You dont have javascript enabled! Please enable it! স্থানীয় মুক্তিবাহিনী পাঠান বাহিনী (হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর) - সংগ্রামের নোটবুক

স্থানীয় মুক্তিবাহিনী পাঠান বাহিনী (হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর)

পাঠান বাহিনী (হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর) একটি স্থানীয় মুক্তিবাহিনী। এর প্রধান ছিলেন চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলার অলিপুর গ্রামের আবদুল গনি পাঠানের পুত্র জহিরুল হক পাঠান ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে তিনি অসীম সাহস ও বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন এবং খেতাবপ্রাপ্ত হন। ১৯৬৭ সালে দেশে প্রত্যাবর্তন করলে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে সাফল্যের জন্য তাঁকে চট্টগ্রাম লালদিঘি ময়দান, চাঁদপুর, হাজীগঞ্জ, মতলব ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্মাননা জানানো হয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে তিনি সুবেদার হিসেবে যশোর ক্যান্টনমেন্টে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭১ সালের প্রথম দিকে যশোর থেকে লাহোরে বদলি করলে তিনি ২ মাসের ছুটি নিয়ে বাড়ি আসেন। আ. করিম পাটোয়ারী এমপিএ, পাকিস্তান গোলন্দাজ বাহিনীর হাবিলদার আ. সাত্তার, প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন বাবুল, ডা. আ. ছাত্তার প্রমুখের পরামর্শ এবং সহযোগিতায় ১৮ই মার্চ হাবিলদার আ. সাত্তার (হারেস ওস্তাদ)-এর নেতৃত্বে অলিপুর গ্রামে গড়ে ওঠা ৩০ জন ছাত্র-যুবকের মুক্তিফৌজের দলটির নেতৃত্ব ১০ই এপ্রিল জহিরুল হক পাঠান গ্রহণ করেন। ৩০ জনের এ দলটিতে আরো ছিলেন নায়েব সুবেদার আ. সাত্তার (সহ-অধিনায়ক), সুবেদার আ. গফুর, হাবিলদার আ. হাফিজ, নায়েক মোস্তফা কামাল পাঠান, সিপাহি শহীদ উল্লাহ, শহীদ উল্লাহ মীর, সিপাহি আ. রব, সিপাহি আব্দুল মান্নান, নৌসেনা মো. রুহুল আমিন, মো. দেলোয়ার হোসেন বাবু, এ এফ আজিজ মন্টু, মো. তরিকুল্লাহ পাঠান, দিদারুল আলম পাটোয়ারী, মো. সফিউল্লাহ পাঠান, মো. বশির উল্লাহ পাঠান, মো. লোকমান পাঠান, মো. আবু মুন্সি, মো. দেলোয়ার হোসেন দিলু, মো. সাইফুল ইসলাম মীর, এ এফ রশীদ মানিক, মফিজুল ইসলাম মিয়াজি, তফাজ্জল হোসেন মীর, মো. আবুল বাসার, আ. মতিন, শহীদ উল্লাহ, নজির আহমেদ, সিপাহী বতু মিয়া প্রমুখ। এ-সময় চাঁদপুর মহকুমায় একটি স্বাধীন সরকারের প্রশাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য জহিরুল হক পাঠানকে সেকেন্ড-ইন-চিফ নিযুক্ত করা হয়। যুদ্ধ পরিচালনার জন্য তিনি স্থানীয়ভাবে সরকারের আদলে গঠিত নেতৃত্বের সঙ্গে একটি ডকুমেন্ট তৈরি করেন, যা ছিল এরূপ- ক) সিভিল প্রশাসন খাদ্য সংগ্রহ করবে এবং খাদ্য এক জায়গা থেকে সরবরাহ করা হবে; খ) খাদ্য সংগ্রহের সোর্স হিসেবে প্রাথমিকভাবে সরকারি খাদ্য ভাণ্ডারগুলো মুক্তিবাহিনীর আয়ত্তে আনা হবে; খাদ্য সংগ্রহে ডিফেন্সের প্রয়োজন হলে মুক্তিযোদ্ধারা সাহায্য করবে; গ) সামরিক নিয়ম-কানুন অনুযায়ী সুবেদার জহিরুল হক পাঠানের কমান্ডে সকল যুদ্ধ ও গেরিলা আক্রমণ পরিচালিত হবে; ঘ) সংগৃহীত খাদ্য, অর্থ ও সম্পদ সংগ্রাম কমিটি ও সিভিল প্রশাসনের নিকট থাকবে; ঙ) প্রতিমাসে মুক্তিযোদ্ধাদের সামান্য হলেও ভাতা এবং সপ্তাহে ৫ প্যাকেট সিগারেট দেয়া হবে, যাতে তাদের পরিবার-পরিজনের প্রতি দুশ্চিন্তা না থাকে এবং অন্য কারণে দল ছেড়ে বাইরে যেতে না হয়।
