You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে পাটগ্রাম উপজেলা (লালমনিরহাট)

পাটগ্রাম উপজেলা (লালমনিরহাট) একটি সীমান্তবর্তী উপজেলা। লালমনিরহাট জেলা সদর থেকে ৮২ কিলোমিটার দূরে উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে এটি অবস্থিত। পাটগ্রামের উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিমে ভারতের কুচবিহার এবং পূর্বদিকে হাতীবান্ধা উপজেলার বড়খাতা ইউনিয়ন। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে পাটগ্রাম মুক্ত ‘ক’ অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ এলাকা ৬ নম্বর সেক্টরের আওতাভুক্ত ছিল। বহু বিদেশী রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা পাটগ্রামের মুক্তাঞ্চল পরিদর্শন করেন। এ অঞ্চল পরিদর্শন শেষে অনেকে স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্ববাসীর কাছে যুদ্ধের বাস্তব অবস্থা তুলে ধরতে কাজ করেন। ঐতিহাসিক তিনবিঘা কড়িডোর ও দহগ্রাম ছিটমহল এ উপজেলায় অবস্থিত।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ- বিজয় লাভ করলেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তর না করে নানা ষড়যন্ত্র করতে থাকে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১লা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেন। সারা বাংলাদেশ ইয়াহিয়ার এ ঘোষণায় বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২রা মার্চ প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। ৩রা মার্চ বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে পল্টনের জনসভায় তাদের কর্তৃক স্বাধীনতার ইস্তেহার পাঠ করা হয়। ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ-লক্ষ জনতার সামনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান – যুদ্ধের প্রস্তুতির আহ্বান জানান। তিনি ঘরে-ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার নির্দেশ দেন। সেই ঘোষণার পর থেকে সারাদেশে দুর্বার আন্দোলন শুরু হয়। এ আন্দোলনের প্রভাব পাটগ্রামেও পড়ে। ১৯৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ী আবিদ আলী এমপিএ-এর নেতৃত্বে পাটগ্রামের আবালবৃদ্ধবনিতা হতে থাকে। সারাদেশের মতো পাটগ্রামেও সংগ্রামী ছাত্র-জনতা পাকিস্তানি শাসন অকার্যকর করে দেয়।
এখানে মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হন যথাক্রমে আবিদ আলী এমপিএ এবং অধ্যক্ষ কাজী নুরুজ্জামান। অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন- আজিজার রহমান মিয়া, তফিজ উদ্দিন আহমেদ, আবুল হোসেন মিয়া, শাহ এন্তাজ উদ্দিন আহমেদ, আশরাফ আলী, জলিলুর রহমান, তোজাম্মেল হোসেন মিয়া, আফতাব উদ্দিন আহমেদ, ডা. সলেমান আহমেদ, নবার উদ্দিন পণ্ডিত, দেস্তার হোসেন খান, আব্দুল হামিদ শিকদার, আহসানুল হক ইদু, জবেদ আলী মিয়া, আমিনুর রহমান বুলু মিয়া, কদর উদ্দিন আহমেদ, মনির উদ্দিন আহমেদ, আবু বক্কর সিদ্দীক প্রধান, বোরহান উদ্দিন (সুবেদার) ও কায়তুল্লাহ্ (ওসি)। পাটগ্রামে একটি মহিলা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এ পরিষদের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন- মোমেনা আবিদ (সভানেত্রী), ফাতেমা তফিজ (সহ-সভানেত্রী), সাজেদা খাতুন (সম্পাদিকা), ফেরদৌস জাহান নার্গিস (সহ-সম্পাদিকা), আনোয়ারা তোজাম্মেল (কোষাধ্যক্ষ), হোসনে আরা বুলি (সাংগঠনিক সম্পাদিকা), বদরুন নাহার তানি (সাংস্কৃতিক সম্পাদিকা) প্রমুখ।
