You dont have javascript enabled! Please enable it!

পাবনা পুলিশ লাইন্স যুদ্ধ (পাবনা সদর)

পাবনা পুলিশ লাইন্স যুদ্ধ (পাবনা সদর) সংঘটিত হয় ২৭ ও ২৮শে মার্চ দুদিন। পুলিশ, ইপিআর ও প্রাক্তন বাঙালি সৈনিকদের সঙ্গে ছাত্র-যুবকসহ সর্বস্তরের মুক্তিকামী জনতা এতে যোগ দেয়। এ-যুদ্ধে পাকহানাদারদের পরাজয় ঘটে। তাদের একজন সেনা নিহত হয়। অপরপক্ষে একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং কয়েকজন আহত হন।
৭১-এর ২৬শে মার্চ পাবনা শহরের বিভিন্ন স্থানে পাকবাহিনীর গুলিবর্ষণের সংবাদে পাবনা রিজার্ভ পুলিশ লাইন্সের রিজার্ভ ইন্সপেক্টর (আর আই) আবুল খায়ের সকল পুলিশ সদস্যকে একত্রিত করে ঢাকার রাজারবাগ ও চট্টগ্রামের পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেন এবং উদ্ভূত পরিস্থিতিতে করণীয় সম্বন্ধে সকলের মতামত জানতে চান। সবাই একবাক্যে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে আমৃত্যু সংগ্রাম চালিয়ে যাবার শপথ গ্রহণ করেন। ২৭শে মার্চ জেলা প্রশাসক নুরুল কাদেরের কাছে খালেদ মোশাররফের প্রেরিত বিদ্রোহের (We have revolted) টেলিগ্রামটি প্রতিরোধ বাহিনীর মনোবল বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। এদিকে সন্ধ্যার পূর্বেই আর আই আবুল খায়ের পুলিশ সদস্যদের দৃঢ় মনোবল দেখে অস্ত্রাগার খুলে অস্ত্র ও প্রয়োজনীয় রসদ দিয়ে সকলকে পুলিশ লাইন্সের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পজিশন নিতে নির্দেশ দেন। অন্যদিকে জেলা প্রশাসকও নিশ্চিত ছিলেন যে, পুলিশ বাহিনীকে নিরস্ত্র করতে হানাদার বাহিনী পুলিশ লাইন্স আক্রমণ করবে। এ আশঙ্কা থেকেই জেলা প্রশাসক ও আর আই আবুল খায়ের পূর্ব পরিকল্পনা অনুয়ায়ী একটি দল পুলিশ লাইন্সের সামনে জেলা পরিষদ ভবনের ছাদে, একটি দল আবুল খায়েরের বাসার ছাদের ওপর এবং অপর একটি দল পুলিশ লাইন্সের পশ্চিম দিকে অবস্থিত মসজিদের ছাদের ওপর অস্ত্রসহ পজিশন গ্রহণ করে। তাঁদের আশঙ্কা সত্যি প্রমাণিত হয়। মাঝরাতে পাকবাহিনীর ২টি ট্রাক ও ১টি জিপ এসে পুলিশ লাইন্সের এক কর্ণার এবং পুলিশ লাইন্স ও জেলা পরিষদ ভবনের মাঝখানে থামে। সঙ্গে-সঙ্গে পাকসেনারা গাড়ি থেকে নেমে পুলিশ লাইন্স লক্ষ করে কয়েক রাউন্ড গুলিবর্ষণের মধ্য দিয়ে আক্রমণ শুরু করে। পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে থাকা পুলিশ বাহিনী এবং মুক্তিকামী প্রতিরোধযোদ্ধারা বিভিন্ন অবস্থান থেকে আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকেন। উভয় পক্ষে অবিরাম গুলিবর্ষণ চলতে থাকে। খোলা জায়গায় অবস্থান নেয়ায় পাকবাহিনী বেকায়দায় পড়ে যায়। আর আই আবুল খায়ের পুলিশ লাইন্সের ওপর থেকে হ্যান্ড মাইক দিয়ে পুলিশ বাহিনীর প্রতি আমৃত্যু যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিতে থাকেন। অন্যদিকে পাকসেনারা মাইক দিয়ে পুলিশ বাহিনীকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছিল। পুলিশ সদস্যদের অত্যন্ত সুরক্ষিত ও সুবিধাজনক স্থানে অবস্থানের কারণে পাকবাহিনী মেশিনগান ও মর্টার শেলিং করেও তাঁদের আক্রমণ মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়। এমনকি পুলিশের দৃঢ় প্রতিরোধের মুখে পাকসেনারা বারবার সিভিল সার্জনের অফিসের পাশ দিয়ে ক্রলিং করে পুলিশ লাইন্সের ভেতরে প্রবেশ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। পুলিশ লাইন্সের এ-যুদ্ধে পুলিশ সদস্যগণ আসন্ন বিপদ অনুধাবন করে চতুর্দিক ঘিরে অবস্থান নিয়েছিলেন। হাবিলদার সিরাজুল ইসলাম ও কনস্টেবল জহির হোসেন পুলিশ লাইন্সের পশ্চিম দিকে অবস্থান নিয়েছিলেন। কনস্টেবল আনোয়ার হোসেন ও নাসির উদ্দিন ছিলেন ম্যাগাজিন গার্ডের সামনে। আর আই আবুল খায়েরের সঙ্গে কনস্টেবল রণজিৎ কুমার রিজার্ভ অফিসের দোতলা থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। কয়েকজন কনস্টেবলসহ পিআরএফ-এর সুবেদার মাহতাব ছিলেন পাকসেনাদের মুখোমুখি ক্যান্টিনের সামনে। পুলিশ সদস্যরা পুলিশ হাসপাতালের পেছন এলাকা এবং পুলিশ লাইন্স। স্কুলের মধ্যবর্তী শক্ত ঘাঁটি থেকে যুদ্ধ করছিলেন। তাঁদের সঙ্গে মুক্তিকামী জনতা জজকোর্ট, পোস্টঅফিস, জেলখানা এলাকা ও জেলা স্কুলের ভেতরে বৃত্তাকারে অবস্থান নিয়ে পাকসেনাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকে।
এদিকে মধ্যরাতে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দে পদ্মাচরে অবস্থানরত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যরা বুঝতে পারেন যে, পাকসেনারা পুলিশ লাইন্স আক্রমণ করেছে এবং তারা সবাই সঙ্গে-সঙ্গে শহরের দিকে এগিয়ে আসেন। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী প্রধান রফিকুল ইসলাম বকুলও ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে শহরের দিকে ছুটে আসেন। কাচারিপাড়ায় জামতলা বাঁধের কাছে এসে তিনি সহযোদ্ধাদের সঙ্গে মিলিত হন এবং নিজের টু-টু বোর রাইফেলসহ যার যা অস্ত্র আছে তাই নিয়ে পেছন দিক থেকে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। যাদের হাতে কোনো অস্ত্র ছিল না তাদের বলা হয় গ্রামের ভেতরে গিয়ে খবর দিতে যাতে গ্রামবাসী বন্দুক, ফলা, তীর-ধনুক ইত্যাদি নিয়ে শহরে এসে শত্রুর মোকাবেলা করে। গুলিবর্ষণ করতে-করতে বকুল কয়েকজন যোদ্ধাসহ জামতলা থেকে এগিয়ে এসে কোর্ট এলাকায় প্রবেশ করেন। এ সময় জজকোর্টের পাশেই পাকসেনাদের বহনকারী একটি জিপের কাছে দাঁড়িয়ে দুজন পাকসেনা পুলিশ লাইন্স লক্ষ করে গুলি করছিল। বকুল তাদের ওপর গুলি শুরু করলে পাকসেনারা ছুটে পালাতে থাকে। বকুলের পাশের অল্পবয়সী এক সহযোদ্ধা পাকসেনাদের পালাতে দেখে চিৎকার করে তাদের পিছু ছুটতে থাকেন। তাঁর কাছে অস্ত্র ছিল তীর-ধনুক। স্বাধীনতার জন্য জীবন দেয়ার উন্মাদনায় তিনি এতটাই পাগল ছিলেন যে, বকুলের পিছু ডাক তাঁকে থামাতে পারেনি। হঠাৎ একটি গুলি এসে তাঁকে আঘাত করলে মুহূর্তেই তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। কিশোর মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুর দৃশ্য দেখে প্রতিশোধে বকুল জ্বলে ওঠেন। এখান থেকে তিনি জজ সাহেবের বাড়ির পাশের ড্রেনের মধ্য দিয়ে দ্রুত পাকা রাস্তার দিকে চলে যান। তখন সকাল প্রায় ৮টা। তিনি দেখতে পান যে, পাকসেনা ভর্তি একটি জিপ পৌরসভা ও আমজাদ হোসেনের বাড়ির মাঝখানের রাস্তা দিয়ে খুব ধীরগতিতে পাকা রাস্তায় ওঠার জন্য এগিয়ে আসছে। পাকবাহিনী কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রতিশোধের নেশায় বকুল ড্রাইভারকে লক্ষ করে গুলি করলে গুলিটা ড্রাইভারের মাথায় বিদ্ধ হয় এবং জিপটি পৌরসভার বড় ড্রেনে উল্টে পড়ে। পাকসেনারা ড্রেনের কাদায় ছিটকে পড়েই এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে। কিন্তু একটু পরেই তাদের একজন বাঁশি বাজিয়ে সংকেত দিতেই সবাই উল্টো দিকে জিলাপাড়ার দিকে দৌড়ে পালিয়ে যায়। ইতোমধ্যে গুলিবর্ষণের শব্দও স্তিমিত হয়ে আসে। পুলিশ লাইন্স থেকে মাঝে-মধ্যে দু-একটি গুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। জনতার প্রচণ্ড চাপের মুখে পাকসেনারা ভীত হয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়। পুলিশ লাইন্সের দিকে প্রচণ্ড উল্লাসে মেতে ওঠে স্বাধীনতাকামী জনতা। পাকসেনারা পালিয়েছে বুঝতে পেরে বকুল ও তাঁর সঙ্গীরা আনন্দে ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিতে-দিতে ছুটে যান পুলিশ লাইন্সের দিকে। বিজয়ের উল্লাসে মেতে ওঠে সবাই। পুলিশের আর আই ছুটে এসে বকুলসহ প্রতিরোধকারীদের নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এ-যুদ্ধে একজন পাকসেনা নিহত হয়। অপরপক্ষে একজন প্রতিরোধ যোদ্ধা শহীদ এবং কয়েকজন আহত হন।
পুলিশ লাইন্স যুদ্ধের কথা ছড়িয়ে পড়তেই পার্শ্ববর্তী চর এলাকা থেকে মুক্তিকামী জনতা পুলিশ লাইন্সের দিকে যেমন ছুটে আসে, তেমনি পার্শ্ববর্তী অন্যান্য এলাকা থেকেও হাজার-হাজার মানুষ পাবনা শহরের দিকে এগিয়ে আসে। সাঁথিয়া থানার ধোপাদহ, হলুদঘর, তেতুরিয়া, গোপালপুরসহ বিভিন্ন গ্রাম থেকে ছাত্র, যুবক, জনতা লাঠি, দা, ফালা, ট্যাটা ইত্যাদি নিয়ে পাবনা শহরের উদ্দেশে ‘সকলেই পাবনা চলো, পাকবাহিনী খতম কর’ স্লোগান সহকারে শহরের দিকে আসতে থাকে। অন্যদিকে ২৭শে মার্চ রাতে ঈশ্বরদীর বিভিন্ন রাস্তায় বেরিকেড সৃষ্টি এবং প্রতিরোধ যোদ্ধাদের পেট্রল ডিউটির ব্যবস্থার পর পরবর্তী নির্দেশের জন্য যখন সবাই অপেক্ষামাণ, তখন পাবনা থেকে খবর আসে ঈশ্বরদী- আটঘরিয়া থানার এডভোকেট আমিনুদ্দিন এমপিএ-কে পাকসেনারা আটক করেছে। এমনি পরিস্থিতিতে সন্ধ্যার পরও যখন জেলা শহর পাবনা থেকে বারবার যোগাযোগ করেও কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন সিরাজগঞ্জ মহকুমার এসডিও শামসুদ্দিন আহমেদ ঈশ্বরদী থানায় টেলিফোন করে সংবাদ দেন পাবনা শহর পাকসেনা কর্তৃক অবরুদ্ধ। এসডিও সাহেব ঈশ্বরদী থানার পুলিশ বাহিনী এবং জনসাধারণসহ অন্যান্য প্রতিটি থানার পুলিশ বাহিনীকে শত্রুর বিরুদ্ধে মোকাবেলা করে দেশমাতৃকাকে হানাদারমুক্ত রাখার আহ্বান জানান। সঙ্গে-সঙ্গে ঈশ্বরদী থেকে হাজার- হাজার ছাত্র-জনতা যার যা-কিছু ছিল তাই নিয়ে প্রায় ১৬ মাইল দূর থেকে ভোর না হতেই চলে আসে পাবনায় পুলিশ লাইন্সের পশ্চিমে ফুটবল খেলার মাঠে। অন্যদিকে সিরাজগঞ্জ মহকুমা থেকেও নদীপথে চলে আসে ছাত্র-জনতার ঢল। পাকসেনাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে জনতা। এভাবে ২৭ ও ২৮শে মার্চ দুদিনব্যাপী একটানা পাকসেনাদের সঙ্গে পুলিশ, প্রাক্তন সৈনিক, ছাত্র এবং মুক্তিকামী জনতার যুদ্ধ হয়। আত্মরক্ষার এ জনযুদ্ধ-এ জয়লাভের পর জনগণের মনোবল বহুগুণে বেড়ে যায়। [মো. হাবিবুল্লাহ্]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!