You dont have javascript enabled! Please enable it!

পাবনা ওয়াপদা ভবন গণকবর (পাবনা সদর)

পাবনা ওয়াপদা ভবন গণকবর (পাবনা সদর) পাবনা জেলার সর্ববৃহৎ গণকবর। ওয়াপদা ভবন ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প। এটিকে টর্চার সেল হিসেবেও ব্যবহার করা হতো। নকশাল ও স্বাধীনতাবিরোধী দালাল- রাজাকারদের সহযোগিতায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনকে ধরে এনে এ টর্চার সেলে অমানুষিক নির্যাতন শেষে হত্যা করে এসিড দিয়ে মৃতদেহ গলিয়ে দেয়া হতো। এরপর কঙ্কালগুলো ওয়াপদা ভবনের ভেতরের দেয়াল ঘেঁষে গর্ত করে মাটিচাপা দেয়া হতো। ঐসব কঙ্কালের সঙ্গে অর্ধমৃতদেরও মাটিচাপা দেয়া হতো। এভাবে এখানে একাধিক গণকবর ছিল এবং স্বাধীনতার পর অসংখ্য নরকঙ্কাল সেখান থেকে উদ্ধার করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাবনায় নকশালরা পাকিস্তানি আর্মিদের সহযোগিতা করে। পাকসেনারা নকশালদের মনে করত বড় রাজাকার। পাকবাহিনী এবং নকশালরা যৌথভাবে পাবনার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নিরীহ মানুষদের ধরে নিয়ে আসত ওয়াপদার পাকসেনা ক্যাম্পে। পাকসেনারা ওয়াপদা ভবনকে তাদের হেডকোয়ার্টার্স হিসেবে ব্যবহার করত। কাউকে সন্দেহ হলেই তাকে পাকিস্তানি সৈন্যরা গাড়িতে ওঠাত এবং জিজ্ঞাসাবাদের নামে নিয়ে আসত ওয়াপদার টর্চার সেলে। হানাদার বাহিনীর ক্যাপ্টেন তাহের টর্চার সেলের দায়িত্ব পালন করত। গাড়া মান্নান নামে এক দালাল হানাদার বাহিনীকে আওয়ামী লীগ-এর লোকদের চিনিয়ে দিত। পাবনা সদরের নয়নামতির সাবেক বিমান বাহিনীর এক কর্মচারী পাকিস্তানি বাহিনীর দোভাষী হিসেবে কাজ করত। মানুষজন ধরে এনে টর্চার সেলে হাত-পা বেঁধে মেঝেতে ফেলে তাদের শরীরের ওপর নাইট্রিক এসিড ঢেলে দিত। মুহূর্তে গলে যেত সারা শরীর। এভাবে অসংখ্য গলিত লাশ ওয়াপদা ক্যাম্পের ভেতরের দেয়ালের কাছে গর্ত করে পুঁতে রাখা হয়। সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ছিল মৃত মানুষের সঙ্গে অর্ধমৃত মানুষকেও মাটিচাপা দেয়া। স্বাধীনতার পর ওয়াপদা ভবন প্রাঙ্গণে অসংখ্য গণকবরের সন্ধান পাওয়া যায়। এসব গণকবর খুঁড়ে হাজার-হাজার নরকঙ্কাল উদ্ধার করা হয়। স্বাধীনতার পর গণসমাধিগুলোতে হাজার-হাজার নিরীহ বাঙালির কঙ্কাল ছিন্নভিন্ন অবস্থায় পড়ে থাকতেও দেখা যায়। এতে বোঝা যায় নিহতদের অনেককে হানাদারদের আত্মসম্পর্ণের ঠিক আগ মুহূর্তে নির্মম নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হয়। ওয়াপদা গণকবরগুলোতে ছিন্ন কাপড়, মাথার খুলি, চুল, জুতা প্রভৃতি পাওয়া যায়। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে এ স্থানে কমপক্ষে ৩ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়। ওয়াপদা অফিসের ঝাড়ুদার ভানু লাল ও ওয়াপদা কর্মচারী মকবুল হোসেন অসংখ্য ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। ভানুলালের সহায়তায় পূর্বদেশ পত্রিকার প্রতিনিধি একটি উন্মুক্ত কবরের সন্ধান পান এবং উক্ত প্রতিনিধির পক্ষে অন্তত ১৬টি নরকঙ্কাল গণনা করা সম্ভব হয়। কুমারগাড়ি গ্রামের কৃষক আব্দুর রহমানের বর্ণনামতে হানাদাররা তাকে একাধিকবার মাঠ থেকে ধরে এনে গণকবর তৈরির কাজে নিয়োজিত করে। হানাদাররা একই কবরে একাধিক লাশ পুঁতে রাখত। একবার প্রায় ৫০ জন লোককে হানাদাররা ধরে নিয়ে এসে হত্যা করার পর একটি খাদে ফেলে মাটিচাপা দেয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে পাবনার গণপরিষদ সদস্য আব্দুর রব বগা মিয়া, জেলা প্রশাসক কাজী লুৎফুল হক এবং অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আব্দুল হাকিম ওয়াপদা ভবনের গণকবরগুলো পরিদর্শন করেন। একটি কবরে তাঁরা ৬০টি কঙ্কাল দেখতে পান। কবরটির পাশেই একটি তরবারি পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, এ তরবারি দিয়েই অসহায়দের জবাই করা হয়। পাবনা জেলায় অবস্থিত গণকবরগুলোর মধ্যে ওয়াপদা ভবন গণকবরই সর্ববৃহৎ। [মো. ছাবেদ আলী]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!