You dont have javascript enabled! Please enable it! পাকবাহিনীর দৌলতপুর থানা নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির (দৌলতপুর, মানিকগঞ্জ) - সংগ্রামের নোটবুক

পাকবাহিনীর দৌলতপুর থানা নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির (দৌলতপুর, মানিকগঞ্জ)

পাকবাহিনীর দৌলতপুর থানা নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির (দৌলতপুর, মানিকগঞ্জ) মানিকগঞ্জ জেলার দৌলতপুর উপজেলায় অবস্থিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে বহু লোককে নির্যাতন ও বন্দি করে রাখা হয়।
দৌলতপুর থানার সেনা ক্যাম্প অপারেশন ও ইপিআর বিদ্রোহের পরের দিন ২৬শে সেপ্টেম্বর ২৫০ জন পাকসেনা নদীপথে একটি দ্বিতল লঞ্চে করে সিও অফিস ঘাটে এসে নোঙ্গর করে। তারা শান্তি কমিটি ও রাজাকার দের সহযোগিতায় বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সন্দেহভাজন তরুণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে নিয়ে আসে এবং চোখ বেঁধে তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। কখনো তাদের পায়ে রশি বেঁধে লোহার রড দিয়ে আঘাত করত, কখনো তাদের চোখ ও হাত বেঁধে শুকনো মরিচের গুঁড়া পায়ুপথে ঢুকিয়ে দিত। কখনো পায়ুপথে লাঠি ঢুকিয়ে দিত।
সিও অফিসের পুকুরের উত্তর পাড়ে দুটি সরকারি বাসভবন ছিল। পাকসেনারা ঐ ভবন সেনা ছাউনি হিসেবে ব্যবহার করত। পশ্চিম দিকের ভবনের একটি কক্ষ ছিল তাদের নির্যাতনকেন্দ্র। অক্টোবর মাসের ৩ তারিখ পাকসেনারা ডাক্তার রিয়াজ উদ্দিনের বাড়িতে (দৌলতপুর) অভিযান চালায়। তাঁর দুই ছেলে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। তাঁকে না পেয়ে পাকসেনারা ভাড়াটিয়া সরকারি কর্মকর্তা রেজাউল করিম (টিসিও)-কে ধরে নিয়ে যায়। চোখ বেঁধে ৩ দিন যাবৎ তাঁর ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। মরিচের গুঁড়া ও লাঠি তাঁর পায়ুপথে ঢুকিয়ে দেয়। টিসিও রেজাউল করিম জ্ঞান হারিয়ে মৃতের মতো পড়ে থাকেন। ৭ দিন পর তাঁর জ্ঞান ফিরে আসে। এরপর তাঁকে ছেড়ে দেয়া হয়। ৩ দিন পর ৭ই অক্টোবর পাকসেনারা গোপন সংবাদ পেয়ে মুক্তিযোদ্ধা কফিলউদ্দিনকে (ভাদ্রা, নাগরপুর) ধরে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। তাঁকেও চোখ ও হাত বেঁধে ৩-৪ দিন একই কায়দায় নির্যাতন করে। নভেম্বর মাসের ৬ তারিখ হানাদার বাহিনী খলসি ইউনিয়নে অভিযান চালায়। আওয়ামী লীগ-এর নীতিনির্ধারক ক্ষিতীশ বোসকে পাকহানাদাররা তাঁর নিজ বাসভবন থেকে ধরে নিয়ে যায়। প্রথমে তাঁকে দৌলতপুর সেনা ক্যাম্পে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে। পরে তাঁকে মানিকগঞ্জ সেনা ক্যাম্পে হাজির করা হয়৷ মানিকগঞ্জ টর্সার সেলে আবদ্ধ রেখে কয়েক দফা ইলেকট্রিক শক দিয়ে তাঁকে ব্যাপক জিজ্ঞাসবাদ করা হয়। ক্ষিতীশ বোস অচেতন অবস্থায় লুটিয়ে পড়েন। ঐ রাতে পাকসেনারা তাঁকে জাগীর ব্রিজের নিচে ধলেশ্বরী নদীর পাড়ে পেট ও বুকে বেয়নেট দিয়ে উপর্যুপরি আঘাত করে মৃতপ্রায় অবস্থায় ফেলে রেখে যায়।
২০শে আগস্ট মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম (বাঘুটিয়া) দৌলতপুর থানার ইপিআর সদস্যদের মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার পথ তৈরি করছিলেন। এর কিছুদিন পর তিনি নিজ বাড়ি থেকে শিবালয় ইপিআর ক্যাম্প অপারেশনের সুযোগ খুঁজছিলেন। এমনি এক সময়ে সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে একদল পাকসেনা আবুল কাশেমের বাড়ি ঘেরাও করে তাঁকে ধরে ফেলে। তাঁর বৃদ্ধ পিতা-মাতা-ভাই ও নব বিবাহিতা স্ত্রীকে দৌলতপুর সেনা ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায়। সেখানে পাকসেনারা আবুল কাশেমের ওপর শারীরিক নির্যাতন চালায়। পরের দিন তাদের মানিকগঞ্জ সেনা ক্যাম্পে হস্তান্তর করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর তাঁর বৃদ্ধ পিতা- -মাতা, ভাই ও স্ত্রীকে ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু আবুল কাশেমকে টর্চার সেলে আটক রেখে উপর্যুপরি ইলেকট্রিক শক দেয়া হয়। পড়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে মার্শাল-ল-কোর্টে তাঁকে প্রেরণ ও বিচার করা হয়। বিচারে আবুল কাশেমকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজীবন জেল দেয়া হয়। ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবসের পরের দিন ১৭ই ডিসেম্বর তিনি জেল থেকে ছাড়া পান। নির্যাতন ভোগকারীদের মধ্যে আরো যারা ছিলেন, তারা হলেন— আওলাদ হোসেন (রৌহা, খলসি), মুরেন নিয়োগী, রঞ্জন ঘোষ ও আ. হামিদ (লাউতারা, জিয়নপুর)। পাকসেনারা রাতের অন্ধকারে এদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। এদেরকেও দৌলতপুর সেনা ক্যাম্পে জিজ্ঞাসাবাদ করে মানিকগঞ্জ সেনা ক্যাম্পে হাজির করা হয়। পরে টর্চার সেলে নির্যাতন শেষে মানিকগঞ্জ কোর্টে ওঠানো হয়। তাদেরকেও দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন জেল দেয়া হয়। তারাও ১৭ই ডিসেম্বর মুক্তি লাভ করেন। [মো. আমিনুর রহমান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড