পাকিস্তানি মিলিশিয়া বাহিনীর কুমিরা অভিযান (সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম)
পাকিস্তানি মিলিশিয়া বাহিনীর কুমিরা অভিযান (সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম) পরিচালিত হয় ১৯শে এপ্রিল। মিলিশিয়ারা সন্দ্বীপ চ্যানেল হয়ে গুলিয়াখালীর দিক থেকে অগ্রসর হচ্ছে মর্মে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে খবর আসে। শ্রমিক নেতা নূর আহমদসহ হাবিলদার বশর সীতাকুণ্ড সদরের নামার বাজারের পথে পশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। কিছুদূর যাওয়ার পর তাঁরা পাকবাহিনীর একটি জঙ্গি বিমান আকাশে উড়তে দেখেন। তৎক্ষণাৎ তাঁরা বিমানটিকে লক্ষ করে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়েন। বিমানটি দ্রুতগতিসম্পন্ন হওয়ায় গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। তাঁরা ক্যাম্পে এসে ক্যাপ্টেন মতিনকে বিষয়টি জানান। ক্যাপ্টেন মতিন পুনরায় তাঁদের পাক মিলিশিয়াদের প্রতিরোধ করার জন্য বশরতনগর পাঠান।
১৫-২০ জন ইপিআর সৈনিককে সঙ্গে নিয়ে নূর আহমদ ছুটে চলেন। হামিদউল্লাহাটস্থ ফজল ডাক্তারের বাড়ির সম্মুখ পর্যন্ত গিয়ে তাঁরা এলাকার সমুদ্রগামীদের কাছ থেকে জানতে পারেন যে, ছোট কুমিরা খালে একটি মাঝারি আকারের জাহাজ ভিড়েছে এবং কালো পোশাকধারী কিছু সৈনিক বেড়িবাঁধে নেমেছে। তাঁরা নিশ্চিত হন যে, এরা পাক মিলিশিয়া বাহিনীর সদস্য। দূর থেকে ইপিআর সৈনিকরা গুলি ছুড়তে থাকেন। ঘণ্টা দেড়েক সেখানে অবস্থান করার পর দ্রুত তাঁরা স্থান ত্যাগ করেন। শ্রমিক নেতা নূর আহমদ ইপিআর সৈনিকদের সঙ্গে না গিয়ে সীতাকুণ্ড স্কুল ক্যাম্পে ফিরে যান। সেখানে তিনি কাউকে দেখতে পেলেন না। তিনি জানতে পারেন ইপিআর সৈনিকরা আধঘণ্টা আগে রেললাইন ধরে মিরসরাইয়ের দিকে চলে গেছেন। নূর আহমদ ইপিআর ক্যাম্পের অস্ত্রশস্ত্র ও গোলা-বারুদের কয়েকটি কার্টুন রিক্সায় তুলে উত্তর দিকে ছুটে চলেন। কিছুদূর যাওয়ার পর উত্তর দিক থেকে একটি খালি বাস আসতে দেখেন এবং বাসটি থামিয়ে সেটিতে চড়ে তিনি মিরসরাই পৌঁছান।
পাক মিলিশিয়া বাহিনী বারআউলিয়া, বাড়বকুণ্ড ও কুমিরার উপকূলীয় সন্দ্বীপ চ্যানেল পথে পূর্বদিকে লোকালয়ের দিকে এগিয়ে যায়। কুমিরা টিবি হাসপাতালে পুনরায় ডিফেন্স স্থাপন করে তারা হত্যাকাণ্ড ও অগ্নিসংযোগ করে। তারা কুমিরার শাহ আলম ওরফে লেদু কোম্পানি, কবির ড্রাইভার, ভোলা মিয়া, রবীন্দ্র সাহা, যোগেন্দ্র শীল, আবদুল হামিদ, মুকুল দাস, কালা বাঁশী জলদাস ও বাড়বকুণ্ডের মান্দরী টোলার আব্দুল বারেকের পুত্র কবির আহম্মদকে গুলি করে হত্যা করে। মিলিশিয়া বাহিনী মুরাদপুরের ডা. নলিনীকুমার দাসের বাড়ি, ভাটেরখিলের কোয়াল বাড়ি ও সীতাকুণ্ড বাজার জ্বালিয়ে দেয়। তারা বাজারের সোবহান ফকির, লক্ষ্মিণী পাগলি, চন্দ্রনাথ ফকির, মদন বড়ুয়া, নুরুল আলম ও কবিরাজ ফণীভূষণ নন্দীকে হত্যা করে। এছাড়া তারা অধ্যাপক হারুন আল রশিদকে ধরে নিয়ে হত্যা করে।
মিলিশিয়া বাহিনী ৮নং সোনাইছড়ি ইউনিয়নে হানা দিয়ে দেলীপাড়ার ঘরে-ঘরে তল্লাশি চালায় এবং আব্দুল করিম আরকাঠীর পরিবারের সদস্য নুরুল আলমের স্ত্রী পাখিজা খাতুন, তাদের এক বছরে শিশুপুত্র মো. বেলাল ও মোহাম্মদ মুছা সওদাগরের ছয় বছরের শিশুপুত্র মুহাম্মদ সেকান্দরকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে। কণ্ঠনালীতে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতরভাবে আহত হন আব্দুল করিম আরকাঠীর দ্বিতীয় স্ত্রী ছরা খাতুন। পাকসেনারা শীতলপুরের সালেহ আহম্মদের স্ত্রী সুফিয়া খাতুনকে বন্দুকের বাট দিয়ে বেদম পেটায়। তিন মাস পর তিনি মারা যান।
নিরাপদ আশ্রয়ে সন্দ্বীপ চ্যানেল পথে যাচ্ছিল ছলিমপুরের সৈয়দ পরিবার। নৌকায় ঐ পরিবারের ১৪ জনসহ ১৫ জন যাত্রী ছিল। দালালদের মাধ্যমে খবর পেয়ে পাক মিলিশিয়া বাহিনী তাদের ওপর গুলি চালায়। এতে ঘটনাস্থলে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান সৈয়দ আহম্মদ চৌধুরীর ভাগ্নে শাহ আলম ও নৌকার মাঝি। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় সৈয়দ আহম্মদ চৌধুরীসহ পরিবারের অপর ৩ সদস্যকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়৷ ঐদিনই সৈয়দ আহম্মদ চৌধুরী ও তার সাত বছরের শিশু কন্যা নিহত হয়। গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মকভাবে আহত হন তাঁর দুই ছেলে আবুল মুনছুর চৌধুরী ও আবুল কালাম চৌধুরী। মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করা হয় সৈয়দ আহম্মদ চৌধুরীর দুই স্ত্রী সামছুন নাহার ও হোসনেআরা বেগম, ৩ মেয়ে কহিনুর বেগম, ইয়াসমিন বেগম ও রোকসানা বেগম এবং তিন ছেলে আবু তাহের মাসুদ চৌধুরী, আবুল বশর চৌধুরী ও আবুল হাসান চৌধুরীকে। [জামসেদ উদ্দীন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড