১০ শ্রাবণ ১৩৭৮, মঙ্গলবার ২৭ জুলাই, ১৯৭১
মেজর জিয়া তাঁর রেজিমেন্টের কোম্পানিকে সুবেদার আলতাফের নেতৃত্বে মুক্ত এলাকা রৌমারীতে অবস্থান গ্রহণের জন্য এদিন প্রেরণ করেন। পরবর্তীতে তাঁদেরকে দিয়ে তিনি ‘জেড
ফোর্স’ গঠন করলেন। উল্লেখ্য, মেজর জিয়াউর রহমান ছিলেন চট্টগ্রাম, পার্বত্য-চট্টগ্রাম ও ফেনী নদী পর্যন্ত এলাকা নিয়ে গঠিত এক নম্বর সেক্টরের কম্যান্ডার। তিনি জুন মাস পর্যন্ত এক নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর এই সেক্টরের দায়িত্ব নেন ক্যাপ্টেন ( পরে মেজর)
মোহাম্মদ রফিক। উল্লেখ্য ২৭মার্চ স্বাধীন বাংলা বেতারে স্বাধীনতা ঘোষণা ও চট্টগ্রামের প্রতিরোধ সংগ্রামের উজ্জ্বল ইতিহাসের সঙ্গে মেজর জিয়ার নাম ইতিহাসের ষ্ট্যালিন গ্রাড প্রতিরোধ সংগ্রামের সঙ্গে তুলনীয়। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করে বাঙালীর হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন।
মুক্তিযোদ্ধা আখরুজ্জামান মণ্ডল লিখেছেন, সুবেদার আলতাফের নেতৃত্বে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যরা রৌমারী মুক্ত এলাকায় মানুষের মধ্যে ত্রাসের সৃষ্টি করে।… এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে আসাম বি এস এফ কর্তৃপক্ষ সুবেদার আলতাফ ও তার কোম্পানিকে রৌমারী থেকে তুরায় ফেরত জেতে বাধ্য করেন। (উত্তর রণাঙ্গনে বিজয় পৃঃ ৯০)
বিপ্লবী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনিক জোন প্রতিষ্ঠার বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। (৩ খঃ পৃঃ ৮৬)
সিনেটর প্রক্সামায়ার ও সিনেটর উইলিয়াম স্যাক্সবি মার্কিন সিনেটে বলেন, অবশ্যই বাংলাদেশে ট্র্যাজেডীর অবসান হওয়া উচিত। গণহত্যা, তা জেভূখণ্ডেই সংঘটিত হোক না কেন কখনোই সমর্থন পেতে পারে না। ধর্মীয় বিশ্বাসবোধের কারণে হাজার হাজার নরনারী-শিশু বর্বরতার শিকার হবে, তাঁদের ওপর ধ্বংসযজ্ঞ চলবে, কোন সভ্য মানুষ তা মেনে নিতে পারে না। পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের রায়ের প্রতিই কেবল বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেননি, লাখ লাখ অধিবাসীকে মাতৃভূমি ত্যাগে বাধ্য করেছেন। এসব হতভাগ্য মানুষের সামনে এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যত। পূর্ব পাকিস্তানে এখনো বেসামরিক নাগরিকদের ওপর নিপীড়ন–নির্যাতন চলছে। অধিকাংশ মানুষ সেখানে সশস্ত্র অবস্থায় রয়েছে। যে কোন মুহূর্তে তাঁদের ওপর চরম ব্যবস্থা নেমে আস্তে পারে বলে তাঁরা মনে করেছেন। মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য ইতিমধ্যে হাজার হাজার তরুন গেরিলা বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। তাঁরা প্রশিক্ষণ নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে শুরু করেছে। এদের সংখ্যা ৩০ হাজারের কম নয়। পাকিস্তান সরকার এ মুহূর্তে প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বীদের সাথে সত্যিকার রাজনৈতিক মীমাংসার উদ্যোগ না নিলে কেবল পাকিস্তানের নয় গোটা অঞ্চলের ভাগ্য অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে। (সংবাদপত্র)
সুনামগঞ্জের বালট সাব-সেক্টরের এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধার দল দু’টি নৌকায় বিরাম পুর পৌছে গ্রামে অবস্থান নেয়। ৫০জন পাক হানাদার সেনা হালুয়াঘাট থেকে ভারী অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে মুক্তি যোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর হামলা চালায়। ৭জন পাকসেনা খতম হন । তিনজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়, কিন্তু মরদেহগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। (মুঃ যুঃ সুঃ পৃঃ ৪৫)
আগষ্ট মাসের প্রথম দিকে পাকিস্তানের সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের বিচার শুরু হবে বলে খবর পাওয়ার পর বিচারপতি চৌধুরী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী স্বয়ং ম্যাকব্রাইডকে ইসলামাবাদ পাঠাবার ব্যবস্থা করেন। লণ্ডনের বার্ণার্দ শেরিডান সলিসিটার্স নামক প্রতিষ্ঠানের একজন অভিজ্ঞ সলিসিটারও তার সংগে যান। ১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় এই প্রতিষ্ঠানের “ব্রিফ” গ্রহণ করে শ্রমিকদলীয় পার্লামেন্ট সদস্য স্যার টমাস উইলিয়ামস কিউ সি, বঙ্গবন্ধুর পক্ষ সমর্থন করার জন্য ঢাকা গিয়েছিলেন। মিঃ ম্যাকব্রাইডকে পাঠাবার আগে বিচারপতি চৌধুরী এ সম্পর্কে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সংগে টেলিফোনে আলাপ করেন। তিনি বলেন, কাজ হোক বা না হোক বঙ্গবন্ধুর জন্য সকল রকম চেষ্টাই করতে হবে, তাতে যত খরচই হোক। ২৪ শেল জুলাই (শনিবার) মিঃ ম্যাকব্রাইড ইসলামাবাদ পৌঁছে কয়েকজন উচ্চপদস্থ সরকারী অফিসারের সঙ্গে দেখা করেন। ইয়াহিয়া খান নিজে দেখা করতে অস্বীকার করে। কাজেই বাধ্য হয়ে তিনি ইয়াহিয়ার আইন বিষয়ক উপদেষ্টা কর্ণোলিয়াসের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি ( কর্ণেলিয়াস) বলেন, কোন বিদেশী আইনজীবীকে শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ অথবা তাঁর পক্ষ সমর্থন করতে দেওয়া হবে না। ইয়াহিয়া খানের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রুদ্ধদ্বার কক্ষে শেখ মুজিবের বিচার অনুষ্ঠিত হবে এবং তাঁর পক্ষ সমর্থন করার জন্য একজন পাকিস্তানী আইনজীবি নিয়োগ করা হবে। শেখ মুজিবের সঙ্গে এই প্রথমবার মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে দেখা করার চেষ্টা করা হয়। গ্রেপ্তারের পর থেকে তাঁকে নির্জন কারাগারকক্ষে বন্দী করে রাখা হয়। (“দি টাইমস” ২৭ শে জুলাই, ১৯৭১)
-লন্ডনের ফিরে এসে মিঃ ম্যাকব্রাইড বঙ্গবন্ধুর পক্ষ সমর্থন করার সুযোগ না পাওয়ার জন্য দুঃখ প্রকাস করে বিবৃতিতে দেন। ( স্বাঃ সং প্রঃ বাঃ পৃঃ ৯৬)
-২৭ জুলাই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ‘শেখ মুজিবের বিচার প্রহসন’ শিরোনামে আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত কথিকা প্রচারিত হয়। কথিকায় বলা হয়।“ বাংলাদেশ অনেক মহান নেতা জন্মেছেন। দেশের জন্য তারা যথেষ্ট কষ্ট ভোগ করেছেন, নির্যাতন সহ্য করেছেন তারা সকলেই আমাদের শ্রদ্ধেয়। তবু একটা স্বীকার করতেই হবে, নির্যাতন বরণ ও নেতৃত্বদানের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যুগ সৃষ্টিকারী নেতা। তাঁর ত্যাগ, সাহস ও ব্যাক্তিত্ব অতুলনীয়। তিনি এখন শুধু বাংলার নয়ন মনি, কিংবদন্তী রাজা। জীবনের শ্রেষ্ট প্রায় বারটি বছর তিনি কাটিয়েছেন জেলে। ইয়াহিয়ার আগে আইয়ুব একবার তাঁর গলায় ফাঁসির রজ্জু পরাতে চেয়েছিলো। পারেনি। এখন আবার সেই ফাঁসির রজ্জু হাতে নিয়ে খুনী ইয়াহিয়া নতুন খুনের নেশায় মত্ত হয়ে উঠেছে। শেখ মুজিবের অপরাধ তিনি বাংলাদেশকে ভালোবাসেন। বাংলাদেশের মানুষ তাঁকে ভালবাসে। শেখ মুজিব বাংলাদেশের ইতিহাসে যে অধ্যায় যোজনা করেছেন তাঁর দ্বিতীয় নজির নেই। একটি নিয়মতান্ত্রিক গণআন্দোলন রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও নেতৃত্বের প্রভাবে তিনি রূপান্তরি করেছেন বিপ্লবে।বিপ্লবে রূপান্তরিত করেছে মুক্তিযুদ্ধে। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ আজ মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের নিরীহ নিরস্ত্র মানুষ ইতিহাসের সবচাইতে জঘন্য ও বর্বর হত্যাকাণ্ড রুখে দাঁড়িয়েছিল।… একি ইতিহাসের কম বড় বিস্ময়? এই অসম্ভব সম্ভব হয়েছে একটি মাত্র মানুষের সবল ও প্রেরণাদানকারী নেতৃত্বের জন্য। একটি নামই আজ বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুক্তি সংগ্রাম। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের সংগ্রামী ইতিহাস বঙ্গবন্ধুকে সৃষ্টি করেছে। আর বঙ্গবন্ধু সৃষ্টি করেছেন বাংলাদেশের নতুন সংগ্রামী ইতিহাস।”…।।(বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র ( অখণ্ড) পৃঃ২৬৪৬)
Reference:
একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী