You dont have javascript enabled! Please enable it!

পানপট্টি যুদ্ধ (গলাচিপা, পটুয়াখালী)

পানপট্টি যুদ্ধ (গলাচিপা, পটুয়াখালী) সংঘটিত হয় ১৮ই নভেম্বর। মুক্তিযুদ্ধের সময় পটুয়াখালী সাব-সেক্টরকে ভাগ করে এক বা একাধিক থানা নিয়ে কয়েকটি জোনে ভাগ করা হয়েছিল। প্রত্যেকটি জোনে একজন করে কমান্ডার নিয়োগ করা হয়। পটুয়াখালী ও গলাচিপা থানা নিয়ে গঠিত জোনের কমান্ডার ছিলেন বাউফল উপজেলার নওমালা গ্রামের কে এম নুরুল হুদা (বর্তমান সিইসি) এবং তাঁর সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ছিলেন হাবিবুর রহমান শওকত। তিনি ছিলেন তখন ছাত্র গলাচিপা উপজেলার অন্তর্গত পানপট্টি ইউনিয়ন পরিষদের একটি সাইক্লোন শেল্টারে নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা কমান্ডার কে এম নুরুল হুদা ও ডেপুটি কমান্ডার হাবিবুর রহমান শওকতের নেতৃত্বে একটি ক্যাম্প স্থাপন করেন। ১৭ই নভেম্বর রাত আনুমানিক ১০টার দিকে হঠ্যাৎ ফল-ইনের বাঁশি বেজে ওঠে। মুহূর্তের মধ্যে ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধারা সাইক্লোন শেল্টারের সামনের মাঠে ফল-ইনে যান। কমান্ডার ও ডেপুটি কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত ব্রিফিং দিয়ে তাঁদের দুগ্রুপে ভাগ করে দেন। এক গ্রুপের নেতৃত্ব দেন কমান্ডার নুরুল হুদা স্বয়ং এবং অপর গ্রুপের নেতৃত্ব দেন কমান্ডার হাবিবুর রহমান। রাত ১১টার দিকে উভয় গ্রুপ গলাচিপা থানা আক্রমণের উদ্দেশ্যে ক্যাম্প থেকে রওনা হয়। পানপট্টি ইউনিয়নের জয়মানিক গ্রাম ও গলাচিপা সদর ইউনিয়নের মুরাদ নগরের মধ্য দিয়ে বোয়ালিয়া নদী প্রবাহিত। এটি পারাপারে একমাত্র মাধ্যম ছিল ছোট্ট একটি খেয়া নৌকা। একসঙ্গে ৭-৮ জনের বেশি এতে পার হওয়া সম্ভব ছিল না। তাই মুক্তিযোদ্ধাদের নদী পার হতে অনেক সময় লাগে। এরপর ৭-৮ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে গলাচিপা শহরের দক্ষিণ উপকণ্ঠে পৌঁছলে কমান্ডারদ্বয় সবাইকে প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দেন। এ-সময় গোমেজ নামে এক মুক্তিযোদ্ধার এসএলআর থেকে অসাবধানতাবশত একটি গুলি বেরিয়ে যায়। এ মিসফায়ারে পাকবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর ও শান্তি কমিটি-র লোকেরা মুক্তিযোদ্ধাদের আগমনবার্তা টের পেয়ে যায়। প্রতিপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে ৪ রাউন্ড গুলি ছোড়ে। এমতাবস্থায় কমান্ডারদ্বয় শত্রুদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে যথাসময়ে খবর দেয়ার জন্য স্থানীয় একজন মুক্তিযোদ্ধাকে গলাচিপা শহরের নিজ বাসায় রেখে বাকি সকলকে নিয়ে পানপট্টি ক্যাম্পে ফিরে আসেন। ঐ মুক্তিযোদ্ধা প্রত্যুষেই শত্রুদের তৎপরতা টের পেয়ে সমস্ত প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে হানাদারদের মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প আক্রমণের প্রস্তুতির খবর মুক্তিবাহিনীর কাছে পৌঁছে দেন। এ খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের প্রতিহত করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। তাঁরা কমান্ডারদের নির্দেশ অনুযায়ী ৪টি গ্রুপে ভাগ হয়ে এম্বুশ রচনা করে হানাদারদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। ঐ সময় পটুয়াখালী জেলা সদরে পাকসেনাদের বিশাল একটি বাহিনী অবস্থান করছিল, যার নেতৃত্বে ছিল পাকিস্তানি মেজর ইয়ামিন। ১৮ই নভেম্বর ভোররাতে সে তার বাহিনী নিয়ে গলাচিপা সদর হয়ে পানপট্টি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প আক্রমণের উদ্দেশে রওনা দেয়। এ বাহিনীতে প্রশিক্ষিত পাকসেনাই ছিল ৩৭৫ জন। এছাড়া আরো ছিল কয়েকশ রাজাকার ও আলবদর। রাতের আঁধারে চারদিক থেকে একযোগে হামলা চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প ধ্বংস করাই ছিল পাকসেনাদের উদ্দেশ্য। কিন্তু বিচ্ছু বাহিনী-র কারণে তাদের সে আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি। সাইক্লোন শেল্টারে ক্যাম্প স্থাপনের পরপরই কে এম নুরুল হুদা মশিউর রহমান বাবুল ও খোকনসহ কয়েকজন শিশু-কিশোর নিয়ে একটি ‘বিচ্ছু বাহিনী’ গড়ে তোলেন। নিয়মিত যুদ্ধের পাশাপাশি এ বাহিনীর সদস্যরা গুপ্তচরের কাজ করত। বিচ্ছু বাহিনীর সদস্যরা বয়সে এতটাই ছোট ছিল যে, পাকসেনা বা তাদের দোসররা কখনো তাদের সন্দেহ করত না। এ বাহিনীর সদস্যরা খেলাধুলার ছলে কিংবা ব্যাগভর্তি হাটবাজারের সওদা নিয়ে অনায়াসে থানার ভেতর পাকসেনাদের ঘাঁটিতে ঢুকে যেত এবং গোপন খবর নিয়ে আসত। বিচ্ছু বাহিনীর এমন এক সদস্য লেখক স্বয়ং ভোররাতে তীব্র শীতের মধ্যে নদী সাঁতরে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে পাকসেনাদের অভিযানের খবর পৌঁছে দেয়, যে কারণে পাকসেনাদের আকস্মিক অভিযানের প্রথম পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। পাকসেনাদের পৌঁছানোর আগেই মুক্তিযোদ্ধারা চারদিকে সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান নেন।
সকাল সাড়ে ৬টার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধের প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন করেন। কমান্ডার হাবিবুর রহমান বাইনোকুলার নিয়ে সাইক্লোন শেল্টারের দোতলার ছাদে উঠে পাকসেনাদের গতিবিধি লক্ষ করেন এবং সে মোতাবেক মুক্তিযোদ্ধাদের নির্দেশ দেন। সুশীল, ভূদেব, রবীন্দ্রনাথ হালদার, মো. কাওসার, কুণ্ডু ও গোমেজের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপ ক্যাম্পের পশ্চিম পাশে অবস্থান নেয়। কামান্ডার নুরুল হুদার নেতৃত্বে আরেকটি গ্রুপ পশ্চিম-উত্তর কোণে খালের পাড়ে নিচু জায়গায় ছৈলা গাছের আড়ালে অবস্থান নেয়। কমান্ডার হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন গ্রুপটি উত্তর দিকের রাস্তার পাশে পজিশন নেয়। অন্যরাও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়ে দুর্ভেদ্য প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
পাকসেনারাও চারটি গ্রুপে ভাগ হয়। তাদের একটি গ্রুপ সাইক্লোন শেল্টারের পশ্চিম পাশ দিয়ে দক্ষিণ দিকে এগিয়ে আসে। দুটি গ্রুপ পশ্চিম দিকের একটি বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ে। চতুর্থ গ্রুপটিতে ছিল ৭০-৮০ জন পাকসেনা। তাদের সবার হাতে আধুনিক অস্ত্র। এর বিপরীতে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্বল কেবল একটি এলএমজি, কয়েকটি এসএলআর, থ্রি- নট-থ্রি রাইফেল আর গ্রেনেড। মুক্তিযোদ্ধা রবীন্দ্রনাথ হালদার তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে গাছ-লতাপাতার আড়ালে একটি বাঁধের ওপর অবস্থান নেন। সকাল ৮টার দিকে ২৫-৩০ জন পাকসেনা সেদিকে অগ্রসর হতে থাকে। তারা বাঁধের ওপর উঠতেই মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র গর্জে ওঠে। ঘটনার আকস্মিকতা কাটিয়ে ওঠার আগেই ৬ জন পাকসেনা ও দুজন পুলিশ গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ে। এতে পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। বেলা ১টার দিকে পাকসেনারা তিনদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ঘিরে ফেলে। তারা ক্যাম্প লক্ষ করে ৬টি মর্টার শেল নিক্ষেপ করে। তার মধ্যে একটি শেল সাইক্লোন শেল্টার থেকে ৩০ ফুট দূরত্বে খালি স্থানে পড়ে বিস্ফোরিত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা গুলিবর্ষণ করেন। শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। এক পর্যায়ে মেজর ইয়ামিন মুক্তিযোদ্ধাদের মাত্র এক হাজার গজের মধ্যে এসে পড়ে। এর মধ্যেও একের পর এক পাকসেনা গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়তে থাকে। তাদের আর্তচিৎকারে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল আরো বেড়ে যায়। তাঁদের ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। সন্ধ্যার দিকে নিশ্চিত পরাজয় জেনে এবং নিজের জীবন বাঁচাতে মেজর ইয়ামিন মাটিতে শুয়ে পড়ে এবং প্রায় এক মাইল ক্রলিং করে নদীর তীরে গিয়ে ওঠে। সেখানে আগে থেকে প্রস্তুত করা ছিল স্পিডবোট। পালানোর আগ মুহূর্তে সে দলের অপর সেনা ও রাজাকারআলবদরদের এই বলে আশ্বস্ত করে যে, পটুয়াখালী থেকে আরো সৈন্য নিয়ে সে ফিরে আসবে। কিন্তু সে আর ফেরেনি। সন্ধ্যার মধ্যে যুদ্ধ চূড়ান্ত রূপ লাভ করে।
পানপট্টির এ-যুদ্ধে পাকসেনা ও রাজকাররা ব্যাপকভাবে হতাহত হলেও মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ মারাত্মকভাবে আহত হননি। একটি গুলি রবীন্দ্রনাথ হালদারের ডানহাত ভেদ করে বেরিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা দূর থেকে পাকসেনা ও তাদের দোসরদের বেশ কিছু লাশ পড়ে থাকতে দেখেন। সমগ্র পটুয়াখালী জেলায় পানপট্টির এ-যুদ্ধই ছিল পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সবচেয়ে বড় সম্মুখ যুদ্ধ। এ যুদ্ধে প্রশিক্ষিত ৪২ জন মুক্তিযোদ্ধা অংশগ্রহণ করেন। তারা হলেন— ইউনিট কমান্ডার কে এম নূরুল হুদা (বাউফল, পটুয়াখালী), সামরিক কমান্ডার ও ইউনিটের ডেপুটি কমান্ডার হাবিবুর রহমান শওকত (পটুয়াখালী), রবীন্দ্রনাথ হালদার (চরপাড়া, পটুয়াখালী), বাউফল উপজেলার মো. সুলতান আহম্মেদ, মো. শফিজ উদ্দিন, মোসলেম খলিফা, হাবিবুর রহমান হাবিব, মো. ইউছুফ (নওমালা), মো. আতাহার তালুকদার (নওমালা), মো. মুনছুর, গলাচিপা উপজেলার আ. কাদের বিশ্বাস (বকুলবাড়িয়া), গোলাম মোস্তফা টিটো (পানপট্টি), ফোরকান (পানপট্টি), শফিকুল ইসলাম (পানপট্টি), বাকু মিয়া (পানপট্টি), কাওসার (পানপট্টি), ভুদেব কর্মকার (বেতাগী), গোমেজ বাসন্ডা (বেতাগী), মতিউর রহমান (পাড়ের হাট), খোকন (আলীপুরা, দশমিনা), মন্মথ গাইন (চরদোয়ানী), মো. আবু তালেব (খেপুপাড়া), মো. রফিক মিয়া (খুলনা), টুনু মিয়া (খুলনা), আমিন (দশমিনা), শিশির বিশ্বাস (লোহালিয়া), সেনাসদস্য আ. মজিদ (বানারিপাড়া, বরিশাল), আবুল (নাজিরপুর, পিরোজপুর), জাহাঙ্গীর (নাজিরপুর, পিরোজপুর), সুনীল (বরগুনা), আ. লতিফ (বামনা, বরগুনা), ঝালকাঠী জেলার বলরাম কুণ্ড, প্রশান্ত বিশ্বাস, অমল, সেনাসদস্য ফজলুল হক (নবগ্রাম), ঝালকাঠী জেলার নলছিটি উপজেলার আলী আকবর মাস্টার, মো. শাহজাহান, আদম আলী, আ. হাকিম, নজরুল ইসলাম, মো. আলম মিয়া ও আ. মন্নান।
পানপট্টীর এ-যুদ্ধ পটুয়াখালী অঞ্চলে আজো স্মরণীয় হয়ে আছে। সেদিন অল্প কয়েকজন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা যে বীরবিক্রমে একটি সশস্ত্র বাহিনীকে নির্মমভাবে পরাজিত করেছিল, তা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অসাধারণ ঘটনা। এখানে একটি মুক্তিযুদ্ধ ‘বিজয় স্মৃতিস্তম্ভ’ নির্মাণ করা হয়েছে। [মশিউর রহমান বাবুল]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!