You dont have javascript enabled! Please enable it!

পাবনা প্রতিরোধযুদ্ধ (আটঘরিয়া, পাবনা)

পাবনা প্রতিরোধযুদ্ধ (আটঘরিয়া, পাবনা) সংঘটিত হয় ২৮ ও ২৯শে মার্চ দুদিন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এ-যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল ছাত্র, শ্রমিক ও সাধারণ জনতা। যুদ্ধে প্রায় ২০০ পাকসেনা নিহত হয়। অপরদিকে কয়েকজন প্রতিরোধযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষ শহীদ হন।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে স্বাধীনতার দাবিতে গোটা দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন, ৩রা মার্চ পল্টন ময়দানে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ, ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ সব মিলিয়ে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত একদিকে স্বাধীকার আন্দোলন অন্যদিকে স্বাধীনতা আন্দোলন চলতে থাকে। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর থেকেই ছাত্র- যুবকদের যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ চলতে থাকে। অন্যদিকে ২৫শে মার্চের পূর্ব পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আলোচনা চলে। গোটা দেশে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন-, মিটিং-মিছিল ইত্যাদি চলতে থাকে। পাশাপাশি যুবকদের সামরিক প্রশিক্ষণও চলতে থাকে। পাবনা শহরে জেলা স্কুল মাঠ, জি সি আই স্কুল মাঠ, নয়নামতি অভিযান ক্লাব এবং রাধানগর মক্তবপাড়ায় অধিনায়ক ক্লাবের উদ্যোগে প্রশিক্ষণ শুরু হয়। বাঁশের লাঠি এবং স্কাউটদের ব্যবহৃত ডামি রাইফেল দিয়ে ট্রেনিং দেয়া হতো। স্কুলের স্কাউট শিক্ষক, আনসার এবং অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকরা প্রশিক্ষক ছিলেন।
২৬শে মার্চ ভোর থেকে স্থানীয় তথ্য অফিসের গাড়ি সেনা প্রহরায় শহরময় প্রচার করে যে, শহরে কাফু জারি করা হয়েছে। সমস্ত মানুষকে ঘরের মধ্য থাকতে বলা হচ্ছে। রাস্তায় কেউ বের হলে গুলি করা হবে। মুহূর্তে গোটা শহর যেন নীরব নগরীতে পরিণত হয়। বাইরে কি হচ্ছে তা বোঝার কোনো উপায় নাই। একমাত্র রেডিওর মাধ্যমে আকাশবাণী, বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকার সংবাদে যা জানা যায়।
২৭শে মার্চ সকাল থেকেই পাড়ায়-পাড়ায় যুবকরা সংঘটিত হতে থাকে। পাশাপাশি উৎসুক জনতা সমবেত হওয়ায় ক্রমে কাফু দুর্বল হয়ে পড়ে। সন্ধ্যার মধ্যে খবর আসতে থাকে যে, বহু মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ২৫শে মার্চ রাতে পাবনা শহরের গোপালপুর থেকে আটঘরিয়া ও ঈশ্বরদী থেকে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য এডভোকেট আমীন উদ্দিন, ভাসানী ন্যাপের জেলা সভাপতি ডা. অমলেন্দু দাক্ষী, তৃপ্তি নিলয় হোটেলের মালিক সাঈদ তালুকদারসহ প্রায় অর্ধশত মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়।
২৬শে মার্চ রাতে কৃষ্ণপুরে জানাজা নামাজে গুলি করে মুসল্লিদের হত্যা করা হয়। ২৭শে মার্চ পুলিশ লাইন্স আক্রমণ করলে সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। দিনভর পাড়ায়- পাড়ায় যুবকরা লাঠি, তীর-ধনুক ইত্যাদি দেশীয় অস্ত্রসহ সংগঠিত হয়। পাশাপাশি গ্রাম-গঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকার লাইসেন্সকৃত বন্দুক ও স্থানীয়ভাবে তৈরি বোমা সংগ্রহের কাজ চলতে থাকে।
২৭শে মার্চ রাত থেকেই থেমে-থেমে গুলির শব্দ শোনা যায়। রাত যত বাড়ে গুলির শব্দও তত বাড়তে থাকে। তখন পাড়া- মহল্লা জনতার দখলে। শহরের মধ্যে টেলিফোন একচেঞ্জে একদল পাকিস্তানি সৈন্যকে অবরুদ্ধ করে চতুর্মুখী আক্রমণ করা হয়। পাকসেনাদের আরেকটি বড় দল শহরের উপকণ্ঠে বিসিক শিল্পনগরীতে আটকে আছে। সারারাত ধরে গোলাগুলি চলে। ভোর থেকে তুমুল আক্রমণ শুরু হয়। দুপুরের আগেই টেলিফোন একচেঞ্জে অবস্থানরত ২৮ জন পাকসেনাকে হত্যা করা হয়। টেলিফোন একচেঞ্জ দখল করার পর লস্করপুর (বর্তমান বাস টার্মিনাল) চেকপোস্ট, বালিয়াহালট গোরস্থান, সার্কিট হাউস এবং বিসিকে অবস্থানরত পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ করা হয়। লস্করপুরে ৩ জন এবং বালিয়াহালটে ২ জন পাকসেনাকে হত্যা করা হয়। লস্করপুর যুদ্ধে শহীদ হন বুলবুল (যার নামে সরকারি শহীদ বুলবুল কলেজ নামকরণ করা হয়), ফুনু, মুকুল এবং আফসার।
২৯শে মার্চ বিসিক শিল্পনগরী, মালিগাছা এবং দাপুনিয়া মাধপুরে পলায়নরত পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ করে ৯০ জন পাকসেনাকে হত্যা করা হয়। পাবনা প্রতিরোধযুদ্ধে পাকিস্তানি মেজর আসলামসহ প্রায় ২০০ সৈন্য নিহত হয়। মালিগাছা যুদ্ধে আটঘরিয়া থানার দারোগা আব্দুল জলিল শহীদ হন। মাধপুর, দাশুড়িয়া, ঈশ্বরদী ও লালপুরের প্রতিরোধযুদ্ধে ১২ জন বীর জনতা শহীদ হন। বিসিক মুক্ত হবার পর পাকসেনাদের হাতে আটক সংসদ সদস্য এডভোকেট আমীন উদ্দিন এমপিএ, ন্যাপ নেতা ডা. অমলেন্দু দাক্ষী, সাঈদ তালুকদার, রাজন পাগলসহ অজ্ঞাত অনেক নারী-পুরুষের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করা হয়।
২৯শে মার্চ পাবনা জেলা প্রথম হানাদারমুক্ত হয় এবং ১০ই এপ্রিল পর্যন্ত তা শত্রুমুক্ত থাকে। প্রায় ১২ দিন পাবনার ঘরে- ঘরে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা ওড়ে। এই বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধে যাঁদের অগ্রণী ভূমিকা ছিল, তাঁরা হলেন- পাবনা জেলা আওয়ামী লীগ-এর সভাপতি মো. আমজাদ হোসেন, সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রব বগা মিয়া, ন্যাপ নেতা আমিনুল ইসলাম বাদশা, রণেশ মৈত্র, আওয়ামী লীগ নেতা ওয়াজি উদ্দিন খান, গোলাম আলী কাদেরী, জেলা ছাত্রলীগ-এর সভাপতি আব্দুস সাত্তার লালু, সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম বকুল প্রমুখ। পাবনা প্রতিরোধযুদ্ধে পাবনার তৎকালীন জেলা প্রশাসক নূরুল কাদের খানও অংশ নেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রথম উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। আরেকজন হলেন তৎকালীন পুলিশ সুপার আব্দুল গাফ্ফার।
পাবনা প্রতিরোধযুদ্ধে তৎকালীন ভাসানী ন্যাপের ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের টিপু বিশ্বাসের নেতৃত্বাধীন অংশ (যারা নকশাল নামে পরিচিত) প্রথমদিকে ভূমিকা রাখলেও, যদিও পরবর্তীতে তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে চলে যায়। এছাড়া ন্যাপ (মোজাফ্ফর)-এর ছাত্র ইউনিয়নের রবিউল ইসলাম রবি ও শিরিন বানু মিতিলদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। সেদিনের প্রতিরোধযুদ্ধে ছাত্রলীগের চুপ্পু, বেবী ইসলাম, ফজলুল হক মন্টু, মোখলেছুর রহমান মুকুল, সাঈদ আকতার ডিডু, গোরা মান্নান প্রমুখ যোদ্ধার সাহসী ভূমিকা ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। [আমিরুল ইসলাম রাঙা]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!