২৬শে মার্চ বিকেলে আবিদ আলী এমপিএ-র আহ্বানে টি এন হাইস্কুল মাঠে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এদিন ৩টার মধ্যে দেশীয় অস্ত্র লাঠি, দা, কুড়াল, ছুড়ি, বল্লম ও বন্দুক হাতে নিয়ে হাজার-হাজার মানুষের উপস্থিতিতে মাঠ কানায়- কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। আবিদ আলীর নির্দেশে পাটগ্রাম থানা ও ইপিআর হেডকোয়ার্টার্সে কর্মরত সকল বাঙালি ইপিআর ও পুলিশ সদস্য তাদের অস্ত্রসহ সভায় উপস্থিত হন। ওসি কায়তুল্লাহ্ ও সুবেদার বরহান উদ্দিনের নেতৃত্বে তাঁরা সভায় আসেন। আবিদ আলীর আহ্বানে উপস্থিত জনতা এবং ইপিআর ও পুলিশের সদস্যরা প্রথমে পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে ফেলেন। পরে আবিদ আলী তাদের মুক্তিযুদ্ধের শপথবাক্য পাঠ করান। এর ফলে সমবেত ছাত্র-জনতার মনোবল বৃদ্ধি পায়। হাজার-হাজার মানুষের কণ্ঠে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান উচ্চারিত হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ পরিবেশিত হয়। জনতার উদ্যম ও উৎসাহের মধ্যে আবিদ আলী পাটগ্রামে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। তিনি সকল ছাত্র-যুবককে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণের আহ্বান জানান।
২৬শে মার্চ রাতে আবিদ আলী পাটগ্রাম বাজারস্থ জবেদ মিয়ার বাসায় সহকর্মীদের নিয়ে আলোচনা ও পরামর্শ করেন। এখান থেকে তাঁরা বিবিসি ও ভারতীয় রেডিও থেকে জানতে পারেন যে, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বহু বেসামরিক লোককে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী হত্যা করেছে, বস্তিতে আগুন দিয়েছে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। ২৭ ও ২৮শে মার্চ আবিদ আলী বাউরা, বড়খাতা ও হাতীবান্ধার বিভিন্ন স্থানে সভা-সমাবেশ করে সবাইকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করেন। ২৯শে মার্চ পাটগ্রামের পশ্চিমে অবস্থিত ভারতের মেকলিগঞ্জ মহুকুমা শহরে গিয়ে আবিদ আলী কয়েকজন কংগ্রেস নেতাসহ বিএসএফ-এর ক্যাপ্টেন ভি পি সিং-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন। সেখান থেকে আবিদ আলী ভারতের প্রধানমন্ত্রীসহ বিশ্বের শক্তিধর ৫টি দেশে টেলিগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশে গণহত্যার কথা তুলে ধরেন। তাঁর প্রেরিত তথ্যাদি পরের দিন ভারতীয় বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। পাটগ্রামে ফিরে আবিদ আলী আওয়ামী লীগ ও সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে পাটগ্রাম থানা সংগ্রাম পরিষদের সম্পাদক কাজী নূরুজ্জামান ও হাতীবান্ধা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী নজরুল ইসলামকে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রস্তুত করার পরামর্শ দেন।
পাটগ্রামের মুক্তিযোদ্ধারা দেশের ভেতরে এবং ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ৪ঠা এপ্রিল একটি ব্যাচে ১২০ জনকে পাটগ্রাম থানা মাঠে যাচাই-বাছাই করে ব্যাংকান্দার মুক্তিযোদ্ধা ওসমান গণির নেতৃত্বে ভারতের টাপুরহাটে প্রশিক্ষণের জন্য প্রেরণ করা হয়। পরে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই করতে বুড়িমারী বড়াইবাড়ী মাঠে ইয়ুথ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। এখান থেকে ৬-৭টি ব্যাচে অনেককে প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে পাঠানো হয়।
রংপুরের মো. সিদ্দিক হোসেন এমপিএ দহগ্রামে ইয়ুথ ক্যাম্প স্থাপন করে ওমর আলী প্রধান, আমিনুর রহমান, মঈন উদ্দিন ও ক্যাম্পের ডেপুটি কমান্ডার সাবুবার রহমানের সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি করে অনেককে প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে পাঠান।
আবিদ আলী এমপিএ, জলিলুর রহমান (সমন্বয়কারী) ও কদর উদ্দিনের উদ্যোগে ৬ নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর বাউরায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য অস্থায়ী প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। এখানে ক্যাম্পের ইনচার্জ ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানের পরিচালনায় দুজন ভারতীয় সামরিক অফিসার ও দুজন ইপিআর সদস্যের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। পাটগ্রাম ৬ নম্বর সেক্টরের আওতাধীন ছিল। এ সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন এম কে বাসার। পাটগ্রামে অন্য কমান্ডারদের মধ্যে ছিলেন- মো. মোকলেছুর রহমান প্রধান (কোম্পানি কমান্ডার), আব্দুল জব্বার (কোম্পানি কমান্ডার), মো. খোর্শেদ আলম বসুনিয়া (প্লাটুন কমান্ডার), মো. আশরাফুল হক (প্লাটুন কমান্ডার), আবদুর রাজ্জাক প্রধান (প্লাটুন কমান্ডার), মজিবর রহমান (প্লাটুন কমান্ডার), মো. হাবিবুল হক বসুনিয়া (প্লাটুন কমান্ডার), মো. হাসনাদুল আলম প্রধান (প্লাটুন কমান্ডার), জহুরুল হক প্রধান (প্লাটুন কমান্ডার) প্রমুখ।
পাকবাহিনী যাতে পাটগ্রামে অনুপ্রবেশ করতে না পারে সেজন্য আবিদ আলী এমপিএ ছাত্র-জনতাকে পাটগ্রামে যোগাযোগের একমাত্র ব্যবস্থা রেলপথ বিচ্ছিন্ন করার আহ্বান জানান। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ছাত্র-জনতা বড়খাতা থেকে বুড়িমারী জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত রেললাইন তুলে ফেলে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় পাকবাহিনী আর পাটগ্রামে প্রবেশ করতে সাহস পায়নি।
পাটগ্রামের বুড়িমারী হাসর উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ নম্বর সেক্টরের সদর দপ্তর স্থাপিত হয়। এম কে বাসারের নেতৃত্বে এ সেক্টরের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। অস্ত্র সংগ্রহের জন্য আবিদ আলী বাউরা সাব-সেক্টরের সমন্বয়ক জলিলুর রহমান ও নীলফামারীর আব্দুর রউফ এমএনএ- কে সঙ্গে নিয়ে ভারতের জলপাইগুড়িতে যান। সেখানে তিনি বিভিন্ন বামপন্থী রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বেনারসে গিয়ে ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় নেয়া নেপালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ভি পি কৈরালার সঙ্গে দেখা করেন। কলকাতায় ফিরে আবিদ আলী তাঁর এসব কার্যক্রম সম্পর্কে প্রাধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন
আহমদ কে অবহিত করেন।
পাটগ্রামকে কেন্দ্র করে আবিদ আলী এমপিএ-র নেতৃত্বে মুক্তাঞ্চলকে একটি প্রশাসনিক অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলা হয়। এ কার্যক্রম ভারতের কুচবিহার থেকে শুর হয়। প্রশাসনিক অঞ্চলের নাম দেয়া হয় জোনাল এডমিনিস্ট্রেটিভ অফিস, নর্থ জোন। ফয়েজ উদ্দিন আহম্মেদ জোনাল এডমিনিস্ট্রেটরের দায়িত্ব পালন করেন। আবিদ আলী এমপিএ ও কাজী নুরুজ্জামান এখানকার চেকপোস্টে অনেককে কাস্টমস অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেন। জোনাল অফিস থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের যাবতীয় কার্যাদি সম্পাদিত হতো। মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য ৬ নম্বর সেক্টর সদর দপ্তর বুড়িমারীতে হাসপাতাল স্থাপন করা হয়। এখানে ডা. এজাহার উদ্দিন চিকিৎসক হিসেবে এবং তানি, রিনাসহ অনেকে সহযোগী হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা প্রদান করেন। মুক্তিযুদ্ধ সমর্থনকারী পাটগ্রাম টি এন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এককালীন সম্মানী ভাতা মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার্থে প্রদান করা হয়। এখানকার নারী সমাজ, বিশেষ করে মোমেনা আবিদ, ফাতেমা তফিজ, সাজেদা খাতুন, ফেরদৌস জাহান ও আনোয়ারা বেগমের উদ্যোগে গঠিত থানা মহিলা সংগ্রাম পরিষদ মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহযোগিতা প্রদান ও অনুপ্রাণিত করেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণাদানের জন্য বিপ্লবী সাংস্কৃতিক পরিষদ গঠিত হয়। মুক্ত এলাকায় কোনোভাবে যাতে অনৈতিক কার্য সংঘটিত না হয় সেজন্য সংগ্রাম পরিষদের সদস্য তফিজ উদ্দিন, জলিলুর রহমান, আজিজার রহমান, আবুল হোসেন, তোজাম্মেল হোসেন, আবতাব উদ্দিন, এন্তাজ মিয়া, আশরাফ হোসেন, জবেদ মিয়া, আমিনুর রহমান ও আহসানুল হকসহ অনেকে দিনরাত পরিশ্রম করে মুক্তাঞ্চলে একটি স্বচ্ছ ও গতিশীল প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। এমনকি এখানে বিচারিক আদালতও গঠন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য এখানকার প্রতিটি মানুষ সদা সচেষ্ট ছিলেন। ১০ই অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এখানে এসে বড়খাতা রণাঙ্গন পরিদর্শন করে সন্তোষ প্রকাশ করেন। সন্ধ্যায় তিনি টি এন উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জনসমাবেশে জনতার উচ্ছ্বাস ও সাহসিকতা দেখে অভিভূত হন। তিনি এদিন রাতে সেক্টর হেডকোয়ার্টার্সে রাত্রি যাপন করে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেন। পরদিন আবিদ আলী এমপিএ-এর অনুরোধে তিনি আবারো পাটগ্রামে এসে পাবলিক অডিটরিয়ামে বিপ্লবী সাংস্কৃতিক পরিষদের আহ্বায়ক বেতার শিল্পী সিরাজ উদ্দিন, মশু, তোতা, মোজাম্মেল, রতন লাল, এমি-সহ অনেকের কণ্ঠে বিপ্লবী সঙ্গীত শুনে তাঁদের প্রশংসা করেন। আবু বক্কর ছিদ্দিকের বাঁশি শুনে মুগ্ধ হয়ে প্রধানমন্ত্রী রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের বিপ্লবী সঙ্গীতের মাধ্যমে উজ্জীবিত করতে আহ্বান জানান। এরপর অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান পাটগ্রাম পরিদর্শন করেন। তাঁরা পরিদর্শনকালে বাংকারে- বাংকারে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ দেন। এক সময় ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম এমএনএ, ছাত্রনেতা নূরে আলম সিদ্দিকী, অধ্যাপক হামিদুর রহমান, মোস্তফা সরওয়ার-সহ অনেকে এ এলাকা পরিদর্শন করেন। অনেক বিদেশী সাংবাদিক এসে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব দেখে অভিভূত হয়ে ফিরে গিয়ে সে সংবাদ বিশ্বময় পরিবেশন করেন। ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ ডোনাল্ড চেসওয়ার্থ- (মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাজ্যে গঠিত ‘War on Want’ সংগঠনের সভাপতি এবং বাংলাদেশ ফান্ড-এর অন্যতম ট্রাস্টি) এসে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের ছবি ও ভিডিও বৃটেনসহ কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোতে প্রেরণ করেন, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্বজনমত গড়ে তুলতে সহায়তা করে।
পাটগ্রাম উপজেলায় একটি গণকবর আছে গণকবর। এখানে ৬ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধাকে কবর দেয়া হয়। পাটগ্রাম মুক্তাঞ্চল হলেও এখানকার মুক্তিযোদ্ধারা পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে অবস্থিত পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে আক্রমণ করেন এবং হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন যুদ্ধে অংশ নেন। ২২শে অক্টোবর সকাল ১০টায় কমান্ডার আশরাফুল হকের নেতৃত্বে প্রায় ১০০ জন মুক্তিযোদ্ধা টংডাভাঙ্গা, ভবানীপুর ও সিংগীমারী (হাতীবান্ধা থানার সীমান্তে) অবস্থিত পাকিস্তানিদের ক্যাম্প আক্রমণ করেন। পাকসেনারা তাদের ক্যাম্প থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পাল্টা আক্রমণ করলে দুপক্ষের মধ্যে ৩ ঘণ্টাব্যাপী যুদ্ধ চলে। এক সময় পাকসেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস ছামাদ, হাবু ও খয়বর এক পর্যায়ে সম্মুখে এগিয়ে গেলে লুকিয়ে থাকা পাকসেনারা অতর্কিতে পেছন থেকে তাঁদের আক্রমণ করে এবং হাবু ও খয়বরকে তারা ধরে ফেলে। ক্যাম্পে নিয়ে তাঁদের অমানবিক অত্যাচার শেষে হত্যা করে। এ অপারেশনের সময় ক্যাম্পটি দখল করতে না পারলেও পরে শক্তিবৃদ্ধি ও পরিকল্পিত সম্মুখ যুদ্ধে পাকবাহিনীকে পরাজিত করে মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্পটির ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন।
৯ই নভেম্বর কোম্পানি কমান্ডার মো. মোকলেছুর রহমান প্রধান তাঁর কোম্পানি নিয়ে বড়বাড়িহাট (বর্তমানে লালমনিরহাট সদর থানাভুক্ত) অপারেশনে যান। এটি ছিল একটি ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশন। কারণ লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামের মধ্যবর্তী স্থানে রাস্তার পাশে বড়বাড়িহাটের অবস্থান ছিল বলে দুদিক থেকেই পার্কসেনাদের আসার আশংকা ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা বড়বাড়িহাট থেকে একটু দূরে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেন। হানাদার সৈন্যদের গতিবিধি লক্ষ করতে ও তাদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা একটি বাড়িতে লুকিয়ে থাকেন। এ বাড়ির পার্শ্ববর্তী একটি বন্ধ ঘরে ৬-৭ জন পাকসেনার একটি দল এসে দরজা খুলে ঘরে কাউকে না পেয়ে কিছুক্ষণ থেকে ফিরে যায়। অথচ পাশের ঘরেই মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান করছিলেন। কিছুক্ষণ পরে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ স্থানে যাওয়ার জন্য বের হলে পাকসেনারা তাঁদের লক্ষ করে গুলি ছোড়ে। গুলিতে মুক্তিযোদ্ধা মুক্তার এলাহি শহীদ হন। তবে অন্য মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরক্ষা ক্যাম্পে ফিরে আসতে সক্ষম হন।
১৬ই নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা ভোটমারী ভাকারী রেলব্রিজ (হাতীবান্ধা-কালীগঞ্জ থানার মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত) ধ্বংস করার জন্য একটি অপারেশন পরিচালনা করেন। পাকবাহিনী এ রেলপথে তাদের রসদ সরবরাহ করত। ব্রিজটিতে রাজাকারদের পাহারা ছিল। রাতের বেলা অপারেশন শুরু হয়। ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা এ অপারেশনে অংশ নেন। জ্যোৎস্না রাতে ক্ষেতের আল দিয়ে অগ্রসর হওয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধাদের আলাপচারিতা শুনে রাজাকাররা তাঁদের লক্ষ করে গুলিবর্ষণ করে। অপ্রস্তুত মুক্তিযোদ্ধারা উপায়ান্তর না দেখে আত্মরক্ষার্থে নিরাপদ স্থানে ফিরে যান। ভোর হওয়ায় অপারেশন স্থগিত ঘোষণা করা হয়।
২৫শে নভেম্বর বিকেলবেলা একদল মুক্তিযোদ্ধা দইখাওয়া বাজারে (হাতীবান্ধা থানাধীন) গেলে তাঁদের কাছে খবর আসে যে, হাতীবান্ধার কেটকীবাড়ী গ্রামে হানা দিয়ে রাজাকার ও পাকসেনারা মানুষের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে। তৎক্ষণাৎ ৭ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল সেখানে যায়। তাঁরা ঘটনাস্থল থেকে ২০০ গজের মধ্যে দুজন-দুজন করে তিনদিকে অর্ধচন্দ্রাকৃত হয়ে শুয়ে হানাদারদের লক্ষ করে এলএমজি ও এসএলআর-এর গুলিবর্ষণ করতে থাকেন। তিনদিক থেকে গুলি বর্ষিত হওয়ায় রাজাকার ও পাকিস্তানি সৈন্যদের ধারণা হয় যে, তারা বিপুলসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। ফলে ভয়ে তারা আধঘণ্টার মধ্যে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে সেখানে একজন পাকসেনা নিহত হয়। সাধারণ মানুষের বাড়িঘর রক্ষায় মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে যাওয়ায় এলাকার মানুষের মনোবল বৃদ্ধি পায়।
নভেম্বর মাসে রমজানের ঈদের দিনের আগের রাতে পাকবাহিনী বড়খাতা (হাতীবান্ধা) অবস্থান থেকে পাটামের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর মেশিনগান, মর্টার ও আর্টিলারিগানের ফায়ার করে। মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা গুলিবর্ষণ শুরু করলে দুপক্ষের মধ্যে সারারাত যুদ্ধ চলে। পরদিন (ঈদের দিন) পাকবাহিনী বড়খাতা ছেড়ে চলে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা পলায়নরত পাকসেনাদের ওপর গুলিবর্ষণ করলে তারা পাল্টা গুলি করে পিছু হটতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা এদিন হাতীবান্ধা পর্যন্ত প্রায় ৮ মাইল স্থান নিজেদের দখলে নেন। তবে পাকিস্তানি হানাদারদের গুলিতে হাবিলদার জাফর আলী (ইপিআর) ও সিপাহি মোমিন শহীদ হন। মুক্তিযোদ্ধারা কাছাকাছি স্থানে একটি অস্থায়ী প্রতিরক্ষা অবস্থান নেন। পরদিন সেক্টর কমান্ডার এম কে বাসার, মেজর নওয়াজেস ও ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান এখানে আসেন। বিকেল ৩টায় ভারতীয় সেনাবাহিনী এসে আর্টিলারি কামান দিয়ে শত্রুদের ওপর গোলা নিক্ষেপ করে। প্রায় ২০ মিনিট ভারতীয় বাহিনীর গোলাবর্ষণের পর মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুদের ওপর আক্রমণ করেন। তাঁরা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে পাকিস্তানিদের প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর আঘাত হানেন। বড়খাতা যুদ্ধ নামে পরিচিত এ আক্রমণে পাকবাহিনীর ১৫ জন সৈন্য মারা যায়। এ-যুদ্ধের পরিণতিতে পাকবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর মুক্তিযোদ্ধাদের দখল প্রতিষ্ঠিত হয়। তারপর মুক্তিযোদ্ধারা হাতীবান্ধা রেলস্টেশন দখল করেন। এখান থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ৭ দিনের মধ্যে রংপুর হারাগাছ তিস্তা নদীর কাছ পর্যন্ত পৌঁছতে সক্ষম হন। নদীর এপারে মুক্তিযোদ্ধারা এবং ওপারে পাকবাহিনী অবস্থান নেয়। সেখানে ৪ দিন যুদ্ধ করার পর ঐ এলাকার পাকহানাদার বাহিনী ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পাকসেনারা কখনো পাটগ্রামে প্রবেশ করতে পারেনি। পাটগ্রাম সবসময় মুক্তাঞ্চল ছিল।
পাটগ্রামের শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আফজাল হোসেন (পিতা জালিমুদ্দিন, ধবলসতী), আব্দুল হক (পিতা নেন্দো মোহাম্মদ, উফারমারা, শ্রীরামপুর), ফজলুল হক (পিতা রংগু মিয়া, জমগ্রাম, বাউরা), আনোয়ার (পিতা আ. ছোবাহান, বাউরা), নজরুল ইসলাম (পিতা জাহাঙ্গীর আলম, জমগ্রাম, বাউরা), শহির মিয়া (পিতা জাকির হোসেন, জমগ্রাম, বাউরা), মকবুল হোসেন (পিতা নায়েব আলী, নবীনগর, বাউরা) এবং হাবিবুর রহমান হাবু (পিতা আ. রাজ্জাক, কৈটারী, মদাতী, উপজেলা কালিগঞ্জ, লালমনিরহাট)। পাটগ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা খয়বর (ময়মনসিংহ), জাফর আলী, সিপাহি মোমিন ও মুক্তার এলাহি শহীদ হন।
পাটগ্রামে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে ৬ নম্বর সেক্টর হেডকোয়ার্টার্স বুড়িমারীতে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। পাটগ্রাম উপজেলা চত্বরে শহীদ আফজাল মিলনায়তন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পাটগ্রাম রেলগেট থেকে থানা মোড় পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে আবিদ আলী স্মরণী। এছাড়া পাটগ্রাম উপজেলা সদরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিসহ মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স নির্মিত হয়েছে। [মন্জুরুল হক]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!