You dont have javascript enabled! Please enable it!

পাকবাহিনীর চক্রাখালী অভিযান (বটিয়াঘাটা, খুলনা)

পাকবাহিনীর চক্রাখালী অভিযান (বটিয়াঘাটা, খুলনা) পরিচালিত হয় ২৪শে এপ্রিল। এ-সময় কয়েকজন সাধারণ মানুষ শহীদ হন এবং পাকসেনারা বেশ কয়েকটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে।
খুলনায় স্বাধীনতাকামী মানুষের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে এবং ৪ঠা এপ্রিল খুলনা রেডিও স্টেশন অভিযান ব্যর্থ হলে মুক্তিযোদ্ধারা অনেকটা হতাশ এবং ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। তাঁরা এলাকা ত্যাগ করে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেন। মুক্তিবাহিনীর একটি দল দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়ে বটিয়াঘাটার চক্রাখালী হাইস্কুলে অবস্থান নেয়। স্থানীয় মুসলিম লীগ সদস্য ও স্বাধীনতাবিরোধীদের মাধ্যমে এ খবর খুলনায় অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে পৌছে যায়। খুলনা শহরের সঙ্গে বটিয়াঘাটার সড়ক যোগাযোগ তখন তেমন উন্নত ছিল না। তাই পাকসেনাদের একটি দল নদীপথে এসে প্রথমে চক্রাখালী হাইস্কুলে আক্রমণ চালায়। এরপর গানবোট থেকে নেমে গ্রামের ভেতর ঢুকে মানুষ হত্যা এবং অসংখ্য ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালায়। খুলনা জেলা শহরের দক্ষিণ সীমানা পেরিয়ে বটিয়াঘাটার উত্তর সীমানা শুরু। শুরুতেই ১নং জলমা ইউনিয়ন। ইউনিয়নের প্রাণকেন্দ্র চক্রাখালী গ্রামে আজো একাত্তরের চিহ্ন বুকে ধারণ করে কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে চক্রাখালী মাধ্যমিক বিদ্যালয়। ২৪শে এপ্রিল শনিবার দুপুরের পরপরই জলমা ইউনিয়ন পরিষদের সামনে সাপ্তাহিক হাট বসে। হাট তখন কেবলমাত্র শুরু। হঠাৎ লোকজন এদিক-সেদিক ছোটাছুটি শুরু করে। কাজীবাছা নদীতে পাশাপাশি দুটি জলপাই রঙের গানবোট এগিয়ে আসছিল। গানবোট দুটি চক্রাখালী হাইস্কুলের সামনে এসে গতিবেগ কমাতে-কমাতে স্থির হয়ে দাঁড়ায়। গানবোট দুটির ওপর পাকিস্তানি সেনাদের দ্রুত চলাফেরা করতে দেখা যায়। হঠাৎ একটা গুলির আওয়াজ হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে গানবোট থেকে শুরু হয় মুহুর্মুহু শেলিং আর মর্টারের গুলিবর্ষণ। আধাঘণ্টা ধরে গুলি চলে। লক্ষ্যবস্তু চক্রাখালী বিদ্যালয়ের পাকা ভবন।
৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর এ এলাকার কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র-যুবকরা মিলে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য চিড়া, মুড়ি, নারকেল প্রভৃতি সংগ্রহ করে চক্রাখালী স্কুলে মজুদ করে রাখত। পাকসেনারা দীর্ঘক্ষণ ধরে এ স্কুলে আশ্রয় নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। এক পর্যায়ে গুলিবর্ষণ বন্ধ করে গানবোট থেকে নেমে নৌকাযোগে ৩০ জনের অধিক পাকসেনা চক্রাখালী গ্রামের টিকাদার বাড়ির ঘাটে নেমে গ্রামের দক্ষিণ দিকের ঘরবাড়ি পোড়াতে-পোড়াতে উত্তরদিকে অগ্রসর হতে থাকে। এ-সময় টিকাদার বাড়ির মুক্তিযোদ্ধা নিরঞ্জন টিকাদারের পিতা কালিপদ টিকাদারের পেটে পাকসেনারা বেয়নেট বসিয়ে দেয়। কিছুদিন পর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ঐদিন পাকসেনারা চক্রাখালী গ্রামের অধিকাংশ বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। গ্রামের মানুষ প্রাণভয়ে আশপাশের গ্রাম ও বন- জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। খুলনা শহর থেকে আসা স্থানীয় জনৈক দুলালের ভাগ্নেকে পাকসেনারা ধরে নিয়ে যায় এবং চক্রাখালী গ্রামের ঢালীর খালে নামিয়ে তাকে গুলি করে হত্যা করে। মুক্তিযোদ্ধা কার্তিক চন্দ্র রায় তাঁর স্কুল-কলেজের সার্টিফিকেটগুলো আনার জন্য বাড়ির দিকে যাওয়ার পথে পাকসেনারা তাঁকে ধরে ফেলে এবং ঢালীর খালের পাড়ে নিয়ে হ্যান্ডস-আপ করতে বলে গুলি চালায়। কার্তিক চন্দ্র রায় দুহাত উঁচু করেই লাফ দিয়ে খালের পানিতে ডুব দেন। লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় তাঁর গায়ে গুলি লাগেনি। তিনি এক ডুবে পাশের হোগলা বনের মধ্যে ঢুকে প্রাণে বেঁচে যান। এর অল্প কিছুক্ষণ পরেই ঐ হোগলা বনে লুকিয়ে থাকা বৃদ্ধ চন্দ্ৰকান্ত রায়কে পাকসেনারা গুলি করে হত্যা করে। শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের ভক্ত রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস তার বাড়ি থেকে ঢালীর খালের পাশ দিয়ে অন্য গ্রামে যাওয়ার পথে পাকসেনারা গুলি করে তাঁকে হত্যা করে। ঐদিন ঢালীর খালের পানিতে আরো কিছু লাশ ভাসতে দেখে স্থানীয় লোকজন। [শংকর কুমার মল্লিক]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!