পাকুন্দিয়া থানা যুদ্ধ (কিশোরগঞ্জ)
পাকুন্দিয়া থানা যুদ্ধ (কিশোরগঞ্জ) সংঘটিত হয় দুবার ১৫ ও ২২শে অক্টোবর। প্রথমবারের যুদ্ধে ১৪৭ জন রাজাকার ও আলবদর নিহত হয় এবং দ্বিতীয়বারের যুদ্ধে পাকসেনারা পুনরায় থানা দখল করে নেয়। এরপর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অনবরত গেরিলা হামলার কারণে টিকতে না পেরে ৩রা ডিসেম্বর তারা পাকুন্দিায়া ছেড়ে জেলা শহর কিশোরগঞ্জে চলে যায়।
আগস্ট মাসের দিকে ভারতে প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধারা নিজ-নিজ এলাকায় ফিরতে শুরু করেন। তাঁরা পাকবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকারআলবদর বাহিনীর ওপর “হিট এন্ড রান’ পদ্ধতিতে গেরিলা হামলা চালাতে থাকেন। তাঁরা এরূপ আক্রমণের মাধ্যমে প্রাকুন্দিয়ার গুনিবাড়ীর রাজাকার কমান্ডার গুনি আবদুল জব্বারকে হত্যা করেন। এর ফলে পাকবাহিনী ও রাজাকার আলবদরদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। তাই তাঁরা হানাদারদের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে বড় ধরনের অপারেশনের জন্য প্রস্তুত হতে থাকেন।
সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে পাকুন্দিয়ায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন দলের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপিত হয়। তাঁরা সম্মিলিতিভাবে পাকুন্দিয়া থানাকে শত্রুমুক্ত করার পরিকল্পনা করেন এবং ১৫ই অক্টোবর আক্রমণের দিন ধার্য করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী থানা সদর থেকে মঠখোলাগামী রাস্তাটি খোলা রেখে তিনদিক থেকে ত্রিমুখী আক্রমণ পরিচালিত হয়। আক্রমণের সময় এলাকার জনসাধারণও মুহুর্মুহু ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেয়। অতর্কিত এ সাঁড়াশি আক্রমণ এবং চতুর্দিক থেকে আসা ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে পাকবাহিনী ও রাজাকার আলবদরদের অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। তারা অস্ত্র ফেলে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। এ-সময় মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে থানার ওসি-র দায়িত্বে নিয়োজিত স্থানীয় শান্তি কমিটির সভাপতি মাওলানা হাদিউল ইসলাম (হাঁপানিয়া লক্ষিয়া), থানা শান্তি কমিটির সম্পাদক আবদুস সালাম চেয়ারম্যান (পাকুন্দিয়া) ও শান্তি কমিটির সদস্য কেরামত আলী (চরলক্ষিয়া)-সহ ১৪৭ জন রাজাকারআলবদর নিহত হয়। থানায় অবস্থানরত অন্যান্য রাজাকার, পুলিশ ও পকিস্তানি সেনারা কোনোমতে পালিয়ে যায়। জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ‘জয় বাংলা’ ধ্বনির মধ্য দিয়ে থানায় উত্তোলিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। এরপর থানা এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের একছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
অক্টোবর মাসের ২২ তারিখ হোসেনপুর থেকে ৫০-৬০ জন পাকসেনা পাকুন্দিয়া পুনর্দখলের জন্য অগসর হয়। পথিমধ্যে জাংগালিয়া এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা সাইদুর রহমান রতন তাঁর সহযোদ্ধাদের নিয়ে তাদের বাধা দেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু পাকসেনাদের গুলিতে তিনি গুরুতর আহত হন। অন্য মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর ভারী অস্ত্রের সামনে টিকতে না পেরে পিছু হটেন। ফলে পাকবাহিনী পুনরায় থানা দখল করে নেয়। মুক্তিযোদ্ধারা এরপর থেকে অনবরত চোরাগুপ্তা হামলা চালাতে থাকেন। এর ফলে ৩রা ডিসেম্বর পাকবাহিনী পাকুন্দিয়া ছেড়ে কিশোরগঞ্জে চলে যায়। পাকুন্দিয়া উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
পাকুন্দিয়া থানা যুদ্ধে শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা অংশগ্রহণ করেন। তাঁদের মধ্যে যাঁদের নাম জানা গেছে, তাঁরা হলেন: কমান্ডার সাইদুর রহমান রতন (এগারসিন্দুর), সেকেন্ড-ইন-কমান্ড মফিজ উদ্দিন মাস্টার (চরকাওনা), কমান্ডার আবু তাহের মাস্টার, কমান্ডার মোজাম্মেলুর রহমান ওরফে মোজাম মাস্টার (হোসেন্দী), টুআইসি খন্দকার জামাল উদ্দিন (য়ৈদগাঁও), সৈয়দ মোতাহার হোসেন (য়ৈদগাঁও), আবু তালেব (হোসেন্দী), মকবুল হোসেন (নারান্দী), বজলুর রহমান (হোসেন্দী), আসাদুজ্জামান (নারান্দী), দেলোয়ার হোসেন (নারান্দী), মাইজ উদ্দিন (নারান্দী), মোশারফ হোসেন (পশ্চিম রাজাবাজার, ঢাকা), আবদুল মোতালেব (পুরাতন ঢাকা), কোম্পানি কমান্ডার হজরত আলী মাস্টার (দগদগা), মো. চান মিয়া (তারাকান্দী), কোম্পানি কমান্ডার শুকুর মামুদ (পুমদি), ফারুক আহমেদ (আতিরা), খালেকুজ্জামান চান মিয়া (পুমদি), আতাউর রহমান (জামাইল), গিয়াস উদ্দিন (জগদল), জামাল উদ্দিন (বীর পাইকশা), জালাল উদ্দিন (রামপুর), আবদুল মোতাবেল (বর্শিকুড়া), হোসেন আলী (সিধলা), খলিলুর রহমান (হরিশ্চন্দ্রপট্টি), আবদুল মতিন (গোবিন্দপুর), খুর্শিদ উদ্দিন (কাপাশাটিয়া), নুরুল ইসলাম কয়েস (গোবিন্দপুর), আজহারুল ইসলাম লাল মিয়া (পুমদি), সিরাজউদ্দিন (পুমদি), শামছুদ্দিন (পুমদি), নুর হোসেন (গবিন্দপুর), রেণু মিয়া (আনুহা), ওয়াস মিয়া (লতিবপুর), শামছউদ্দিন (পুমদি), লিয়াকত আলী (পুমদি), আবদুল হামিদ (চরমুমদি), সুজিত কুমার (আশুতিয়া), মো. মতিউর রহমান (করমুলি, কিশোরগঞ্জ), গোলাম রব্বানী মুক্ত (করমুলি), রফিকুল ইসলাম মেনু (করমুলি) এবং আবদুল হামিদ (চরপুমদি)। তাঁদের সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যাঁদের নাম পাওয়া গেছে, তাঁরা হলেন: ইয়াকুব আলী (মাধখলা, হোসেনপুর) ও এ কে এম রফিকুল ইসলাম ভূঞা (বীর কাটিহারী, হোসেনপুর)। [আবদুর রব খান]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড