You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে পানছড়ি উপজেলা (খাগড়াছড়ি) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে পানছড়ি উপজেলা (খাগড়াছড়ি)

পানছড়ি উপজেলা (খাগড়াছড়ি) খাগড়াছড়ি জেলা শহরের উত্তর সীমান্তে অবস্থিত। ১৯৭৬ সালের ১লা অক্টোবর এটি থানার স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৭১ সালের মার্চের অসহযোগ আন্দোলন-এর সময় এ উপজেলার পাহাড়ি-বাঙালি নির্বিশেষে সর্বস্তরের জনগণ পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়। তারা বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ শুনে স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত হয় এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে অনুপ্রেণা লাভ করে।
২৫শে মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট-এর নামে পাকবাহিনী পূর্ব বাংলার নিরস্ত্র মানুষের ওপর হত্যা ও নির্যাতন শুরু করলে পানছড়ির অনেকে মাটিরাঙ্গার তবলছড়ি সীমান্ত দিয়ে ভারতের শিলাছড়ির ফেনী নদীর তীরে আশ্রয় নেয়। এদিকে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য এলাকার তরুণ- যুবকদের একটি দল হরিনার (রাঙ্গামাটি) তেল্লেমুড়ার অম্পিনগরে সমবেত হয়। সেখানে তারা ২৯ দিনের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণশেষে ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা ভারতের শিলাছড়িতে গিয়ে অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করেন। ভারত সরকার তাঁদের উচ্চতর প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রের ব্যবস্থা করে। এই ক্যাম্প থেকে তাঁরা পানছড়িসহ খাগড়াছড়ির বিভিন্ন স্থানে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করেন। যুদ্ধ পরিচালনার জন্য তাঁরা পাঁচটি কোম্পানি গঠন করেন, যেমন— আলফা কোম্পানি, ব্রাভো কোম্পানি, ইকো কোম্পানি, চার্লি কোম্পানি এবং ডেলটা কোম্পানি।
উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার ছিলেন শনটিলার মো. সিরাজ মিয়া। পেশায় তিনি ছিলেন একজন কৃষক। তিনি তেল্লেমুড়ায় ২৯ দিন প্রশিক্ষণ নিয়ে ভারতের শিলাছড়িতে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তিনি পানছড়ি ছাড়াও খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটির একাধিক স্থানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনী ও রাজাকারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধসমূহের মধ্যে পানছড়ির গাছবাগান যুদ্ধ – উল্লেখযোগ্য।

পাকবাহিনী এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে পানছড়িতে প্রবেশ করে এবং পানছড়ি থানাসংলগ্ন পুরাতন হাসপাতাল এলাকায় স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে। এছাড়া কানুনগোপাড়া, ভাইবোনছড়া ও কুকিছড়াতেও তাদের ক্যাম্প ছিল। এসব ক্যাম্প থেকে তারা পানছড়ির বিভিন্ন গ্রামে ধ্বংসলীলা চালায়। পানছড়ি উপজেলায় রাজাকাররা পাকবাহিনীর সহযোগী হিসেবে কাজ করে। রাজাকারদের মধ্যে শহিদুল হক (পাইলট ফার্ম), মো. হানিফ (শনটিলা), সরোয়ার মেম্বার (কলাবাগান), আহম্মদ সৈয়দ (আয়ুবনগর বাজার) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। পাকবাহিনী ও রাজাকাররা পানছড়ি বাজার ও তৎসংলগ্ন গ্রাম, দমদম গ্রাম, মির্জাটিলা, ছোটকর্মাপাড়া, শনটিলা, পূজগাং, লোগাং, দেবেন্দ্র পাড়া ও লতিবানছড়ায় হত্যা, নির্যাতন, নারীধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠন করে। রাজাকার ও পাকবাহিনী শনটিলা গ্রামের নিরীহ দুদু মিয়াকে (দুদু মাঝি) হাত-পা বেঁধে উল্টোভাবে গাছে ঝুলিয়ে নির্যাতনের পর হত্যা করে। আরব আলী নামে অপর একজনকে তারা গুলি করে হত্যা করে। রাতের অন্ধকারে পানছড়ি বাজারে অগ্নিসংযোগ করলে অনেক নিরীহ মানুষ জীবন্ত দগ্ধ হয়। রাজাকার বাহিনী বহু নারীকে পাকসেনাদের হাতে তুলে দেয়। এছাড়া অনেক সাধারণ মানুষকে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে।
পানছড়ি উপজেলার মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে মো. ইদ্রিস মিয়া (পিতা কালা মিয়া, পূজগাং মৌজা), জুলফু মিয়া (পিতা লাতু মিয়া, পানছড়ি), মো. আনোয়ার আলী (পিতা মো. সুজত আলী, তালুকদার পাড়া), নোয়াব আলী (পিতা আলী আজম, পানছড়ি), আলী আহাম্মদ (পিতা মো. সফর আলী, শনটিলা), মো. শেখ আহাম্মদ (পিতা জমিদার মিয়া, পাইলট ফার্ম), শিশু মিয়া (পিতা আবুল কাশেম, ইসলামপুর), আব্দুছ ছোবহান (পিতা আকমত আলী, দমদম), মো. মনছুর আহাম্মদ (পিতা আলতাফ হোসেন, পানছড়ি), দিলীপ বড়ুয়া (পিতা লহড়ী বড়ুয়া, পানছড়ি), মো. সিরাজ মিয়া (পিতা আলী আহাম্মদ, শনটিলা), আনোয়ার হোসেন (পিতা অসি মিয়া, মোল্লাপাড়া), আব্দুল গণি (পিতা মাসুদ হোসেন, তালুকদার পাড়া), আলী আহাম্মদ (পিতা মো. আকমত আলী, দমদম), দুলাল মিয়া (পিতা আব্দুল মজিদ, মোহাম্মদপুর), মো. আব্দুল বারেক (পিতা নবী হোসেন, হাছাননগর), মো. আরফান আলী (পিতা সাদির উদ্দিন মুন্সী, মধ্যনগর), মো. আলী আকবর (পিতা মো. আব্দুল জলিল, দমদম), মো. ইউসুফ (পিতা আহাম্মদ হোসেন, পানছড়ি), মো. সিদ্দিকুর রহমান (পিতা আছমত আলী, লোগাং বাজার), বাছেদ মিয়া (পিতা আব্দুর রব আকন্দ, ফাতেমা নগর), মো. মনু মিয়া (পিতা মহরম আলী, ফাতেমা নগর), মো. রবিউল হক (পিতা মো. হেলু মিয়া, মোল্লাপাড়া), মো. হাফেজ উদ্দিন (পিতা সমসের আলী, হাছান নগর), মো. হাফিজ উদ্দিন (পিতা নবী নেওয়াজ, উল্টাছড়ি), আকবর আলী (পিতা সামছুল, ফাতেমা নগর), মো. ইদ্রিস আলী খান (পিতা নোয়াব উদ্দিন খান, উল্টাছড়ি), এ কে এম শহীদুল ইসলাম (পিতা আবুল হোসেন সরকার, মুসলিম পাড়া), শেখ মো. আজগর আলী (পিতা শেখ রজব আলী, উল্টাছড়ি), আলী আশরাফ (শার্লি কোম্পানির প্রধান), মনিরুজ্জামান (পিতা রংশু মিয়া সরদার, মোহাম্মদপুর) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
পানছড়িতে যুদ্ধের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো পানছড়ি ক্যাম্প আক্রমণ। আলী আশরাফের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর শার্লি কোম্পানি মির্জাটিলা গ্রামে অবস্থান নেয়। এখান থেকে তারা শত্রুবাহিনীর বিভিন্ন ক্যাম্পে অপারেশন চালাত। একদিন বিকেলে তাঁরা মির্জাটিলা থেকে চেঙ্গী নদীর পাড় দিয়ে অতর্কিতে পাকবাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণ করেন। প্রায় ৩ ঘণ্টা ধরে চলা এ-যুদ্ধে পাকবাহিনীর ক্যাম্প সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর কানুনগোপাড়া, পাইলট ফার্ম, পূজগাং, ভাইবোনছড়া ও কুকিছড়া ক্যাম্পেও আক্রমণ চালায়। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে না পেরে এক পর্যায়ে পাকবাহিনী খাগড়াছড়ি হয়ে মহালছড়ি দিয়ে পালিয়ে যায়। মুখলেস নামে একজন সাধারণ গ্রামবাসী পানছড়িতে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত নানাভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য-সহযোগিতা করেন। তিনি পানছড়ির বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে-ঘুরে শত্রুদের অবস্থান সম্পর্কে নানা তথ্য সংগ্রহ করে মুক্তিবাহিনীকে সরবরাহ করতেন। তাঁর দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতেন। ১২ই ডিসেম্বর পানছড়ি উপজেলা হানাদার মুক্ত হয়। [ত্রিরতন চাকমা]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড