You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.23 | পারকুমিরা গণহত্যা (তালা, সাতক্ষীরা) - সংগ্রামের নোটবুক

পারকুমিরা গণহত্যা (তালা, সাতক্ষীরা)

পারকুমিরা গণহত্যা (তালা, সাতক্ষীরা) সংঘটিত হয় ২৩শে এপ্রিল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এ জঘন্য গণহত্যায় ৭৯ জন নিরীহ মানুষ শহীদ হন।
পারকুমিরার অবস্থান সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার পাটকেলঘাটা থানার ১ কিমি উত্তরে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পারকুমিরায় দাতব্য স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সামনে এ বর্বরোচিত গণহত্যাটি সংঘটিত করে। তারা তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকারদের সহযোগিতায় এ নারকীয় গণহত্যা চালায়। এ হত্যাকাণ্ডে স্থানীয় গ্রামবাসী ও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা শরণার্থীসহ মোট ৭৯ জন শহীদ হন। এ-সময় তারা অনেকগুলো ঘরবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ করে।
পাটকেলঘাটা বাজারে মনু কসাই নামে একজন অবাঙালি রুটি বিক্রেতা ছিল। পাকিস্তানি বাহিনীর হয়ে সে কাজ করত। মনু কসাই এবং তার ভাগ্নে মানিক কসাই এবং স্থানীয় কয়েকজন রাজাকার পাটকেলঘাটার খবরাখবর সাতক্ষীরায় অবস্থানকারী পাকিস্তানি বাহিনীর নিকট পাঠাত। ইতোমধ্যে পুটিয়াখালীর আওয়ামী লীগ নেতা শেখ আবদুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারণা শুরু হলে পাটকেলঘাটার সকল অধিবাসী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ শুরু করে।
২৫শে মার্চ হানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করে। দলমত নির্বিশেষে স্বাধীনতার পক্ষের সবাই এ গণহত্যার শিকার হলেও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন তাদের প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন প্রাণের ভয়ে ভারতে আশ্রয়ের জন্য ছুটতে থাকে। ২২শে এপ্রিল খুলনার হিন্দু অধ্যুষিত ফুলতলা এলাকার দক্ষিণডিহি ও যশোরের নওয়াপাড়া এলাকা থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের বেশকিছু মানুষ ভারতে যাওয়ার পথে পারকুমিরায় আশ্রয় নেয়। এদিন সাতক্ষীরায় অবস্থানরত হানাদার বাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় সীমান্তে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধযুদ্ধ হয়। এতে হানাদার বাহিনী টিকে থাকতে না পেরে খুলনার দিকে পিছু হটে। ২৩শে এপ্রিল পাকবাহিনী পাটকেলঘাটায় পৌঁছলে মনু কসাই, মানিক কসাই এবং স্থানীয় রাজাকাররা তাদের এখানকার আওয়ামী লীগের কার্যক্রম এবং শরণার্থীদের আশ্রয়ের খবর জানিয়ে দেয়। তারা পাকিস্তানি বাহিনীকে পারকুমিরায় ডেকে নিয়ে আসে।
বেলা ১২টার দিকে হানাদার বাহিনী ৪টি গাড়ি নিয়ে পাটকেলঘাটা বাজারে আসে। তারা মনু কসাইকে সঙ্গে নিয়ে কালীবাড়ি রোড হয়ে সরুলিয়া ও কাশিপুর রাস্তার সংযোগস্থলে ন্যাড়া বটতলা নামক স্থানে গাড়ি রেখে ২ ভাগে বিভক্ত হয়। একদল পায়ে হেঁটে পারকুমিরার উত্তরপাড়ায় যায়। সেখানে খুলনার ফুলতলা এলাকার দক্ষিণডিহি ও যশোরের নওয়াপাড়া এলাকা থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের বেশকিছু মানুষ ভারতে যাওয়ার জন্য আশ্রয় নিয়েছিল। হানাদার বাহিনীর আগমনের খবর পেয়ে আশ্রিতরা উত্তর দিকে দৌড়াতে থাকে। এ-সময় কেউ-কেউ উত্তরপাড়ার একটি বড় গাছে উঠে আশ্রয় নেয়। হানাদার বাহিনীর দলটি প্রথমে গোষ্ঠ কুণ্ডুর বাড়িতে প্রবেশ করে তাকে হত্যা করে। তারা এ বাড়িতে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের গুলি করে। এতে শিশুসহ ৪ জন শহীদ হয়। এরপর তারা গাছে লুকিয়ে থাকা আরো কয়েকজনকে গুলি করে হত্যা করে। বাঁশবাগান থেকে কয়েকজনকে ধরে এনে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে এবং গুলি করে হত্যা করে। ফিরে যাওয়ার সময় তারা পাগল কুণ্ডুর পুত্র ষষ্ঠী কুণ্ডুকে গুলি করে হত্যা করে। এখানে ১৭ জন মানুষ তাদের হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।
হানাদারদের অপর দলটি পুটিয়াখালী গ্রামের দিকে যায়। তারা পুটিয়াখালী গ্রামে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ আবদুর রহমান ও তার জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ জালাল উদ্দীনসহ কয়েকজনকে ধরে পারকুমিরার কুণ্ডু বাড়িতে নিয়ে আসে। জুম্মার নামাজের পর অতি উৎসাহী কিছু মুসলমান কুণ্ডু বাড়ির ঘটনা দেখার জন্য সেখানে গেলে তাদেরও তারা বেঁধে ফেলে। তাদের সকলকে একত্রিত করে পশ্চিম দিকে পারকুমিরা দাতব্য চিকিৎসালয়ের সামনে এনে গুলি করে হত্যা করা হয়।
পাকবাহিনী ফিরে আসার সময় পাটকেলঘাটা বাজারের বিশিষ্ট ধান ব্যবসায়ী শেখ হায়দার আলীকে হিন্দু বাড়ি দেখিয়ে আগুন দেয়ার নির্দেশ দেয়। হায়দার আলী অস্বীকৃতি জানালে গায়ে পাট জড়িয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে তাকে হত্যা করে। পারকুমারি গণহত্যায় সকল শহীদের নাম জানা যায়নি। যাদের নাম জানা গেছে, তারা হলেন- পুটিয়াখালী গ্রামের শেখ আবদুর রহমান (পিতা আলহাজ্ব শেখ কছিমুদ্দীন), শেখ জালাল উদ্দীন (পিতা শেখ আবদুর রহমান), শেখ শামছুর রহমান (পিতা শেখ শাহাবুদ্দীন), শেখ বদর উদ্দীন, (পিতা শেখ আকিম উদ্দীন), সালামত আলী মল্লিক (পিতা তরফ মল্লিক), শেখ ফজলুর রহমান (পিতা শেখ সাইফুল ইসলাম), শেখ আজিজুর রহমান (পিতা শেখ আলী বক্স), শেখ বিলায়েত আলী (পিতা শেখ রহিম বক্স), শেখ আব্দুল জব্বার মোড়ল (পিতা শেখ কাদের মোড়ল), শেখ সাজ্জাত আলী (পিতা শেখ ওয়াজেদ আলী), শেখ অজিয়ার রহমান (পিতা শেখ করম আলী), শেখ শামছুর ছাইদুর রহমান, পাঁচবাড়িয়া), আছাতন বিবি (স্বামী শাহ চাঁদ, পাঁচবাড়িয়া), খেয়ালা প্রামাণিক (পিতা আবদুল কাদের প্রামাণিক, পাঁচবাড়িয়া), বিল্টু বিশ্বাস (পিতা গৌরচন্দ্র বিশ্বাস, পাঁচবাড়িয়া), দুলাল বিশ্বাস (পিতা হরিপদ বিশ্বাস, পাঁচবাড়িয়া), শাহ চাঁদ ও জাগাদ্দিন। [শফিউদ্দিন তালুকদার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড