You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.08.15 | পারুলিয়া ব্রিজ অপারেশন (দেবহাটা, সাতক্ষীরা) - সংগ্রামের নোটবুক

পারুলিয়া ব্রিজ অপারেশন (দেবহাটা, সাতক্ষীরা)

পারুলিয়া ব্রিজ অপারেশন (দেবহাটা, সাতক্ষীরা) পরিচালিত হয় ১৫ই আগস্ট। এতে ৪ জন রাজাকার নিহত হয়।
সাতক্ষীরা-কালিগঞ্জ সড়কের মধ্যবর্তী স্থানে পারুলিয়া গ্রামটি অবস্থিত। পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা সাপমারা খাল পারুলিয়া ও সখিপুরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। খালের দক্ষিণ পাশে সখিপুর এবং উত্তর পাশে পারুলিয়া গ্রাম। গ্রামদুটি এবং সংশ্লিষ্ট বাজারকে সাপমারা খালের ওপর অবস্থিত একটি কাঠের পুল যুক্ত করেছে। পুলটির ওপর দিয়ে বাস, ট্রাক অনায়াসে যাতায়াত করত। পুলটি মহকুমা শহর সাতক্ষীরা থেকে কালিগঞ্জ ও শ্যামনগর যাওয়ার ক্ষেত্রে একমাত্র যোগসূত্র এবং যোগাযোগের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পুলটি ভেঙে দিতে পারলে দেবহাটা, কালিগঞ্জ ও শ্যামনগরে অবস্থানকারী পাকসেনারা মহকুমা শহর সাতক্ষীরা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। এ কথা চিন্তা করে মুক্তিবাহিনী এ পুলটি ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেন। পক্ষান্তরে পাকবাহিনী পুলটি রক্ষার জন্য সর্বপ্রকার প্রচেষ্টা নেয়। পুলের দু-প্রান্তে পরিখা খনন করে সেখানে পাকসেনা এবং রাজাকাররা দিনরাত পাহারা দিত। ১৫ই আগস্ট সাব-সেক্টর কমান্ডার লে. মাহফুজ আলম বেগের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পারুলিয়া ব্রিজে এক অভিযান পরিচালনা করেন। অভিযানে অংশগ্রহণ করেন পাইকগাছার (খুলনা) স ম বাবর আলী, মোশাররফ হোসেন মশু (পারুলিয়া) এবং ভারতীয় ন্যাশনাল ক্যাডেট কোরের দুজন বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞসহ মোট ১১ জন। ইতঃপূর্বে আরো দুবার পারুলিয়া ব্রিজটি ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়। তন্মধ্যে ৬ই জুন রাতে একটি অভিযান চালানো হয়। সেদিন ভারতের টাকি অপারেশন ক্যাম্প থেকে তিনটি দল তিনটি আলাদা অপারেশনে অংশগ্রহণের জন্য ইছামতি নদী পার হয়। একটি দলের ওপর দায়িত্ব পড়ে পারুলিয়া ব্রিজ ধ্বংসের। এর চেষ্টাও হয়। কিন্তু অভিযানটি সফল হয়নি। যশোরের ফজলুর রহমান নামক একজন দুঃসাহসিক মুক্তিযোদ্ধার নেতৃত্বে অপর একটি প্রচেষ্টা নেয়া হয়। তিনি তাঁর কয়েকজন সঙ্গীসহ পারুলিয়া ব্রিজের কয়েকশ গজ দূরে উপস্থিত হন এবং একটা বড় খড়ের গাদার ওপর বিস্ফোরক রেখে সেটাকে খালের পানিতে ভাসিয়ে অনুকূল স্রোতে ব্রিজের কাছাকাছি নেন। বিস্ফোরকের সঙ্গে বাঁধা দড়ি তার হাতেই ছিল। ব্রিজের ওপর সারাক্ষণই সশস্ত্র রাজাকারদের প্রহরা থাকায় নানা কৌশলে রাজাকারদের চোখে ধুলো দিয়ে তিনি নিজে একটি মাঝারি ধরনের খড়ের গাদা পানিতে ভাসিয়ে তার নিচে আত্মগোপন করে ওই বিস্ফোরকের নিকট উপস্থিত হন এবং ব্রিজে বিস্ফোরক স্থাপন করে ফিরে এসে তাতে আগুন লাগিয়ে দেন। বিস্ফোরণ ঘটে বটে, তবে ব্রিজের তেমন ক্ষতি হয়নি সাব-সেক্টর কমান্ডার লে. মাহফুজ আলম বেগের নেতৃত্বে তৃতীয় বারের মতো ব্রিজটি ধ্বংসের অপারশেন পরিচালিত হয়। এ লক্ষ্যে ভারতের টাকি থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ইছামতি নদী পার হয়ে পারুলিয়ায় আসেন। মাহফুজ বেগ তাঁর দলকে ব্রিজ থেকে ৫০০ গজ দূরে একটি স্থানে কভারিং ফায়ারের জন্য রেখে একাই সাপমারা খালে নেমে পড়েন এবং অতি ধীরে ব্রিজের নিচে চলে যান। ব্রিজের ওপর বরাবরের মতো রাজাকারদের সশস্ত্র প্রহরা ছিল। রাতের অন্ধকারে তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে তিনি ব্রিজের তলায় বিস্ফোরক লাগিয়ে ৫০০ গজ দূরে কর্ড নিয়ে যান। তারপর এক পর্যায়ে আগুন দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটান। বিকট আওয়াজে কাঠের পুলটি ভেঙে পড়ে। পাকসেনারা হতভম্ব হয়ে যায়। পুলের ওপর প্রহরারত ৪ জন রাজাকার নিহত হয়। অন্যরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই লে. বেগ দ্রুত তাঁর দলের অপেক্ষামাণ মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ফিরে আসেন। এরপর শুরু হয় পাকসেনা ও রাজাকারদের একটানা গুলিবর্ষণ। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা গুলিবর্ষণ করতে-করতে স্থান ত্যাগ করেন।
পারুলিয়া ব্রিজ ধ্বংস করার ফলে পাকবাহিনীর যোগাযোগ ব্যবস্থায় মারাত্মক বিঘ্ন ঘটে। তারা খুবই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তাদের ধারণা খালপাড়ের খেজুরবাড়িয়া গ্রামের ঝোপ- জঙ্গলের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা লুকিয়ে থাকে এবং ঐ গ্রামের মানুষ তাদের আশ্রয় দেয়। তাই পরদিন খেজুরবাড়িয়া গ্রামের বহু ঘরবাড়ি তারা জ্বালিয়ে দেয় এবং স্থানীয় মানুষকে গাছপালা ঝোপ-জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করার নির্দেশ দেয়। [সিরাজুল ইসলাম]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড