পাকুড়িয়া গণহত্যা (মান্দা, নওগাঁ)
পাকুড়িয়া গণহত্যা (মান্দা, নওগাঁ) সংঘটিত হয় ২৮শে আগস্ট। এতে ১২৮ জন নিরীহ গ্রামবাসী নিহত হন। গণহত্যার পর পাকবাহিনী গ্রামের বহু বাড়িতে লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। ২৪শে আগস্ট পাকবাহিনীর পক্ষ থেকে ঘোষণা করা যে, ২৮শে আগস্ট পাকুড়িয়া ইউনাইটেড উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এক সভা অনুষ্ঠিত হবে। এলাকার সকল মোড়ল এ সভায় উপস্থিত থাকবেন। সভায় গ্রামবাসীদের উপস্থিত থাকার আহ্বান জানানো হয়। ২৮শে আগস্ট নওগাঁ ক্যাম্প থেকে পাকহানাদার বাহিনীর আনুমানিক ১০০ সদস্য ইউনাইটেড স্কুল মাঠে উপস্থিত হয়। সেখানে সাধারণ মানুষের সামান্য উপস্থিতি দেখে তারা ক্রোধে ফেটে পড়ে। রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকসেনারা চারদিক থেকে পাকুড়িয়া গ্রাম ঘেরাও করে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বহু মানুষকে আটক করে হাইস্কুল মাঠে জড়ো করে। আটককৃতদের ওপর নির্যাতন চালানোর পর কমান্ডারের নির্দেশে পাকসেনারা উপস্থিত গ্রামবাসীকে হাঁটু গেড়ে লাইন করে বসিয়ে দেয়। এ-সময় পাকসেনাদের একটি দল পুরো গ্রামে নারীনির্যাতন, লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ ঘটায়। এরপর আটক গ্রামবাসীদের ওপর দফায়-দফায় গুলিবর্ষণ শুরু হয়। সকাল থেকে কয়েক ঘণ্টা ধরে চলা এ হত্যাকাণ্ডে ১২৮ জন নারী-পুরুষ প্রাণ হারান। গণহত্যায় বাবা, চাচা, দাদাসহ এক পরিবারের ৭ জন নিহত হন। হানাদার বাহিনী পাকুড়িয়া ত্যাগ করার পর বুলেটবিদ্ধ ও মারাত্মকভাবে আহত ১৯ জনকে উদ্ধার করা হয়। এ নির্মম হত্যাকাণ্ড নওগাঁ জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এক বর্বর অধ্যায় হিসেবে পরিচিত।
পাকুড়িয়া গণহত্যায় নিহত ১২৮ জনের মধ্যে ৭৩ জনের নাম পাওয়া গেছে। তারা হলেন- নহির উদ্দিন প্রামাণিক, সাবির উদ্দিন সরদার, বয়েজ উদ্দিন মণ্ডল, জেককার আলী মণ্ডল, মোসলেম আলী মণ্ডল, ইসমাইল হোসেন প্রামাণিক, পিয়ার বক্স প্রামাণিক, নাজিম উদ্দিন, মহির সরদার, আববাছ আলী সরদার, ফজের চৌকিদার, কেমতুল্ল্যা, মঞ্জিলা সরদার, বিনোদ আলী শাহ, মকবুল হোসেন শাহ, নজরুল ইসলাম শাহ, ঝড়ু মণ্ডল, পবন মণ্ডল, লহির মোল্যা, আবেদ আলী মোল্যা, সুরুজ আলী মণ্ডল, বাছের আলী সরদার, ইমান আলী মোল্যা, আব্দুর রহমান পাইক, হযরত আলী মোল্যা, তঞ্জের আলী মোল্যা, মহির উদ্দিন মোল্যা, মছের আলী সুতার, মোবারক আলী প্রামাণিক, আরব আলী প্রামাণিক, তালেব আলী প্রামাণিক, বারু মোল্যা, জমির আলি মোল্যা, চৈতা মোল্যা, ছবের আলী মোল্যা, ইনাত আলী করাতী, পিয়ার বক্স মণ্ডল, বাদলা মণ্ডল, কদম মোল্যা, অদল মোল্যা, বজের মোল্লা, বশরতুল্লা প্রামাণিক, মজিবর রহমান প্রামাণিক, ইসমাইল হোসেন প্রামাণিক, ফারাজ আলী প্রামাণিক, দশো মোল্যা, নেপুর মোল্যা, তছির মোল্যা, খোদাবক্স প্রামাণিক, মাদারবক্স মোল্যা, ভাদু মোল্যা, হাফিজ উদ্দিন মোল্যা, তালেব আলী মোল্যা, লবির দেওয়ান, তমিজউদ্দিন দেওয়ান, লজের আলী, লোকমান আলী, হাফেজ আলী মোল্যা, বজের পাথর, প্রফুল দেওয়ান, আব্দুল হামিদ, ওসমান আলী, নুর উদ্দিন, মোসলেম উদ্দীন, মাহতাব আলী, বদু শাহ, বুলন বেওয়া ওরফে পুড়া, কুড়ানু মোল্যা, মছির প্রামাণিক, বিরাজ মণ্ডল, ইয়াদ আলী করাতী, খছের আলী ও লজের আলী শাহ। এদের পাকুড়িয়ায় গণকবর দেয়া হয়। গণকবরের স্থানটি রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কের মাঝামাঝি দেলুয়া বাড়ি থেকে ২ কিমি দক্ষিণ-পশ্চিমে।
পাকুড়িয়া গণহত্যার সময় আহত ব্যক্তিরা হলেন- মো. শমসের প্রামাণিক, হেদায়েতুল্লাহ, মমতাজ উদ্দীন, ছাবেদ আলী, জোনাব আলী, হাছেন আলী, আশরাফুল ইসলাম, আফসার আলী, আফজাল হোসেন, আজিজুর রহমান, ইমান আলী, ইনায়েত আলী, মেরুল্ল্যা শাহ, আকন্দি, কছের, নসরতুল্লা মিঞা, মহবতুল্ল্যা, গাবু পাথর ও নাসের আলী। স্বাধীনতার পর পাকুড়িয়া গণহত্যার স্থানটি সংরক্ষণ করা হয়েছে। সেখানে একটি নামফলক নির্মিত হয়েছে। ফলকের দেয়ালে শ্বেতপাথরে শহীদ ও আহতদের নামের তালিকা রয়েছে। [চিত্তরঞ্জন মিশ্র]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড