যেখানে- সেখানে ফেলে রাখে শেয়াল-কুকুরের খাদ্য হিসেবে। পাবনা শহরের বিসিক শিল্পনগরী, এডওয়ার্ড কলেজ, নূরপুর ডাকবাংলো, নাজিরপুর, বাঙ্গাবাড়িয়া, শ্রীকৃষ্ণপুর, সমসপুর, মাধপুর, টিকোরি, মনোহরপুর, হেমায়েতপুর প্রভৃতি স্থানে পাকসেনাদের হাতে নিহত মানুষের গণকবর ছিল। পাকসেনাদের গণহত্যার প্রধান কেন্দ্র ছিল পাবনা পাওয়ার হাউজ। নয়মাস যুদ্ধের শেষে এসব স্থানে পাওয়া যায় অনেক গণকবর ও হাজার-হাজার মানুষের কঙ্কাল। এ-রকম একটি গণকবরের সন্ধান পাওয়া যায় পাবনা ওয়াপদা ভবন গণকবর-। গণকবরটি খুড়ে কয়েক হাজার মানুয়ের কঙ্কাল এবং ধারালো অস্ত্র পাওয়া যায়। এছাড়া পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের ডিগ্রি ক্যাম্পাসে হাজার-হাজার মানুষকে হত্যা করে ইছামতি নদীর দুই তীরে মাটি চাপা দেয়া হয়। স্বাধীনতার পর ডিগ্রি ক্যাম্পাস চত্বরে শতশত লোকের লাশ ও কঙ্কাল বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল।
ওয়াপদা পাওয়ার হাউজ অফিসের প্রত্যক্ষদর্শী ঝাড়ুদার ভানুলাল জমাদারের ভাষ্যমতে পাকহানদার বাহিনী সাধারণ জনগণকে ধরে এনে নির্মম নির্যাতন ও পরে হত্যা করে মৃতদেহ মাটিচাপা দিত। ভানুলালকে দিয়ে তারা গর্ত খোঁড়ার কাজ করাত। পাবনা শহর মুক্ত হবার পর তিনি একটি উন্মুক্ত কবরে ষোলটি মৃতদেহ জনসাধারণকে দেখান। এখানকার কাঁচের জানালা দেয়া দোতলা বাড়িটি ছিল পাকসেনাদের টর্চার সেল। এর দুটি কক্ষ তারা কসাইখানা হিসেবে ব্যবহার করত। এখানকার কয়েকটি কবর থেকে হাজারখানেক মানুষের মাথার খুলি এবং একটি কবরে ষাটটি লাশ পাওয়া যায়। পাবনা শহর থেকে দেড় মাইল দূরে বালিয়াহালটে ছিল আরেকটি বধ্যভূমি। এখানে পাবনার বিভিন্ন এলাকা থেকে নিরীহ লোকদের ধরে হত্যা করা হয়। যুদ্ধের পর বালিয়াহালটের পার্শবর্তী জমিগুলোতে অনেক মাথার খুলি ও কঙ্কাল পাওয়া যায়।
পাবনা সদর থানায় অবস্থিত ভাড়ালা গ্রামে ১৯৭১ সালের ২রা মে পাকসেনারা অতর্কিতে হামলা চালিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত বেশকিছু গ্রামবাসীকে আটক করে ভাড়ালার ঐতিহাসিক শাহী মসজিদ চত্বরে জড়ো করে। তাদের মধ্যে পাকসেনাদের দৃষ্টিতে সন্দেহভাজন ২৫ জন গ্রামবাসীকে তারা পাবনা সদরের বন্দিশিবিরে নিয়ে যায়। তিনদিন অনাহারে রাখার পাশাপাশি তাদের ওপর চালানো হয় নৃশংস নির্যাতন। এক সময় দেবোত্তর নামক স্থানে তাদের মধ্যে ৮ জনকে এবং অন্যদের সাড়াঘাটে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। নিহতদের মধ্যে ছিল মো. আবদুল জব্বার শেখ, রোস্তম আলী শেখ, সিরাজুদ্দিন শেখ, নুরুল হক শেখ, ইয়াদ আলী সরদার, হাফিজ সরদার প্রমুখ।
মুক্তিবাহিনী ১০ই নভেম্বর তিনগাছা ও ২৭শে নভেম্বর শ্রীকৃষ্টপুর রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এতে মহরম ও ছানা শহীদ হন। অন্যদিকে রাজাকাররা সবাই নিহত হয়। এ ঘটনার প্রতিশোধ নিতে পাকসেনারা ১লা ডিসেম্বর নাজিরপুর গ্রামে গণহত্যা চালায়। নাজিরপুর গণহত্যায় অসংখ্য নিরীহ গ্রামবাসী এবং কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এছাড়া টিকোরি, দাপুনিয়া, মাধপুর প্রভৃতি অঞ্চলেও ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটিত হয়।
১১ই এপ্রিল বিকেলে পাবনা শহরে পুনরায় পাকবাহিনী প্রবেশ করে পুলিশ লাইন, সার্কিট হাউস, নূরপুর ডাকবাংলো, বিসিক ও ওয়াপদার দিকে যেতে থাকে। তাদের একটি দল পলিটেকনিক পার হয়ে ডানদিকে ফজলুল হক রোড দিয়ে রক্ষাকালী মন্দিরের কাছে তিনমাথায় পৌঁছায়। সেখানে ডা. বিহারী লাল সাহার গোবিন্দবাড়ি মন্দিরে অনেক লোক এসে আশ্রয় নিয়েছিল। বর্বর পাকসেনারা সেই বাড়ি, মন্দিরের ভেতর এবং রাস্তার আশপাশে লুকিয়ে থাকা সবাইকে ধরে রক্ষাকালী মন্দিরের সামনে এনে লাইনে দাঁড় করিয়ে নৃশংসভাবে ২০-২৫ জনকে গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনা <রক্ষাকালী মন্দির গণহত্যা- নামে পরিচিত। গভীর রাতে জিলাপাড়ার লোকজন মুসলমানদের কয়েকজনের মৃতদেহ রক্ষাকালী মন্দিরের পাশের মনসেফবাবু রোডে নিয়ে কোনোরকমে মাটিচাপা দেয়। সৎকার করা সম্ভব না হওয়ায় হিন্দুদের লাশগুলো সেখানেই পড়ে থাকে।
১৩ই এপ্রিল পাকসেনারা পাবনা সদরের আতাইকুলা ইউনিয়নের কুচিয়ামোড়া, শাঁখারীপাড়া ও সারদিয়া গ্রামে গণহত্যা চালায়, যা কুচিয়ামোড়া মোড় গণহত্যা- নামে পরিচিত। এতে অর্ধশতাধিক মানুষ শহীদ হন। সকাল ৯টা থেকে শুরু করে বিকেল ৪টা পর্যন্ত তারা গ্রামগুলোতে তাণ্ডবলীলা চালায়। কুচিয়ামোড়া হিন্দুপ্রধান এ এলাকার মন্দির, বিগ্রহসহ বহু বাড়িঘর হানাদাররা জ্বালিয়ে দেয়।
৭ই মে পাবনা পুলিশ লাইন থেকে প্রায় ৪০ জন পুলিশ সদস্যকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ধরে নিয়ে যায়। সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার কথা বিশ্বাস করে পুলিশ সদস্যরা চাকরিতে যোগদান করেছিলেন। হানাদাররা তাদের ধরে নিয়ে প্রথমে ওয়াপদার টর্চারসেলে নির্মম অত্যাচার করে পরে রাতের বেলা বালিয়াহালট গোরস্তানের পেছনে নিয়ে গিয়ে বেয়নেট চার্জ এবং শুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনা বালিয়াহালট গোরস্তান গণহত্যা নামে পরিচিত।
৮ই মে পাবনা শহরের সিঙ্গা বাজারের মন্দিরের পেছনে পালপাড়ায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে ‘কাফের হত্যার’ কথা বলে দালালরা নিয়ে যায়। আগুন ধরিয়ে দেয় পালপাড়ার বিভিন্ন বাড়িতে। এরপর হানাদাররা ১০-১২ জনের হাত-পা বেঁধে নির্মমভাবে অত্যাচার করতে থাকে। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে দেহ ছিন্নভিন্ন করতে থাকে। এই নৃশংস ঘটনার সময় সেখানকার বিভিন্ন পরিবারের তিন- চারজন মেয়েকে তারা প্রকাশ্যে গণধর্ষণ করে। পরে তাদের গুলি করে হত্যা করে ফেলে রেখে যায়।
১৪ই আগস্ট এফএফ – ট্রেনিংপ্রাপ্ত সুবোধ কুমার দে টেংকু পাকহানাদারদের গুলিতে শহীদ হন। টেংকু, মাহতাব এবং আরো কয়েকজন মিলে নৌকা নিয়ে আতাইকুলার কাছারপুরের বৈদ্যুতিক টাওয়ার উড়িয়ে দিতে যান। টাওয়ারের সঙ্গে এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে সেভটি ফিউজে আগুন দিতে গিয়ে তাঁরা দেখেন সঙ্গে আনা ম্যাচ পানিতে ভিজে যাওয়ায় কাজ করছে না। এদিকে সকাল হয়ে আসছিল। বেশকিছু দূরের বাজার থেকে টেংকু ম্যাচ কিনে দাম পরিশোধ করছেন ঠিক সেই মুহূর্তে নগরবাড়ি থেকে একটি জিপে পাকিস্তানি আর্মি এসে হাজির হয়। দোকানে উপস্থিত সকলের নাম-ঠিকানা জিজ্ঞেস করার এক পর্যায়ে টেংকুকে হানাদারদের সন্দেহ হয়। তখন তাঁকে বলে ‘তোমহারা কাপড় উতারো’। টেংকু ইতস্তত করায় আর্মিরা জোর করে কাপড় খুলে যখনই বুঝতে পারে যে টেংকু হিন্দু, তখনই হানাদাররা তাকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে।
৭ই অক্টোবর মান্না, মতি ও পল্টু এই তিন মুক্তিযোদ্ধা দ্বীপচরে অবস্থানরত মান্নার ভাই বেবী ইসলামের কাছে যাওয়ার পথে পাবনা সদরের কুচিয়ামোড়া নামক স্থানে তাঁদের তিনজনকে সশস্ত্র রাজাকাররা ধরে ফেলে। তিনজনের মধ্যে একজন কোনোক্রমে রাজাকারদের হাত থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হলেও মান্না ও অন্যজন রাজাকারদের নির্মম নির্যাতনের শিকার হন। রাজাকাররা তাঁদের দুজনকে বেয়নেট চার্জ করে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে হত্যা করে।
পাবনা জেলা কাউন্সিলের সহকারী প্রকৌশলী মোকররম হোসেন মুকুল বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের আহ্বানে সাড়া দিয়ে পিতার লাইসেন্সধারী দোনলা বন্দুক নিয়ে অসহযোগ আন্দোলন ও প্রাথমিক প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ১১ই এপ্রিল পুনরায় পাকসেনারা পাবনা দখল করলে তাঁর তিন সহোদর মঞ্জু, অঞ্জু, রঞ্জুসহ মুকুল ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে পাবনার বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। একসময় অসুস্থ মায়ের সঙ্গে তাঁরা দেখা করতে পাবনার সাধুপাড়ার বাড়িতে এলে ১১ই ডিসেম্বর পাকসেনারা মুকুল, মঞ্জু, অঞ্জু, রঞ্জুসহ একমাত্র বোনের স্বামী ইউসুফকে জোরপূর্বক গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। তাঁরা আর কখনো ফিরে আসেননি।
পাবনা সদর উপজেলায় অবস্থিত বিসিক শিল্পনগরী, মোসলেম প্রামানিকের তে-মাথা, পাবনা আলীয়া মাদ্রাসা, সার্কিট হাউস, ওয়াপদা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের বিভাগীয় অফিস, জেলা পরিষদ ভবন, এডওয়ার্ড কলেজের ডিগ্রি ভবন প্রভৃতি স্থান ছিল পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র। সার্কিট হাউজের পেছনে গাড়ির গ্যারেজও ছিল টর্চার সেল। যাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত হতো, তাকে রাতে এখান থেকে বিসিকের ভেতরের মাঠে নিয়ে গুলি করে হত্যা করার পর মাটিতে পুঁতে রাখা হতো।
সদর উপজেলার টেবুনিয়া বাজার, বালিয়াহালট ব্রিজের নিকটস্থ স্থান, লস্করপুর তিনমাথা, আতাইকুলা বাজার, কালীদহ মোড় প্রভৃতি স্থানে ছিল হানাদার বাহিনীর চেকপোস্ট। এসব চেকপোস্টে রাজাকার অথবা নকশালরা রাস্তা দিয়ে চলাচলরত লোকজনকে বিভিন্নভাবে পরীক্ষা- নিরীক্ষা ও জিজ্ঞাসাবাদ করত। যাদের সন্দেহভাজন ও শত্রুবলে মনে হতো, তদের চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হতো ওয়াপদার টর্চার সেলে। তারপর অমানুষিক নির্যাতন করে তাঁদের হত্যা করা হতো।
পাবনা সদর উপজেলার বধ্যভূমিগুলো হলো- নূরপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্ৰ বধ্যভূমি, নাজিরপুর নজরুল ইসলাম উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন বধ্যভূমি গফুরিয়াবাদ গোরস্থান বধ্যভূমি, কুচিয়ামোড়া মোড় বধ্যভূমি এবং টেবুনিয়া বীজ গোডাউন সংলগ্ন বধ্যভূমি।
১৪ই জুলাই ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা প্রবল শক্তি নিয়ে পাবনায় প্রবেশ করেন। এ সময় থেকেই স্বাধীনতা যুদ্ধের গতিধারা পাল্টে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা পাবনা জেলার সুজানগর, অটিঘরিয়া, চাটমোহর, ভাঙ্গুরা, সাতবাড়িয়া, দ্বীপচর, ঢালারচর, নাজিরপুর, টিকরি, দাপুনিয়া, মাধপুর, বাঁশেরবাদা, আওতাপাড়া, চর শানিকদিয়া, চর সদিরাজপুর প্রভৃতি স্থানে অবস্থান নেন। এ সমস্ত স্থান থেকে তাঁরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অবস্থান ও থানাগুলোতে আক্রমণ চালাতে থাকেন।
২২শে অক্টোবর তিনগাছা বাবুদের বাগানে পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা টিপু বিশ্বাসের বাহিনী (নকশাল নামে এলাকায় পরিচিত)-র সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের এক ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। তিনগাছা যুদ্ধ-এ টিপু বিশ্বাস বাহিনীর ৩৪ জন নিহত হয়। দুটি ব্রিটিশ এলএমজি, একটি ব্যাটাগানসহ ২৮টি থ্রি- নট-থ্রি রাইফেল মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। এ-যুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধা মহরম আলী ও ছানাউল্লাহ্ খাঁ শহীদ হন।
৭ই নভেম্বর সন্ধ্যায় আরেকটি ভয়াবহ যুদ্ধ হয় প্রতাপপুর গ্রামে। প্রতাপপুর যুদ্ধ- হয় মুক্তিযোদ্ধা এবং নকশাল ও আলবদর বাহিনীর মধ্যে। নকশালরাই প্রথম যুদ্ধের সূচনা করে। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়দাতা কোরবান মালিথার বাড়ি আক্রমণ করে তাঁকে হত্যা করে ও বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। তারা প্রতাপপুরের সমস্ত বাড়ি-ঘরও জ্বালিয়ে দেয়। এ-যুদ্ধে কোরবান মালিথাসহ বীর মুক্তিযোদ্ধা আতিয়ার ও জয়নাল শহীদ হন।
সানিকাদিয়ার চরে পাকবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর আলবদর ও নকশালদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। ২৭শে নভেম্বর ভোর ৪টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত সানিকাদিয়া চর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে জাহাঙ্গীর আলম সেলিম, আব্দুল হামিদ, আফতাব মালিথা, শাহজাহান মালিথা, ফজুমোল্লা, সুলতান, আমীর আলীসহ বেশকয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এ-যুদ্ধে নকশালদের ২২ জন নিহত হয়। এ যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন রফিকুল ইসলাম বকুল, জাহাঙ্গীর আলম সেলিম, ইকবাল হোসেন, ফজলুল হক মন্টু, আবুল কালাম আজাদ, ইসরাইল হোসেন মেছের ও শামছুল আলমসহ আরো আনেকে।
১৮ই ডিসেম্বর পাবনা সদর শত্রুমুক্ত হয়। ১৪ই ডিসেম্বর ভারতীয় মিত্রবাহিনী – পাকসেনাদের আঘাত কারার জন্য পাবনা জেলার বিভিন্ন স্থানে বিমান হামলা শুরু করে। ফলে পাবনা শহরের বেশকিছু অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই বিমান হামলার সময় পাকশির ঐতিহাসিক হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ১২ নম্বর স্প্যানটি ধ্বসে পড়ে এবং ব্রিজের ৯ ও ১৫ নম্বর স্প্যানেও আঘাত লাগে। এ সময় মিত্রবাহিনী পাকসেনাদের পালানোর পথ রুদ্ধ করার জন্য বিমান থেকে বোমা নিক্ষেপ করে। বিমান হামলার সময় ব্রিজের ওপর দিয়ে স্লিপার পেতে পাকসেনাদের সাঁজোয়া গাড়ি ও ট্যাঙ্ক পার হচ্ছিল। স্প্যান ভেঙ্গে পড়ার পরও একটি ট্যাঙ্ক ব্রিজের ওপর পড়ে ছিল। এমনকি কয়েকজন পাকসেনার লাশও ব্রিজের ভাঙ্গা স্প্যানে ঝুলে থাকতে দেখা যায়। মিত্রবাহিনী বিমান আক্রমণের পাশাপাশি কুষ্টিয়া থেকে পাবনায় মর্টার ও শেল নিক্ষেপ করে। ১৬ই ডিসেম্বর বিজয়ের পূর্ব মুহূর্তেও পাকসেনাদের এদেশীয় দালালরা শেষ আক্রমণ করে ১৫ই ডিসেম্বর। এদিন অপরাহ্নে রফিকুল ইসলাম বকুলের নেতৃত্বে প্রচুর সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা পাবনা শহরে প্রবেশ করেন এবং পাবনা কালেক্টরেট ভবনে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। এই বিবেচনায় পাবনা সদর মুক্ত হয় ১৫ই ডিসেম্বর। তবে ১৬ই ডিসেম্বর পাকসেনারা পাবনায় আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকার করে। ইতোমধ্যে পাবনার বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে- ছিটিয়ে থাকা পাকসেনারা নূরপুর ওয়াপদা ভবনে এসে জমায়েত হতে থাকে এবং এদের কিছু অংশ চলে যায় ঈশ্বরদী ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউটে। কেননা অবাঙালি অধ্যুষিত ঈশ্বরদী থানাকে পাকসেনারা নিরাপদ মনে করেছিল। অবশেষে এলো দীর্ঘ প্রতীক্ষিত দিন ১৬ই ডিসেম্বর। এদিন রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলেও পাবনা সদরে অবস্থানরত পাকসেনারা সেদিন আত্মসমর্পণ করতে রাজি হয়নি। পাকসেনারা একমাত্র ভারতীয় মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে আগ্রহ প্রকাশ করে। এদিকে মুক্তিযোদ্ধারা চারদিক থেকে পাবনা শহর ঘিরে ফেলে পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ শুরু করেন। এসময় পাকসেনারাও পাল্টা আক্রমণ করলে উভয়পক্ষের মধ্যে শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। দুদিন এভাবেই যুদ্ধ চলে। ১৭ই ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক কোম্পানি সৈন্য মেজর কে কে কোলির নেতৃত্বে পাবনায় এসে পৌঁছান। তাঁরা পাবনা সার্কিট হাউজ, নূরপুর ডাকবাংলো ও বিসিক এলাকায় অবস্থান গ্রহণ করেন। ১৮ই ডিসেম্বর সকালে তাঁরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে নিরস্ত্র করে ওয়াপদা ক্যাম্পে বন্দি করেন। এভাবেই পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে পাবনা জেলা সদর পরিপূর্ণভাবে হানাদারমুক্ত হয়।
পাবনা সদরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মোস্তাক হোসেন (পিতা মোতাহার হোসেন, সাধুপাড়া), আবদুর রাজ্জাক সিদ্দিক (পিতা আব্দুল আজিজ প্রামাণিক, গোপালপুর), হাফিজুর রহমান (পিতা ডা. আব্দুর রহমান, নারায়ণপুর), আলেফ (পিতা জেহের আলী, রাধানগর), ইসমাইল হোসেন গামা (পিতা মো. আবু তালেব, জেলাপাড়া), সুবোধ কুমার দে (পিতা শান্তি চন্দ্র দে, শালগাড়িয়া), আবু বকর সিদ্দিক (পিতা কেদার প্রামাণিক, দ্বীপচর, আশুতোষপুর), আবুল হোসেন (পিতা বাহাদুর আলী, আড়িয়া), মোসলেম উদ্দিন (পিতা ইয়াদ আলী প্রামাণিক, তাড়াবাড়ীয়া), শাহজাহান আলী (পিতা জাবেদ আলী, শুকচর), আব্দুল কুদ্দুস (পিতা ইরাদ আলী বিশ্বাস, কোলচুরী), মোশারফ হোসেন (পিতা মোতাহার হোসেন, পাবনা), ইউসুফ আলী (পিতা মোতাহার হোসেন, পাবনা), আমির হোসেন (পিতা আছাদ আলী বিশ্বাস, ভাঁড়ারা), রবেল (পিতা ছয়মান সরদার, নাজিরপুর), জনাব আলী (পিতা আজগর আলী, নাজিরপুর), সুলতান মাহমুদ (পিতা কছির সরদার, কৃষ্ণদিয়ার), আতাব মালিথা (পিতা বাহার উদ্দিন, গাফুরিয়াবাদ, দাপুনিয়া), আব্দুস ছাত্তর ছানা (পিতা আতাহার আলী সরদার, নাজিরপুর), জাহাঙ্গীর সেলিম (পিতা আব্দুল গনি, দিলালপুর), হামিদ (পিতা হাসেন আলী আটুয়া, পাবনা), ছানাউল্লাহ্ খাঁ (পিতা বেলায়েত আলী খাঁ, চরপ্রতাবপুর), গোলাম রাজ্জাক চৌধুরী (পিতা গোলাম কাদের চৌধুরী, পাথরতলা), নজরুল ইসলাম (পিতা আকবর, দিলালপুর), আবুল হাসেন (পিতা হাকিম উদ্দিন শেখ, কাচারিপাড়া), হাবিবুর রহমান (পিতা আজিজুর রহমান, ভাঁড়ারা), মাওলানা কছিমুদ্দিন (পিতা মহির উদ্দিন সরকার, গোপালপুর), রবি (পিতা নূরু শেখ, গোবিন্দা), মোকারম হোসেন (পিতা মোতাহার হোসেন, সাধুপাড়া), মনসুর হোসেন (পিতা মোতাহার হোসেন, সাধুপাড়া), আল্লা রেখা খান (পিতা মওলা বক্স খান, আটুয়া), শাজাহান (পিতা ডা. বাহার উদ্দিন, গাফুরিয়া), মহরম আলী (পিতা ইয়াজ উদ্দিন শেখ, নারায়নপুর), আবুল মোহসিন বেগ (পিতা আলিম উদ্দিন আহম্মেদ, শালগাড়িয়া), আলমগীর (পিতা আব্দুল গণি, দিলালপুর), আবুল বারিক (পিতা বেরাজ আলী, রাধানগর), আব্দুল মান্নান (পিতা ইসমাইল হোসেন, গোপালপুর), মতি (পিতা আসকাল সরদার, গোপালপুর), পল্টু মোহন চৌধুরী (পিতা প্রফুল্ল মোহন চৌধুরী, গোপালপুর), লিয়াকত (পিতা জনাব আলী প্রামানিক, টিকুরী), আকমল হোসেন (পিতা আব্দুল গণি, চকপৈলানপুর), গোলাম সরোয়ার খান সাধন (পিতা আব্দুল হামিদ খান, শালগাড়িয়া), দেলওয়ার হোসেন দিলু (পিতা ইসমাইল হোসেন, কৃষ্ণপুর), ফিরোজ (পিতা সেকেন্দার আলী, চকপৈলানপুর), তৌহিদ খান (পিতা মাদারন মিয়া, দক্ষিণ রাঘবপুর), নূরুল ইসলাম নূরু (পিতা কফিল উদ্দিন, শিবরামপুর), মহিউদ্দিন হায়দার (পিতা ছদর উদ্দিন আহমেদ, কাচরিপাড়া), মোহাম্মদ আলী বাবলু (পিতা সিরাজ উদ্দিন আহম্মেদ, কাচারিপাড়া), আনোয়ার হোসেন (পিতা শেখ মকবুল হোসেন, লস্করপুর), আমিরুল ইসলাম (পিতা আজিমুদ্দিন মিয়া, লস্করপুর), সেনা সদস্য ওসমান গণি (পিতা জাবেদ আলী মোল্লা, কোলাদি), সেনা সদস্য আনোয়ারুল হক (পিতা টুকু মিয়া, সিংগা), সেনা সদস্য আনছার আলী (পিতা হোসেন আলী মিয়া, শালগাড়িয়া), সেনা সদস্য আবুল ফজল (পিতা আব্দুস ছালাম, সিংগা), সেনা সদস্য মফিজ উদ্দিন (পিতা লাইস উদ্দিন, শিবরামপুর), বা.রা. খলিলুর রহমান (পিতা ড. আব্দুর রহমান, নারায়ণপুর), পুলিশ সদস্য আকরাম হোসেন (পিতা রহিম উদ্দিন আহমেদ, পাবনা), পুলিশ সদস্য গোলাম মওলা (পিতা কেরামত আলী, হেমায়েতপুর), পুলিশ সদস্য আব্বাস আলী (পিতা সোবান মিয়া, গোপালপুর), পুলিশ সদস্য ইমান আলী মোল্লা (পিতা সধু মোল্লা, কাচারিপাড়া) এবং মোয়াজ্জেম হোসেন (পিতা মোসলেম উদ্দিন, নাজিরপুর)। পাবনা সদর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে একাধিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। শহীদ এডভোকেট আমিনুদ্দিন পাবনা পৌরসভার চেয়ারম্যান ও এমপিএ ছিলেন। ২৬শে মার্চ পাবনা শহর থেকে পাকসেনারা তাঁকে গ্রেফতার করে এবং ২৭শে মার্চ গভীর রাতে নির্মম নির্যাতন শেষে গুলি করে হত্যা করে। তাঁর নামে পাবনা শহরে একাধিক প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে শহীদ আমিনুদ্দিন আইন কলেজ, শহীদ এডভোকেট আমিনুদ্দিন স্টেডিয়াম, শহীদ এডভোকেট আমিনুদ্দিন পৌর মিলনায়তন ও শহীদ আমিনুদ্দিন সড়ক।
পাবনা জেলা স্কুলের হেড মাওলানা ও জনপ্রিয় শিক্ষক মাওলানা কসিমুদ্দিন মুক্তিযুদ্ধের সূচনাকালে স্বেচ্ছাসেবকদের আধাসামরিক প্রশিক্ষণ দেন। ৬ই জুন পাবনা থেকে গ্রামের বাড়ি উল্লাপাড়া যাওয়ার পথে শহরের পূর্ব উপকণ্ঠ মোসলেম খাঁর তেমাথার চেকপোস্টে পাকসেনারা তাঁকে গাড়ি থেকে নামিয়ে নেয়। অমানবিক নির্যাতনের পর তাঁকে নূরপুর সেনা ছাউনিতে নেয়া হয়। এরপর সাঁথিয়া থানার মাধপুরে ইছামতি নদীর পাড়ে নিভৃত পল্লীতে বাঁশঝাড়ের মধ্যে ১০ই জুন তাঁকে হত্যা করা হয়। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পাবনাতে একাধিক প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়েছে। পাবনা শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত জালালপুর উচ্চ বিদ্যালয়টির নামকরণ করা হয় শহীদ মাওলানা কসিমুদ্দিন আহম্মদ উচ্চ বিদ্যালয়। ১৯৭৩ সালে পাবনা পৌরসভা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত রাঘবপুর নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়টির নামকরণ করা হয় শহীদ মাওলানা কসিমুদ্দিন আহম্মদ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়। পাবনা শহরের জেলা স্কুলের দক্ষিণ পাশের মনসেফ বাবু রোডটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় শহীদ মাওলানা কসিমুদ্দিন সড়ক। জেলা স্কুলের ছাত্রাবাসের নামকরণ করা হয় শহীদ মাওলানা কসিমুদ্দিন আহম্মদ ছাত্রাবাস এবং পাবনা মুসলিম ইনস্টিটিউটের নাম পরিবর্তন করে মাওলানা কসিমুদ্দিন আহমেদ স্মৃতিকেন্দ্র রাখা হয়।
পাবনা শহরের গোপালপুরের আবদুল আজিজ প্রামাণিকের ছেলে আবদুর রাজ্জাক রিদ্দিক ১৯৭১ সালে আলবদর ও পাকসেনাদের হাতে শহীদ হন। তিনি ছিলেন পাবনা সদর থানা মুজিব বাহিনীর লিডার। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পাবনা শহরের ইমব্যাংকমেন্ট রোডের নামকরণ করা হয়েছে শহীদ আবদুর রাজ্জাক রিদ্দিক সড়ক।
পাবনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, বীর মুক্তিযোদ্ধা, পাবনা জেলা মুজিব বাহিনীর প্রধান, স্বাধীনতার পরে সংসদ সদস্য প্রয়াত রফিকুল ইসলাম বকুলের স্মৃতি রক্ষার্থে পাবনা পৌরসভার উদ্যোগে ২০০৮ সালের ২৬শে মার্চ পাবনার টাউন হলের নামকরণ করা হয় বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুল পৌর মিলনায়তন। পাবনা স্টেডিয়ামের সুইমিং পুলের নামকরণ করা হয় বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুল সুইমিং পুল।
১৯৭১ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর ভোরে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ ও রাজাকার মধু মৌলবির সহায়তায় পাকসেনারা সুজানগর থানার সাগরকান্দি গ্রাম থেকে গোলাম সারোয়ার খান সাধন ও তাঁর কয়েকজন সঙ্গীকে নগরবাড়ি ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায়। এরপর অমানুষিক নির্যাতন করে লোহার তার দিয়ে তাঁর হাত-পা বেঁধে যমুনা নদীতে ফেলে দেয়। ফলে তাঁর করুণ মৃত্যু হয়। স্বাধীনতা উত্তরকালে সঙ্গীত শিল্পী শহীদ সাধনের স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয় শহীদ সাধন সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়।
সুজানগর উপজেলার ভাটি কয়া গ্রামের আব্দুস শুকুর মিয়ার পুত্র শামসুল আলম বুলবুলের স্মরণে ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাবনা ইসলামিয়া কলেজের নামকরণ করা হয় শহীদ বুলবুল কলেজ। এই কলেজের ছাত্রদের মধ্যে শামসুল আলম বুলবুল প্রথম শহীদ হন। সেজন্য তাঁর নামে কলেজের নামকরণ করা হয়।
কুচিয়ামোড়া গ্রামের জনহিতৈষী জমিদার সুধীরচন্দ্রকে পাকসেনারা নির্মমভাবে হত্যা করে। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে কুচিয়ামোড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয় সুধীরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ স্মৃতি স্মারক হিসেবে পাবনার রাজাপুরে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টির নামকরণ করা হয় শহীদ স্মরণিকা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়।
আটঘরিয়া উপজেলার কৈজুরী শ্রীপুর গ্রামের সাধক ও বাউল শিল্পী ওস্তাদ এম এ গফুরকে আগস্ট মাসে পাকসেনারা নির্মমভাবে হত্যা করে। এ সাধক বাউল শিল্পীর নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শহীদ এম এ গফুর সঙ্গীত একাডেমি। স্বাধীনতা উত্তরকালে পাবনা শহরের মোজাহিদ ক্লাবের পাশে ১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টির নামকরণ করা হয় শহীদ ফজলুল হক পৌর উচ্চ বিদ্যালয়। শহীদ মতিয়ার রহমান মতি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর থানার খাস-সাতবাড়িয়া গ্রামের শফিউদ্দিন সরকারের পুত্র। তিনি পাবনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১৪ অক্টোবর রাজাকাররা তাঁকে পাবনার কুচিয়ামোড়া নামক স্থানে হত্যা করে মাটিচাপা দেয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাঁর নামে পাবনা শহরের দিলালপুর মহল্লায় প্রতিষ্ঠা করা হয় শহীদ মতি স্মৃতি সংঘ ক্লাব। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পল্টুর নামে পাবনা শহরের গোপালপুরে প্রতিষ্ঠিত হয় শহীদ পল্টু ক্লাব। পাবনা শহরের আটুয়া মহল্লায় স্থাপিত হয় শহীদ স্মৃতি পাঠাগার। পাবনা শহরের প্রাণকেন্দ্রে জেলা প্রশাসন অফিসের পাশে স্থাপন করা হয় দুর্জয় পাবনা – ভাস্কর্য। এটি পাবনার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্মারক হিসেবে গৌরব বহন করে চলেছে। ১১ই এপ্রিল বিকেলে পাবনা শহরে পুনরায় পাকবাহিনী প্রবেশ করে গোপালপুরে রক্ষাকালী মন্দিরের সম্মুখ থেকে ২০-২৫ জন নিরীহ মানুষকে নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা করে। এই শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে নির্মিত হয় গোপালপুর শহীদ সমাধি ও স্মৃতিসৌধ। মুক্তিযুদ্ধে পাবনায় কর্মরত অনেক পুলিশ সদস্য শহীদ হয়েছিলেন। তাঁদের স্মরণে পাবনা পুলিশ প্যারেড ময়দানে নির্মাণ করা হয় শহীদ পুলিশ স্মৃতিসৌধ।
পাবনা শহরের প্রবেশপথে ঢাকা রোডের দক্ষিণ পাশে বাস টার্মিনালের পূর্ব প্রান্তে পাবনা জেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে একটি শহীদ স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে। এতে পাবনা জেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নাম লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। ২৯শে মার্চ পাকসেনারা পাবনা থেকে পালানোর সময় সেনাবহরের সঙ্গে সর্বস্তরের মুক্তিকামী জনতার যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে ১০-১১ জন বীর বাঙালি শহীদ হন। এই শহীদদের স্মরণে মাধপুরে নির্মিত হয় শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ। ৭ই অক্টোবর পাবনার কুচিয়ামোড়ায় মুক্তিযোদ্ধা মতিয়ার রহমান মতি, আবদুল মান্নান ও পল্টু মোহন চৌধুরীকে রাজাকাররা হত্যা করে মাটিচাপা দেয়। এই শহীদদের স্মরণে নির্মাণ করা হয়েছে কুচিয়ামোড়া শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ। পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মাণ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ভাস্কর্য স্বাধীনতা চত্বর। বাঙালির স্বাধিকার সংগ্রাম থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল ঘটনাপ্রবাহ এই ভাস্কর্যের মূল প্রতিপাদ্য। [মো. হাবিবুল্লাহ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!