You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে পাথরঘাটা উপজেলা (বরগুনা)

পাথরঘাটা উপজেলা (বরগুনা) সাগর ও নদীবিধৌত একটি উপকূলীয় এলাকা। এর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে বিষখালী নদী এবং পশ্চিমে বলেশ্বর নদ ও সুন্দরবন। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও বন্যা এ এলাকার নিত্যসঙ্গী। তাই এলাকার মানুষ বরাবরই দারিদ্র্যপীড়িত। ১৯৭০ সালের নভেম্বরের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে এখানকার হাজার-হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। কিন্তু পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে আশানুরূপ সাহায্য-সহযোগিতা পায়নি এলাকাবাসী। এ কারণে তারা সরকারের প্রতি বিশেষভাবে ক্ষুব্ধ হয়। পক্ষান্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর দল চরম বিপদে তাদের পাশে দাঁড়ানোর কারণে তারা বঙ্গবন্ধু ও। আওয়ামী লীগ-এর একনিষ্ঠ সমর্থকে পরিণত হয়। এর প্রতিফলন ঘটে পরবর্তী ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে। তাতে তারা আওয়ামী লীগকে বিপুলভাবে ভোট দেয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক সরকার বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা না দিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু করলে সারাদেশের মানুষের মতো এ এলাকার মানুষও ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ হয়। ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন- আহ্বান করেন। এ আন্দোলনে পাথরঘাটার মানুষও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। তারপর ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ শুনে তারা স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর পাথরঘাটায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ সভাপতি মজিবুল হকের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। পরিষদের নির্দেশে আধাসামরিক বাহিনী ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা কে এম মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে ছাত্র- যুবক, কৃষক-শ্রমিক ও সাধারণ জনগণকে বাঁশের লাঠি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। পরবর্তীতে কয়েকটি সাধারণ বন্দুক সংগ্রহ করে সেগুলো দিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। মে-জুন মাসের দিকে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য অনেকে সুন্দরবন হয়ে ভারতে যান।
পাথরঘাটা উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন মজিবুল হক, আব্দুল মজিদ মিয়া, মতিয়ার রহমান মিয়া, সেকান্দার হায়াত, নুর মোহাম্মদ সিকদার, আব্দুর রাজ্জাক পাহলান, আব্দুল জব্বার প্রমুখ। পাথরঘাটা উপজেলায় পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। তবে ১৫ই মে তারা যখন শহরে প্রবেশ করে, তখন আব্দুল মজিদ নামে একজন পুলিশ সদস্য গেরিলা পদ্ধতিতে তাদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু পাকবাহিনীর গুলিতে তিনি শহীদ হন। পাকবাহিনী  শহরে প্রবেশ করে পাথরঘাটা থানায় ক্যাম্প স্থাপন করে।
পাকবাহিনী পাথরঘাটা উপজেলায় প্রবেশ করার পর স্থানীয় মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামী-র নেতা-কর্মীরা স্বাধীনতাবিরোধী তৎপরতা শুরু করে। তারা শান্তি কমিটি, রাজাকার আলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠন করে তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়। এরপর তারা এলাকায় নারীনির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজে পাকবাহিনীকে সহযোগিতা করে।
উপজেলায় স্বাধীনতাবিরোধী শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা হলো- মো. খলিলুর রহমান (রায়হানপুর, বরগুনা মহকুমা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান), মো. হাতেম রাশেদী (ছোটটেংরা, ৩নং চরদুয়ানী ইউনিয়ন; চরদুয়ানী ইউনিয়ন শান্তি কমিটির সভাপতি), মো. মজিদ ফরাজী (পাথরঘাটা বন্দর), মো. হাসেম হাজী (পাথরঘাটা সদর ইউনিয়ন), মো. শহিদুল্লাহ্ (পাথরঘাটা), মো. হাবিব চৌধুরী (পাথরঘাটা সদর), মো. আহের উদ্দিন তালুকদার (কালমেঘা ইউনিয়ন), মো. মজিদ জোমাদ্দার (চরদুয়ানী), মো. হাকিম ডাক্তার (চরদুয়ানী), মো. বারেক পোস্টমাস্টার (চরদুয়ানী), মো. মকবুল চেয়ারম্যান (কাঠালতলী), মো. হাকিম মাওলানা (কাঠালতলী), মো. ফখর উদ্দিন (নাচনাপাড়া), মো. বাঘা আলতাফ (কাকচিড়া), মো. জালাল ডিলার (চরদুয়ানী), মোহাম্মদ আলী মল্লিক (পাথরঘাটা), মো. শেখ আব্দুল মালেক (পাথরঘাটা বন্দর), মো. অহেদ সিকদার (কাঠালতলী ইউনিয়ন) প্রমুখ।
পাকবাহিনী ১৫ই মে পাথরঘাটায় প্রবেশ করে ঐদিন বিকেল ৩টার দিকে খলিলুর রহমান (মহকুমা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান), মজিদ ফরাজী, হাসেম হাজী, মো. শহিদুল্লাহ্, মো. হাতেম রাশেদী, শেখ আব্দুল মালেকসহ আরো অনেককে নিয়ে পাথরঘাটা বন্দরের দক্ষিণে গহরপুর গ্রামের সতীন্দ্রনাথ হাওলাদারের বাড়িতে হানা দেয়। সেখান থেকে তারা ১১ জনকে ধরে এনে বিষখালী নদীর পাড়ে লঞ্চঘাটের জেটির পূর্ব পাশে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে। তাদের মধ্যে গণেশ সাহা নামে একজন নদীতে ঝাঁপ দিয়ে বেঁচে যান, বাকি ১০ জন নিহত হন। এ ঘটনা পাথরঘাটা লঞ্চঘাট গণহত্যা নামে পরিচিত।
জুন মাসে খলিলুর রহমান ও হাতেম রাশেদীর নেতৃত্বে হানাদাররা হোগলাপাশা গ্রামে ঢুকে বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে এবং সুরেন্দ্রনাথ অধিকারীকে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। জুলাই মাসে খলিলুর রহমানের নেতৃত্বে মকবুল মিয়া (কাঠালতলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও শান্তি কমিটির সদস্য), অহেদ সিকদার, হাকিম মাওলানা প্রমুখ পাকবাহিনীকে নিয়ে তালুকের চরদুয়ানী ও সিংরাবুনিয়া গ্রামে অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ ও নারীনির্যাতন চালায়। এ-সময় তারা কর্ণধার মিস্ত্রী, মনোহর মিস্ত্রী, মতিয়ার রহমান ও মথুরানাথ মিস্ত্রীকে তালুকের চরদুয়ানীর খেয়াঘাটে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। ১০ই অক্টোবর চেয়ারম্যান ফখর উদ্দিন ও খলিলুর রহমানের নেতৃত্বে নাচনাপাড়া ইউনিয়নে গিয়ে তারা সিংরাবুনিয়া গয়ালীবাড়ি থেকে সাতজনকে ধরে এনে স্থানীয় নাপিতবাড়ি খেয়াঘাটের উত্তর পাশে লাইনে বসিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনা সিংরাবুনিয়া গণহত্যা নামে পরিচিত। অক্টোবর মাসেই হাতেম রাশেদী, হাকিম ডাক্তার, মজিদ জোমাদ্দার, জালাল ডিলার, পোস্টমাস্টার বারেক প্রমুখ পাকবাহিনীকে নিয়ে হোগলাপাশা গ্রামে অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ ও নারীনির্যাতন করে এবং সুরেশ অধিকারী ও চরদুয়ানী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল গনি হাওলাদারকে ধরে চরদুয়ানী বাজারে নিয়ে আসে। এরপর তারা কাকচিড়া নামক স্থানে তাঁদের গুলি করে বরগুনা চলে যায়। পরের দিন তারা চরদুয়ানী ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আব্দুস ছামাদ জোমাদ্দারকে ধরে এনে পাকবাহিনীর হাতে তুলে দেয়৷ তিনদিন নির্যাতনের পর নদীর পাড়ে নিয়ে তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। নভেম্বর মাসে হাতেম রাশেদী জনৈক আব্দুল মালেক মাস্টারের জামার পকেটে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি দিকনির্দেশনা ও তাঁদের যোগাযোগের ব্যাপারে সাহায্য করা সংক্রান্ত একটি চিঠি পায়। চিঠিটি সে উর্দুতে অনুবাদ করে পাকসেনাদের শোনায়। এরপর পাকসেনারা আব্দুল মালেক মাস্টারকে ক্যাম্পে ধরে এনে নির্মম নির্যাতন করে। বাড়ি থেকে তাঁর ছেলে মো. শাহজাহান মিয়াকে ধরে আনে এবং পিতা-পুত্রকে এক রশিতে বেঁধে পুরাতন খালের ব্রিজের পশ্চিম পাশে হত্যা করে খালে ফেলে দেয় ঐ স্থানটিকে বধ্যভূমি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। হাসেম হাজী ও মজিদ ফরাজীর নেতৃত্বে পাকবাহিনীর দোসররা লক্ষ্মণ দাস ও তার ছেলে অরুণ দাসকে পদ্মা গ্রাম থেকে পাথরঘাটায় ধরে এনে পাকবাহিনীর হাতে তুলে দেয়। পাকসেনারা বর্তমান নতুন বাজার আইউব মল্লিক ডকইয়ার্ডের কাছে আরো চারজনসহ তাদের হত্যা করে। এছাড়া চরদুয়ানী ইউনিয়নের কালিয়াখাল সারদা গোমস্তার বাড়ির কাছে চারজন এবং কাঠালতলী ইউনিয়নের খেয়াঘাট সংলগ্ন শরৎচন্দ্র মণ্ডলের বাড়িতে তিনজনকে হত্যা করা হয়। শরৎচন্দ্র মণ্ডলের বাড়িটি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়।
এ উপজেলায় মোট ২৯ জন শহীদের নাম জানা গেছে।
পাথরঘাটা উপজেলায় একটি গণকবর রয়েছে- সিংরাবুনিয়া গণকবর। নাচনাপাড়ার জানকীনাথ মাস্টারের বাড়িসংলগ্ন এ গণকবরে ৭ জনকে মাটিচাপা দেয়া হয়।
পাথরঘাটা উপজেলা হানাদারমুক্ত হয় ২রা ডিসেম্বর। এতে নেতৃত্ব দেন মুক্তিযোদ্ধা কামাল উদ্দিন ওরফে আবুল কাসেম (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্য)।
পাথরঘাটা উপজেলার দুজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম জানা যায়। তাঁরা হলেন- আব্দুল মজিদ (পুলিশ সদস্য, ১৫ই মে পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে শহীদ) এবং মো. আলাউদ্দিন (কাকচিড়া ইউনিয়ন, বাগেরহাটের শরণখোলায় হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ)।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার্থে উপজেলা পরিষদের সামনে একটি নামফলক ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। উপজেলার খাসকাচারী মাঠে মুক্তিযুদ্ধের একটি স্মৃতিফলক স্থাপিত হয়েছে। এছাড়া পাথরঘাটা শহরের উকিল পট্টি এলাকায় একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মজিদ সড়ক। [শফিকুল ইসলাম খোকন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!