এ বাহিনী প্রথমে ফরিদগঞ্জ থানার খাদ্য গোডাউন থেকে কয়েকশ মন চাল ও গম হস্তগত করে। পাঠান বাহিনীর আরেক বলিষ্ঠ নেতা ছিলেন বিশিষ্ট সমরকুশলী ও বীরযোদ্ধা কলিমউল্লাহ ভূঁইয়া। ভূঁইয়া মোহাম্মদ কলিমউল্লাহ ছিলেন চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ থানার কাসিমাবাকের রামচন্দ্রপুর গ্রামের হায়দার আলী ভূঁইয়ার পুত্র। ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই তিনি চাঁদপুরের হাজিগঞ্জ থানায় কয়েকজনের সহযোগিতায় সংগ্রাম কমিটি গঠন করে প্রশিক্ষণ কর্মকাণ্ড শুরু করেন। এ কাজে তাঁকে সহযোগিতা করেন মতলবের সুবেদার আব্দুল হক, হারেস, অলিপুরের নায়েক সুবেদার আব্দুস সাত্তার পাটোয়ারী প্রমুখ। ২৬শে মার্চের পর চাঁদপুর মহকুমা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলে তিনি এ পরিষদের সদস্য হন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী চাঁদপুরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়ার পর হাজীগঞ্জে যে পাঠান বাহিনী গঠিত হয়, তিনি তার অন্যতম সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। তিনি সর্বদা সামরিক নেতা হিসেবে জহিরুল হক পাঠানকে মেনে চলতেন এবং পাঠানও কলিমউল্লাহ ভূঁইয়াকে পূর্ণ মর্যাদা দিতেন। এ দুজনের মিলিত শক্তিই পাঠান বাহিনীর মূল ভিত্তি ছিল।
পাঠান বাহিনীর হেডকোয়ার্টার্স শুরুতে পাইকপাড়া হাইস্কুল হলেও পরবর্তী সময়ে ভৌগোলিক ও কৌশলগত কারণে নোয়াখালীর রামগঞ্জের পানি আলী গ্রামের ঠাকুর বাড়িতে স্থানান্তর করা হয়। ডা. বদরুন্নাহার চৌধুরী (পরে সিভিল সার্জন, চাঁদপুর জেলা সদর হাসপাতাল) ও ডা. জয়নাল আবেদিন (পরে সোরসাগ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ- সভাপতি) হেডকোয়ার্টার্সে অবস্থান করে দায়িত্ব পালন করেন। পাঠান বাহিনীতে শুরুতে প্রায় ২০০ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তাঁদের অঞ্চলভিত্তিক ৫টি ভাগে বিভক্ত করে প্রতিরক্ষাব্যূহ রচনা করা হয়। এ বাহিনীর অঞ্চলভিত্তিক কমান্ডাররা ছিলেন— নায়েক সুবেদার আলী আকবর পাটোয়ারী (রামগঞ্জ), দায়িত্বভুক্ত এলাকা— হাজীগঞ্জ, রামগঞ্জ, চাটখিল, রায়পুর ও লাকসামের কিছু অংশ; নায়েক সুবেদার জহুরুল ইসলাম (বরিশাল), দায়িত্বভুক্ত এলাকা— মতলব থানা; সার্জেন্ট জয়নাল আবেদিন চৌধুরী (চাঁদপুর), দায়িত্বভুক্ত এলাকা— চাঁদপুর ও হাইমচর; নায়েক সুবেদার আবদুর রব (ফরিদগঞ্জ), দায়িত্বভুক্ত এলাকা— ফরিদগঞ্জ ও রামগঞ্জের কিছু অংশ এবং রায়পুরের কিছু অংশ; হাবিলদার সিরাজুল ইসলাম (কচুয়া), দায়িত্বভুক্ত এলাকা— কচুয়া থানা; নায়েব সুবেদার মফিজ (শাহরাস্তি), দায়িত্বভুক্ত এলাকা— হেডকোয়ার্টার্স। ধীরে-ধীরে পাঠান বাহিনীর সদস্য সংখ্যা বেড়ে ৮৯৭ জনে পৌঁছায়। যুদ্ধের শেষদিকে এ সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পায়।
পাঠান বাহিনীর একটি গোয়েন্দা ইউনিট ছিল। এটি জহিরুল হক পাঠান এবং কলিমউল্লাহ ভূঁইয়া কেন্দ্ৰীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন। উল্লেখ্য যে, পাঠান বাহিনীর বেসামরিক প্রশাসন হাজীগঞ্জে গঠিত সংগ্রাম কমিটির মাধ্যমেই পরিচালিত হতো। পাঠান বাহিনীর অস্ত্রের উৎস মূলত চাঁদপুরের বিভিন্ন থানা দখল করে সংগৃহীত অস্ত্রশস্ত্র। এছাড়া পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের সঙ্গে সংঘর্ষের পর তাদের ফেলে যাওয়া অস্ত্র বাহিনীর অস্ত্রের চাহিদা অনেকটা পূরণ করে। এছাড়া, পাঠান বাহিনী ২নং সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের নিকট থেকে ৫০,০০০ গুলি ও কিছু গ্রেনেড পেয়েছিল।
ফরিদগঞ্জের পাইকপাড়া হাইস্কুল মাঠ, হেডকায়ার্টার্স পানিআলী গ্রামের ঠাকুর বাড়ি, টোরাগড় বাজার, নরিংপুর বাজার, লোটরা বাজার, উগারিয়া বাজার, সোরসাগ বাজার, বটতলা প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠ, হাসনাবাদ বাজার, আলী নকীপুর হাইস্কুল মাঠ, কাদরা প্রাইমারি স্কুল মাঠ, রামো প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠ, গৃহকালিন্দিয়া হাইস্কুল মাঠ, চররামপুর হাইস্কুল মাঠ, কালির বাজার, দক্ষিণ সাহেবগঞ্জ প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠসহ চাঁদপুরের বিভিন্ন থানার বিভিন্ন স্থান ছিল পাঠান বাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
পাঠান বাহিনীর যোদ্ধাগণ চাঁদপুরের মতলব, হাজীগঞ্জ, ফরিদগঞ্জ, কচুয়া, হাইমচর, সদর, নোয়াখালীর রামগঞ্জ, চাটখিল, লক্ষ্মীপুরের রায়পুরের উত্তর-পূর্বাংশ, কুমিল্লার লাঙ্গলকোট, দাউদকান্দির দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ও লাকসাম অঞ্চলে যুদ্ধ করেছেন। এ বাহিনী ২৬টি সফল যুদ্ধের নেতৃত্ব দেয়, যার মধ্যে বাশারা যুদ্ধ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ বাহিনীর প্রথম যুদ্ধ ছিল গাজীপুরের যুদ্ধ। এ-যুদ্ধে তাঁরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি লঞ্চ ধ্বংস করেন। এতে বেশ কয়েকজন হানাদার সৈন্য নিহত হয় এবং ২টি হেভি মেশিনগান, ১টি ৩ ইঞ্চি মর্টার, ১টি রকেট লাঞ্চার, ৪টি চাইনিজ এলএমজি ও প্রচুর রাইফেল এ বাহিনীর হস্তগত হয়। পুরোপুরি মুক্তাঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত না হলেও এ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল প্রায় ১০০০ বর্গমাইল এলাকা।
বাহিনী প্রধান জহিরুল হক পাঠান ২০শে অক্টোবর বাংলাদেশ সরকার-এর আমন্ত্রণে কলকাতা গমন করেন। সেখানে ২নং সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের সঙ্গে দেখা করে তিনি বাহিনীর কার্যক্রম বিস্তারিত তুলে ধরেন। সেক্টর কমান্ডার জহিরুল হক পাঠানকে চাঁদপুর সাব-সেক্টর কমান্ডার (সেক্টর কোড নাম মধুমতি ও নম্বর ১২০৪) নিযুক্ত করা হয়। পাঠান বাহিনী যুদ্ধকালে সংগৃহীত সমস্ত অস্ত্র ২৯শে ডিসেম্বর চাঁদপুর টেকনিক্যাল হাইস্কুল মাঠে বাংলাদেশ সরকারের কাছে হস্তান্তর করে। উল্লেখ্য, শুধু পাঠান বাহিনীর অস্ত্রই নয়, চাঁদপুর এফএফ এবং বিএলএফ যোদ্ধাদের অস্ত্রও সাব-সেক্টর কমান্ডার জহিরুল হক পাঠানের মাধ্যমে সরকারের নিকট হস্তান্তর করা হয়। [মনিরুজ্জামান শাহীন ও মিথুন সাহা]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড