You dont have javascript enabled! Please enable it!

পাখুল্ল্যা যুদ্ধ (রাজৈর, মাদারীপুর)

পাখুল্ল্যা যুদ্ধ (রাজৈর, মাদারীপুর) সংঘটিত হয় ১৩ই নভেম্বর। এতে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। অপরদিকে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার আহত হয় ঘটনার দিন ভোরে রাজাকার ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মাদারীপুর জেলার রাজৈর থানার পাখুল্ল্যা গ্রামে অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে অতর্কিতে হামলা চালায়। এর আগে ১২ই নভেম্বর বাজিতপুর থেকে দুজন রাজাকারকে ধরে মুক্তিযোদ্ধাদের পাখুল্ল্যা ক্যাম্পে আনা হয়েছিল। তাদের একজনের ভাই ছিল প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার। রাতে সে মাদারীপুর পাকসেনাদের ক্যাম্পে গিয়ে ভাইকে বাঁচানোর আবেদন করে। একই রাতে কমান্ডার শেখ সেকান্দার আলীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল আমগ্রাম ব্রিজে প্রহরারত রাজাকারদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে দুজন রাজাকারকে হত্যা করে। মূলত এসব ঘটনার প্রতিশোধ নিতে হানাদার বাহিনী আমগ্রাম ইউনিয়নের পাখুল্ল্যা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারাও মর্টার ও এলএমজি দিয়ে পাল্টা আক্রমণ চালান। এ-যুদ্ধে আলাউদ্দিন নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। শহীদ আলাউদ্দিন ছিলেন পাখুল্ল্যা ক্যাম্পের একজন মুক্তিযোদ্ধা। অপরপক্ষে মুক্তিযোদ্ধাদের মর্টার শেলের আঘাতে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার আহত হয়। এদিন সকালে টেকেরহাটের রাজাকার কমান্ডার মনি হাওলাদার পাকিস্তানি সেনাদের পথ দেখিয়ে পাখুল্ল্যা গ্রামে নিয়ে আসে। মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ছিল গ্রামের সুনীল বালা ও রাসু মৃধার বাড়িতে। পাশের গ্রাম গয়লাবাড়িতে সরোয়ার হোসেন মোল্লার ক্যাম্প ছিল। পাকিস্তানি সেনারা রাজাকারদের সহায়তায় বড় নৌকায় ভারী মেশিন গান বসায়। তারা নৌকা থেকে দুই ইঞ্চি মর্টার ও সিক্স রাউন্ডের গোলা নিক্ষেপ করতে থাকে। পাকসেনারা আমগ্রাম ব্রিজের দিক থেকে রিফেট ফায়ারও করে। পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা আমগ্রাম ব্রিজের কাছে নৌকা থেকে নেমে খালপাড়ের রাস্তা ধরে পায়ে হেঁটে গুলি ছুড়তে-ছুড়তে পাখুল্ল্যা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের দিকে অগ্রসর হয়।
পাকসেনা ও রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের পাখুল্ল্যা ক্যাম্প নিজেদের দখলে নিয়ে গয়লাবাড়ির ক্যাম্পের দিকে তিন ইঞ্চি মর্টারের অবিরাম গোলা নিক্ষেপ করতে শুরু করে। অবস্থা বেগতিক দেখে কমান্ডার আবদুল কাদের মোল্লা ৪০-৫০ জন সহযোদ্ধা নিয়ে প্রতিরোধ না করে বিলের দিকে সরে যান। মাদারীপুর থানার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার খলিল খান তাঁর কলাগাছিয়া গ্রামের ক্যাম্প থেকে দুই ইঞ্চি মর্টার এনে বেলা ১২টার দিকে পাকসেনাদের দিকে পাল্টা মর্টারের গোলা নিক্ষেপ শুরু করলে যুদ্ধ ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। প্রবল প্রতিরোধের মুখে হানাদার বাহিনী গয়লাবাড়ি গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের দিকে অগ্রসর হতে সাহস পায়নি। বিকেল ৩টার দিকে পাখুল্ল্যা গ্রামে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পর টেকেরহাট ক্যাম্পে ফিরে যাবার পথে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা খাল সংলগ্ন ধানক্ষেতের পানির মধ্য থেকে আলাউদ্দিনের ভাসমান লাশ তুলে আমগ্রাম ব্রিজের ওপর টেনে আনে। বাস ড্রাইভার মধু মিয়াকে আলাউদ্দিনের লাশ বাসের পেছনে বেঁধে বাস চালাতে বললে সে এভাবে লাশ টানতে অস্বীকার করে। ফলে পাকিস্তানি সৈন্যরা আলাউদ্দিনের লাশ ব্রিজের নিচে নদীতে ফেলে দিয়ে চলে যায়।
মুক্তিযোদ্ধা মো. আলাউদ্দিন (পিতা কফিলউদ্দিন মাতবর, বান্ধব দৌলতপুর, ইউনিয়ন কুনিয়া) আমগ্রাম রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে ডিউটি করছিলেন। হঠাৎ পাকসেনাদের আসতে দেখে তিনি খালের মধ্যে নেমে কচুরিপানার নিচে নিজেকে লুকাবার চেষ্টা করেন। পাকসেনারা নদীর পাড় ধরে খালের কচুরির ধাপ লক্ষ করে গুলি করতে থাকে। ধাপের নিচে লুকিয়ে থাকা আলাউদ্দিনকে তারা দেখে ওপরে তোলে। তারপর তারা আলাউদ্দিনের নাভিতে বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে।
পাখুল্ল্যা যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কাদের মোল্লার ক্যাম্প লক্ষ্মীপুর গ্রামের বাবুরাম সরকারের বাড়িতে এবং খালিয়ার টুলু মুখার্জীর বাড়িতে স্থানান্তর করা হয়। এ-যুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আলাউদ্দিন নাজিমউদ্দিন কলেজের ডিগ্রি ক্লাসের ছাত্র ছিলেন। নয়া নগর গ্রামের আছির উদ্দিন মিয়ার বাড়ির দক্ষিণ পাশে খালের মধ্যে তাঁর লাশ পাওয়া যায়। সহযোদ্ধারা আলাউদ্দিনের লাশ তাঁর গ্রামের বাড়িতে বাবা-মার কাছে পৌঁছে দেন। [শেখ নাছিমা রহমান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!